শেখ হাসিনার পতন ঘটানো গণঅভ্যুত্থানের সূত্রপাত করা ছাত্র নেতৃত্বের রাজনৈতিক দল আগামী মাসের মধ্য থেকে শেষ ভাগে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। সংসদীয় আসন, উপজেলা ও ইউনিয়নে বিএনপির দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের দলে টানার চেষ্টা করবে তারা। আওয়ামী লীগ বাদে অন্যান্য দলের নেতাদের জন্যও দুয়ার উন্মুক্ত রাখবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে বাহাস শুরু হলেও, তিন ছাত্র উপদেষ্টার মধ্যে অন্তত একজন দলের নেতৃত্বে আসতে পারেন। সরাসরি বিএনপি বিরোধিতা না করে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, সিন্ডিকেট ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে ছাত্র নেতৃত্বের দল। মূলনীতি এবং কর্মসূচি যাই হোক, চাঁদাবাজি-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ বিরক্ত থাকায়, এ ইস্যুতে আত্মপ্রকাশের আগে লংমার্চ কর্মসূচি দিতে পারে তারা। তবে তা নির্ভর করছে মধ্য ফেব্রুয়ারির আগে কতগুলো উপজেলা ও থানায় কমিটি করা যায়, তার ওপর।

ছাত্র নেতৃত্বের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে। এসব সংগঠনের নেতাদের ভাষ্য, দল গঠনের পরও নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সক্রিয় থাকবে। আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না থাকলেও নতুন রাজনৈতিক দলের সহযোগী হিসেবে কাজ করবে।

গত বৃহস্পতিবার নাগরিক কমিটির সদস্য আখতার হোসেন জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারিতেই আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা আসবে। শতাধিক নামের প্রস্তাব এলেও, এখনও নাম ঠিক হয়নি।
নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন সমকালকে বলেন, ফেব্রুয়ারিতে সম্ভাব্য কয়েকটি সময় রয়েছে দলের আত্মপ্রকাশে। তবে কোনোটিই চূড়ান্ত হয়নি।

সাড়া ফেলার চেষ্টা
গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ ও একাত্তরের চেয়ে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানকে গৌরবান্বিত দেখানোর অভিযোগ করা হচ্ছে। তা মোচনে প্রাথমিকভাবে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে দলের আত্মপ্রকাশের চিন্তা ছিল। কিন্তু রমজান এবং ওই দিন থেকে ঈদুল ফিতরের ছুটি শুরু হওয়ায় আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে বড় জমায়েত সম্ভব হবে না– চিন্তা থেকে ফেব্রুয়ারি বেছে নেওয়ার কথা জানিয়েছে নাগরিক কমিটির সূত্র।

গত ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৩০ উপজেলা ও থানায় প্রতিরোধ কমিটি করেছে নাগরিক কমিটি। সামান্তা শারমিন বলেন, ঢাকায় থানার পর ওয়ার্ড কমিটি গঠন শুরু হয়েছে। ৪০০ উপজেলা ও থানায় কমিটি শেষে দল আত্মপ্রকাশ করবে।
গত ১৮ জানুয়ারি নাগরিক কমিটির সাধারণ সভায় লংমার্চের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশের প্রস্তাব আসে। চাঁদা, দখল, ঘুষ, দুর্নীতি, সিন্ডিকেট নির্মূলের দাবিতে গণঅভ্যুত্থানে রংপুরে শহীদ আবু সাঈদ থেকে শুরু করে চট্টগ্রামে শহীদ ওয়াসিম আকরামের কবর পর্যন্ত লংমার্চের আলোচনা হয়। জনদৃষ্টি আকর্ষণে হেঁটে এ কর্মসূচি করার প্রস্তাবও রয়েছে।

চাঁদা, দখল, দুর্নীতিবিরোধী বয়ান
নাগরিক কমিটির মূল্যায়ন, ৫ আগস্ট রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন হলেও চাঁদাবাজি, দখলদারি বন্ধ হয়নি। এতে গণঅসন্তোষ রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল বিএনপি নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি-দখলের জন্য দায়ী করছে। তারা আওয়ামী লীগের পরিবর্তে এখন বিএনপির দখলদারিত্ব এসেছে– এমন একটি  রাজনৈতিক বয়ান তৈরির চেষ্টা করছে। নাগরিক কমিটি এ বয়ানকে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করে, আওয়ামী লীগহীন ভোটের মাঠে বিএনপির প্রতিপক্ষ হতে চাচ্ছে।

সরকারি অফিসে ঘুষ, দুর্নীতি, সেবা পেতে ভোগান্তি নিয়েও নিজের পক্ষে বয়ান তৈরি করতে চায় নাগরিক কমিটি। কিন্তু ক্ষমতায় তাদের সমর্থিত ড.

মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার থাকায় এ প্রচার জোরদার করার চেয়ে চাঁদা, দখল এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ হিসেবে চিহ্নিত সিন্ডিকেটবিরোধী বয়ানে জোর দিচ্ছে।

নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সমকালকে বলেন, জুলাই বিপ্লবে মানুষ শুধু কোটা সংস্কারে জীবন দেয়নি। চাঁদাবাজি, দখল, দুর্নীতি, সিন্ডিকেটের নির্মূল চেয়েছিল। তা কি হয়েছে? ৫ আগস্টের পর কি চাঁদাবাজি, দখল হচ্ছে না? কারা করছে, তাও তো দেশের মানুষ দেখছে। তাদের পরিচয় জনগণের সামনে স্পষ্ট। মানুষ সত্যিই অতিষ্ট চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও দুর্নীতিতে। এগুলো আর চলতে দেওয়া যাবে না। এটাই নাগরিক কমিটির অবস্থান।

জুলাই গণহত্যা, শেখ হাসিনার শাসনামলের অপকর্মের বিচারের দাবিতে বিএনপির চেয়ে বেশি সোচ্চার এবং ভারতবিরোধী সুরও অন্যদের চেয়ে চড়া রাখবে নাগরিক কমিটি। তারা বিএনপিকে চাপে রেখে নির্বাচনের আগে সংস্কার নিশ্চিতে গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি রাখবে মাঠে। গতকালও সমাবেশের বক্তৃতায় নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এসব দাবির কথা তুলেছেন।

লক্ষ্য বিএনপির নেতাকর্মী
৫ আগস্টের পর বিএনপি, এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে কোন্দল বেড়েছে। হচ্ছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, খুনাখুনি। এতে ক্ষুব্ধ, নবগঠিত কমিটির পদবঞ্চিত এবং আসন্ন নির্বাচনগুলোতে যারা বিএনপির মনোনয়ন ও সমর্থন প্রাপ্তিতে পিছিয়ে; তাদের নতুন দলে টানার চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে ছাত্রদলসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের কমিটিতে ভেড়ানো হয়েছে।
নাগরিক কমিটির সূত্র এ তথ্য সমকালকে জানালেও সামান্তা শারমিন তা স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটিই করেননি। তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করেন– এমন সব নাগরিকের জন্য নতুন রাজনৈতিক দলের দুয়ার উন্মুক্ত। শুধু বিএনপি নয়, অন্য যে কোনো দলের যে কেউ জুলাই চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে এলে স্বাগত জানানো হবে। তবে যারা অতীতে ফ্যাসিবাদী রাজনীতি তথা আওয়ামী লীগে যুক্ত ছিলেন, তাদের নেওয়া হবে না। বিভিন্ন কমিটিতে কয়েকজন অতীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য গোপন করে ঢুকে পড়েছিলেন। তা জানামাত্র বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানান সামান্তা।

উপদেষ্টারা কি দলে থাকবেন
সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ছাত্রদের সরকারের সহযোগিতা নিয়ে দল গঠন বা কিংস পার্টি হওয়া উচিত হবে না। উপদেষ্টারা ছাত্রদের দলে থাকলে অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষতা হারাবে। সে ক্ষেত্রে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রয়োজন হবে।

ছাত্র নেতৃত্ব এ বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যকে আরেকটি ১/১১-এর ইঙ্গিত আখ্যা দেন। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া স্পষ্ট করেন, উপদেষ্টা রাজনীতি করলে সরকার ছেড়েই করবে। বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি ফেসবুকে লেখেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সরকারি এবং সাংবিধানিক পদের নিয়োগে চাপ-তদবিরও অনুচিত। উপদেষ্টারা খোলাখুলি বলেন, সরকারের সব স্তরে বিএনপিপন্থিরাই রয়েছেন।

এমন বাহাস চললেও শোনা যাচ্ছে, নাহিদ ইসলাম আসতে পারেন নতুন দলের নেতৃত্বে। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল। সামান্তা শারমিন সমকালকে বলেন, এ-সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট আলাপ-আলোচনা হয়নি। নাগরিক কমিটি মনে করে, উপদেষ্টাদের কেউ রাজনীতি করতে চাইলে সরকারের পদ ছাড়তে হবে। নইলে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। শুধু নাগরিক কমিটি নয়, একই নীতি অন্য দলের জন্যও প্রযোজ্য হতে হবে। সরকারের কোনো স্তর যেন কোনো দলের প্রতি অনুগত থাকতে না পারে।

