যাত্রীবাহী বাস খাটছে ভাড়ায় কর্মকর্তাদের পকেট ভারী
Published: 24th, January 2025 GMT
পরিবহন সংকটে অসহনীয় ভোগান্তিতে চট্টগ্রামের মানুষ। সকাল ও সন্ধ্যায় বাস পেতে যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। শুধু তাই নয়, কর্মস্থল ও বাসাবাড়ি যেতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় তাদের। ঠাসাঠাসি করে যেতে হয় গন্তব্যে। ভাড়াও গুনতে হয় বেশি। এমন পরিবহন সংকট নিরসনে ভালো একটি উপায় হতে পারত বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন-বিআরটিসির বাসগুলো। কিন্তু এসব বাসের বড় একটি অংশ সাধারণ যাত্রী পরিবহনে ব্যবহৃত হচ্ছে না। গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিয়ে-পিকনিকে ভাড়ায় খাটছে। ফলে বিদ্যমান গণপরিবহন সংকট নিরসনে আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে পারছে না সরকারি বাস।
চট্টগ্রামে নিয়মবহির্ভূতভাবে বাস পরিচালনা করছে বিআরটিসি। এ বাসগুলো সংস্থারই চালক-হেলপারদের দৈনিক ভিত্তিতে ভাড়ায় দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ইচ্ছামতো গাড়িগুলো পরিচালনা করছেন তারা। এটা অনেকটা যে সংস্থায় চাকরি, সেই সংস্থার সঙ্গে ব্যবসা করার মতোই। চালকদের সঙ্গে থাকেন এলাকার প্রভাবশালী লোকজন এবং কতিপয় দালাল। রুটভিত্তিক এসব গাড়ি বণ্টনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে অর্থ লেনদেন হয়ে থাকে। তাছাড়া চালক-হেলপার থাকার পরও নিজেরাই গাড়ি পরিচালনা না করে দৈনিক ভিত্তিতে ভাড়ায় লাগিয়ে দেওয়ায় অনেকটা আরাম-আয়েশে সময় কাটে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। আবার পকেটও ভারী হয় তাদের।
বিআরটিসির নীতিমালা অনুযায়ী কোনো কারণে আয় বৃদ্ধি কিংবা লোকসান হ্রাসে স্বল্পমেয়াদে অপারেটর নিয়োগের মাধ্যমে গাড়ি ইজারা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু তা না করে খোদ বিআরটিসির চালক ও কিছু দালালের হাতে দৈনিক ভিত্তিতে গাড়ি তুলে দিচ্ছেন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
বিআরটিসির একাধিক চালক জানিয়েছেন, রুট ও গাড়িভিত্তিক বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ দিয়ে বাস নিতে হয়। দিনে প্রতি বাসের জন্য ‘অফিস খরচ’ হিসেবে এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। এ ছাড়া নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ দিতে হয় একশ্রেণির শ্রমিক নেতাদেরও। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন আর শ্রমিক নেতাদের সেই টাকা দিতে হচ্ছে না।
গত ১৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় সরেজমিন দেখা যায়, অফিসপাড়া হিসেবে পরিচিত বন্দর নগরীর বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ মোড়ে ঘরমুখো মানুষের ভিড়। চোখের সামনে দিয়ে একের পর এক চলে যাচ্ছে বাস-মিনিবাস। মাঝে মাঝে যাচ্ছে বিআরটিসির বাসও। কিন্তু এসব বাস-মিনিবাস যাত্রী ওঠানামা করছে না। দেখলে মনে হবে এগুলো ‘বিরতিহীন সার্ভিস’। হঠাৎ কোনো একটি বাস একটু থামলেই তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন সাধারণ যাত্রীরা। অনেক পুরুষ যাত্রী কোনোভাবে ঠাসাঠাসি করে বাসে উঠতে পারলেও বেশির ভাগ নারী যাত্রীকে হতাশ হতে হচ্ছে। পরে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তাদের। গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় ভাড়ায় চলাচলের কারণে সাধারণ যাত্রীরা এসব বাসের সুফল পাচ্ছে না। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই গাড়িগুলো ভাড়ায় খাটায় বিপাকে পড়তে হয় যাত্রীদের।
প্রতিদিন আগ্রাবাদ থেকে বহদ্দারহাট যাওয়া-আসা করেন ব্যাংক কর্মচারী নাছির উদ্দিন। রোববার সন্ধ্যায় আগ্রাবাদ মোড়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। এ সময় তিনি বলেন, বিআরটিসির বাসগুলো বিভিন্ন শিল্প-কারখানার সঙ্গে চুক্তি করে শ্রমিক-কর্মচারীদের আনা-নেওয়ায় ব্যস্ত থাকে। সাধারণ যাত্রীদের পরিবহন করে না। অথচ এসব বাস যদি নিয়মিত যাত্রী পরিবহন করত তাহলে নগরীতে গণপরিবহন সংকট কমে আসত।
