আইন সংশোধনের মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির সর্বনিম্ন বয়সসীমা নতুন করে নির্ধারণ করা হচ্ছে। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের (সক্রিয়) পরিচিতি ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ থাকলেও অন্য সবার ক্ষেত্রে পরিচয় হবে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’।

এই দুই শ্রেণিতে স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বয়স সাড়ে ১২ বছরের পরিবর্তে ১৩ বছর নির্ধারণ করা হচ্ছে। বাদ দেওয়া হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানের বিষয়টিও। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা পরিবর্তনের পাশাপাশি পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগী হিসেবে রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের ক্রমবিন্যাস পুনর্নির্ধারণ করা হচ্ছে।

এ লক্ষ্যে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন ২০২২ সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। জামুকা থেকে পাঠানো খসড়াটি অধ্যাদেশ আকারে প্রকাশের জন্য চলছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ের পর্যালোচনাসহ অন্যান্য প্রস্তুতি। শিগগিরই এটি উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন হওয়ার কথা। এর পর রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে অধ্যাদেশ জারি হবে।

খসড়ায় উল্লিখিত নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারীরাই হবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে বা প্রবাসে সংগঠকের ভূমিকা পালন করা, বিশ্ব জনমত গঠনে ভূমিকা রাখা ব্যক্তিরা, মুজিবনগর সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য সহকারী যারা মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন। 

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বীরপ্রতীক সমকালকে বলেন, ‘রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের আপত্তি রয়েছে, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি তাদেরকে একইভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে। তারা চান মুক্তিযোদ্ধা বলতে শুধু সরাসরি যারা যুদ্ধ করেছেন, তাদেরই বোঝানো হোক। এর বাইরে মুক্তিযুদ্ধে যারা ভূমিকা রেখেছেন, তারা অন্য পরিচয়ে পরিচিত হবেন। আমরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছি। এজন্য মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আলোচনার ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধার সর্বনিম্ন বয়সসীমাও পরিবর্তন করা হচ্ছে। এটি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।’ মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীদের ভাতা প্রসঙ্গে ফারুক ই আজম বলেন, ভাতা হিসেবে এখন যা আছে, তারা সেটাই পাবেন। শুধু স্বীকৃতির শ্রেণি পরিবর্তন হবে। এটাই এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত।

জামুকা আইন সংশোধন-সংক্রান্ত অধ্যাদেশের গেজেট প্রকাশের পর এর আওতায় বিধিমালা প্রণয়ন করা হবে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেটভুক্তি নিয়ে অনেক তুঘলকি ব্যাপার হয়েছে। জনমনে অনেক প্রশ্ন আছে। অথচ আইনটি কার্যকরে কখনও বিধিমালা করা হয়নি। এজন্য অধ্যাদেশ জারির পর বিধিমালাও প্রণয়ন করা হবে।

জামুকার ৯১তম সভায় গত ২ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা, বয়সসীমাসহ সংশ্লিষ্ট আইন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেটভুক্তি সংক্রান্ত নির্দেশিকা সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর আলোকে প্রণীত খসড়ায় বিদ্যমান আইনের উল্লিখিত দুই ডজনের বেশি বিষয়ে পরিবর্তন, সংযোজন বা প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে।

নতুন সংজ্ঞায় যা থাকছে

১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠনের সময় মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়। সংজ্ঞায় বলা হয়, ‘মুক্তিযোদ্ধা বলতে যে কোনো ব্যক্তি, যিনি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।’ কিন্তু ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর এক গেজেটের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞা করা হলে এর পরিধি বিস্তৃত হয়। ওই গেজেট অনুযায়ী ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন’ যুগোপযোগী করে জাতীয় সংসদে পাস করে তৎকালীন সরকার। সংজ্ঞায় বলা হয়, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে সকল ব্যক্তি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁরাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন।’ 

সংজ্ঞায় রণাঙ্গনের সশস্ত্র বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল, স্বাধীন বাংলা বেতার কর্মী, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রবাসে পেশাজীবী সংগঠক, ভারতে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেওয়া ব্যক্তি, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য, পাকিস্তান বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত নারী (বীরাঙ্গনা), মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসা প্রদানকারী চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্টদেরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এবার সেই সংজ্ঞা পরিবর্তন করে রণাঙ্গনে অংশগ্রহণকারী প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদেরই কেবল বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। অন্যদের মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এখানেও নতুন প্রশ্ন রয়েছে। নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী, দেশের অভ্যন্তরে গ্রামেগঞ্জে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে যারা যুদ্ধ করেছেন, তাদেরও বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ১১ উপধারা সংশোধনীতে পরিবর্তিত সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা অর্থ যাহারা ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ হইতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে গ্রামেগঞ্জে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করিয়াছেন এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হইয়া হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাহাদের এ দেশীয় সহযোগী রাজাকার, আল বদর, আল শামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামী ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছেন এইরূপ সকল বেসামরিক নাগরিক এবং সশস্ত্র বাহিনী, মুক্তি বাহিনী, বিএলএফ ও অন্যান্য স্বীকৃত বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, ইপিআর, নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স এবং আনসার সদস্য উক্ত সময়ে যাহাদের বয়স সরকার নির্ধারিত বয়সসীমার মধ্যে, তাহারা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হইবেন।’

মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা 

নতুন আইনে মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিস্থাপিত ১৩ নম্বর উপধারায় সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধ অর্থ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ হইতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় হানাদার ও পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাহাদের সহযোগী রাজাকার, আল বদর, আল শামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামী ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ।’ বিদ্যমান আইনের সংজ্ঞায় বলা রয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধ অর্থ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়া দখলদার ও হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগ এবং তাহাদের সহযোগী রাজাকার, আল বদর, আল শামস, মুজাহিদ বাহিনী ও পিস কমিটির বিরুদ্ধে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ হইতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধ।’ দুটি সংজ্ঞা পর্যালোচনায় দেখা যায়, খসড়ায় রাষ্ট্রের নাম ও মূলনীতি পরিবর্তনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর অবদান বাতিল এবং পাকিস্তান বাহিনীর দোসর হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগী বাহিনীগুলোর নাম আগে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধার বয়সসীমা

বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বনিম্ন বয়স ১২ বছর ৬ মাস। ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি এক পরিপত্রের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর যেসব মুক্তিযোদ্ধার বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ৬ মাস ছিল, তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে নতুন সংজ্ঞায় মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বনিম্ন বয়স ১৩ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বরের বদলে ২৬ মার্চ মুক্তিযোদ্ধার সর্বনিম্ন বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়। তবে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী ও তার দোসরদের দ্বারা নির্যাতিত নারী বা বীরাঙ্গনার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বয়সসীমা প্রযোজ্য হবে না বলে খসড়ায় বলা হয়েছে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে গেজেটভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ২ লাখ ৮ হাজার ৫০ জন। জীবিত ৯১ হাজার ৯৯৮ জন। খসড়া অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞা কার্যকর হলে এ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। সংজ্ঞার আলোকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই-বাছাই করা হবে বলেও একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

 
এদিকে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত? এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি শাখায় খোঁজ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ বলছেন এর সংখ্যা দেড় লাখের নিচে হতে পারে। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যেভাবে ডেটাবেজে লিপিবদ্ধ হয়েছে, তাতে রণাঙ্গনের সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়টি পৃথক করা সময়সাপেক্ষ। অধ্যাদেশ জারি হলে তখন নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

খসড়া অধ্যাদেশ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব সমকালকে বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর বীর মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ কতটুকু যুক্তিসঙ্গত, তা সময়ই নির্ধারণ করবে। রণাঙ্গনের নগণ্য অংশীদার হিসেবে আশা করব বৃদ্ধ বয়সে মুক্তিযোদ্ধারা যেন আর নতুন করে হয়রানি না হন। যদি হয়, তা হবে চরম দুর্ভাগ্যজনক।’ তাঁর মতে, মুক্তিযুদ্ধ জাতির ইতিহাসে মীমাংসিত সত্য, তাই এ বিষয়টি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টির অবকাশ নেই। বাংলাদেশ বহু দল-মতে বিভক্ত হয়ে এগিয়ে যাবে। মত ও মতের অমিলের যৌথ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে– এটাই প্রত্যাশা।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ম ক ত য দ ধ র সহয গ র ২৬ ম র চ সশস ত র ব কর ছ ন র জন য র পর য সরক র ব ষয়ট খসড় য় ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢাললেন ইয়াহিয়া

শুরু হলো অগ্নিঝরা মার্চ। মহান স্বাধীনতার মাস। ১৯৭১ সালের এ মাসে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ, অচিরেই যা জনযুদ্ধের রূপ লাভ করে। ওই বছরেরই ১৬ ডিসেম্বর সফল পরিণতিস্বরূপ জন্ম হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের। তাই ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিনটিকে বলা যায় আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ের সূচনার দিন।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সংঘটিত আন্দোলনকে বলা হয় আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রভাতকাল। 

