কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী এক বিপ্লব ঘটিয়েছে। শিক্ষাও তার বাইরে নয়। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশেও এই প্রযুক্তি শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, বিস্তার এবং শিক্ষার সামগ্রিক ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণে ব্যাপক সম্ভাবনার সুযোগ তৈরি করছে। আজ আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবসে প্রতিপাদ্য– ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও শিক্ষা: স্বয়ংক্রিয়তার যুগে মানবিক ক্ষমতা সংরক্ষণ’। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে, এটি বর্তমানে শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যক্তিকেন্দ্রিক শেখার অভাবনীয় সুযোগ প্রদান করছে, যা কিছুদিন আগেও আমাদের কল্পনায় ছিল না। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাডাপ্টিভ লার্নিং প্ল্যাটফর্মগুলো শিক্ষার্থীদের শেখার সক্ষমতা বিশ্লেষণ করে তাদের প্রয়োজন ও সক্ষমতা অনুযায়ী শেখার ক্ষেত্রকে সাজাতে এবং শেখার সুযোগ দিতে পারে। 

একটি শ্রেণির প্রত্যেক শিক্ষার্থীর শেখার অগ্রগতি, পাঠে সম্পৃক্ততা এবং পারফরম্যান্সের তথ্য সংগ্রহ, পর্যবেক্ষণ করে এর আলোকে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা শেখার অভিজ্ঞতা প্রদান করতে পারে এআই; যার মাধ্যমে এ ধরনের প্রযুক্তি আমাদের শহর ও গ্রামের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য কমাতে সাহায্য করবে বলে আমরা আশাবাদী। এ ছাড়া শিক্ষকদের কাজকে সহজ করতে এআইর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। শিক্ষকরা এখন এআইর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্স পর্যবেক্ষণ; খুব সহজে এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুত করতে পারেন, যার ব্যবহার শিক্ষাদান পদ্ধতিকে আরও উন্নত করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। 

বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে জনসংখ্যার বড় অংশ এখনও মানসম্মত শিক্ষার আওতার বাইরে, সেখানে এআই শিক্ষার সামগ্রিক মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, যা সমতাভিত্তিক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি ও বিস্তারে বিরাট অবদান রাখবে। এআইর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি। বাংলাদেশ এখন শিল্পবিপ্লব ৪.

০-এর যুগে প্রবেশ করছে। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের জন্য এআই ও অন্যান্য উদ্ভাবনী প্রযুক্তি শেখা অত্যন্ত জরুরি, যা তাদের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সাম্প্রতিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম তাদের ‘দ্য ফিউচার অব জবস রিপোর্ট ২০২৫’-এ বিশ্বের এক হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠানের ওপর জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৫০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান এআই ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের ব্যবসার কাঠামো পুনর্গঠনের পরিকল্পনা করেছে। ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের এআই সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে এবং ৬৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠান এআই দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা করছে। এতে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি, ভবিষ্যৎ চাকরি বাজার এআইনির্ভর হবে এবং এআইর দিকেই ঝুঁকছে।      

যদিও এআই শিক্ষার মান উন্নয়নের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, তবে এর বাস্তবায়নে বাংলাদেশে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনও পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। ইন্টারনেট সংযোগের সীমাবদ্ধতা, উন্নত কম্পিউটারের অভাবে এআইভিত্তিক সিস্টেমের ব্যবহার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে প্রযুক্তিগত সুবিধার ঘাটতি এআই বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা। দ্বিতীয়ত, এআই ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং শিক্ষা প্রশাসক আছেন, যারা এআই সম্পর্কে এখনও জানেন না। তাদের এআই ব্যবহারে প্রশিক্ষিত করতে সময় ও অর্থের প্রয়োজন। তৃতীয়ত, এআই বাস্তবায়নে বড় ধরনের আর্থিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে বাজেট সীমিত হওয়ায় এই বিনিয়োগকে কার্যকর করার জন্য পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্ব অপরিহার্য। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হলো শিক্ষার মানবিক দিক হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতি অতি নির্ভরশীলতা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা, মূল্যবোধ এবং সমালোচনামূলক চিন্তাধারার দক্ষতাকে প্রভাবিত করতে পারে।    

