গোপালগঞ্জ কারাগারে অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসনের উদ্যোগ
Published: 25th, January 2025 GMT
কারাগারে বন্দি করে রাখা হয় অপরাধীদের। অপরাধের ধরণ অনুযায়ী তাদের কারাবাসের সময় নির্ধারণ করে দেন আদালত। কারাগারে তাদের নিরাপদ রাখতে ও আলোর পথ দেখাতে নেওয়া হয়েছে কল্যাণমুখী উদ্যোগ। এরমধ্যে রয়েছে সেলাই প্রশিক্ষণ, পাঠাগার স্থাপন, মাদকাশক্তি নিরাময়, অপরাধ প্রবণতা হ্রাস, খেলাধূলা, সবজি ও ফল চাষ, ভালো কাজে উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির মতো কর্মকাণ্ড।
অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসনের প্রত্যয়ে গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে স্থাপিত ‘ইহসান বেকারিতে’ রুটি, বিস্কুট, কুকিজ ও কেকসহ বেকারি সামগ্রী তৈরি করা হচ্ছে। গত ১৯ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান ফিতা কেটে কারা অভ্যন্তরে এ বেকারির উদ্বোধন করেন। এখানে বেকারিপণ্য তৈরিতে দক্ষ মহিদুল ইসলামের কাছে কারাবন্দিরা কাজ শিখছেন। উৎপাদিত পণ্য থেকে আয়ের অংশ পাবেন করাবন্দিরা।
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের প্রবেশন অফিসার আল আমিন মোল্লা জানান, অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসন সমিতি, প্রবেশন অফিসারের কার্যালয় গোপালগঞ্জের তত্ত্বাবধানে এবং জেলা প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতায় এ বেকারি স্থাপন করা হয়েছে। এখানে আধুনিক ওভেন, মিক্সার মেসিনসহ প্রয়োজনীয় সব মেসিনে পাউরুটি, কেক, বিস্কুট, কুকিজসহ মানসম্পন্ন বেকারি সামগ্রী প্রস্তুত করা হচ্ছে। এ বেকারিতে উৎপাদিত পণ্য মানবদেহের জন্য নিরাপদ। খেতে মজাদার ও মুখরোচক।
আরো পড়ুন:
শিশুকে পুকুরে ফেলে দেওয়া সেই শাহজাহান কারাগারে
ভারতে কারাভোগ শেষে দেশে ফিরলেন ২ বাংলাদেশি
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক হারুন অর রশীদ জানান, কারাবন্দিদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয় বৃদ্ধির জন্য কারাগারে বেকারি স্থাপন করা হয়েছে। কারাবন্দিরা বেকারি সামগ্রী উৎপাদনের কাজ শিখছেন। পাশাপাশি উৎপাদিত পাউরুটি, বিস্কুট, কুকিজ, কেক গোপালগঞ্জে বাজারজাত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখান থেকে আয়ের অংশ তারা পাবেন।
তিনি আরো জানান, কাজ শিখে কারাবন্দিরা দক্ষতা বৃদ্ধি করবেন। কারাগার থেকে বের হয়ে তারা বেকারি স্থাপন বা বেকারিতে কাজ করে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন। এতে অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হবে। কারগার থেকে বের হয়ে তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পাবে। পরিবার-পরিজনের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে।
গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান জানান, এ বেকারিতে উৎপাদিত পণ্যে ক্ষতিকারক উপকরণ ব্যবহার করা হয় না। মান নিয়ন্ত্রণ করে সবসময় গুণগত মানসম্মত পণ্য উৎপাদন করা হয়। এ কারাগার বেকারিতে উৎপাদিত পণ্য গোপালগঞ্জবাসীর কাছে দ্রুত সমাদৃত হবে। পাশাপাশি কারাবন্দিরা এখানে কাজ করে অর্থ উপার্জন এবং দক্ষতা আয়ত্ত করবেন। এতে কারাগারে বেকারি স্থাপনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সফল হবে।
ঢাকা/বাদল/বকুল
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর উৎপ দ ত প গ প লগঞ জ অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কৃতি ও রাজনীতির সংঘাত ও সমন্বয়