চট্টগ্রাম বাস ডিপো সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামে বিভিন্ন রুটে বিআরটিসির একতলা এবং দ্বিতল মিলে ৬৭টি যাত্রীবাহী বাস চলাচল করছে। এর বাইরে দুটি বাসকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। চলাচলরত বাসগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে ছয়টি, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে ১২টি, স্মার্ট স্কুল বাস হিসেবে চলে ১২টি এবং ছাদখোলা বাস দুটি। এ হিসেবে ৩২টি বাসই ব্যস্ত থাকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পরিবহনে এবং ছাদখোলা দুটি বাস চলে পর্যটকদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কাজে। নগরীর নতুন ব্রিজ হয়ে জেলার পটিয়া রুটে চলে ১০টি বাস, আনোয়ারা রুটে চারটি, চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটে দুটি, চট্টগ্রাম-কুমিল্লা কোম্পানীগঞ্জ রুটে একটি, চট্টগ্রাম-রাঙামাটি রুটে চারটি, চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি রুটে চারটি, চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে দুটি এবং চট্টগ্রাম থেকে সিলেট হয়ে সুনামগঞ্জ রুটে চলে দুটি বাস। এর বাইরে কয়েকটি বাস শহরে চলাচল করে। রিজার্ভ ভাড়ার যাত্রীদের নামিয়ে সময় পাওয়া গেলে নগরীর সাধারণ যাত্রীদের পরিবহন করে কয়েকটি বাস। তবে পিক আওয়ারে এসব বাসে ওঠার সুযোগ পান না সাধারণ যাত্রীরা। সব মিলিয়ে বিআরটিসি বাস থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলাল সমকালকে বলেন, নগরীতে যাত্রীর অভাব নেই। তাই বিআরটিসির বাস চলাচল নিয়ে আমাদের তেমন কোনো ক্ষতি নেই। বরং নগরীর গণপরিবহনের সংকট নিরসনে আমরাও চাই বিআরটিসির বাসগুলো সাধারণ যাত্রী পরিবহন করুক। কিন্তু তারা সেটি না করে বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় ভাড়ায় লাগিয়ে দিচ্ছেন। কিছু গাড়ি নিজেদের চালকদের দৈনিকভিত্তিতে দিয়ে পরিচালনা করছে।
তবে এমন সব অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেছেন বিআরটিসি চট্টগ্রাম ডিপোর ম্যানেজার (অপারেশন) জুলফিকার আলী। তিনি বলেন, বিআরটিসি বাস বিভিন্ন গার্মেন্ট ও শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের পাশাপাশি সাধারণ যাত্রীদেরও পরিবহন করছে। নিউমার্কেট থেকে পতেঙ্গাসহ বিভিন্ন রুটে কয়েকটি বাস নিয়মিত চলাচল করে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব আরট স র ব স এসব ব স নগর র
এছাড়াও পড়ুন:
অভ্যুত্থান থেকে জন্ম নিল এনসিপি
অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে আত্মপ্রকাশ করেছে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। গণঅভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেওয়া দলটির নেতারা ঘোষণা করেছেন, তারা অন্য কোনো দেশ নয়, তারা হবেন বাংলাদেশপন্থি। তাদের লক্ষ্য ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ তথা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আর তা পূরণে নতুন সংবিধান প্রণয়নে সংসদের আগে গণপরিষদ নির্বাচন চান জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নায়করা।
শেখ হাসিনার পতন ঘটানো গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের উদ্যোগে গঠিত এনসিপির ঘোষণাপত্রে এসব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বড় জমায়েতের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছে ইতিহাসের মেরূকরণ পাল্টে দেওয়া দলটি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদদের আত্মত্যাগকে সার্থক ঘোষণা দিয়ে তারা বলেছেন, ভারতপন্থি, পাকিস্তানপন্থি রাজনীতির ঠাঁই বাংলাদেশে হবে না।
