চট্টগ্রামের পটিয়ায় চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে রাজন দত্ত (৩৭) নামের এক যুবক আত্মহত্যা করেছেন। আজ শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে চট্টগ্রামের পটিয়া-কক্সবাজার রেল সড়কের ধলঘাট রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

রাজন দত্ত পটিয়া উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নের দত্তপাড়া এলাকার প্রয়াত মিলন দত্তের ছেলে বলে জানা গেছে।

স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, আজ সকাল ৮টার দিকে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা কক্সবাজারগামী পর্যটন এক্সপ্রেস ট্রেনটি পটিয়া ধলঘাট স্টেশন অতিক্রম করছিল। এ সময় চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দেন রাজন দত্ত। মুহুর্তেই রাজনের দেহের পা ও কোমর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ঘটনাটি জানাজানি হলে তার পরিবারের সদস্যরা মরদেহ শনাক্ত করেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে মরদেহের খন্ডিত অংশ উদ্ধার করে পুলিশ।

প্রতিবেশী তন্ময় দে বলেন, রাজন দত্ত খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ধলঘাট এলাকায় একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করতেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি চাকরি না পেয়ে মানসিকভাবে বেশ চাপে ছিলেন। সে কারনে হয়তো তিনি চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

চট্টগ্রামের ষোলশহর রেলওয়ে জিআরপি থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (ইনচার্জ) আবুল কাশেম বলেন, পটিয়া ধলঘাট এলাকার রেললাইনে ট্রেনে কাটা পড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আমরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাচ্ছি। বিস্তারিত পরে জানাতে পারবো।

.

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

বিজয় যখন কড়া নাড়ছে

পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঠিক আগমুহূর্তে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাড়া জাগায়। দেশবাসীসহ বিশ্ব জানতে পারে, জাতিগত গণহত্যার মধ্যেই চলেছিল পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। এখানে সে সময়ের একটি আলোচিত প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো।

আত্মসমর্পণের আগে

ঢাকায় বৃহস্পতিবার আত্মসমর্পণের আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শহরের বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করেছে এবং তাঁদের মধ্যে পঞ্চাশের বেশি লোককে গুলি করে হত্যা করেছে। আকস্মিক সামরিক অভিযানের অংশ হিসেবে নিবিড় পরিকল্পনার আওতায় বাঙালি এলিট নিধনের অংশ হিসেবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। এটা অবশ্যই কমান্ডিং অফিসার জেনারেল নিয়াজিসহ পাকিস্তান হাই কমান্ডের পূর্ণ জ্ঞাতসারে ঘটেছে।

এসব মৃতদেহের আবিষ্কার ঢাকা শহরে উত্তেজনা বাড়াতে পারে, পাল্টা হত্যাকাণ্ড ও দাঙ্গার জন্ম দিতে পারে, এমনকি মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যেও সংঘর্ষ সৃষ্টি করতে পারে।

ঢাকার মূল শহরের পাশের রায়েরবাজারে কতগুলো বিচ্ছিন্ন গর্তে নিহত বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়। আমি নিজে ৩৫টি গলিত দেহ দেখেছি। আপাতদৃষ্টে মনে হয়, তাঁরা চার-পাঁচ দিন আগে নিহত হয়েছেন। মৃতের সংখ্যা সম্ভবত আরও বেশি হবে। ঢাকায় অপহরণ করা এ ধরনের লোকের সংখ্যা অন্তত ১৫০ হতে পারে।

ইউপিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রধান হৃদ্​রোগ চিকিৎসক ফজলে রাব্বী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান মুনীর চৌধুরী রয়েছেন। ঢাকার মধ্যবিত্ত এলাকা ধানমন্ডির বাইরে একটি ইটখোলাকে বধ্যভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। যদিও কচুরিপানার নীল-সাদা ফুল কর্দমাক্ত জলাশয়ে শোভা পাচ্ছে। স্থানটি লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন। আজ ঢাকার শত শত মানুষ মাটির বাঁধ দিয়ে হেঁটে হেঁটে এখানে এসেছে, তাদের অনেকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে নিরুদ্দিষ্ট স্বজনদের।

