Samakal:
2025-04-24@01:20:18 GMT

সরিষা ক্ষেতের কাঁটাকাঙালি

Published: 24th, January 2025 GMT

সরিষা ক্ষেতের কাঁটাকাঙালি

কাঁকালভরা কাঁটা, এমন দৃষ্টিনন্দন গাছ পৃথিবীতে বিরল। লাইন ধরে জন্মানো এ গাছ দেখার জন্য বহুবার রেলসড়কের পাশ দিয়ে হেঁটে গেছি আমি। বাসার পেছনে রান্নাঘর থেকে নিষ্কাশিত ছাইয়ের গাদায় জন্মাতো শৈশবের এই গাছ; গলা সমান লম্বা। গাছের মাথায় হলুদ ফুল ফুটলে তা থেকে অদ্ভুত মৃদু একটা সুবাস ছড়িয়ে পড়ত। খেলার সঙ্গী ছোট বোন হাত বাড়িয়ে এই ফুল চাইত, কিন্তু রাশি রাশি কাঁটার কারণে একটুও কাছে যেতে পারতাম না। ব্যর্থতার গ্লানিতে একসময় কঞ্চি দিয়ে গাছের গায়ে আঘাত করতাম আমরা; ফলে আহত গাছের কাণ্ড থেকে বের হয়ে আসত হলুদ রঙের কষ।
হলুদ রঙের কষ বের হয় বলে অনেকে একে স্বর্ণক্ষীরী বলেন। স্বর্ণক্ষীরী নামটির উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাচীন সংহিতায়। তবে এটি সেই গাছ নয়, ২০০০ বছর আগেকার রচিত আদি চরকের নয়। প্রকৃত স্বর্ণক্ষীরী গাছটি গার্সিনিয়া মরেলা। আলোচ্য শিয়ালকাঁটা ‘আর্গেমনি মেক্সিকানা’ গাছটি বিদেশি, মেক্সিকোর। কেউ কেউ মনে করেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের। পর্তুগিজরা ১১ শতকে এই গাছ প্রবর্তন করেছে ভারতবর্ষে। গাছকে সঙ্গে আনার সম্ভাব্য কারণ, সিফিলিস রোগগ্রস্ত পর্তুগিজদের জন্য দ্রুত উপশমকারী ওষুধ ছিল এই গাছের হলুদ স্বর্ণক্ষীর। বর্তমানে আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইনসহ বহু দেশে এই ভেষজের বিস্তার ঘটেছে– কোথাও ওষুধ, কোথাও বা আগাছা হিসেবে।
কুষ্টিয়া-যশোর অঞ্চলে এ গাছের আঞ্চলিক নাম ‘কাঁটাকাইংলি’ অর্থাৎ কাঁটাকাঙালি। শরীরভর্তি কাঁটা অথচ কাঁটার কাঙাল, সাহিত্যরসসমৃদ্ধ এ এক অনুপম ব্যঙ্গার্থক নাম। বাংলায় সর্বাধিক প্রচলিত এর শিয়ালকাঁটা নামকরণের কী কারণ তা জানা যায় না। 
অতি উপকারী, টবে রাখা দূষণ নিয়ন্ত্রণকারী সর্পিল গাছ সানসেভিরিয়া ট্রাইফাসকিয়েটাকে বলা হয় ‘মাদার-ইন-ল’জ টাং’। শাশুড়ির প্রতি এমন অসম্মান গ্রহণ করতে রাজি নই আমরা। কৃষ্ণচূড়ার লাতিন নাম ডিলোনিক্স রিজিয়ার অর্থ দাঁড়ায় ‘রাজোচিত নখর’। অ্যাবরোমা অগাস্টার ফুল গাছের ডালে উল্টো কমলের মতো ঝুলে থাকে বলে একসময় এর যুক্তিগ্রাহ্য নাম ছিল ‘উল্টোকমল’। জিহ্বা ও কালের কশাঘাতে সেই নাম বদলে