সাতচল্লিশ, বায়ান্ন, একাত্তর এবং চব্বিশকে ধারণ করা বাংলাদেশপন্থি রাজনৈতিক শক্তির ঐক্য চেয়ে সংসদের আগে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে এনসিপি। দলটি সরকারের আনুকূল্যে তথা ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে গঠিত হচ্ছে বলে সমালোচকরা বললেও, তা নাকচ করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার পদ ছেড়ে আসা নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বাধীন দলটির নেতারা। অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারের উপদেষ্টাদের আমন্ত্রণ করা হলেও তাদের কেউ আসেননি।
আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে এনসিপি নেতারা বলেন, গণপরিষদে নতুন সংবিধান রচিত হবে। যার মাধ্যমে গড়ে উঠবে কাঙ্ক্ষিত প্রজাতন্ত্র। যেখানে সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত হবে। পরিবারতন্ত্র নয়, মেধা ও যোগ্যতায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে। বাংলাদেশের ক্ষমতায় কে যাবে, তা ভারত নির্ধারণ করবে না।
ভারতীয় ‘আধিপত্যবাদের’ বিরোধিতা করা এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান স্লোগান ছিল– ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ উচ্চারিত হয়েছে এর পরেই। আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অভাবনীয় পতন ঘটানো গণঅভ্যুত্থানের স্লোগান– ‘ক্ষমতা না জনতা, জনতা জনতা’; ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’; ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’ স্লোগানও দেওয়া হয় আত্মপ্রকাশ মঞ্চ থেকে।
জমকালো মঞ্চ, বড় উপস্থিতি
মানিক মিয়া অ্যাভিনিয়ে মূল সড়কে তৈরি করা হয় মঞ্চ। এতে গতকাল সকাল থেকেই মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পূর্বমুখী মঞ্চের সামনে শহীদ পরিবার ও আহত, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিশিষ্ট নাগরিক এবং কূটনীতিকদের আসন ছিল।
মঞ্চের সামনের চেয়ার ফাঁকা থাকলেও আসাদ গেট থেকে খেজুর বাগান পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের সর্বত্রই ছিল ছোট ছোট জমায়েত, জটলা। এনসিপি নেতারা দাবি করেছেন, লাখো মানুষের জমায়েত হয়েছে আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে। অন্যান্য রাজনৈতিক সমাবেশের সঙ্গে তুলনায় এনসিপি জমায়েতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল বেশি। বিপুল সংখ্যক তরুণী, কিশোরী আসেন সমাবেশে। সপরিবার ও শিশুসন্তানদের নিয়ে সমাবেশে আসতে দেখা গেছে অনেককে।
ঢাকার বাইরে থেকে হাজারো বাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির (জানাক) নেতাকর্মী আসেন দলের আত্মপ্রকাশ সমাবেশে। গণঅভ্যুত্থানের নেতাদের দুই প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগেই গঠিত হয়েছে এনসিপি। গত বুধবার আত্মপ্রকাশ করা গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি না করার ঘোষণা দিলেও এনসিপির আত্মপ্রকাশে উপস্থিতি ছিলেন শিক্ষার্থীদের এই সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।
বিকেল ৩টায় আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান শুরুর কথা থাকলেও শুক্রবার সকাল থেকেই নেতাকর্মীরা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে আসতে শুরু করেন। সড়কে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান নেন। মঞ্চের সামনে জুমার নামাজে অংশ নেন তারা।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যরা অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন। জুমার নামাজের পর থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসতে শুরু করেন। বিকেল ৩টার দিকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে আসেন নেতাকর্মীরা। আগতদের প্রায় সবাই ছিলেন তরুণ-তরুণী। বয়স্ক মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে হাতেগোনা। কয়েকটি মিছিল ঘোড়ার গাড়ি, বাদ্যযন্ত্র নিয়ে আসে। লোকসমাগমে এনসিপি সরকারি আনুকূল্য পেয়েছে বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। পিরোজপুর থেকে পাঁচটি বাস জেলা প্রশাসক রিকুউজিশন করে দেন অনুষ্ঠানে আগতদের।
