এসেছিস যখন দাগ রেখে যা– কথাটা রামকৃষ্ণ বলার আগেই মানুষ দাগ রাখতে শুরু করেছিল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কয়েক হাজার ফুট উপরে শ্রীলঙ্কার পবিত্র মালয় পাহাড়ে পাওয়া গেছে প্রাচীন পদচিহ্ন। প্রতিটি ধর্মের মানুষ মনে করেন এটি তাদের ধর্মের মহাপুরুষের পদচিহ্ন। সনাতনধর্মীরা মনে করেন শিবের, বৌদ্ধরা মনে করেন গৌতমের আর কেনান ধর্মের মানুষেরা বিশ্বাস করেন এটি প্রথম মানব অ্যাডামের পদচিহ্ন। এক পদচিহ্নকে স্থানীয়রা বলেন শ্রীপদ বা পবিত্র পা। এ পদচিহ্নকে সম্মান করেন প্রতিটি ধর্মের অনুসারীগণ। পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষ তার পূর্বপুরুষের যে কোনো স্মৃতিচিহ্নকে ভালোবাসে। হোক সে পায়ের দাগ বা যে কোনো স্মৃতিবাহী কিছু।
আমাদের পূর্বপুরুষেরা ছবি এঁকে দাগ রেখে গেছেন গুহার ভেতর, পাথরের গায়ে। নিজেদের কথা রেখে গেছেন গল্প গসপেল প্যারাবল, রূপকথায়। মানুষ সেগুলো যত্নে আগলে রেখেছে, হৃদয়ে বহন করে চলেছে পরম মমতায়। এর কোনো কোনো স্মৃতি একান্ত নিজের, পরিবারের, আবার কোনো কোনোটি পুরো একটি সম্প্রদায় বা জাতি রাষ্ট্রের। যেনবা এ জগতে হারায় না কিছুই। মায়া রেখে যায়।
মানুষ বড় স্মৃতিকাতর জীব। অবশ্য অন্যান্য প্রাণীর খবর আমরা জানি না। সম্ভবত তাদের স্মৃতি মানুষের মতো এত দীর্ঘস্থায়ী নয়। অনেকে বিশ্বাস করেন কেউ কেউ নাকি পূর্বজন্মের স্মৃতিও বহন করে চলেন। বাংলা ভাষায় জাতিস্মর শব্দটি রয়েছে। মানুষের স্মৃতি বহন করার এই কাজটি যে সব সময় সুখকর, এমনটি নয়। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুঃখের। মানুষ দুঃখ বিয়োগ বেদনার স্মৃতিই বেশি বহন করে। আর কবিদের প্রধান কাজই স্মৃতি নিয়ে।
২.
রাঙা মামিমার সাঁকো হয়ে ভোর রাতে দেশত্যাগ করার কবিতাটি তো অনেকেরই জানা। তিনি সাঁকো পার হয়ে চলে গেছেন কিন্তু রাঙা পায়ের দাগ রেখে গেছেন সাঁকোর গায়ে। সে দাগের বেদনা ভুলতে পারেননি ফেলে যাওয়া স্বজন। সে না হয় অন্য দেশে যাওয়া। কিন্তু প্রিয় মানুষের যাওয়া যদি হয় চিরতরের, তাহলে সে দাগ কি ভুলে যাওয়ার?