যদিও বর্তমানে এআই ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে সেগুলো মোকাবিলা করার জন্য সঠিক কৌশল গ্রহণ করলে এআই বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রকে অদূর ভবিষ্যতে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

এআইভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে আমরা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের তরুণ প্রজন্মকে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত করতে পারি। বাংলাদেশ সরকার যদি এআইকে চলমান শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে, তাহলে পরবর্তীকালে শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হবে। এআই ব্যবহার করে ক্লাসরুমে শিক্ষাদান পদ্ধতিকে আরও আকর্ষণীয় ও কার্যকর করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এবং অগমেন্টেড রিয়েলিটি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের অভিজ্ঞতাকে বাস্তবধর্মী করা সম্ভব। তা ছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের এসটিইএম (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত) শিক্ষা উন্নত করা যাবে। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরও দক্ষ করে তোলার পাশাপাশি দেশের উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ ব্যবস্থা আত্মস্থকরণেও এআই সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এক অপার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ নিয়ে এসেছে। এটি সমভাবে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্য দূর করতে অত্যন্ত কার্যকর একটি হাতিয়ার। তবে এ প্রযুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের জন্য যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা মোকাবিলার জন্য যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ অত্যাবশ্যক। সঠিক পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিভিত্তিক অবকাঠামো গড়ে তোলা গেলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। এর মাধ্যমে আমরা এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিশ্বমানের দক্ষতায় উন্নীত করবে এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।

মো. রমজান আলী: ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার ফর এডুকেশন, ইউনেস্কো, ঢাকা

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: এআই ব যবহ র ব যবস থ র জন য ত করত

এছাড়াও পড়ুন:

দেখে এলাম চক্ষু মেলিয়া 

‘‘ইচ্ছে তো হয় সারাটা জীবন
এই পৃথিবীকে
এফোঁড়-ওফোঁড় করে যাই দুই
পায়ে হেঁটে হেঁটে
অথবা বিমানে...’’ 
[মানস ভ্রমণ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যয়]

আমরা বিমানেই যাব ঠিক করলাম। দিনক্ষণও ঠিক হলো। এরই মধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ক্রমে তীব্র হয়ে উঠল। অগাস্টের প্রথম দিনগুলোতে পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হলো যে, ফ্লাইট যাবে কিনা সংশয় দেখা দিলো। সংশয় দূর করার উপায় নেই! ইন্টারনেট নেই, মুঠোফোন বেজে চলে, ওপাশ থেকে রিসিভ হয় না, ‘ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া’ অফিসে গিয়ে জেনে আসব, তাতেও মনের বেজায় আপত্তি। পরিবারের আপত্তি তো আছেই- এর মধ্যে আনন্দভ্রমণ! কদাপি নহে। 

শেষ পর্যন্ত ওদের সঙ্গে সংযোগ হলো। বলল, নতুন তারিখ জানাতে। এ আরেক সংকট! আমরা মানে তিনরতœ। কথাসাহিত্যিক মুম রহমান, প্রকাশক সফিক রহমান এবং অধম এই আমি। ওদের কাজের অবসর মিললে আমার ছুটি মেলে না। আমার ছুটি মিললে ওরা বেজায় ব্যস্ত। সময় মেলানো সহজ নয়। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, সেপ্টেম্বরের শুরুতে উড়ব আমরা। ততদিনে পরিস্থিতি থিতিয়ে আসবে নিশ্চয়ই। মানুষ আশায় বাঁচে। আমরাও সেই আশায় দিন গুনতে লাগলাম।

দিন এগিয়ে আসছে। ভেতরে আনন্দের বুদ্্বুদ টের পাচ্ছি। মুম রহমান পরিকল্পনা আঁটছেন। তিনিই প্রধান পরিকল্পক। আমাদের মুরুব্বি। এরই মধ্যে আমাদের হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ খুলে ফেলেছেন সফিক রহমান। সবাই মতামত দিচ্ছেন। আমি হুঁ হ্যাঁ করছি। অন অ্যারাইভাল ভিসা। প্লেনের টিকিট কনফার্ম। হোটেল বুকিং শেষ- আর চিন্তা কি!