বিকেল সোয়া ৪টায় পবিত্র কোরআন, গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক পাঠের মাধ্যমে শুরু হয় আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান। এর পর জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। এর পর জুলাই শহীদদের স্মরণে নীরবতা পালন করা হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক তরিকুল ইসলামের সঞ্চালনায় বক্তৃতা করেন গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের মা-বাবা এবং পরিবারের সদস্যরা। নতুন দলের নাম, আহ্বায়ক পদে নাহিদ ইসলাম এবং সদস্য সচিব পদে আখতার হোসেনের নাম ঘোষণা করেন ৫ আগস্ট শহীদ ইসমাইল হোসেন রাব্বির বোন মিম আক্তার। তিনি সেদিন ভাইয়ের লাশ কাঁধে নিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন শেখ হাসিনার পতনে।
পরে আংশিক কমিটির নাম ঘোষণা করেন আখতার হোসেন। সামান্তা শারমিন ও আরিফুল ইসলাম আদিব যুগ্ম আহ্বায়ক, ডা. তাসনিম জারা ও নাহিদা সারওয়ার নিভা জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব, হাসনাত আবদুল্লাহ মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল), সারজিস আলম মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল), মুহাম্মদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী মুখ্য সমন্বয়কারী এবং আবদুল হান্নান মাসউদ জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পেয়েছেন। পরে অন্য যুগ্ম আহ্বায়ক, যুগ্ম সদস্য সচিব, সংগঠক, সমন্বয়কারীসহ ১৫১ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়।
নতুন দলের নেতারা যা বললেন
সব শেষে বক্তৃতা করেন ৩ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে শেখ হাসিনার পতনের ঐতিহাসিক এক দফার ঘোষক নাহিদ ইসলাম। উত্তাল জুলাইয়ের মতো মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ভারত ও পাকিস্তানপন্থি রাজনীতির ঠাঁই হবে না। আমরা বাংলাদেশকে সামনে রেখে, জনগণের স্বার্থ সামনে রেখে রাষ্ট্র বিনির্মাণ করব। আগামীর কথা বলতে চাই। পেছনের ইতিহাস অতিক্রম করে সম্ভাবনার বাংলাদেশের কথা বলতে চাই।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ‘তুমি কে, আমি কে, বিকল্প, বিকল্প’ স্লোগানটি তুলে ধরে নাহিদ ইসলাম বলেন, বিকল্পের জায়গা থেকে এই নতুন দলের আত্মপ্রকাশ। আজকের মঞ্চ থেকে শপথ– বাংলাদেশকে বিভাজিত করা যাবে না।
এর পর দলের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। সেখানে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সূচনা বলে উল্লেখ করেন। গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সব আশঙ্কার অবসান ঘটানোর আহ্বান করা হয়।
নাহিদ ইসলাম বলেন, দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। আমাদের দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় গড়ে তোলা ও তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে আমাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার। এর মধ্য দিয়েই কেবল আমরা একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারব।
নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে জুলাই গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের বিচার সম্ভব হবে জানিয়ে আখতার হোসেন বলেন, একটি নতুন সংবিধানের বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। স্বপ্ন বাস্তবায়নে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানান তিনি।
সামান্তা শারমিন বলেন, বাংলাদেশে গত ৫৩ বছরে একটি ‘বাইনারি’ ছিল। হয় একে, নয় ওকে বেছে নিতে হবে। দেশের মানুষ দুর্নীতি, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজমুক্ত সমাজ চায়।