না। প্রিয়জন হারানোর দাগ মানুষের মন থেকে সহজে মুছে যায় না। বহন করতে হয়।
আমার জীবনেও প্রিয়জন হারানোর স্মৃতি অনেক।
খুব ছোটবেলায় যাকে হারিয়ে প্রথম গভীর কষ্ট পেয়েছিলাম, সে ছিল একটি লাল কুকুর। লালু। শিশু অবস্থায় তাকে কোথা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল, আমার ঠিক জানা নেই। তাকে আমিই বড় করতে থাকি। সে আমার শৈশবের সঙ্গী হিসেবে বড় হতে থাকে। তার জন্য আলাদা খড়ের জাজিম বানানো হয়, খাবারের বাটি বরাদ্দ করা হয়। আমি যেখানে যাই সে পিছু পিছু ছোটে। একসাথে স্নানও করা হয় গ্রামের পুকুরে। শীতের দিনের সকালে কুয়াশায় ভিজে শস্যভরা মাঠ থেকে জমির আল ধরে দুজনে ফিরি একসাথে। তারপর একদিন আমার কলেজ হোস্টেলে চলে যাওয়ার দিন আসে। সে আমাকে বিদায় দিতে রিকশার পিছু পিছু গ্রামের বাজার পর্যন্ত আসে। মন খারাপ করে দুজনে দু’দিকে ছুটি।
আম্মার স্ট্রোক করেছিল তাঁর অল্প বয়সেই। ফলত তাঁর চলাফেরা সীমিত হয়ে পড়েছিল। লাঠির সাহায্য নিয়ে চলাফেরা করতে হতো তাঁকে। বেশির ভাগ সময়ই তিনি বারান্দায় বসে সামনের সুপারি বাগানের দিকে তাকিয়ে সময় কাটাতেন। বাড়িতে লোকজন ছিল কম। তারপর দুই সন্তানের মধ্যে আমরা দুজনই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ায় তিনি একদম নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। লালু সে সময় তাঁর সঙ্গী হয়ে ওঠে। আম্মার পায়ের কাছে বসে থাকত সারাক্ষণ। তাদের মধ্যে কথাবার্তাও চলত। কী কথা হতো তা অন্য কারও বোঝার সাধ্য হয়তো ছিল না। কিন্তু লালুর একসময় বয়স হতে থাকে। সে অ্যাজমায় আক্রান্ত হয় শেষ বয়সে। তারপর মারা যায় এক শীতে।
আমরা তাকে সমাহিত করি সুপারি বাগানে। যেন আম্মা বারান্দায় বসে তার কবরটি দেখতে পান। তারপর আম্মা প্রায় সময়ই চেয়ে থাকতেন লালুর কবরের দিকে। আর চোখের পানি ফেলতেন। আমরা ঠিক জানি না লালু কত কত স্মৃতিচিহ্ন রেখে গিয়েছিল আম্মার মনে।
দ্বিতীয় কষ্টটি পাই যাঁর জন্য, তিনি আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ ছিলেন না। ছিলেন একজন উদ্বাস্তু মানুষ। তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে এসেছিলেন দূরের এক বানভাসি জেলা হতে। এখানে এসে উদ্বাস্তু হিসেবেই ভেসে বেড়াচ্ছিলেন নানা জলা জঙ্গলায়। তাঁর মূল পেশা ছিল মাটি কাটা। তাঁর স্ত্রী নানা গৃহস্থ কাজ করতেন। একসময় তিনি আমাদের ঘরের কাজ শুরু করেন। সে সূত্রে আমার দয়াবান পিতা তাদের আমাদের উঠানের ওপারে সুপারি বাগানের ভেতর ঘর করে থাকতে দেন। তাঁর ছিল অনেক ছেলেমেয়ে। সংসারে অভাব আর হানাহানি লেগেই থাকত। তিনি নিজে ছিলেন খানিকটা উন্নাসিক প্রকৃতির। পরিবারের সমস্যা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতেন না। মাটি কাটার কাজ তো আর নিয়মিত থাকত না। থাকলেও তিনি নিয়মিত যেতেন না। প্রায় সারাদিনই খুপরি ঘরে শুয়ে বসে থাকতেন। মাঝে মাঝে কাঁধে গামছা নিয়ে বের হতেন। কলতলায় গিয়ে কল চাপতেন।