যাত্রার শুরুতে প্রথম কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলল বৃষ্টি। অঝোর বৃষ্টি চারপাশ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় সকালে বৃষ্টি মানেই খিচুড়ি। হেঁসেলের কথা বলছি না, রাজপথের কথা বলছি। অফিসগামী কর্মজীবীদের বিড়ম্বনার শেষ নাই। তাদের পিছু থেমে থেমে আমিও চলছি। মহাসড়কে অজগর নড়ছে না। এয়ারপোর্টের দূরত্ব কম নয়। সুনীলের কবিতা ‘এই পৃথিবীকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে যাই দুই পায়ে হেঁটে হেঁটে’ ভাবছি আর ঘড়ি দেখছি। কিন্তু বৃষ্টি তো হচ্ছে। আমি নিশ্চিত এই ঝুম বৃষ্টিতে কবি হাঁটার রিস্ক নিতেন না। তাছাড়া আমি শতভাগ নিশ্চিত কবি ঢাকার ফুটপাতের অবস্থা জানেন না। হন্টন বহুত দূর কি বাত ভায়া! পায়ের নিচে সর্ষে গড়াগড়ি খাচ্ছে, এখন খোলা ম্যানহোলে পড়ার কোনো মানে হয় না।  

যাক্ বাবা মান বেঁচেছে। আমিই এয়ারপোর্টে ফার্স্ট। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর অপর দুজনের দেখা মিলল। তারাও বাসা থেকে বেরিয়ে একই বিড়ম্বনায় পড়েছেন। যাই হোক, এয়ারপোর্টের কাজগুলো দ্রুত হাতে সারতে হলো। খুব বেশি ঝামেলা হলো না। তবে চেকিং অন্য সময়ের চেয়ে কড়াকড়ি। কিন্তু সে আমাদের জন্য নয়, যাদের জন্য তারা বুঝুক। সব দুশ্চিন্তা রেখেই তো যাচ্ছি। বলা ভালো হাফিয়ে ওঠা প্রাণে মুক্ত বাতাস লাগাতেই এই যাত্রা। বিমানের জানালা খুলে দেওয়ার উপায় নেই। ফলে অপেক্ষা করতেই হচ্ছে। তবে হ্যাঁ, রোদ উঠেছে। চারপাশে রোদের ঝিকিমিকি। আর কে না জানে, ঝুম বৃষ্টির পর রোদ একটু বেশিই চকচক করে।

নেপালের ত্রিভুবন এয়ারপোর্টের কথা শুনেছি। কবুল করছি- ভয়ও পাইয়ে দিয়েছেন অনেকে। নামার সময় বিমানের চাকা মাটি স্পর্শ করার পরপরই হ্যাচকা টানে দুলে উঠলাম। পাশের সিট থেকে মুরুব্বি ইশারা করলেন, বুঝলি কিছু? আমি গলায় আটকে থাকা ভয় চুপচাপ গিলে ফেললাম। শেষ গতিতে মার্বেলের গড়িয়ে যাওয়ার মতো খুব ধীরে এক সময় প্লেন থামল। এবার নামার অপেক্ষা। কিন্তু এ তো আর ‘মতিঝিল ৬ বনানী’ নয়। অপেক্ষা অবধারিত। ঘোষণা হবে। হ্যান্ড ব্যাগ নিতে হবে। দরজা খুলবে। মানুষ নামবে। কিন্তু না। এ দৃশ্য আমি বহুবার দেখেছি। থামার সঙ্গে সঙ্গে একদল যাত্রী উঠে দাঁড়াবে এবং দরজার সামনে গিয়ে জটলা করবে। করবেই। সিটের মাঝখানের সরু পথটুকুও তখন ঘিঞ্জি গলি।  

যত সহজ ভেবেছিলাম, এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসা তত সহজ হলো না। কোন হোটেলে উঠেছি জানাতে হবে। আমরা জানালাম। তারা মানলেন না। বুকিং রিসিট দেখাতে হবে। কিন্তু এ কথা আমাদের তো শাকিল বলেনি! 
শাকিল কে?
পরে বলছি। তখন শুধু মনে হচ্ছিল শাকিলকে পেলে দুমদুম দুটো কিল বসিয়ে দেই। কিন্তু পাবো কোথায়? সে ঢাকায় বসে এভারেস্ট জয়ের আক কষছে। সেই আমাদের নেপাল ভ্রমণের পরামর্শদাতা। এ দিকে আমাদের কারো মোবাইলে নেট নেই। থাকবে কীভাবে, কথা ছিল, এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে সিম কিনব। বিদেশ ভ্রমণে এ হলো পয়লা নম্বর কাজ। অথচ এয়ারপোর্টে জালে আটকা পড়ে আছি। ঝান্ডুদার চুঙ্গিঘরের কা- মনে পড়ল। চুঙ্গিওয়ালাকে শুধালাম, ওয়াইফাই আছে কি না? সদুত্তর পেলাম না। হোটেলের নাম বললাম, বললাম সেখানে দয়া করে ফোন করে জেনে নিন অথবা আমাদের ফোনে ধরিয়ে দিন। চুঙ্গিওয়ালা নিরুপায়। বললাম, আপনার মোবাইলটা অন্তত দিন। ওতে নিশ্চয়ই নেট আছে। চুঙ্গিওয়ালা এবার কানেই শুনতে পেলেন না। তিনি শুধু হাঁকছেন- নেক্সট। 