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ৫ আগস্ট দুঃশাসনের কবর রচনা করেছি। সংসদে কে যাবে, তা নির্ধারণ করবে জনতা। ক্ষমতার মসনদে কে বসবে, তা নির্ধারণ করবে এই ভূখণ্ডের মানুষ। বাংলাদেশের গণভবনে কে যাবে, তা ভারত থেকে ঠিক হবে না।
সারজিস আলম বলেন, যারা বড় রাজনৈতিক দল, তারা যদি ছোট দলকে এগিয়ে যেতে না দেয়, তাহলে আবার স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে। খুনি হাসিনাকে দেখে যেন আমরা সেই শিক্ষা নিতে পারি। পরিবারতন্ত্র এখানেই শেষ, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে হবে আগামীর রাজনীতি।
নাসীরুদ্দীন বলেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন পর্যন্ত যারা সহযোগিতা করেছেন, তাদের সবার ত্যাগের মূল্যায়ন করা হবে। বিভাজনের রাজনীতি বাদ দিয়ে আগামীতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
আর যেন রক্তপাত না হয়– প্রত্যাশা জানিয়ে গণঅভ্যুত্থানের ছয় বছর বয়সী শিশু জাবির ইব্রাহিমের বাবা নওশের আলী বলেন, আমার দেশ যেন এনসিপির কাছে নিরাপদ থাকে।
শহীদ পরিবারের প্রত্যাশা
শহীদ মোবারকের মা ফরিদা বেগমের প্রত্যাশা, নতুন দল ভালো কিছুই করবে। তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমাগো সন্তানেরা ঝাঁপায়ে পইড়া এ বিজয় নিয়ে আসছে। তাদের কারণে আমরা স্বাধীন। নাহিদ, সারজিসসহ যারা নতুন এই দলে আছে, সবাই যেন সুন্দরভাবে দেশটি পরিচালনা করতে পারে দোয়া করি। দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে উঠুক।’
শহীদ ইমাম হোসেনের ভাই রবিউল ইসলাম বলেন, নাহিদ-আখতারদের ডাকে আন্দোলনে নেমেছিলাম। তাদের মাধ্যমে যেন প্রতিটি হত্যার বিচার হয়। আহত-শহীদ পরিবার যেন ন্যায্য অধিকার পায়।
গত ৪ আগস্ট পুলিশের গুলিতে আহত আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আহমেদ বলেন, এসেছি নতুন দলকে সমর্থন দিতে। নতুন দলের কাছে প্রত্যাশা, আগামীর বাংলাদেশে দুর্নীতি থাকবে না।
ক্রাচে ভর করে এসেছিলেন গণঅভ্যুত্থানে আহত শাকিল হোসেন। ৪ আগস্ট রাজধানীর গুলশানে ছাত্রলীগের হামলায় পা ভাঙে তাঁর। তিনি বলেন, নতুন রাজনৈতিক দলের কাছে প্রত্যাশার জায়গা থেকেই এখানে আসা। ছয় বছর বয়সী শহীদ জাবিরের বাবা মঞ্চ থেকে বলেন, সন্তান হত্যার বিচার চাই।
সাধারণ মানুষ যা বললেন
মিরপুর থেকে আসা নাজমুল ইসলাম বলেন, দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভিড়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা হচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে নিজেকে শামিল করতে এসেছি।
আবু ইউসুফ মাসুদ বলেন, তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি হচ্ছে। এর মাধ্যমে মানুষের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন হোক।
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর ফুটপাতে বসে কথা হয় ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে। নতুন দলের আত্মপ্রকাশ দেখতে এসেছেন তিনি। নতুন রাজনৈতিক দলের প্রত্যাশার বিষয়ে বলেন, আশা করি, নতুন দল দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়বে। ক্ষমতা নয়, ন্যায়ের জন্য লড়াই করবে।
যারা এসেছিলেন
আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলের শরিক ছাড়া ৩৬ রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ করা হয়। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালাল উদ্দিন আহমেদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন্দ, হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির আহমদ আলী কাসেমী, বিকল্প ধারার নির্বাহী সভাপতি মেজর (অব.) আবদুল মান্নান, বিএলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আবদুল কাদেরসহ বিভিন্ন দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তবে ছিলেন না গণপরিষদ সভাপতি নুরুল হক নুর।
ভ্যাটিকানের রাষ্ট্রদূত কেভিন এস রেন্ডালসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরাও এ অনুষ্ঠানে যোগ দেন।