তারপর খুব যত্ন করে অনেকক্ষণ ধরে হাতমুখ ধুতেন। গা মুছে আশেপাশে পায়চারি করতেন আর গামছা দিয়ে গায়ের মাছি তাড়াতেন। এমন করে হুসহাস করে মাছি তাড়াতেন আর কথা বলতেন যেন মাছিরা তার গায়ে বসে খুবই অপরাধ করেছে। তারপর একসময় বিরক্ত হয়ে বলতেন, বাউরে, তুনগো জ্বালায় আই বাইছতাম নো। আমরা খুব মজা পেতাম তার কথাবার্তায়। এমনিতেই তিনি খুব ভদ্র সজ্জন মানুষ ছিলেন। ঝগড়াটে হয়ে উঠতেন সন্ধ্যার পর স্ত্রী পুঁটলিতে করে একটু খাবার নিয়ে আসার পর। তাঁর স্ত্রী সারাদিন কাজ করে নিজের বরাদ্দ খাবারটুকুই হয়তো পুঁটলিতে করে ঘরে নিয়ে যেতেন। সে খাবার তো আর তাঁর মন মতন হবার কারণ ছিল না। সেটা নিয়ে তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে উঠতেন। তারপর ঘরে সদস্যসংখ্যা ছিল বেশি। কিছুক্ষণের মধ্যেই মারামারি, চিৎকার শুরু হতো। তাদের এ সবটুকু আমাদেরও জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিল। একদিন ভরসন্ধ্যায় তাদের বাসায় কান্নার রোল শোনা গেল। এ কান্নার ধরন আলাদা। আমরা ছুটে গেলাম। গিয়ে দেখি তিনি মারা গেছেন। জানা গেল তিনি মুরগির কলিজা দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী কীভাবে যেন সে ব্যবস্থাও করেছিলেন। তিনি কলিজা মুখে দিয়ে অর্ধেক গিলার আগেই মারা যান। তাঁর স্ত্রী সুর করে রোদন করতে করতে সে কথাগুলো বারবার বলছিলেন। মৃতের গোর কাফনের সব ব্যবস্থা আমাদেরই করতে হয়। এই প্রথম আমি কাউকে শেষ যাত্রার জন্য প্রস্তুতি চোখের সামনে দেখতে পাই। মনে প্রচণ্ড দাগ কাটে। তাঁকে সমাহিত করা হয় দিঘির পাড়ে। তাঁর চিহ্ন অনেক দিন থেকে যায় আমার বুকে। আজও হয়তো মুছেনি বলেই লিখছি।
আমরা দুই ভাই। আমাদের কোনো বোন ছিল না। চিরকাল চাচাতো বোন শিল্পী আপাকেই আপন বোন বলে জানতাম। চাচা চাকরি করতেন চা বাগানে। তাঁর শৈশব কেটেছিল চা বাগানেই। আমরা শীতে চা বাগানে বেড়াতে গেলে বোনের স্নেহের স্বাদ অনুভব করতাম। তিনি সম্ভবত নবম শ্রেণিতে ওঠার পর আমাদের বাড়িতে আসেন এখানকার স্কুলে ভর্তি হওয়া উপলক্ষে। আমরা পিঠাপিঠি ভাইবোন হিসেবে বড় হতে থাকি। একসময় তাঁর বিয়েও হয়ে যায়। দুটো কন্যাসন্তানও হয়। হঠাৎ একদিন তাঁর ক্যান্সার ধরা পড়ে। নানান হাসপাতালে চিকিৎসা চলতে থাকে। একসময় চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নেন তাঁর শরীরের কিছু অংশ কেটে বাদ দিতে হবে।
অপারেশন হওয়ার আগে তিনি বলেন, আমি মরে গেলে কী হবে রে?
