জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেছেন, “বর্তমান সরকার নিরপেক্ষ নয়।এই সরকার সঠিক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারবে বলেও সন্দেহ আছে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারই দেশের বর্তমান অচলাবস্থা ও অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি দিতে পারে।”

শ‌নিবার (২৫ জানুয়ারি) জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয় মিলনায়তনে প্রেসিডিয়াম সদস্যদের সভায় তি‌নি এ কথা বলেন।

গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, “অনেক আগেই আমরা সংবিধান সংস্কারের দাবি তুলেছি। সংস্কার হতে হবে একটি নির্বাচিত পার্লামেন্টে। নির্বাচিত পার্লামেন্ট ছাড়া কোনো সংস্কারই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। যদি সব রাজনৈতিক দলের সম্মতিতে সংস্কার হয় তা নির্বাচিত পার্লামেন্টে গ্রহণযোগ্য করা যায়। বর্তমানে দেশকে বিভক্ত করে যে সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে তা একপেশে ও বাস্তবতার ততটা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ কারণে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আমরা আগ্রহী নই। নির্বাচিত পার্লামেন্টে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আমরা কাজ করতে চাই।”

আরো পড়ুন:

জিএম কাদেরসহ ১৪৫ জনের নামে সিদ্ধিরগঞ্জে মামলা

জিএম কাদেরসহ অনুসারীদের গ্রেপ্তারে লিগ্যাল নোটিশ

অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে জা‌নি‌য়ে জিএম কা‌দের ব‌লেন, “কেউ জানে না কেমন হবে দেশের ভবিষ্যৎ। এমন বাস্তবতায় আমাদের রাজনীতি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। একটি নির্বাচন হবে, আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু জাতীয় পার্টির সাথে বর্তমান সরকার বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। আমাদের নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের স্বাভাবিক রাজনীতিতে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে বর্তমান সরকার সবার জন্য লেভেল প্লেয়িংফিল্ড করতে পারবে? নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি হবে?”

সরকারের সহায়তায় কয়েকটি রাজনৈতিক দল রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অভিযোগ ক‌রে দল‌টির চেয়ারম‌্যান ব‌লেন, “তারা সরকারের সাথে সম্পর্ক রেখে সরকারি দলের মত আচরণ করছে। তারা ক্ষমতার মোহে দেশকে বিভক্ত করছে।বিভিন্ন অজুহাতে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করতে চাচ্ছে। অপরদিকে দেশে অরাজক পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও বেকারত্বের বিস্তার ব্যাপক। এ কারণেই, দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ তাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।”

“জাতীয় পার্টিও মাঠে থাকবে, আমরা দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের রাজনীতিতে কখনোই পিছপা হব না। শত নির্যাতনেও আমরা মানুষের অধিকারের প্রশ্নে চুপ থাকবো না। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় দেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। মানুষের জান-মালের ও ইজ্জতের নিরাপত্তা নেই। প্রশাসনের কাছে কোন সেবা পাচ্ছে না মানুষ। আমরা মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে রাজপথেই থাকব।”

প্রেসিডিয়াম সভায় বক্তৃতা করেন সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, মীর আব্দুস সবুর আসুদ, হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন, এটি ইউ তাজ রহমান, সোলায়মান আলম শেঠ, নাসরিন জাহান রতনা, আব্দুর রশীদ সরকার, ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, অ্যাডভোকেট মো.

রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, সৈয়দ দিদার বখ্ত, নাজমা আখতার, আলমগীর সিকদার লোটন, এমরান হোসেন মিয়া, লিয়াকত হোসেন খোকা, মো. জহিরুল ইসলাম জহির, মোস্তফা আল মাহমুদ, মোহাম্মদ আতিকুর রহমান আতিক, জহিরুল আলম রুবেল, শেরীফা কাদের, মাসরুর মওলা, জসীম উদ্দিন ভূঁইয়া, মো. আরিফুর রহমান খান, মো. আশরাফুজ্জামান আশু।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/এসবি

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জ এম ক দ র জ এম ক র জন ত সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

বৈষম্যবিরোধীদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান অগ্রহণযোগ্য

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যে গণঅভ্যুত্থান হয়, তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতার ফসল, সন্দেহ নেই। আন্দোলনটি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহের আগে নেহাতই সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা অবসানের দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল, যদিও ১৪ জুলাই দেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বক্তব্যটি আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে কয়েকজন সমন্বয়ককে ডিবি হারুনের অফিসে ধরে নিয়ে গিয়ে ‘মিডিয়া-ডিনার’ খাওয়ানোর দৃশ্য এবং সমন্বয়কদের একজনকে দিয়ে লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় আন্দোলন সমাপ্ত করার ঘোষণা দিতে বাধ্য করা জনগণের ক্রোধকে দ্রুত ঘনীভূত করে। অন্যদিকে আন্দোলন মোকাবিলার জন্য পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মাস্তান বাহিনীকে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের, যার ফলে সারাদেশে এক দিনেই শতাধিক আন্দোলনকারীর প্রাণহানি ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে কারফিউ জারি করে তা বলবৎ করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু কারফিউ প্রায় ১০ দিন চলার পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ৩ আগস্ট দুপুরে সামরিক বাহিনীর ঢাকায় অবস্থিত সব অফিসারের সভা (দরবার) ডাকেন। সভায় প্রধানত জুনিয়র অফিসাররা মতামত ঘোষণা করেন– সেনাবাহিনী জনগণের বিপক্ষে গুলি চালাবে না। সেনাপ্রধান তাদের মত মেনে নেন। সেনাবাহিনীর এই সিদ্ধান্ত জানাজানি হওয়ার পর ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিশাল সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা সরকারের পদত্যাগ চেয়ে এক দফা দাবি ঘোষণা করেন। তাদের ঘোষিত ৬ আগস্টের ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিকে এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে ৪ আগস্ট আবারও ছাত্রলীগ-যুবলীগ-পুলিশের যৌথ বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা। ওই দিনও শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। ওই দিন দেশের প্রায় ৪০০ থানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়। উপরন্তু, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় আক্রমণ চালিয়ে ১৩ জন ও নরসিংদীতে ৬ জন পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সাহস হারিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে থানা থেকে পালিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ বুঝে যায়, শেখ হাসিনার পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। 