গিয়ে হয়েছে ‘উলটকম্বল’, যা প্রহসনমূলক। ইংরেজিতে শিয়ালকাঁটার সাধারণ নাম ‘মেক্সিকান পপি’। লাতিন নাম আর্গেমনি মেক্সিকানার মধ্যে মৃদু সমস্যা রয়েছে। কার্ল লিন্নিয়াস যখন এর দ্বিপদী বৈজ্ঞানিক নাম করেন তখন মনে করা হয়েছিল, এটি এক ধরনের ‘ভূমধ্যসাগরীয় পপি’ এবং এর দ্বারা চোখের চিকিৎসা করা হতো। এর জাতিগত নামে ‘আর্গেমনি’ যুক্ত হয়েছে, যার অর্থ চোখের ছানি বা সাদা স্পট।
শিয়ালকাঁটার তীব্র বিষাক্ত বীজ দেখতে অবিকল সরিষার মতো, যা থেকে ৩০-৪০ শতাংশ তেল উৎপাদিত হতে পারে। এ কারণে একে সূর্যমুখী তেল, তিল তেল ও প্রধানত সরিষার তেলে ভেজাল দেওয়া হয়েছে বহুকাল ধরে। মিশ্রিত তেল ব্যবহারের কারণে অতীতে সারা ভারতবর্ষে, বিশেষত বাংলায় বেশ কয়েকবার মহামারি শোথ রোগ (এপিডেমিক ড্রপসি) দেখা দিয়েছে। এতে পা ফোলা, বমি, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট এবং চোখের গ্লুকোমা রোগ দেখা দিতে পারে; যা পরবর্তীকালে অন্ধ করে দিতে পারে মানুষকে। 
১৯২৬ সালে ভারতীয় গবেষক এসএন সরকার তেল থেকে মহামারি বিস্তারের বিষয়টি তুলে ধরেন; যাতে বিষাক্ত পদার্থ ‘স্যাঙ্গুইনারিন’ মিশ্রিত অবস্থায় থাকে। বাংলা অঞ্চলে ১৯৩৫ সালে প্রায় সাত হাজার লোক এতে আক্রান্ত হয়ে দেড় হাজার প্রাণ হারান। গোয়ালিয়র, কনৌজ, লক্ষ্ণৌ ইত্যাদি এলাকায় ২০০০ সালের পরও মহামারি দেখা দিয়েছে।
সরিষা-ইলিশ আমাদের খুব প্রিয় একটি খাবার। নাম শুনলেই মনে হয় নাসিকায় সুঘ্রাণ এসে ঢুকছে। সেই উপাদেয় রান্নায় সরিষার ভেতর যে শিয়ালকাঁটার বীজ নেই তা আমরা কী করে জানব! এটি কোন মুল্লুক থেকে আমদানি করা সরিষা, সেটি জানাও কঠিন। জানার চেষ্টা করাও অকারণ সময়ক্ষেপণ। যে দেশেরই হোক, সরিষা ক্ষেতে এই গাছ প্রচুর পরিমাণে জন্মাতে পারে এবং খুব সহজেই মিশে যেতে পারে সরিষার সঙ্গে। এই বীজের বিষাক্ততা এত তীব্র যে, ১০০টা সরিষাদানার ভেতর শিয়ালকাঁটার মাত্র একটি দানা থাকলেও তাকে হাসপাতালে যেতে হতে পারে। এ সমস্যার একটি সহজ সমাধান আছে। শিয়ালকাঁটার বীজ দেখতে সরিষার মতো হলেও এর ঘনত্ব একটু কম বলে জলের ওপর ভেসে থাকে। অতএব সরিষা-ইলিশ রান্নার আগে একটু জলে ডুবিয়ে নিয়ে ভেসে থাকা সরিষাগুলো ফেলে দিলেই দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। v
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: এই গ ছ