বাংলাদেশে ‘সিনক্রিটিজম’ বা সমন্বয়বাদের প্রভাব, বিশেষত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ঐতিহ্য ও সমসাময়িকতার অনন্য সংমিশ্রণ তুলে ধরে। সিনক্রিটিজম বলতে বিভিন্ন ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিশ্বাসের মেলবন্ধন বোঝায়, যা আমাদের অঞ্চলে বহু শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছে। এই সমন্বয়বাদের বিপরীতমুখী প্রবণতায় সংঘাতের চিত্রও আমরা দেখতে পাই; রামু সহিংসতা (২০১২), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হামলা (২০১৬), পূজামণ্ডপে হামলা ও সহিংসতা (২০২১), শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর হামলা (২০১৫), ভাস্কর্য বিতর্ক (২০২০), বিভিন্ন মাজার ও ধর্মীয় স্থাপনায় হামলা (২০২৪-২৫)।
বাংলাদেশের মাটি বহুমুখী সংস্কৃতি ও ধর্মের মিলনস্থল। বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলিম সংস্কৃতি এ অঞ্চলকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। বাউল ও সুফিবাদ বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে সমন্বয়ের ভিত্তি তৈরি করেছে। এই সংস্কৃতির মূলে রয়েছে মানবিকতা, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্বের অমলিন চেতনা। এর বাইরেও বিভিন্ন আঞ্চলিক উৎসব যেমন নবান্ন, পৌষ সংক্রান্তি, বৈশাখী উদযাপনেও বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণ দেখা যায়। এ ধরনের সমন্বিত উৎসব সমাজে সহনশীলতা ও স্থানীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করে।
বাংলাদেশে সিনক্রিটিজম সহজিয়া ও রক্ষণশীল ধারার মধ্যে সমন্বয় করতে চায়। সহজিয়া ধারা মূলত লোকজ, প্রাকৃত ও সহজ সাধনার পথে পরিচালিত আধ্যাত্মিক ও সামাজিক দর্শন, যেখানে আচারবিধির চেয়ে মানবিক সম্পর্ক, সমন্বয় ও সরলতায় জোর দেওয়া হয়। এটি কোনো ধর্ম বা সম্প্রদায়ের সীমার মধ্যে বাঁধা থাকে না। অন্যদিকে, রক্ষণশীল দর্শনে ধর্মীয় শুদ্ধতা, নিয়মানুবর্তিতা, সামাজিক আচারকে কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। এই ধারা বিশেষত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সম্প্রদায়ে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত।
এ দুই ধারার মধ্যকার মৌলিক সংঘাত একসময় সমন্বয়েও রূপ নিতে পারে। সহজিয়া ধারা যেমন রক্ষণশীল সমাজকে নমনীয় করে তুলতে পারে, তেমনই রক্ষণশীলতাও সহজিয়াকে কাঠামোগত স্থিতিশীলতা দিতে পারে। বাংলাদেশের লোকায়ত ও ঐতিহ্যিক সংস্কৃতিতে এ দুই ধারার সহাবস্থান সমাজে ভারসাম্য বজায় রাখে। সহজিয়া-রক্ষণশীল ধারা দুটির মিশ্রণে যে সিনক্রিটিজমের প্রকাশ ঘটে, তা অনেক সময় রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিরোধ ও সংহতির দ্বৈত চেহারা সৃষ্টি করে। যেমন স্থানীয় বিভিন্ন উৎসব বা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে কিছু অংশ সহজিয়া পথ মেনে চলে, কিছু অংশ রক্ষণশীলতায় গুরুত্ব দেয়।
বিগত কয়েক দশকে, বাংলাদেশে সিনক্রিটিজম রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। অনেক রাজনৈতিক শক্তি ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সিনক্রিটিজম ধারা প্রচার করে; কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে প্রায়শ বিভাজনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যানারে একদিকে যেমন বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের ঐক্যের কথা বলা হয়, অন্যদিকে ক্ষমতা ধরে রাখতে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার স্থানকে সংকুচিত করা হয়। আবার কিছু রাজনৈতিক দল একদিকে ধর্মীয় সংহতির কথা বলে, অন্যদিকে কিছু অংশকে প্রান্তিকীকরণ বা নিপীড়নের মাধ্যমে অন্য অংশের সমর্থন আদায়ে কৌশল গ্রহণ করে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানে হামলা বা নিপীড়ন ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক কৌশল এবং প্রভাবশালী গোষ্ঠীর স্বার্থ জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে সিনক্রিটিজম ধারণা, যা মূলত ঐক্যের জন্যই ছিল, এক ধরনের বিভ্রান্তিকর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সিনক্রিটিজমের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো মানবিকতা ও সহনশীলতা। ধর্ম ও সংস্কৃতির মিশ্রণে সমাজের মধ্যে উদারতার চর্চা গড়ে ওঠে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মানুষের মধ্যে গভীর সম্প্রীতি গড়ে তোলে। আজকের বাংলাদেশে যেখানে বিভাজনের রাজনীতি প্রকট; সিনক্রিটিজমের ইতিবাচক প্রভাব সমাজে প্রশান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে।
যদিও সিনক্রিটিজম ধারণাটি মূলত সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, এর অপব্যবহারের কারণেও সমাজে সংকট দেখা দিতে পারে। রাজনৈতিক শক্তিগুলো প্রায়শ সিনক্রিটিজমের আড়ালে নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগায়। বিশেষ করে সামাজিক অস্থিরতার সময়ে এই প্রবণতা অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা কিংবা মিথ্যাচারের মাধ্যমে তাদের অধিকারে আঘাত করা হয়। এসব ক্ষেত্রে সিনক্রিটিজমের ধারণাটি ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়, যেখানে ধর্মীয় সহনশীলতার বদলে কেবল বিভাজন ও দখলদারি নীতি কার্যকর থাকে। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হতে পারে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর চালানো কিছু হামলা। এসবে রাজনৈতিক ইন্ধনের অভিযোগ আছে। এমন অনেক ঘটনায় রাজনীতির নামে ধর্মীয় সহিংসতার প্রবণতা বেড়েছে।
বাংলাদেশে সিনক্রিটিজমের রাজনীতি ইতিহাস এবং সামাজিক পরিসরে প্রভাবিত এক জটিল প্রেক্ষাপটকে নির্দেশ করে। দেশের সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য সিনক্রিটিজমের একটি প্রাকৃতিক সংমিশ্রণ হিসেবে গড়ে উঠেছে এবং এটি আমাদের জাতীয় পরিচয়ের একটি অংশ। তবে রাজনীতির এই প্রভাব অনেক সময় ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও মেলবন্ধনের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত এবং এক ধরনের বিভ্রান্তিকর পরিবেশ তৈরি করে।
সিনক্রিটিজমের প্রকৃত সৌন্দর্য বুঝতে হলে আমাদের প্রতিটি ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আমাদের সমাজে এই ধারণা যদি সহনশীলতা ও মানবিকতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে শক্তিশালী ও সংহত জাতি গড়ে তুলতে পারব। এ জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক এবং সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা, যাতে সিনক্রিটিজমের মিশ্রণকে শুধু রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে নয় বরং সামাজিক সমন্বয়ের মাধ্যম হিসেবে দেখা যায়। সিনক্রিটিজমের এই রাজনীতি শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি আমাদের সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পারে, যেখানে সংহতি, সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা সমাজকে আরও মজবুত করে তুলবে।
রিমেল সরকার: সংগীতশিল্পী