‘কিছুই হবে না। আমরা নিচে কফিন কিনে রেখেছি। চা পাতা আর বরফও রেডি। মরামাত্রই কফিনে ভরে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাব’– আমার এই সপ্রতিভ জবাব শুনে তিনি হাসেন। এর কয়েক বছর পর একটা সময় আসে, যখন তিনি বুঝতে পারেন তাঁকে সত্যিই চলে যেতে হবে। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে সিলেটের একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। তিনি মারা যান। তাঁকে সমাহিত করা হয় আমাদের গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে। আমি ঢাকা থেকে দ্রুত যাই। কিন্তু তাঁর মুখখানা শেষ দেখা হয়নি। আমি তাঁর মায়াবী মুখখানা এখনও বহন করি সর্বদা, বেদনাভরে।
আমার পিতা খুব স্নেহবৎসল ছিলেন। আমার এখনও মনে আছে, আমি তখন বেশ বড়। শারীরিক উচ্চতায় পিতাকে ছাড়িয়েছি। সে সময় আমার খুব জ্বর হলো। আব্বা আমাকে কোলে নিয়ে হাঁটার চেষ্টা করেছিলেন। আমার পা মাটিতে লেগে যাচ্ছিল, তাও তিনি নিয়ে হাঁটার চেষ্টা করেছিলেন। যখন আমার এসএসসি ফল বের হলো। আব্বা বেশ রাতে বাজার থেকে বাড়ি এসেছেন। আমি ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছি। তিনি শিয়রে বসে থাকলেন আমার ফল জানাবেন বলে। যেন তিনিই বায়েজিদ বোস্তামী।
শেষ বয়সে আব্বা অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ঢাকায় চিকিৎসা নিতে প্রায় সময় আসতেন। একবার ফুসফুসে পানি জমে গেল। জ্বরসহ ঢাকায় নিয়ে এলাম। রাতে আব্বার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে থাকলে তিনি কেবল শীত শীত করতে থাকলেন। আমি বাসায় থাকা সব লেপ-কম্বল তাঁর গায়ের ওপরে দিলাম। কিন্তু আব্বার শীতের অনুভূতি গেল না। তারপর নিজে তাঁর ওপর শুয়ে পড়লাম। আব্বা জ্বরের ঘোরে কেবল বলতে থাকলেন তোমারনু ঠান্ডা লাগব, শোয়াইব (তোমার তো ঠান্ডা লেগে যাবে)।
আম্মা খুব অল্প বয়সে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন। আব্বার শুধু চিন্তা ছিল তিনি আগে মারা গেলে আম্মার অযত্ন হবে কিনা। আম্মাকে আদর করে প্রায় সময় বলতেন, আমি মরলে তোমার কী হবে বুড়ি!
আব্বা কথা রেখেছিলেন। আম্মার মাত্র একদিন আগে মারা গিয়েছিলেন। আব্বা যেদিন মারা যান, আকাশজুড়ে কালো মেঘ জমে ছিল। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল দেশজুড়ে। আব্বার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে বাড়ি থেকে ফোন পেয়ে তখনই রওনা দিই। আমাদের গাড়িটি যখন হবিগঞ্জের মাধবপুর বাঁক পার হচ্ছিল, তখন হঠাৎ আকাশ চিরে যায়। বিদ্যুৎ ঝলকে। আমি পাশে বসে থাকা জেসমিনকে বলি, আব্বা গেলেন। জেসমিন আমার হাত চেপে ধরে রেখেছিল। পরে জেনেছি আব্বা সত্যিই সেই ক্ষণটিতেই মারা গিয়েছিলেন। আম্মা পরদিন সকালে হাসিমুখে কথা বলতে বলতে চলে গিয়েছিলেন। সত্যিই এগুলো অলৌকিক ঘটনা ছিল।
আম্মা সারাজীবন অসম্ভব শারীরিক যন্ত্রণা ভোগ করে গেছেন। খুব অল্প বয়স থেকেই লাঠিতে ভর দিয়ে চলাফেরা করতেন। শেষদিকে পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন। পিঠে বেড সোর হতে শুরু করেছিল। কিন্তু কখনও তিনি কোনো শারীরিক যন্ত্রণার অভিযোগ করতেন না। মাঝে মাঝে শুধু বলতেন, আল্লায় কিতার লাগি আমারে এত পরীক্ষা কররা?? (আল্লাহ কেন আমাকে এত পরীক্ষা করছেন?)। কিন্তু আম্মা কখনও পরীক্ষায় হার মানেননি। শুয়ে শুয়েই ইশারায় নামাজ আদায় করতেন। কোনো কষ্টের কথা উচ্চ স্বরে মাবুদকেও জানাতেন না।
