বিজ্ঞাপন থেকে আয় কমে যাওয়ায় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যম এখন কী সংকটে আছে, তা ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই। এর ফলে বন্ধ হয়ে গেছে বিশ্বের বহু জনপ্রিয় ও পুরোনো সংবাদমাধ্যম। কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম ছাপা সংস্করণ বন্ধ করে অনলাইন সংস্করণ চালু রেখেছে। আবার কিছু সংবাদমাধ্যম বন্ধ না হলেও কর্মী ছাঁটাইসহ নানাভাবে ব্যয় সংকোচন করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের মেডিল স্কুল অব জার্নালিজম অ্যাট নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির জরিপ প্রতিবেদনমতে, ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রেই ১৩০টির বেশি প্রিন্ট পত্রিকা বন্ধ হয়েছে। করোনা মহামারিকালীন বন্ধ হয়েছে ৩৬০টি পত্রিকা। 

বাংলাদেশে এ সংকট আরও বেশি। সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) হিসাবে, ঢাকাসহ দেশের আটটি বিভাগীয় শহর ও সংশ্লিষ্ট জেলা থেকে করোনার আগে ৩৪০টি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। করোনাকালে তা নেমে আসে ৮৬তে। মানে, ওই সময় বন্ধ হয়ে গেছে ২৫৪টি পত্রিকা (প্রথম আলো, ১ জানুয়ারি, ২০২০)। করোনা মহামারি গেলেও বন্ধ পত্রিকাগুলো ফের চালু হয়েছে এ রকম কোনো খবর জানা নেই। দু-একটি পত্রিকা হয়তো রাজনৈতিক কারণে সরকারের রোষানলে পড়ে বন্ধ হতে পারে, অধিকাংশই বাণিজ্যিকভাবে টিকিয়ে রাখতে না পেরে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। যারা এখনও আছে তাদেরও অনেক সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হচ্ছে। সংবাদকর্মীদের নিয়মিত বেতন-ভাতা দেওয়া হয়– এ রকম প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংখ্যাও নগণ্য।

প্রকাশিত/প্রচারিত বিজ্ঞাপন থেকে যে পরিমাণ আয় হওয়ার কথা, সেটি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম। অভিযোগ আছে, দেশের বৃহত্তর মিডিয়া বায়িং এজেন্সিগুলোর ‘সিন্ডিকেট’ বিজ্ঞাপন মূল্যে বড় অঙ্কের কমিশন দিয়ে বিজ্ঞাপনদাতাদের কবজায় রাখে। স্বল্পমূল্যে বিজ্ঞাপন প্রচারের সুযোগ পাওয়ায় বিজ্ঞাপনদাতারাও সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোর ওপর আস্থা রাখে। সংবাদমাধ্যমগুলো এজেন্সির কবজায় থাকা বিজ্ঞাপন পেতে হলে নামমাত্র কিংবা স্বল্পমূল্যে বিজ্ঞাপন ছাপাতে বাধ্য হয়। কোনো মিডিয়া এত কম মূল্যে বিজ্ঞাপন নিতে না চাইলে ওই এজেন্সির অধীনে থাকা বড় বড় কোম্পানির বিজ্ঞাপন হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা থাকে। ফলে এজেন্সির এই কমিশন বাণিজ্যের কারণেও মিডিয়া হাউসগুলো কাঙ্ক্ষিত আয় থেকে বছরের পর বছর বঞ্চিত হচ্ছে। সরকার যে বিজ্ঞাপন দেয়, তার বড় অংশের বিল বছরের পর বছর বাকি পড়ে থাকে। সেই বিল তুলতে ভীষণ বেগ পেতে হয় সংবাদমাধ্যমকে।

ফেসবুক-গুগল-ইউটিউবের মতো বৈশ্বিক প্রযুক্তি জায়ান্টের দৌরাত্ম্যেও কোণঠাসা প্রথাগত সংবাদমাধ্যম। বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী যত বাড়ছে ততই ডিজিটাল দুনিয়ায় বিজ্ঞাপন বাণিজ্য একচেটিয়া দখলে নিয়েছে এসব প্রযুক্তি কোম্পানি। আর ডিজিটাল মাধ্যমের দাপটে ছাপা পত্রিকা এবং টিভি অনুষ্ঠান বাণিজ্যে ভাটা পড়ায় অনলাইনমুখী এখন সব সংবাদমাধ্যম। অনলাইনে বাণিজ্যের লক্ষ্মী হচ্ছে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্ম। এই প্ল্যাটফর্মগুলোয় বাণিজ্যের জাদুমন্ত্র হচ্ছে ‘যত ভিউ, তত আয়’! আয় বাড়াতে ‘ভিউ’-এর জাঁতাকলে পিষ্ট বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা। চটকদার শিরোনাম, অপতথ্য, ভুল তথ্যনির্ভর, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন খবরে দর্শক-পাঠকের জন্য প্রকৃত ঘটনা কী, সেটা বেছে নেওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। রুচিহীন, মূল্যবোধহীন এসব গুজবসর্বস্ব ‘সস্তা খবর’ দ্রুত ভিউয়ের টপচার্টে উঠে আসছে, ভাইরাল হচ্ছে। আয় বাড়িয়ে যেনতেনভাবে টিকে থাকতে ভাইরাল কনটেন্টের নেশায় যুক্ত হয়েছে মূলধারার সংবাদমাধ্যমও। এতেই হচ্ছে সর্বনাশ। মানুষ মূলধারার সংবাদমাধ্যমের ওপরেও আস্থা-বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। 