এছাড়াও পড়ুন:

বিশ্বশক্তির দাবা খেলায় কি ভারত কিস্তিমাত হয়ে যাচ্ছে

বছরের পর বছর বিশ্ব ঘটনাপ্রবাহ ও সিদ্ধান্ত পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ইতিহাসে একই ধারা বারবার ফিরে এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্র হলো কর্মপ্রবণতার প্রতীক। তারা চট করে সাহসী পদক্ষেপ নেয় এবং তা নেয় অনেক সময় না ভেবেই। ভালো হোক বা খারাপ হোক—না ভেবেই তারা কাজ করে বসে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র হলো এমন এক দেশ, যারা আগে কাজ করে, পরে চিন্তা করে। ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক শুল্কযুদ্ধ পর্যন্ত হিসাব করলে দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে চাল দেয়, তারপর হিসাব মেলায়।

এর বিপরীতে ভারত আইডিয়ায় সমৃদ্ধ, কিন্তু সিদ্ধান্তের আগে অতিরিক্ত বিশ্লেষণ ও বিতর্কে আটকে যায়। ফলে পদক্ষেপ নিতে তাদের দেরি হয়ে যায়। অনেক সময় আদৌ কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয় না। স্মার্ট সিটি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডর, স্টার্টআপ ইন্ডিয়া, মেক ইন ইন্ডিয়া—এসব প্রকল্প জাঁকজমকপূর্ণ ঘোষণার পর শিগগিরই আমলাতান্ত্রিক জটের নিচে চাপা পড়ে যায়।

অন্যদিকে চীন দশকের পরিকল্পনায় চলে। তারা ধীরে ধীরে কৌশলে গড়ে তোলে। আর একবার যখন তারা এগোয়, তখন তা পুরো পৃথিবীকে হতবাক করে দেয়। যেমন শেনজেনকে প্রযুক্তির কেন্দ্র বানানো বা ‘ডিপসিক’ নামের এক এআই অ্যাপ বানানো, যা ওয়াল স্ট্রিটকে নাড়িয়ে দেয় এবং এক রাতেই মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বাজারমূল্য থেকে এক ট্রিলিয়ন ডলার উধাও করে দেয়।

এই পার্থক্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক ধারাবাহিকতা, এক গভীর সত্য। কে কীভাবে বিশ্বকে দেখে এবং তাদের অবস্থান নেয়, তা এই পার্থক্যের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়।

আরও পড়ুনইউনূস-মোদি বৈঠকের ফলাফল কী০৯ এপ্রিল ২০২৫

আমেরিকা সাহসী পদক্ষেপ নিতে পরিচিত। কিন্তু তারা কখনো জিজ্ঞেস করে না, ‘এর মূল্য কত পড়বে?’ ভারতের আছে অসাধারণ সম্ভাবনা ও মেধা, কিন্তু ভেতরের ধীরগতি সবকিছু আটকে দেয়। চীনের চিন্তা ও কাজের মধ্যে যে ভারসাম্য, সেটাই তাকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখে।

বিশ্বরাজনীতির ভারসাম্যে শক্তির মাপকাঠি কেবল সামরিক ক্ষমতা বা অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে নয়। এটি চাপের মুখেও নিজের অবস্থানে অটল থাকার সাহসের ওপর নির্ভর করে।

ভারত ২০০৮ সালে এই সাহসিকতার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিল। সে বছর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তির বিষয়ে তাঁর অবস্থান ধরে রেখেছিলেন। দুর্বল একটি জোট সরকার পরিচালনা করার পরও মনমোহন সিং আন্তর্জাতিক চাপে মাথা নত করেননি। বিশ্বজুড়ে ভারতের ওপর চাপ ছিল, যেন তারা পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে (এনপিটি) স্বাক্ষর করে। কিন্তু সিং এ চুক্তিতে স্বাক্ষর না করেই ভারতের পরমাণু স্বায়ত্তশাসন অক্ষুণ্ন রেখে এনএসজি (নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপ) থেকে একটি ঐতিহাসিক ছাড় আদায় করেন।