আজ আমি আমার পিতার অ্যাজমার শ্বাসকষ্ট আক্ষরিক অর্থে অনুভব করি। অনুভব করি মায়ের শারীরিক ব্যথার কষ্ট। তারা তাদের কষ্টগুলো নিয়ে পাশাপাশি কবরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাদের কষ্টগুলোর স্মৃতি আমাকে জাগিয়ে রাখে। কষ্ট দেয়।
আব্বাকে খাটিয়ায় তুলে শেষ যাত্রা যখন যায়, আমি খাটিয়ার পেছনে পেছনে হাঁটছিলাম। মসজিদের বড় গিলাফে তাঁর দেহ আবৃত করা ছিল। কিন্তু সাদা কাফনে মোড়ানো তাঁর পা দুটো আমি পেছন থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম। তাঁর এ পা দু’খানি একদিন আমার শরীরের ভর বহন করেছিল। আমাদের সুখের জন্য পৃথিবীর মাটিতে অস্থির বিচরণ করেছিল। তিনি তাঁর সে চরণ দু’খানি নিয়ে সমাহিত হয়েছেন। কিন্তু দৃশ্যের স্মৃতি রেখে গেছেন, চিরতরে। তা মোছার নয়। আমার বুকে সে চরণ চিহ্নের দাগ মালয় পাহাড়ের পাথরের দাগের মতোই, মায়াময়।
(কবি আজিজুন মাগফুরাকে অকালে হারানোর দাগ এ লেখায় যুক্ত করা হলো না। কালের খেয়ার পাঠক আগেই পড়েছেন।)
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: কর ছ ল র জন য বলত ন একদ ন ত রপর করত ন
এছাড়াও পড়ুন:
হামাস যেভাবে ইসরায়েলের ‘অপরাজেয়তার মিথ’ ভেঙে দিল
ইসরায়েল ভয়াবহ মাত্রায় ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালিয়েছে। এ ভয়াবহতা শুধু গাজা নয়, পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীর, এমনকি ইসরায়েলের ভেতরে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের জীবনের সঙ্গে হামাসের ভবিষ্যৎকে একসূত্রে গেঁথে ফেলেছে। আজ হামাস আত্মসমর্পণ করলে অনেকের চোখে তা পুরো ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার পরাজয় বলে বিবেচিত হবে।
গাজার বর্তমান অবস্থা এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। একে কেউ কেউ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খোলা বন্দিশিবির বলছেন, কেউ বলছেন হত্যাক্ষেত্র। অথচ এর এক ঘণ্টার দূরত্বে তেল আবিব। তেল আবিবের অনেক বাসিন্দা নিশ্চিন্তে আরামে জীবন কাটাচ্ছেন, যেন কিছুই ঘটছে না।
তবে এক বিষয় তাঁরা বোঝেন না, হামাস আত্মসমর্পণ করবে না।
যে কেউ ভেবে নিচ্ছেন, হামাসের নেতারা অর্থ নিয়ে পালিয়ে যাবেন। যেমন একসময় ফাতাহ করেছিল। তাদের এ ভাবনা প্রমাণ করে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তাঁর প্রতিপক্ষকে কতটা ভুলভাবে বুঝেছেন। ১৮ মাসের যুদ্ধে, দুই মাসের অবরোধে ক্ষুধার যন্ত্রণায় নিপতিত এক জনগোষ্ঠীকে এমন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যা কার্যত আত্মসমর্পণের সমান। প্রস্তাব ছিল, সব বন্দী মুক্তির বিনিময়ে দেওয়া হবে ৪৫ দিনের খাবার ও পানি। আর হামাসকে নিরস্ত্র হতে হবে।
আরও পড়ুনইসরায়েলের জঘন্য মিথ্যাচার ও হামাসের বিজয় অর্জন২৮ জানুয়ারি ২০২৫হামাস পাল্টা প্রস্তাব দিয়েছিল, বন্দী মুক্তির বদলে কিছু ফিলিস্তিনি বন্দীর মুক্তি দিতে হবে, করতে হবে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি, গাজা শাসনের ভার অন্য দলকে দিতে হবে। কিন্তু দুটি শর্তে হামাস এখনো অটল—তারা নিরস্ত্র হবে না ও ইসরায়েলি বাহিনীর গাজা পুরোপুরি ছাড়তে হবে।