দেশে ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের বাজার ঠিক কত, তা নিয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই। ধারণা করা হয়, ইতোমধ্যে এ বাজার ১০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছে গেছে। এই বাণিজ্যের লাগাম প্রায় পুরোটাই এখন ফেসবুক, গুগল, ইউটিউবের হাতে। ফলে এসব বহুজাতিক কোম্পানির কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সংবাদমাধ্যমসহ কনটেন্ট ক্রিয়েটররা। বাংলাদেশে ফেসবুক-গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানের কোনো অফিস কিংবা জবাবদিহির জায়গা না থাকলেও সরকারের উদার নীতিমালাকে পুঁজি করে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পকেটে পুরছে এসব প্রতিষ্ঠান।
কোনো কনটেন্ট থেকে গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব ঠিক কত টাকা দেয় কনটেন্টের প্রকাশকদের, এটি নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। অস্ট্রেলিয়া সরকার ২০১৮ সাল থেকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও জরিপ করে দেখেছে, দেশটিতে ডিজিটাল বিজ্ঞাপনে ১০০ ডলার খরচ হলে ৮১ ডলারই পায় গুগল ও ফেসবুক। কিন্তু বাকি ১৯ ভাগও কি কনটেন্ট নির্মাতারা পায়? কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের দোহাই দিয়ে ছোটখাটো অজুহাতে কনটেন্ট প্রকাশকদের পাওনা অর্থ বাতিল করা, আটকে রাখা কিংবা কনটেন্টের রিচ কমিয়ে দেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে।

বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো গুগল-ফেসবুক-ইউটিউব থেকে যে আয় করছে; বলা যায়, এর বিনিয়োগকারী প্রায় শতভাগই বাংলাদেশি বিজ্ঞাপনদাতা কোম্পানি। বাংলাদেশি কোম্পানির বিজ্ঞাপন বাংলাদেশি মিডিয়ায় ফিরে আসছে, মাঝখানে ডিজিটাল মধ্যস্বত্বভোগী হচ্ছে গুগল, ফেসবুক কিংবা ইউটিউব। ফলে বলা যায়, এখানে লাভের গুড় প্রায় পুরোটাই খাচ্ছে ওই ডিজিটাল মধ্যস্বত্বভোগী নামের পিঁপড়াগুলো। আবার এসব বিজ্ঞাপনের সব যে বাংলাদেশি মিডিয়ায় ফেরত আসে, সেটিও নয়। বাংলাদেশিরা যেসব বিদেশি সাইট ব্রাউজ করেন, সেসব সাইটও এই বিজ্ঞাপনের আয়ে ভাগ বসাচ্ছে। মোট কথা, ভিউ বাণিজ্য এবং ফেসবুক-গুগল-ইউটিউবে নির্ভরতার পরও ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমগুলোর পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হচ্ছে। এই চক্র থেকে বের হতে না পারলে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রাপ্তি এবং টেকসই মিডিয়া স্থাপন দুরাশাই থেকে যাবে। 

হাসান জাকির: সহকারী সম্পাদক
ই-মেইল: prantojakir@gmail.

com
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: কনট ন ট ফ সব ক সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ধানমন্ডিতে মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা অভিযান ডিএসসিসির  

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় শুক্রবার মশক নিধন ও বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করেছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী এ অভিযানে উপস্থিত ছিলেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়ার উপস্থিতিতে বর্জ্য ব্যবস্থানা বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগ ও ধানমন্ডি সোসাইটি এ অভিযানে অংশ নেয়। 

সকাল সাড়ে ৭টায় শুরু হওয়া এ পরিচ্ছন্নতা অভিযানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের ৪৫০ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী, স্বাস্থ্য বিভাগের ৫০ জন মশক কর্মী, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির ১০০ জন স্বেচ্ছাসেবক, বিডি ক্লিনের ৫০ জন এবং ধানমন্ডি সোসাইটির ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক অংশগ্রহণ করেন। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকাকে সাতটি অঞ্চলে ভাগ করে মূল রাস্তা, লেক, পার্ক, মসজিদ, ঈদগাহ সংলগ্ন এলাকা পরিষ্কার ও মশার ওষুধ  ছিটিয়ে নেওয়া হয়। 

অভিযানে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদী বলেন, ঢাকাকে সুন্দর ও বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ও বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক সোসাইটিগুলো চেষ্টা করে যাচ্ছে। রাজউক, গণপূর্ত, বিআরটিএ, পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থার অংশগ্রহণে সরকার একটি সুপরিকল্পিত ও সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করছে। এছাড়া পয়ঃনিষ্কাশনের জন্যেও মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন হচ্ছে।

দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক শাহজাহান মিয়া বলেন, বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ রোধে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি অঞ্চলে বিশেষ পরিচ্ছন্নতা ও মশক নিধন অভিযান পরিচালনা করা হবে। ধানমন্ডি থেকে এ অভিযান শুরু হয়েছে।  

অভিযান কার্যক্রমের অংশ হিসেবে অতিথিরা জনসচেতনতামূলক একটি র‍্যালিতে অংশগ্রহণ করেন। পরিচ্ছন্নতা অভিযানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. জিল্লুর রহমান, সকল বিভাগীয় প্রধান এবং ধানমন্ডি সোসাইটির নেতারা উপস্থিত ছিলেন। 
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