সরকারি চাকরিতে আদালতের রায়ে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে সংগঠন গড়ে শিক্ষার্থীরা গত ১ জুলাই আন্দোলনে নামেন। এতে ছাত্রলীগের হামলার পর সাধারণ মানুষ যোগ দেন। পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ হত্যাযজ্ঞ চালালে আন্দোলন রূপ নেয় অভ্যুত্থানে। বিএনপি, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলো আগের ১১ বছরে সরকার পতনের আন্দোলন ডেকে ব্যর্থ হলেও শিক্ষার্থীদের সূত্রপাত করা অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যান।

বিএনপি ও রাজনৈতিক দলগুলো অভ্যুত্থানে তাদের অবদান স্মরণ করিয়ে সংকট নিরসনে দ্রুত নির্বাচন চাইলেও ছাত্র নেতৃত্ব সংস্কারে জোর দিচ্ছে। সংবিধানসহ বিভিন্ন ইস্যুতেও রয়েছে বিপরীতমুখী অবস্থানে। আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় ছাত্ররাই বিএনপির নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে– এমন সম্ভাবনা ও গুঞ্জন রয়েছে, যা নিয়ে নতুন রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত গণঅভ য ত থ ন উপদ ষ ট র ৫ আগস ট সরক র র ব এনপ র র জন য গঠন র উপজ ল আওয় ম স গঠন সমক ল

এছাড়াও পড়ুন:

বৈষম্যবিরোধীদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান অগ্রহণযোগ্য

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যে গণঅভ্যুত্থান হয়, তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতার ফসল, সন্দেহ নেই। আন্দোলনটি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহের আগে নেহাতই সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা অবসানের দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল, যদিও ১৪ জুলাই দেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বক্তব্যটি আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে কয়েকজন সমন্বয়ককে ডিবি হারুনের অফিসে ধরে নিয়ে গিয়ে ‘মিডিয়া-ডিনার’ খাওয়ানোর দৃশ্য এবং সমন্বয়কদের একজনকে দিয়ে লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় আন্দোলন সমাপ্ত করার ঘোষণা দিতে বাধ্য করা জনগণের ক্রোধকে দ্রুত ঘনীভূত করে। অন্যদিকে আন্দোলন মোকাবিলার জন্য পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মাস্তান বাহিনীকে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের, যার ফলে সারাদেশে এক দিনেই শতাধিক আন্দোলনকারীর প্রাণহানি ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে কারফিউ জারি করে তা বলবৎ করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু কারফিউ প্রায় ১০ দিন চলার পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ৩ আগস্ট দুপুরে সামরিক বাহিনীর ঢাকায় অবস্থিত সব অফিসারের সভা (দরবার) ডাকেন। সভায় প্রধানত জুনিয়র অফিসাররা মতামত ঘোষণা করেন– সেনাবাহিনী জনগণের বিপক্ষে গুলি চালাবে না। সেনাপ্রধান তাদের মত মেনে নেন। সেনাবাহিনীর এই সিদ্ধান্ত জানাজানি হওয়ার পর ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিশাল সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা সরকারের পদত্যাগ চেয়ে এক দফা দাবি ঘোষণা করেন। তাদের ঘোষিত ৬ আগস্টের ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিকে এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে ৪ আগস্ট আবারও ছাত্রলীগ-যুবলীগ-পুলিশের যৌথ বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা। ওই দিনও শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। ওই দিন দেশের প্রায় ৪০০ থানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়। উপরন্তু, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় আক্রমণ চালিয়ে ১৩ জন ও নরসিংদীতে ৬ জন পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সাহস হারিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে থানা থেকে পালিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ বুঝে যায়, শেখ হাসিনার পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। 

এ প্রেক্ষাপট তুলে ধরার কারণ এটা বলা, গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মানুষের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, শেখ হাসিনাকে উৎখাত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে কারা রয়েছে– সেটা তাদের কাছে বিবেচ্য ছিল না। শেখ হাসিনার স্থানে কে ক্ষমতায় আসবে– সেটাও তাদের ভাবনায় ছিল না। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের সাড়ে পাঁচ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর জনগণের সিংহভাগ বুঝতে পারছে– বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রভাবশালী সমন্বয়কদের বড় অংশ একটি বিশেষ মতের। আন্দোলনের সময় তারা তাদের পরিচয় সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাদের অনেকেই ছদ্মবেশে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক পরিচয় পর্যন্ত ধারণ করেছিলেন। এখন শীর্ষ সমন্বয়করাই বলে বেড়াচ্ছেন, আন্দোলনের ভ্যানগার্ড ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির, যদিও লাখ লাখ জনতার মিছিল সংঘটিত করার পেছনে ছাত্রশিবিরের কোনো দলীয় তৎপরতার চিহ্নই ছিল না। 

এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে– সরকারে অন্তর্ভুক্ত ছাত্রনেতারাসহ অন্যান্য নেতৃস্থানীয় সমন্বয়ক, যারা বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে ইতোমধ্যে জনপরিসরে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন; তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিবিরের লোক। এই ব্যাপারটি এখন জাতির সামনে একটি মহাবিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে। কারণ তারা জাতির প্রধান ঐতিহাসিক অর্জন ও আদর্শ ‘মুক্তিযুদ্ধ’কে মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর বলে মনে হচ্ছে। বিষয়টি সিংহভাগ সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৭১ সালে কারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তা কারও অজানা নয়। তারা গণহত্যাকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ হিসেবে ‘আলবদর’ ও ‘আলশামস’ গঠন করেছিল। এই আলবদর ও আলশামস বাহিনীর ক্যাডাররা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ঘাতকদের সশস্ত্র সহায়তাকারী, গোয়েন্দা বাহিনী ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি নিজেরাও অত্যন্ত নৃশংস ঘাতকের ভূমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল রাও ফরমান আলীর নীলনকশা অনুসারে এই আলবদর বাহিনীর ক্যাডাররাই দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠেছিল। 

মুক্তিযুদ্ধ নিছক একটি গণঅভ্যুত্থান ছিল না। ছিল এক জনযুদ্ধ, যেখানে ধনী-গরিব-মধ্যবিত্ত সব অংশের প্রায় সব সদস্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিল। এ কথা সত্য, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে দুই বা আড়াই লাখ মানুষ। কিন্তু ভারতের মাটিতে গড়ে ওঠা শরণার্থী শিবিরের এক কোটিরও বেশি মানুষ বলতে গেলে সরাসরি এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। দেশের ভেতরে কত লাখ পরিবার যে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছে, তার কোনো হিসাব নেই। সর্বোপরি এ যুদ্ধের প্রস্তুতি চলেছে পাকিস্তানি শাসনের প্রায় ২৩ বছর ধরে। ফলে এর স্মৃতি, আবেগ ও চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলবে।
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি যদি মনে করে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী সমন্বয়কদের মদদ পেলেই তারা জনগণকে ধোঁকা দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা স্বীয় কবজায় রাখতে পারবে– তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদেরও বলতে চাই, তাদের এই বিশেষ মহলকে তোষণ এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্য ও অবস্থান দেশের সিংহভাগ জনগণ মোটেও পছন্দ করছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার কমিশনগুলো গঠন করেছে, সেগুলোর প্রতিবেদনে যদি মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার কিংবা খাটো করার কোনো প্রয়াস দৃশ্যমান হয়, তাহলে তাদেরও জনরোষ মোকাবিলা করতে হবে। সম্প্রতি ছাত্রদের ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বেশ হইচই হলো। বলা হচ্ছে, সব রাজনৈতিক দলের মত নিয়ে এই ঘোষণাপত্র সরকার দেবে। এই ঘোষণাপত্র আদৌ আলোর মুখ দেখবে কিনা, আমরা জানি না। তবে এতে যদি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন সংবিধানকে ‘ছুড়ে ফেলা’র মতো কোনো কোনো সমন্বয়কের দম্ভোক্তির প্রতিফলন ঘটে, তাহলে জনগণ এর উদ্যোক্তাদের শুধু রুখে দাঁড়াবে না, ছুড়েও ফেলতে পারে– আগেভাগেই এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করছি।

অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি                                                             

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ছাত্রলীগের ‘ভয়ংকররূপে’ ফেরার বার্তা কী বার্তা দেয়?
  • লাল, কালো, সাদার মন্ত্রে এবারের অমর একুশে বইমেলা
  • শেখ হাসিনার ফাঁসির দাবিতে চট্টগ্রামে অনশনে বৈষম্যবিরোধীরা
  • জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত সবুজের লাশ উত্তোলন 
  • গণমাধ্যম এখন নজিরবিহীন স্বাধীনতা ভোগ করছে: প্রধান উপদেষ্টা
  • গণমাধ্যম নজিরবিহীন স্বাধীনতা ভোগ করছে: প্রধান উপদেষ্টা
  • কোটি টাকা সহায়তা দাবি শহীদ পরিবারের
  • বৈষম্যবিরোধীদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান অগ্রহণযোগ্য
  • শাবিপ্রবিতে গণঅভ্যুত্থানের শহীদের স্মরণে দোয়া