চোখের সামনে দিয়ে বিমানের সহযাত্রীরা একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় কে একজন বললেন, ও পাশে ল্যান্ড ফোন আছে। কথা বলতে পারবেন। কিন্তু আমাদের তো হোটেলের নম্বর মুখস্থ নাই। নামটা মনে আছে এই ঢের। বিপদে পড়ে মুরুব্বি পায়চারী করছেন। চিত্ত চঞ্চল। আমরা তার পায়ে পায়ে হাঁটছি। মুরুব্বি বললেন, ল্যান্ড ফোনেই চলবে। তিনি নেপালের এক কবিকে ফোন করলেন। পরে আমরা তার আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলাম। সে গল্প ক্রমশ প্রকাশ্য। 

আপাতত এটুকু জানিয়ে দেই, তিনিই আমাদের কাছ থেকে হোটেলের নাম জেনে নেট ঘেঁটে সেখানে ফোন করে বিপদ থেকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করেছিলেন। যাক্ মুক্তি মিলল। দুজন পাসপোর্টে সিল লাগিয়ে চুঙ্গিঘরের পরীক্ষা উতরে গেলেন। আটকে গেলাম আমি। একেই বলে ছড়কট। একবার সঙ্গী হলে কিছুতেই ছাড়ানো যায় না। 

চুঙ্গিওয়ালার কাছে প্রায় দুই ঘণ্টা নানা বিষয়ে সহযোগিতা চেয়েছি, ঋণ তো কিছু হয়েছেই। পাওনাদারের মতো মেজাজ নিয়ে তিনি আমার ভিসা ফর্ম ফিরিয়ে দিলেন। সেখানে কপাল দোষে ভিসার তারিখ ওই যে শুরুতে যে তারিখে প্লেনের টিকিট কেটেছিলাম, সেই তারিখ লেখা। এ-ও ওই শাকিলের অবদান। সে লক্ষ্য করেনি। আমি তো কানা, চোখেই দেখি না। এখন এই চুঙ্গিঘরে বসে কাকে দোষ দেব? চুঙ্গিওয়ালার মেজাজ ভালো নেই; তবুও পুনরায় শরমের মাথা খেয়ে শরণ নিলাম। তিনি হাত প্রসারিত করে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে বহুদূরে একটা বুথ দেখিয়ে দিলেন। মুখে কিছুই বললেন না। আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে সেই পানে ছুটলাম। গিয়ে দেখি লম্বা লাইন। সবাই ভিসা ফরম পূরণ করছেন। সুখ হলো এই ভেবে যে, আমিই একমাত্র ‘গারল’ নই। 

আমি লাইনে দাঁড়ালাম। অনেক দেশের হরেক মানুষ। আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট বলে কথা! ভাষা আলাদা, পোশাক আলাদা, চোখে-মুখে নানা জিজ্ঞাসা লেপ্টে আছে। কিন্তু সৌজন্য এক। কেউ কারো জন্য লাইন ছাড়তে রাজি নয়। আগে আমার কাজ তারপর তোমার। আরে ভাই, সঙ্গের দুজন চুঙ্গিঘর পেরিয়ে গেছে, আমি চোঙ্গায় আটকে আছি- এই দুশ্চিন্তা আমাকে স্থির হতে দিচ্ছে না। 