এ অচলাবস্থার প্রধান কারণ নেতানিয়াহু নিজেই। আর আগে দুবার হামাসের সঙ্গে চুক্তি করে নিজেই তিনি তা ভেঙেছেন। জানুয়ারির এক চুক্তিতে যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৩৩ বন্দীর মুক্তি ঘটেছিল। এরপর আরও আলোচনার কথা ছিল, কিন্তু নেতানিয়াহু সে আলোচনায় কোনো গরজ দেখাননি। তাঁদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও তাতে কোনো বাধা দেয়নি।
এই যে নেতানিয়াহুর এমন ঔদ্ধত্য আচরণ, এর কারণ কিন্তু সামরিক নয়; বরং রাজনৈতিক। ইসরায়েলে নেতানিয়াহুর যে রাজনৈতিক জোটের সরকার, তা রক্ষা করতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন ছিল। এ পরিস্থিতিতে মানবিক সহায়তা বন্ধ করে দিয়ে খাদ্যগুদামও বোমায় গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল। ক্ষুধাকেই যেন অস্ত্র বানানো হয়েছে। অথচ এর মধ্যেও হামাস প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে।
আফগানিস্তানে তালেবান কিংবা ইরাকে প্রতিরোধ আন্দোলন বড় শক্তিগুলোকেও দেশ থেকে তাড়িয়েছিল। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল ইসরায়েলের মতো ছোট দেশ গাজায় ‘চিরন্তন যুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়া কতটা সম্ভব?যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিনিধি অ্যাডাম বোয়েলারও জানিয়েছেন, সব বন্দী মুক্তি দিলে যুদ্ধ থেমে যেতে পারে। কিন্তু ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নিজেই সে পথে বাধা। এমনকি সিআইএর প্রধান বিল বার্নসের মধ্যস্থতায় একসময় হামাস চুক্তিতে সই করেছিল; কিন্তু নেতানিয়াহু সেখান থেকেও সরে আসেন।
একটা কারণ মানবিক বিপর্যয় নিজেই। গাজায় গত ৭ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভাঙার পর থেকে ১ হাজার ৫০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। হামাসের নেতারা নিহত হয়েছেন। প্রশাসন, হাসপাতাল, স্কুল—সবকিছু ধ্বংস হয়েছে। রাফা শহরও এখন ধ্বংসস্তূপ। কিন্তু অর্থের প্রলোভনেও ফিলিস্তিনিরা গাজা ছাড়ছেন না।
একসময় পিএলওর নেতা ইয়াসির আরাফাত বা ফাতাহ, অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে নির্বাসনে চলে যেতেন, কিন্তু হামাসের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। কারণ কী?
ইসরায়েলি বর্বরতায় গাজা ধ্বংস হয়ে গিয়ে পুরো ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার একটি পবিত্র প্রতীক হয়ে গেছে। আজ আর হামাস আলাদা কোনো সংগঠন নয়। তারা সেই জনগণের অংশ, যাঁদের প্রত্যেকে এক বা একাধিক প্রিয়জন হারিয়েছেন। সেই অর্থে এ প্রতিরোধও একটি জাতিগত সংকল্প।
আর এ প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় কারণ ইসরায়েল নিজেই। যে ইসরায়েল রাষ্ট্র কখনো থামে না, আরও জমি চায়, অন্য ধর্ম ও জনগণের অস্তিত্ব মুছে দিতে চায়। খ্রিষ্টান, মুসলিম—সবাই এখন নিপীড়নের শিকার। শান্তিকালে পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন বেড়েছে—ওসলো চুক্তির পরও থামেনি। ইসরায়েল নামের রাষ্ট্রটি কোনো সময়ই দুই রাষ্ট্র সমাধানে আগ্রহী ছিল না।
এখন যাঁরা ক্ষমতায়—নেতানিয়াহু, ইতামার বেন গাভির, বেজালেল স্মোত্রিচ—তাঁরা মূলত ডেভিড বেন গুরিয়নের অসমাপ্ত কাজ শেষ করছেন। সেই কাজ হলো ‘ইসরায়েলের ভূমি’ থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দেওয়া। ইসরায়েলের ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্মভিত্তিক—সব পক্ষই যেন এ লক্ষ্যে একমত।