বিশিষ্টজনদের অপহরণ করে তুলে নেওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার সকালেই। পাঞ্জাবি সেনাদের কয়েকটি স্কোয়াড নির্দিষ্ট ঠিকানায় হাজির হয়ে নির্ধারিত পুরুষ ও নারীকে সশস্ত্র পাহারায় উঠিয়ে নিয়ে এসেছে। তাঁদের সম্ভবত রায়েরবাজার ইটখোলায় এনে মাটির বাঁধের পাশে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করেছে, যাতে তাঁরা হুমড়ি খেয়ে নিচের জলাশয়ে পড়ে যান।

ড. আমিনুদ্দিন বেঙ্গল রিসার্চ ল্যাবরেটরির প্রধান, অক্সফোর্ডের পিএইচডি। পাকিস্তানি সেনারা যখন তাঁকে তুলে নেয়, সেই মঙ্গলবার সকাল সাতটায় তাঁকে শেষবারের মতো দেখা যায়। নাজিউর রহমান বললেন, ‘আমি দুঃখিত, আমাকেও যেতে হচ্ছে, খুঁজে দেখি।’ ততক্ষণে তিনিও উলের মাফলার দিয়ে নাক-মুখ পেঁচিয়ে নিয়েছেন।

গতকাল আমি কেবল তিন ঘণ্টা ঢাকায় ছিলাম, ততক্ষণে ইটভাটার এই খবর তেমন ছড়ায়নি। জনতা উত্তেজিত, তবে আচরণে অদ্ভুত কোমলতা। ভারতীয় সেনাদের হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছে, গাড়িতে এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে।

সেদিনও অনেক গোলাগুলি হয়েছে, বিশেষ করে রাতের বেলায়। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অবস্থানরত সাংবাদিকেরা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি তখনো বিস্ফোরণোন্মুখ। বাঙালিরা অভিযোগ করছে, বিহারি এই বিদেশিরা বহু বছর আগে মুসলমান হিসেবে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে, তারা বাঙালি হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের সাহায্য করেছে। আট মাস আগে আমি যখন যশোরে ছিলাম, এ কারণেই সেখানে বেসামরিক বিহারিদের হত্যা করা হয়। ঢাকায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড যশোরের হত্যাকাণ্ডের চেয়ে শতগুণ বেশি ভয়াবহ একটি ব্যাপার। কাজেই একধরনের প্রতিশোধ গ্রহণের ব্যাপার অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।

ইতিমধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পাহারায় সেনানিবাসে বন্দী পাকিস্তানি সেনারা এখনো সশস্ত্র, যদি প্রয়োজন পড়ে! ঢাকা যখন জেনে যাবে পাকিস্তানি সেনারা কত পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তখন দেখা দেবে সত্যিকারের সংকট। যা-ই ঘটুক, পরাজিত পাকিস্তানি সেনাদের জন্য সহানুভূতিপ্রবণ হওয়া বাঙালিদের জন্য ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। এ রকম একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী এভাবে খেলাচ্ছলে অপ্রয়োজনে, উন্মত্তের মতো খুন করতে পারে, তা অবিশ্বাস্য।

যদি পাইকারি হত্যাকাণ্ডকে সংবাদপত্র গণহত্যা আখ্যায়িত করে, তা অবশ্যই ভয়ংকর; কিন্তু পরিকল্পিতভাবে বাছাই করে জাতির সবচেয়ে যোগ্য, বুদ্ধিমান ও গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ ও নারী হত্যার মাধ্যমে যদি জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেওয়া হয়, সেই ‘এলিটোসাইড’ এলিট হত্যা যে আরও বেশি ভয়ংকর।

গত মঙ্গলবারের অনেক আগেই পাকিস্তান শেষ হয়ে গেছে। যেসব কর্মকর্তা এই পরিকল্পনা করেছেন, তাঁরাও তা অবশ্যই জানেন। কাজেই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকেও ধসিয়ে দেওয়া। বহুদিন ধরেই অনুমান করা হচ্ছিল, পাঞ্জাব মরুভূমির রুক্ষ সেনারা বাঙালিদের প্রতি হিংস্র বর্ণবাদী ঘৃণা লালন করে আসছে। এখন দেখা যাচ্ছে, তারা বুদ্ধিভিত্তিক ঈর্ষাও লালন করছে, যার প্রকাশ ঘটেছে এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ডে।

ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ: এম এ মোমেন

দ্য সানডে টাইমস, ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১

প্রথম আলো, ২৬ মার্চ ২০১১, পুনর্মুদ্রিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