অবশেষে আমার পালা এলো। সব লিখে ফরম প্রিন্ট করে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে ফিরে এলাম চুঙ্গিওয়ালার দরবারে। কারণ তিনি আগেই বলে দিয়েছেন লাঞ্চ ব্রেকে যাবেন। নেপাল ভ্রমণ না-করতে পারায় আমার হৃদয় ভেঙে গেলে যাক, তার লাঞ্চ ব্রেক কিছুতেই মাটি করা যাবে না। আমি ফরম দিলাম। তিনি সেদিকে ফিরে তাকালেন না পর্যন্ত! খটাস শব্দ তুলে পাসপোর্টে সিল মারলেন। আমি প্লেন ল্যান্ড করার সেই হ্যাচকা টান অনুভব করলাম। ত্রিভুবন পেরিয়ে ছিটকে এসে দাঁড়ালাম এয়ারপোর্টের বাইরে। আমাকে দেখে অন্য দুজন তখনও মিটিমিটি হাসছেন। মুরুব্বি বললেন, কি রে, আগে হোটেলে যাবি, নাকি কিছু খেয়ে নিবি? আমি বললাম, আগে সিম কিনব। 

আমাদের আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল প্রথম দিন আমরা থামেলে কাটাব। সম্ভব হলে পায়ে হেঁটে আশেপাশের জায়গাগুলো ঘুরে দেখব। অর্থাৎ সেদিন বিশ্রাম নেয়াটাই মুখ্য। আমি আবার বরাবরই এ ব্যাপারে মূর্খ। বেড়াতে এসে বিশ্রাম? এসেছি যখন যতটুকু পারি দেখে নেব। কবে আবার আসা হবে ঠিক কি? মুরুব্বি বললেন, আমাদের সব কিছু ভালোভাবে দেখতে হলে আরো একদিন স্টে করতে হবে। তথাস্তু। আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আপত্তি তুললেন বিমান অফিসের কর্মকর্তা। কারণ ফেরার টিকিট তাহলে ক্যানসেল করতে হবে। গুনতে হবে জরিমানা। 

ওহে কাকে ভয় দেখাচ্ছ? অলরেডি দুবার ডেট চেঞ্জ করে জরিমানা গুনেছি, আমাকে ও ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। এসেছি ঘুরতে, ঘুরতে ঘুরতে ভাগ্য যেখানে নিয়ে যায় সেখানেই যাব। কিন্তু যাওয়ার উপায় নাই। এই প্রথম বিতৃষ্ণায় বিমানের ওপর থেকে মন উঠে গেল। ছাদে না হয় নাই যাওয়া গেল, বনেটের ওপর পশ্চাৎদ্দেশ গরম করে, দরজার পাশে রান্নাঘরের পিঁড়ির মতো সুপারভাইজারের ছোট্ট সিট দখলে নিয়ে, নিদেনপক্ষে রেলগাড়িতে ক্যান্টিনে মামারা যেমন মোড়া রাখে, হ্যান্ডশেক করার উসিলায় মুঠোর মধ্যে বিশ টাকা গুঁজে দিলে বসতে দেয়, সেরকম একটা ব্যবস্থা রাখা খুবই উচিত ছিল। 

কর্মকর্তা বললেন, ওই দিন বিমানে দুটো আসন ফাঁকা আছে। অর্থাৎ তিনজনের একসঙ্গে দেশে ফেরা হচ্ছে না।  
মুরুব্বি উঁহুহু... এ হয় না। এসেছি তিনজন, যাব তিনজন। তাহলে পরদিনের কী অবস্থা? কর্মকর্তা এবার একগাল হেসে বললেন, হ্যাঁ, সেদিন তিনটা সিট ম্যানেজ করা যাবে। বললাম, তবে তাই হোক। আমাদের পাঁচ দিনের ট্যুর এক ধাক্কায় গিয়ে ঠেকল সাতদিনে। সেভেন লাকি ডেইস।
হ্যাঁ, সৌভাগ্যই বলতে হবে। সুন্দরবন গেলেই যে আপনি বাঘের দেখা পাবেন এমন নয়। আমার এক সহকর্মী খুলনায় বড় হয়েছেন। বন নিয়ে আগ্রহ আছে। গিয়েছেন অসংখ্যবার। কিন্তু নিজ চোখে বাঘ দেখেননি। দেখেছেন বাঘের গু, পায়ের ছাপ। নেপালও তাই। গেলেই যে আপনি বরফশুভ্র হিমালয়ের পর্বতশৃঙ্গগুলো দেখতে পাবেন এমন নয়। তার জন্য সূর্যদেবকে দাঁত বের করে হাসতে হবে। মেঘের মন খারাপ থাকলে সর্বনাশ! আপনার ভ্রমণ মাটি করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। 

