জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান ছাত্র-জনতাকে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, সেটি বাংলাদেশ বিনির্মাণে আশাবাদী করেছিল। বিশেষত শেখ হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এবং ছাত্র-জনতার খুনের প্রতিবাদে জুলাইয়ের শেষদিক থেকে সারাদেশে এক দফার দাবি ঘিরে সবাই যেভাবে এক ছাতার নিচে দাঁড়িয়েছিল, তা অভূতপূর্ব। তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষু, হামলা, বিভিন্ন বাহিনীর নির্বিচার গুলির মুখে দাঁড়িয়েও যে ইস্পাতদৃঢ় অবস্থান ছাত্র-জনতা দেখিয়েছে, তা যে কোনো গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে চিরকালের উদাহরণ হয়ে থাকবে। কিন্তু ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ও দেশত্যাগের পর রাজনীতির পুরোনো ধারা নতুন করে ফিরে আসতে দেখা গেল। বিভক্তি ও স্বার্থের রাজনীতি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। এ কথা সত্য, দীর্ঘদিনের অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগবে। কিন্তু জুলাই-আগস্টে অগণিত জীবন অকালে হারানোর পরও সেই একই ধারায় বাংলাদেশ চলতে দেখা যাতনার।   

দেশ যাবে কোন পথে– এমন প্রশ্নের দিশা আমরা জুলাই-আগস্টেই পেয়েছি। দেশকে দ্রুত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিকে এগিয়ে নিতে তাই সব পক্ষকেই বিচক্ষণতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক ধারায় দেশকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত হতে দেখা গেছে। এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে সরকার কয়েকটি ‘সংস্কার কমিশন’ গঠন করেছে। এরই মধ্যে চারটি কমিশন সংস্কার প্রস্তাব জমা দিয়েছে। বাকি সংস্কার প্রস্তাব চলতি জানুয়ারিতেই পাওয়া যাবে বলে জানতে পেরেছি। একটা বিষয় পরিষ্কার, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সংস্কার বাস্তবায়ন ও নির্বাচন আয়োজন করতে হবে সরকারকে। সে ক্ষেত্রে ঐকমত্য তৈরি না হলে সংস্কার বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে।
আরেকটি বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার যে, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল। নিত্যনতুন চিন্তা-পদ্ধতি বেরিয়ে আসবে, সেই সঙ্গে পুরোনো ধারণাও বদলে যাবে। আওয়ামী শাসনামলে ভেঙে পড়া গণতান্ত্রিক সেতুটি পুনরায় নির্মাণ করতে হলে সংস্কার অবশ্যই করতে হবে। যেমন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন বলছে, গত দেড় দশকে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। যে কারণে তারা যে প্রস্তাব দিচ্ছে, সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে। তারা বলেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকার সেগুলো বাস্তবায়ন করবে। 

কথা হচ্ছে, দেশে এখন মোটাদাগে রাজনৈতিক শক্তি কারা? এই শক্তিগুলো ঐকমত্যে পৌঁছুতে পারবে কি? নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি দুটি বড় ধারায় বিভক্ত ছিল– বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। এখন চব্বিশের আগস্টের পরে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে বড় ধরনের অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। কেউ কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগের অবস্থা একসময়ে মুসলিম লীগের মতো হয়ে যাবে। ভবিষ্যতের কথা আপাতত তোলা রইল। বর্তমানে আগামী নির্বাচনে দলটির অংশ নেওয়া বিষয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তাতে বলা যায়, আওয়ামী লীগের আগামী নির্বাচনে দলীয় পরিচয়ে অংশ নেওয়া অনিশ্চিত। প্রত্যাশিত সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর যে ঐকমত্য দরকার, সেখানে আওয়ামী লীগের মতামত প্রয়োগের সুযোগ থাকছে না। তাহলে রাজনৈতিক ঐকমত্যের জন্য অবশিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো দুটি মোটাদাগে বিভক্ত– বিএনপি ও জামায়াত। জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক দল হিসেবে কতটা পারফর্ম করতে পারবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এর বাইরে নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে জাতীয় নাগরিক কমিটি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চাইছে। কিন্তু এখনও আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ না করায় রাজনৈতিক শক্তি বলতে যা বোঝায়, সেভাবে এখনও দানা বাঁধতে পারেনি। এ ছাড়া আরও কিছু রাজনৈতিক দল ও জোট থাকলেও, তারা মোটাদাগে উল্লিখিত দুই ভাগে বিভক্ত। 

সংস্কার আগে, নাকি নির্বাচন– এ নিয়ে রাজনৈতিক দল ও দেশবাসী এখনও ধোঁয়াশার মধ্যে। এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি। আবার সংস্কার বলতে ঠিক কতটুকু সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেটিও পরিষ্কার নয়। বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রূপরেখা চাইছে। তারা বলছে, একমাত্র রাজনৈতিক সরকারের পক্ষেই দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। নির্বাচন না হলে দেশের সংকট-অনিশ্চয়তা কাটবে না। সংস্কারের ব্যাপারে কারও কোনো আপত্তি নেই। তবে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে সরকারের উচিত দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাওয়া। 

এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে– আগে সংস্কার, নাকি নির্বাচন? নির্বাচিত সরকার ছাড়া জনগণের প্রত্যাশা আর কেউ পূরণ করতে পারবে না। সে জন্য প্রথমত প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। পরে সেই সংস্কার অনুমোদন করা হবে। নির্বাচন যত তাড়াতাড়ি হবে ততই দেশের জন্য মঙ্গল। দেশের মানুষ বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। নির্বাচন সংস্কার কমিশন বলছে, দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে বেশ কিছু প্রস্তাব তারা চূড়ান্ত করেছে। একটি ভালো নির্বাচন দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার মাপকাঠি। এ ছাড়া অন্যান্য কমিশনও যে প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করেছে, তাতে রাজনৈতিক দলগুলো কতটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে? 