সম্প্রতি আল-আকসা মসজিদে রেকর্ডসংখ্যক ইহুদিকে প্রার্থনার করবার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের সর্বোচ্চ আদালত গাজায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। ইসরায়েল রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান এক হয়ে ফিলিস্তিনকে নির্মূল করতে উঠেপড়ে লেগেছে।
এ প্রেক্ষাপটে হামাস যদি আত্মসমর্পণ করে, তাহলে ফিলিস্তিনিদের কাছে তা হবে তাঁদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে পরাজিত হওয়া। কারণ ধর্মীয় নয়, কৌশলগতভাবেই হামাস এখন প্রতিরোধের একমাত্র বাস্তব পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হামাস ফাতাহর মতো নয়। এ সংঘাত শুরু হয়েছিল আল-আকসায় ইহুদি উপদ্রব নিয়ে। গাজার অনেক মানুষ হামাসের সদস্য না হয়েও এ নির্মমতার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের ধর্মের মধ্যেই সান্ত্বনা খুঁজছেন। যেমন ২৩ বছর বয়সী প্যারামেডিক রিফাত রাদওয়ান। তিনি মারা যাওয়ার আগে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইছিলেন, তিনি নিয়মিত নামাজ আদায় না করায় অনুতপ্ত ছিলেন। শেষ মুহূর্তে বিশ্বাসটাই ছিল তাঁর শেষ আশ্রয়।
তবে আত্মসমর্পণ না করার আরেকটি কারণ আছে। আর তা হলো হামাস তাদের লক্ষ্য ইতোমধ্যে কিছুটা অর্জন করেছে বলে মনে করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার দাবি বিশ্বমঞ্চে আবার জোরালোভাবে তুলে ধরা।
সেই অর্থে আন্তর্জাতিক পরিসরে হামাস যেন সত্যিই ছাপ ফেলতে পেরেছে। যুক্তরাষ্ট্রে আজ ৫৩ শতাংশ মানুষ ইসরায়েলের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। মাত্র কিছুদিন আগেও এ সংখ্যা ছিল অনেক কম।
পশ্চিমা আইন হয়তো হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু অনেক সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিরোধকারী হিসেবে দেখছেন। তাঁরা হয়তো হামাসের হামলাকে অন্যায় ভাবছেন। কিন্তু ইসরায়েলকেও আর সমর্থন করতে পারছেন না।
এ যুদ্ধ ইসরায়েল বলপ্রয়োগে চিরতরে শেষ করতে চায়। এর মানে, এ যুদ্ধ এখন প্রত্যেক ফিলিস্তিনির আত্মপরিচয়ের অংশ হয়ে উঠেছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই একাধিক জটিল মধ্যস্থতা করতে ব্যস্ত। যেমন গাজা, ইরান আর সৌদি-ইসরায়েল সমঝোতা। কিন্তু এর একটিও সহজ নয়। একদিকে চলছে ইরানে হামলার প্রস্তুতির গুঞ্জন। অন্যদিকে গাজা থেকে জনগণকে স্থানান্তরের পরিকল্পনায় প্রতিবেশীরা একমত নয়। মিসর আর ইসরায়েল, এমনকি সিনাই নিয়ে খোলাখুলি দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে।
আফগানিস্তানে তালেবান কিংবা ইরাকে প্রতিরোধ আন্দোলন বড় শক্তিগুলোকেও দেশ থেকে তাড়িয়েছিল। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল ইসরায়েলের মতো ছোট দেশ গাজায় ‘চিরন্তন যুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়া কতটা সম্ভব? তাই নেতানিয়াহুকে দ্রুত একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
৭ অক্টোবরের পর ইসরায়েলের ‘অপরাজেয়তার মিথ’ ভেঙে গেছে। সেই ভাঙন আর জোড়া দেওয়া সম্ভব নয়। এখন সময়, পরাজয়ের আগেই নিজ থেকে সরে দাঁড়ানোর।
ডেভিড হার্স্ট মিডল ইস্ট আই-র সম্পাদক
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