ওয়েদার সাতদিনই আমরা ভালো পেয়েছি। আর পেয়েছিলাম কুমারদাকে। মধ্যবয়সী ট্যাক্সি ড্রাইভার। অমাইক ভদ্রলোক! ঘুরে ঘুরে সব দেখিয়েছেন। যখন যেখানে থামতে বলেছি, বিরক্ত হননি। যা কিছু জানতে চেয়েছি সহাস্যে উত্তর দিয়েছেন। এমনকি কোন জিনিস কোথায় মুফতে মিলবে, খাবার ঠিকঠাক কোথায় পাওয়া যাবে আমাদের চিনিয়েছেন। যেতে যেতে পথেই তার কাছ থেকে জেনেছি নেপালের সংস্কৃতি। একদিন কুমারদাকে নিয়ে নাগরকোট যাচ্ছি সূর্যদয় দেখব বলে। হিমালয়ের কয়েকটি চূড়া নাগরকোট থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। কাঠমা-ু শহর থেকে এর উচ্চতা প্রায় ২ হাজার আটশ ফিট। পর্যটকরা ভোর রাতে এখানে এসে সূর্য ওঠার অপেক্ষা করেন। সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য! সূর্য উঠছে, ক্ষণে ক্ষণে রং বদলাচ্ছে প্রকৃতির। অপার্থিব সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়ছে শৃঙ্গচূড়ায়।   

ভোর হতে দেরি নেই। হাইওয়ে ফাঁকা। তারপরও কুমারদা এক্সেলেটরে চাপ দিচ্ছেন না। গাড়ির গতি সর্বোচ্চ ৪০ কিমি। এ দিকে আমি অধৈর্য সহিসের মতো নিজের পশ্চাৎদ্দেশে নিজেই চাবুক কষছি আর মনে মনে বলছি, কুমারদা গাড়ি হাঁকাচ্ছেন না কেন?
পেছনের সিটে সফিক রহমান তখনও ঘুমে ঢুলছেন। তাকে জোর করে ঘুম থেকে টেনে তুলে এনেছি। জামাকাপড় দিয়ে ভালো করে কান, গলা পেঁচিয়ে নিয়েছেন। তার ঠান্ডার ব্যামো আছে। মুরুব্বি যথারীতি চ্যাটে ব্যস্ত। তিনি যেখানেই যাচ্ছেন ছবি তুলছেন আর বিভিন্ন মোকামে সেন্ট করছেন। তাতে যে জিনিসটি হচ্ছেÑ ও মা! তুমি নেপালে কবে গেলে? আমার জন্য কিন্তু এটা আনতেই হবে। 

বোঝো ঠ্যালা! আমরা গিয়েই থামেলে উঠেছি। মুরুব্বি আমাদের তিনজনের জন্য একই রকম টি শার্ট কিনেছেন। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়। ছবি তুলে লোকজনের মাথা খারাপ করে দেওয়াÑ উস্কানিমূলক পোস্ট! এখন সেই ছবি দেখে দেশ থেকে একেকজন টি শার্টের সাইজ বলে দিচ্ছেন। মুরুব্বি এ ব্যাপারে ঝানু রাজনীতিক। কাউকেই হতাশ করছেন না। কিন্তু আমি পুরোপুরি হতাশ। গাড়ি জোরে চলছে না কেন? কুমারদাকে অভিযোগ করতেই বললেন, ‘হাজার রুপি ফাইন দেনা পারেগা। হাইওয়ে ক্যামেরা হে না ইহাপে।’  

নেপালে যে ক’দিন ছিলাম কাউকে ট্রাফিক আইন ভাঙতে দেখিনি। রাস্তা ভর্তি স্কুটি। ছেলে-মেয়ে-বুড়ো সবাই হাঁকাচ্ছে। থামেলে শুধু একদিন রিকশা দেখেছিলাম। দশ মিনিটের পথ একশ রুপি চাওয়ায় উঠিনি। এতে সে মাইন্ড করেছিল। আমিও মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম। আমরা হলাম রিকশার শহরের মানুষ। আমাদের রিকশাভাড়া শেখাতে এসো না হে- বলে দিয়েছি মুখের ওপর। (চলবে)  
 

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