বিনিয়োগ দেখিয়ে ১০ কোটি টাকা নওফেলের পকেটে
Published: 25th, January 2025 GMT
বেসরকারি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ কোটি টাকা বিজয় টিভির নামে সরানোর অভিযোগ উঠেছে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান থাকাকালে তিনি এ অনিয়ম করেন। ওই সময় নওফেল বিজয় টিভির এমডি ছিলেন।
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর এ অনিয়ম ধরা পড়ে। একই সঙ্গে নওফেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব থেকে অগ্রিম ৩ কোটি টাকা তুলে নেন। প্রায় ছয় মাস পর তা একটি তামাক কোম্পানির মাধ্যমে সমন্বয় করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা বিজয় টিভিতে কীভাবে গেল, তা জানাতে পারেনি চসিক কর্তৃপক্ষ। তবে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কর্মকর্তারা জানান, শিক্ষামন্ত্রী বিজয় টিভির জন্য প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টাকাগুলো এক বছর মেয়াদে ঋণ নিয়েছিলেন। বিনিময়ে ১৫ শতাংশ সুদ দিতে সম্মত হয়েছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান ও চসিক মেয়র ডা.
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে আত্মগোপনে নওফেল। চেষ্টা করেও সমকাল তাঁর বক্তব্য জানতে পারেনি। বিজয় টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাজ্জাদ মাহমুদ রুবেলকে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ হয়নি।
২০০১ সালে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। ২০১৫ সালে আ জ ম নাছির উদ্দীন সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব নিয়ে সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। কর্মকর্তাদের অভিযোগ, আইনিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব নিতে ব্যর্থ হন মহিউদ্দিন চৌধুরী ও তাঁর পরিবার। পরে তাঁর ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল শিক্ষা উপমন্ত্রী হওয়ার পর নিজে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান হয়ে অন্যায়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টির দখল নেন।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুযায়ী, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত অনুষদে শিক্ষার্থী ৪ হাজার ৭৩৯ জন। ২৪৪ শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ৮৪ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক আয় প্রায় ৪৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা। শিক্ষা খাত, বেতন-ভাতা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় হয় প্রায় ৩১ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৪৪(৩) ধারা অনুযায়ী, ‘সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে অবহিতক্রমে সাধারণ তহবিলের অর্থ বোর্ড অব ট্রাস্টিজ কর্তৃক নির্ধারিত খাতে বিনিয়োগ করা যাবে।’ অন্যদিকে ৪৪(৭) ধারা অনুযায়ী, ‘কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের অর্থ উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় ব্যয় ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যয় করা যাবে না।’ বিজয় টিভিতে টাকা সরানোর ক্ষেত্রে নওফেল এসব আইনের ধার ধারেননি।
সমকালের হাতে আসা নথি অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৩ মে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ শাখার একটি চেকে ১০ কোটি টাকা নওফেলের প্রতিষ্ঠান বিজয় টিভি লিমিটেডে সরানো হয়েছে। চেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অনুপম সেন ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক তৌফিক সাঈদের স্বাক্ষর রয়েছে। দু’জনই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গত ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন।
এ ছাড়া ২০২৩ সালের ২৭ মার্চ প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাব থেকে ৩ কোটি টাকা নেন নওফেল। একই বছরের ১ অক্টোবর তামাক কোম্পানি ‘তারা ট্রেডার্স লিংক’ থেকে ওই পরিমাণ টাকা প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে জমা হয়। তামাক কারখানাটি বিদেশি ব্র্যান্ডের নকল সিগারেট বিক্রির দায়ে অভিযুক্ত। এর মালিক সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র আবদুস সবুর লিটন, যিনি নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নওফেলের অনুসারী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, নওফেল প্রভাব খাটিয়ে ১৫ শতাংশ সুদে ১০ কোটি টাকা এক বছরের জন্য বিজয় টিভিকে ঋণ দেন। কিন্তু সাত মাস পার হলেও ঋণের কোনো কিস্তি জমা দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। আর অগ্রিম ৩ কোটি টাকা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের নামে নিয়েছিলেন। ছয় মাস পর তামাক কোম্পানি থেকে তা সমন্বয় করা হয়।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক তৌফিক সাঈদ বলেন, ‘ঋণের বিষয় ইউজিসিকে জানানো হয়নি। অর্থবছর শেষে যে প্রতিষ্ঠান অডিট করে, তাদের প্রতিবেদনে বিশদ উল্লেখ থাকে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনের মাধ্যমে সরকার ও ইউজিসি অবহিত হয়।’
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৫ সেপ্টেম্বর চসিক আবেদন করে। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ১৬ জানুয়ারি বোর্ড অব ট্রাস্টি পুনর্গঠন করে। এতে মেয়রকে চেয়ারম্যান করা হয়। গত ২০ জানুয়ারি পুনর্গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের প্রথম সভায় নানা অনিয়ম ধরা পড়ে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব র ড অব ট র স ট জ ব জয় ট ভ র নওফ ল র মন ত র ১০ ক ট
এছাড়াও পড়ুন:
ইউজিসির নজরদারি সংস্থার অধীনে যাচ্ছে সাত কলেজ
রাজধানীর আলোচিত সাত কলেজ নিয়ে নতুন সিদ্ধান্তে এসেছে সরকার। এ জন্য আপাতত একটি ‘নজরদারি সংস্থা’ গঠন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একজন সদস্য এ সংস্থার নেতৃত্ব দেবেন। সাত অধ্যক্ষের যে কোনো একজন সংস্থাটির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করবেন। নজরদারি সংস্থার কার্যালয় হবে সাত কলেজের যে কোনোটির ক্যাম্পাসে।
এ ছাড়া সাত কলেজের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের নতুন ভর্তি কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ভর্তি ও রেজিস্ট্রার দপ্তর এবং হিসাব বিভাগের প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি সাময়িক কাঠামো থাকবে, যা ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে সাত কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের যাবতীয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এসব কাজের জন্য সাত কলেজের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি পৃথক ব্যাংক একাউন্ট পরিচালনা করবে। বিশ্ববিদ্যালয় মর্যাদার স্বতন্ত্র কাঠামো চূড়ান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই নজরদারি সংস্থার অধীনে সাত কলেজ পরিচালিত হবে।
সরকারের এসব সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে গতকাল সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে চিঠি দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। যুগ্ম সচিব শারমিনা নাসরীনের সই করা চিঠিতে এই সুপারিশমালা বাস্তবায়নে উপাচার্যকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এসএমএ ফায়েজ এই উচ্চ পর্যায়ে গঠিত কমিটির আহ্বায়ক।
ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) কমিটির সদস্য।
এ কমিটি সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে একাধিক সভায় মিলিত হয়ে সরকারের কাছে যে সুপারিশমালা পেশ করেছে, তা সরকার গ্রহণ করেছে।
কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এসএমএ ফায়েজ জাপান সফরে থাকায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এর আগে তিনি সমকালকে বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় সমমর্যাদার স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হওয়ার আগ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সময়ে সাত কলেজ কীভাবে চলবে, সে বিষয়ে আমরা সরকারকে একটি সুপারিশমালা দিয়েছি।
গতকাল ঢাবি উপাচার্যকে দেওয়া চিঠিতে জানানো হয়, ইউজিসি এবং অধিভুক্ত কলেজের একজন অধ্যক্ষের নেতৃত্বে সাত কলেজের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এতে ঢাবি প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতিনিধি থাকবেন। দ্রুত ঢাবির সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলে বিষয়টি চূড়ান্ত করার জন্য উপাচার্যকে অনুরোধ জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সাত কলেজ হলো– ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, সরকারি কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থাকা রাজধানীর এই বড় সাতটি কলেজকে ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত করা হয়েছিল। প্রায় ৮ বছর ঢাবির অধীনে চলে সাতটি কলেজ। গত ২৭ জানুয়ারি অধিভুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেয় ঢাবি। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে এখন সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তর প্রক্রিয়া শুরু করেছে অর্ন্তবর্তী সরকার। তার আগ পর্যন্ত এই নজরদারি সংস্থার অধীনে চলবে সাত কলেজ।
কেমন হবে নজরদারি সংস্থার কাঠামো
নজরদারি সংস্থার প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ঢাবির রেজিস্ট্রার দপ্তর মনোনীত কর্মকর্তা, পরীক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ঢাবির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর মনোনীত কর্মকর্তা, অর্থ ও হিসাব সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট শাখা মনোনীত প্রতিনিধি দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া সাত কলেজের অনলাইন ভর্তি কমিটির মাধ্যমে আবেদন সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালিত হবে। কলেজগুলোর শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে এই কাঠামো।
সুপারিশে বলা হয়েছে, ‘সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রশাসনিক জটিলতা ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের নানা অসুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যেসব শিক্ষার্থী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান শিক্ষা কার্যক্রমের অধীনে রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বর্তমান ব্যবস্থা চালু রাখবে।’
আরও বলা হয়েছে, ‘প্রস্তাবিত ব্যবস্থাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যথাযথ পর্ষদে (একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেট) জরুরি ভিত্তিতে অনুমোদিত হতে হবে।’
উচ্চ পর্যায়ের কমিটির সুপারিশ অনুসারে, ‘সাত কলেজের ভর্তি, পরীক্ষা ও অন্যান্য কার্যক্রম সংক্রান্ত তথ্য আদান প্রদানের জন্য স্ব স্ব কলেজের অধ্যক্ষের নিয়ন্ত্রণে একটি করে হেল্প ডেস্ক থাকবে; নিয়োগপ্রাপ্তির পরেই প্রস্তাবিত সাময়িক কাঠামোর পরিচালক জনবলের প্রস্তাবসহ কাঠামোর কার্যক্রমের অপারেশন ম্যানুয়েল প্রণয়ন করে সিন্ডিকেটে অনুমোদনের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দাখিল করবেন। কমিশন সমন্বিত কাঠামোর সার্বিক তত্ত্বাবধানসহ সময়ে সময়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবে।’