বাস্তবতা হচ্ছে, চাইলেই বিএনপি কিংবা বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত উপেক্ষা করে সংস্কার বাস্তবায়ন করা এই মুহূর্তে সম্ভব না। যদি সরকার মনে করে, সব দলকে আলোচনার টেবিলে বসিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছুবে, সেটা যেমন অতীতে হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। পরিস্থিতি এমন হলে নির্বাচনের রোডম্যাপ বাস্তবায়নেও জটিলতা তৈরি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হবে তা অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হবে বৈ কি। আবার বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচিত সরকার দেখতে চায় বলে বিদেশি বন্ধু ও উন্নয়ন সহযোগী থেকেও প্রকাশ্যে তাগিদ পাওয়া যাচ্ছে। খাদ্য-বস্ত্রসহ অন্য অধিকারগুলোর মতো ভোট দেওয়ার অধিকারও এক ধরনের নাগরিক অধিকার। সবার ওপরের দিকের নাগরিক অধিকারগুলোর একটি ভোট দেওয়ার অধিকার।
নাগরিকরা চায় দেশ কার দ্বারা পরিচালিত হবে, আমি কার দ্বারা পরিচালিত হবো– এই প্রশ্নগুলোর সদুত্তর। ভোটের অধিকার তাই অনেক বড় বিষয়। নির্বাচন বনাম সংস্কারের বিতর্ক এই মুহূর্তে শুভবুদ্ধির লক্ষণ নয়। নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণাই পারে দেশকে স্থিতিশীল রাখতে। এটাই কাম্য। 

এহ্‌সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক, 
সমকাল; কথাসাহিত্যিক

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক সরক র র প র র জন ত ত সরক র ঐকমত য র জন য ব এনপ আওয় ম আগস ট

এছাড়াও পড়ুন:

আইন পর্যালোচনায় আজ বসছে ইসি, ঐকমত্য কমিশনের দিকে নজর

ভোটার তালিকা আইন, সীমানা নির্ধারণ আইন, পর্যবেক্ষণ নীতিমালাসহ একগুচ্ছ আলোচ্যসূচি নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার এএমএম নাসির উদ্দিন কমিশনের তৃতীয় কমিশন সভা বসছে। 

আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশ নিয়ে ‘দ্বান্দ্বিক’ প্রতিক্রিয়া দিয়েছে ইতোমধ্যে। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ থাকলেও ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট করতে নিজেদের প্রয়োজনে ‘জরুরি’ সংস্কার নিয়ে নির্বাচন আয়োজনকারী সাংবিধানিক সংস্থাটি সরকার ও সংস্কার কমিশনের কাছে প্রস্তাব রাখবে। এক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টা নেতৃত্বাধীন ঐকমত্য কমিশনের দিকে তাকিয়ে সংশ্লিষ্টরা। 

তৃতীয় সভায় যেসব বিষয় আলোচনায়
আজ বৃহস্পতিবার সীমানা নির্ধারণ আইনসহ বেশ কয়েকটি আইন পর্যালোচনা করবে ইসি। আইন পর্যালোচনাসহ ১১টি বিষয় রয়েছে আলোচ্যসূচিতে। সিইসির সভাপতিত্বে এ সভায় চার নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিব থাকবেন।

ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ জানান, কমিশনের তৃতীয় সভায় ভোটার তালিকা আইন, ২০০৯ পর্যালোচনা; জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ আইন, ২০২১ পর্যালোচনা; নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালা-২০২৩ এবং গাইডলাইনস ফর ইন্টারন্যাশনাল ইলেকশন অবজারভার অ্যান্ড ফরেন মিডিয়া পর্যালোচনা; নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশিক্ষণ ভাতার হার নির্ধারণ এবং প্রশিক্ষণার্থী ও প্রশিক্ষক নির্বাচন বিষয়ে পর্যালোচনাসহ বেশ কিছু বিষয় রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘সভার কার্যপত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। এজেন্ডার বাইরে কোনো বিবিধ কি আলোচনা হতে পারে তা বলা যাচ্ছে না। তবে সংস্কার বিষয়ক তথ্য এজেন্ডায় নেই।

আলোচ্যসূচিতে আরও রয়েছে- বিভিন্ন দেশে দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রমের শর্ত/পদ্ধতি/সীমাবদ্ধতা পর্যালোচনা, নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংবাদিক/গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য নীতিমালা, ডিআরএস সম্পর্কিত বিষয়াদি, ব্ল্যাঙ্ক কার্ড সরবরাহ সংক্রান্ত বিষয়াদি, প্রস্তাবিত জাতীয় নির্বাচনি পদক নীতিমালা, ২০২৫ এর উপর আলোচনা, আইডিইএ দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্পের মেয়াদ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, নির্বাচন কমিশনে বিদ্যমান প্যানেল আইনজীবী তালিকা হালনাগাদকরণ এবং বিদ্যমান সম্মানী/ফি কাঠামো পর্যালোচন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আইন পর্যালোচনায় আজ বসছে ইসি, ঐকমত্য কমিশনের দিকে নজর