১৯৫২ সালে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পেলেও তার সূচনা হয় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ হরতালের মাধ্যমে। অনেক লড়াই-সংগ্রামের পরিণতিতে মাত্র কয়েক মাস আগে–১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট–প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে সেটিই ছিল প্রথম হরতাল। ওই আন্দোলনেই এ ভূখণ্ডের বাঙালি মুসলমান তার জাতিগত পরিচয় সম্পর্কে সম্বিৎ ফিরে পায়, অনুভব করে ধর্মীয় সাজুয্য সত্ত্বেও পাকিস্তানের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী থেকে তারা প্রায় সব অর্থেই স্বতন্ত্র। বাঙালি হিন্দুর সঙ্গে যৌথ পথচলাও শুরু হয় তখন থেকে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে এ দেশের মানুষ মুখোমুখি হয় ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনের। 

যদি বলা হয় এ নির্বাচনই ছিল অগ্নিঝরা মার্চ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্বের ভিত্তি তাহলে ভুল হবে না। এই নির্বাচনটিই স্পষ্ট করে দেয় ছয় দফার ভিত্তিতে বাংলার মানুষ নিজের ভাগ্য নিজে গড়তে চায়। পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে সংলাপ বা লড়াইয়ে কে বা কোন দল প্রতিনিধিত্ব করবে তাও এতে নির্ধারিত হয়। ওই নির্বাচনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতার স্বীকৃতি দেয়। 
তৎকালীন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের অধীনে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানি শাসকদের হতবাক করে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টিতে জয় পায়। ৩০০ আসনের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মর্যাদা লাভ করে। সংখ্যলঘু দল হয় জুলফিকার আলি ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি–পিপিপি, যদিও তারা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল।

কথা ছিল, নির্বাচনে বিজয়ী দলের কাছে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন, সেই দল অন্যদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানের জন্য সংবিধান বানাবে। কিন্তু ইয়াহিয়ার পাশাপাশি পিপিপি সংসদের অধিবেশন নিয়ে টালবাহানা শুরু করে। 

বলে রাখা দরকার, নির্বাচনটি নিয়েও সরকার ও আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো নানা টালবাহানা করে। এটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর; কিন্তু আওয়ামী লীগের বিরোধিতা উপেক্ষা করে বন্যার উছিলা দিয়ে ইয়াহিয়া তাঁর নতুন তারিখ ৭ ডিসেম্বর ঠিক করেন। ডিসেম্বরে ভোলায় প্রলঙ্করী এক ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রচুর হতাহতের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার আবারও নির্বাচনটি পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু শেখ মুজিবের কড়া হুঁশিয়ারির পর সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়, শুধু সিদ্ধান্ত হয় দুর্গত এলাকার ভোট হবে জানুয়ারিতে।
সুতরাং জাতীয় পরিষদের অধিবেশন নিয়ে সরকার তথা পশ্চিম পাকিস্তানের এস্টাবলিশমেন্টের গড়িমসি বিচিত্র কিছু ছিল না। শেখ মুজিব ১৫ ফেব্রুয়ারি পরিষদের প্রথম অধিবেশন চেয়েছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া জানালেন, দুই অঞ্চলের নেতাদের মধ্যে শাসনতন্ত্রের মৌলিক ধারা নিয়ে সমঝোতা না হলে তিনি অধিবেশন ডাকবেন না। শেখ মুজিব বলে দিলেন, সংসদের সভাতেই দুই অঞ্চলের সদস্যরা ওই আলোচনার সুযোগ পাবেন। ভুট্টো জানালেন, মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের আগে তাঁর দলের পক্ষে সংসদ অধিবেশনে উপস্থিত থাকা সম্ভব নয়। ইয়াহিয়া এ প্রস্তাব গ্রহণ করে ৩ মার্চ সংসদের প্রথম অধিবেশনের তারিখ ঘোষণা করলেন।

কিন্তু ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চের গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন। তাঁর যুক্তি, পিপিপি ও অন্য কয়েকটি দল এতে যোগদান করবে না বলায় তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ ঘোষণায় পুরো ঢাকা প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান বনাম বিশ্ব একাদশের ক্রিকেট খেলা চলছিল। সেখানকার দর্শকরাও খেলা পণ্ড করে যোগ দেন পল্টন-গুলিস্তানে বিক্ষোভরত হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে। সেদিন দিলকুশার পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক ছিল। জনতা সেখানে গিয়ে জোরদার কর্মসূচি দাবি করেন। পূর্বাণী হোটেলেই শেখ মুজিব দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে ২ ও ৩ মার্চ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেন। তিনি জানিয়ে দেন, ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভা হবে, যেখানে মূল ঘোষণা দেবেন।

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ধামাইয়ে পাকিস্তানি ঘাঁটিতে আক্রমণ
  • অগ্নিঝরা মার্চ শুরু
  • ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢাললেন ইয়াহিয়া