প্রবল বিরোধিতার মধ্য দিয়ে মনমোহন এ চুক্তিকে ভারতীয় পার্লামেন্টে পাস করান। এর জন্য তাঁকে একবার অনাস্থা প্রস্তাব পর্যন্ত মোকাবিলা করতে হয়। সেই সময় তিনি একদিকে পার্লামেন্টের সমর্থন নিশ্চিত করেন, অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের পক্ষে একটি বড় কূটনৈতিক জয় অর্জন করেন। এতে এনপিটিতে স্বাক্ষর না করেও পারমাণবিক প্রযুক্তি গ্রহণের দরজা খুলে যায় ভারতের জন্য। এই চুক্তির মাধ্যমে ১৯৯৮ সালের পর ভারতের আন্তর্জাতিক পারমাণবিক বিচ্ছিন্নতা শেষ হয় এবং বিশ্ব মঞ্চে ভারতের কৌশলগত স্পষ্টতা, রাজনৈতিক সাহস এবং দৃঢ় কূটনীতির পরিচয় মেলে।

বর্তমানে রাশিয়া ও চীন দেখিয়েছে তাদের সাহসিকতা। যখন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তখন মস্কো পিছু হটে না। বরং তারা নিজেদের অর্থনীতিকে নতুনভাবে সাজায় এবং বৈদেশিক নীতিও সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলে, যাতে পশ্চিমা চাপ মোকাবিলা করতে পারে। চীনও ট্রাম্প সরকারের আমলে আগ্রাসী শুল্কনীতির মুখোমুখি হয়ে কড়া জবাব দেয়; অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক উভয় দিক থেকেই পাল্টা ব্যবস্থা নেয়, যেন তারা বুঝিয়ে দিতে পারে যে ভয় দেখিয়ে তাদের কিছু করানো যাবে না।

অন্যদিকে ভারত একরকম নরম ও আত্মসমর্পণমূলক পথ বেছে নেয়। নিজের সার্বভৌম স্বার্থ জোরালোভাবে তুলে ধরার বদলে তারা যেন ওয়াশিংটনকে খুশি রাখতেই বেশি আগ্রহ দেখায়। ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের বিরুদ্ধে মোদি সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল দুর্বল ও অনিশ্চিত। ২০০৮ সালের মতো দৃঢ় কৌশলগত অবস্থান আজ আর দেখা যাচ্ছে না।

ভারত যেন পুরো বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে, বিশাল জনসংখ্যা ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সাহসিকতা প্রশ্নে তারা দ্বিধায় ভোগে। ভারত কি বিশ্বশক্তি থেকে ক্রমেই ‘ক্লায়েন্ট স্টেট’-এ পরিণত হচ্ছে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের পর ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে অভিষেক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানাননি, যদিও মোদি বারবার তাঁকে ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। পরে ফেব্রুয়ারিতে মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও সেটা ছিল খুব সাধারণ, ব্যবসাভিত্তিক একটি সফর। একটি কর্মসূচিতেই এটি সীমাবদ্ধ ছিল।

আরও পড়ুনমোদি, এ বিজয় ভারতের নয়, বাংলাদেশের১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

ট্রাম্প বহুবার ভারতকে ‘শুল্কের রাজা’ ও ‘বাণিজ্যিক প্রতারক’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর এই কঠোর অবস্থান বজায় ছিল। তাঁকে খুশি করতে মোদি সরকার তাঁর সফরের আগে কিছু অর্থনৈতিক ছাড় দেয়, যেমন হাই এন্ড মোটরসাইকেলের ওপর শুল্ক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হয় (বিশেষ করে হার্লে-ডেভিডসনের জন্য) এবং সামগ্রিকভাবে গড় শুল্ক ১৩ শতাংশ থেকে নামিয়ে ১১ শতাংশ করা হয়। এমনকি ২০২৪ সালে ব্রিকস জোটের মাধ্যমে ডলারের বিকল্প ব্যবহারের যে উদ্যোগ ছিল, ভারত সেখান থেকেও সরে আসে। কারণ, ট্রাম্প এর জেরে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।

তবু এসব ছাড় দেওয়ার পরও ট্রাম্প তাঁর মূল উদ্দেশ্যেই অটল ছিলেন। সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমানো। তিনি দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যঘাটতি ১০০ বিলিয়ন ডলার, যদিও এর প্রকৃত পরিমাণ ছিল মাত্র ৪৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন। কিন্তু মোদি এই বাড়িয়ে বলা তথ্য যৌথ সংবাদ সম্মেলনে কোনোভাবে সংশোধন করেননি।