এ প্রেক্ষাপট তুলে ধরার কারণ এটা বলা, গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মানুষের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, শেখ হাসিনাকে উৎখাত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে কারা রয়েছে– সেটা তাদের কাছে বিবেচ্য ছিল না। শেখ হাসিনার স্থানে কে ক্ষমতায় আসবে– সেটাও তাদের ভাবনায় ছিল না। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের সাড়ে পাঁচ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর জনগণের সিংহভাগ বুঝতে পারছে– বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রভাবশালী সমন্বয়কদের বড় অংশ একটি বিশেষ মতের। আন্দোলনের সময় তারা তাদের পরিচয় সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাদের অনেকেই ছদ্মবেশে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক পরিচয় পর্যন্ত ধারণ করেছিলেন। এখন শীর্ষ সমন্বয়করাই বলে বেড়াচ্ছেন, আন্দোলনের ভ্যানগার্ড ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির, যদিও লাখ লাখ জনতার মিছিল সংঘটিত করার পেছনে ছাত্রশিবিরের কোনো দলীয় তৎপরতার চিহ্নই ছিল না। 

এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে– সরকারে অন্তর্ভুক্ত ছাত্রনেতারাসহ অন্যান্য নেতৃস্থানীয় সমন্বয়ক, যারা বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে ইতোমধ্যে জনপরিসরে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন; তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিবিরের লোক। এই ব্যাপারটি এখন জাতির সামনে একটি মহাবিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে। কারণ তারা জাতির প্রধান ঐতিহাসিক অর্জন ও আদর্শ ‘মুক্তিযুদ্ধ’কে মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর বলে মনে হচ্ছে। বিষয়টি সিংহভাগ সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৭১ সালে কারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তা কারও অজানা নয়। তারা গণহত্যাকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ হিসেবে ‘আলবদর’ ও ‘আলশামস’ গঠন করেছিল। এই আলবদর ও আলশামস বাহিনীর ক্যাডাররা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ঘাতকদের সশস্ত্র সহায়তাকারী, গোয়েন্দা বাহিনী ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি নিজেরাও অত্যন্ত নৃশংস ঘাতকের ভূমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল রাও ফরমান আলীর নীলনকশা অনুসারে এই আলবদর বাহিনীর ক্যাডাররাই দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠেছিল। 

মুক্তিযুদ্ধ নিছক একটি গণঅভ্যুত্থান ছিল না। ছিল এক জনযুদ্ধ, যেখানে ধনী-গরিব-মধ্যবিত্ত সব অংশের প্রায় সব সদস্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিল। এ কথা সত্য, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে দুই বা আড়াই লাখ মানুষ। কিন্তু ভারতের মাটিতে গড়ে ওঠা শরণার্থী শিবিরের এক কোটিরও বেশি মানুষ বলতে গেলে সরাসরি এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। দেশের ভেতরে কত লাখ পরিবার যে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছে, তার কোনো হিসাব নেই। সর্বোপরি এ যুদ্ধের প্রস্তুতি চলেছে পাকিস্তানি শাসনের প্রায় ২৩ বছর ধরে। ফলে এর স্মৃতি, আবেগ ও চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলবে।
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি যদি মনে করে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী সমন্বয়কদের মদদ পেলেই তারা জনগণকে ধোঁকা দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা স্বীয় কবজায় রাখতে পারবে– তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদেরও বলতে চাই, তাদের এই বিশেষ মহলকে তোষণ এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্য ও অবস্থান দেশের সিংহভাগ জনগণ মোটেও পছন্দ করছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার কমিশনগুলো গঠন করেছে, সেগুলোর প্রতিবেদনে যদি মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার কিংবা খাটো করার কোনো প্রয়াস দৃশ্যমান হয়, তাহলে তাদেরও জনরোষ মোকাবিলা করতে হবে। সম্প্রতি ছাত্রদের ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বেশ হইচই হলো। বলা হচ্ছে, সব রাজনৈতিক দলের মত নিয়ে এই ঘোষণাপত্র সরকার দেবে। এই ঘোষণাপত্র আদৌ আলোর মুখ দেখবে কিনা, আমরা জানি না। তবে এতে যদি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন সংবিধানকে ‘ছুড়ে ফেলা’র মতো কোনো কোনো সমন্বয়কের দম্ভোক্তির প্রতিফলন ঘটে, তাহলে জনগণ এর উদ্যোক্তাদের শুধু রুখে দাঁড়াবে না, ছুড়েও ফেলতে পারে– আগেভাগেই এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করছি।

অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি                                                             

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বৈষম্যবিরোধীদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান অগ্রহণযোগ্য