এর বদলে ট্রাম্প ঘোষণা করেন, ভারতের কাছে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানসহ আরও বেশি পরিমাণে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করা হবে এবং তেল ও গ্যাস রপ্তানি বাড়ানো হবে।

ভারতের বিশ্বমঞ্চে মর্যাদা কমে যাওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হলো এর গণতান্ত্রিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাওয়া। গত এক দশকে মোদি সরকার ধীরে ধীরে একধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে চলে গেছে। ভারতের যে বৈশিষ্ট্যটি একসময় তাকে আলাদা করে তুলেছিল, সেটি হলো দেশটি একটি প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের দেশ ছিল, যেখানে ভুল হতো, আবার তা থেকে শিক্ষা নিয়ে সংশোধনও করা যেত। তবে সেই বৈশিষ্ট্যটাই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু সফরের চিত্র খুব দ্রুত বদলে যায়। মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের মাত্র দুই দিন পর দুটি মার্কিন সামরিক বিমানে ২২৮ জন ভারতীয়কে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। তাঁদের মধ্যে নারী, শিশু, নবজাতকও ছিল। এই ভারতীয়দের হাত-পা শিকলে বাঁধা অবস্থায় ছবি ছড়িয়ে পড়ে। এটি দেশজুড়ে ক্ষোভ তৈরি করে। এ ঘটনা দুটি অস্বস্তিকর বাস্তবতা সামনে নিয়ে আসে: ভারতের অর্থনীতি তার তরুণদের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণে চাকরি তৈরি করতে পারছে না (প্রতিবছর এক কোটির মতো নতুন কর্মসংস্থান প্রার্থী তৈরি হয়) এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের কথিত ‘মিত্রদের’ সঙ্গেও কোনো বিশেষ আচরণ করে না।

ট্রাম্পের ভারতনীতি বরাবরই ছিল লেনদেননির্ভর ও অবজ্ঞাসূচক। তিনি একদিকে ভারতকে শুল্ক দিয়ে চাপে ফেলেছেন, আবার অভিবাসন ও বাণিজ্য নিয়েও চাপ সৃষ্টি করেছেন; কিন্তু বিনিময়ে খুব একটা কিছু দেননি। যুক্তরাষ্ট্র এখন আর ভারতকে সমান কৌশলগত অংশীদার হিসেবে দেখছে না। বরং এমন একটি অনুগত দেশের মতো দেখছে, যার কাজ শুধু নির্দেশ মানা।

একসময় ভারতকে মনে করা হতো একটি উদীয়মান বিশ্বশক্তি হিসেবে—গণতন্ত্র, সম্পদ ও চীনকে টেক্কা দেওয়ার সক্ষমতা যার আছে। কিন্তু মোদির ১০ বছরের নেতৃত্বে ভারতের এই ভাবমূর্তি অনেকটাই ক্ষয়ে গেছে। ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক অবস্থান দেখে এখন মনে হতে পারে, এটি ক্রমেই সেসব দেশের কাতারে যাচ্ছে, যারা সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাস্তব বিশ্বপ্রভাব অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, যেমন ইউক্রেন কিংবা পাকিস্তান।

ভারত কি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পথে

ভারতের বিশ্বমঞ্চে মর্যাদা কমে যাওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হলো এর গণতান্ত্রিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাওয়া। গত এক দশকে মোদি সরকার ধীরে ধীরে একধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে চলে গেছে। ভারতের যে বৈশিষ্ট্যটি একসময় তাকে আলাদা করে তুলেছিল, সেটি হলো দেশটি একটি প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের দেশ ছিল, যেখানে ভুল হতো, আবার তা থেকে শিক্ষা নিয়ে সংশোধনও করা যেত। তবে সেই বৈশিষ্ট্যটাই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়তো কখনোই চীনের মতো দ্রুতগতির হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু ভারতের গণতন্ত্র তাকে টেকসই এবং ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়ার পথ দিয়েছিল। গণতন্ত্রের মূল শক্তি ছিল ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে উন্নত করার ক্ষমতা। কিন্তু গত এক দশকে এই ভিত্তিই দুর্বল হয়ে গেছে। সরকারের জবাবদিহির অভাব এবং ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক বিকাশ আটকে দিয়েছে।

আজকের দিনে সাধারণ মানুষ মনে করছে, সরকার আসল সমস্যাগুলো (যেমন বেকারত্ব, দুর্নীতি ও দারিদ্র্য) সমাধানে ব্যর্থ। অনেকেই বলেন, যখন চীন চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, ভারত তখন প্রাচীন মসজিদের তলে মন্দির খুঁজে বেড়ানোতে ব্যস্ত।

পররাষ্ট্রনীতি নিয়েও ভারতের অবস্থান এখন আর আগের মতো ভারসাম্যপূর্ণ ও বিচক্ষণ বলে মনে হচ্ছে না। একসময় বিশ্বমঞ্চে ভারতের অবস্থান ছিল যুক্তিসংগত ও পরিমিত। কিন্তু এখন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক আলোচনায় ভারতের প্রভাব পড়ছে না। যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ভারত রাশিয়া থেকে তেল আমদানি অব্যাহত রাখে, যা আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনার জন্ম দেয়।

অল্প সময়ের জন্য এ সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাজনক হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এর ফল ভালো নয়। ভারতের যে দুটি বৈশিষ্ট্য ছিল (গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জোট-নিরপেক্ষতা), সেগুলোকেই এখন প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।

অনেকে মনে করছেন, ভারত এখন নীতিকে বিসর্জন দিয়ে স্বল্পমেয়াদি লাভ খুঁজছে। ফলে দেশের বিদেশনীতি দুর্বল ও অবিশ্বস্ত হয়ে পড়ছে। রাশিয়ান জ্বালানির ওপর ভারতের অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা এবং বিকল্প উৎস না থাকা তাকে আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্প্রতি হুমকি দিয়েছেন, রাশিয়া থেকে তেল কিনলে ভারতকেও ‘সেকেন্ডারি ট্যারিফ’ বা পরোক্ষ শুল্কের মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে। এটি ভারতের জন্য বড় চাপের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ, রাশিয়া বর্তমানে ভারতের অন্যতম প্রধান জ্বালানি সরবরাহকারী।

এই চ্যালেঞ্জ এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মোদির নেতৃত্বে বলিষ্ঠ কথা বলার প্রবণতা থাকলেও বাস্তবে ফল খুব কম দেখা যাচ্ছে। ফলে ভারত এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে তার ভবিষ্যৎ বিপদের মুখে। যদি ভারত এখনই নিজের অবস্থান পরিষ্কার না করে, একটি স্বাধীন, আত্মবিশ্বাসী রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে না পারে, তাহলে খুব শিগগির এটি ইউক্রেনের মতো এমন সব দেশের মতো হয়ে উঠতে পারে, যাদের ভাগ্য অন্যরা নির্ধারণ করে।

এখনই পরিবর্তনের সময়। এই পথচলা যদি এখানেই না থামে, তাহলে একসময় এটি এমন এক দিকে নিয়ে যেতে পারে, যেখান থেকে ভারতের ফেরার আর সুযোগ থাকবে না।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

রবি কান্ত এশিয়া টাইমসের নয়াদিল্লিভিত্তিক একজন কলাম লেখক ও সংবাদদাতা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সিনেমার নোংরা পলিটিকস আমার ক্যারিয়ারকে ধ্বংস করে দিয়েছে: আমিন খান
  • পাবনায় পেঁয়াজের দাম মনপ্রতি বেড়েছে ৬০০ টাকা
  • অভিনয় থেকে দূরে থাকা নিয়ে যা বললেন চাঁদনী
  • বিশ্বশক্তির দাবা খেলায় কি ভারত কিস্তিমাত হয়ে যাচ্ছে