মূল্যস্ফীতির মধ্যে শুল্ক-কর বৃদ্ধিতে জনরোষের বার্তা
Published: 23rd, January 2025 GMT
এমনিতেই মূল্যস্ফীতির গতি বলগাহীন। নিত্যপণ্যের দামের চাপে গজগজ করছে মানুষ। এর মধ্যে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর বাড়তি শুল্ক-কর বসিয়ে সরকার যেন ‘আগুনে ঘি ঢেলেছে’। এ সিদ্ধান্তে পণ্যের দরে প্রভাব পড়বে না বলে অর্থ উপদেষ্টা বারবার নির্ভয় দিলেও দামের ঘোড়া ঠিকই ছুটছে। শুল্ক-কর বাড়ানোর এ সিদ্ধান্তের ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে খোদ সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থাও জানিয়েছে, এর ফলে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দিতে পারে অসন্তোষ। এই জনরোষ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল সরকারবিরোধী আন্দোলনের পথে হাঁটতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ প্রতিবেদনটি সম্প্রতি কয়েকজন উপদেষ্টার দপ্তরে পাঠানো হয়। নানামুখী সমালোচনা ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন আমলে নিয়ে গতকাল বুধবার ওষুধ, মোবাইল ফোন ও আইএসপি সেবা, রেস্তোরাঁ, নিজস্ব ব্র্যান্ডের পোশাকসহ কয়েক ক্ষেত্রে শুল্ক-কর পুনর্বিবেচনা করেছে সরকার। গত ৯ জানুয়ারি রাতে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫ এবং দি এক্সাইজ অ্যান্ড সল্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫ জারি করে এ শুল্ক-কর বাড়ায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর পর থেকেই সরকারের এ হঠকারী সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আসছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ ব্যাপারে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড.
গত শনিবার ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘শ্বেতপত্র ও অতঃপর: অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, সংস্কার ও জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক এক সিম্পোজিয়ামে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা বিস্মিত, কীভাবে অবিবেচনাপ্রসূত শুল্ক-কর বাড়ানো হলো। কোনো দেশে সরকার যদি কার্যকর কর আদায় করতে চায় তাহলে তাকে ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ করের দিকে নজর দিতে হবে। তবে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের কোনো পরিকল্পনা দেখছি না।’
গত শনিবার গুলশানের বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে শুল্ক-কর বাড়িয়ে নয়, বরং খরচ কমিয়ে, বিকল্প উপায়ে রাজস্ব বাড়াতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, কর বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানোর মতো সহজ রাস্তায় হেঁটে সরকার দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে তুলবে। তিনি জনগণের ওপর পরোক্ষ কর আরোপের মতো অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। এর আগে ব্যবসায়ীরাও এ সিদ্ধান্তের প্রত্যাহার চেয়েছিলেন।
ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রত্যক্ষ কর হিসেবে ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক সরাসরি করদাতার ওপর আরোপিত না হয়ে পণ্য ও সেবার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে জনগণের ওপর প্রভাব ফেলে। এসব করের খরচ মূলত জনগণের ওপর স্থানান্তরিত হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তৈরি পোশাক, মোবাইল ফোনে কথা বলা, ইন্টারনেট, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্তোরাঁ, মিষ্টি, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, এলপি গ্যাস, গুঁড়া দুধ, বিস্কুট, সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডার, হোটেল সেবাসহ শতাধিক পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট থেকে ১৫ শতাংশ এবং সম্পূরক শুল্ক ১০০ শতাংশ পর্যন্ত করা হয়। ফলে এসব পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব পড়তে পারে। প্রতিবেদন গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাসভিত্তিক সার্বিক মূল্যস্ফীতির তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, এ সময় সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। একই সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ। গত জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল।
শুল্ক-কর বাড়ানোর সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপট
প্রতিবেদনে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো, এসডিজি বাস্তবায়ন এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতার লক্ষ্যে করের আওতা বাড়ানো ও হার যৌক্তিক করতে বর্তমান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। গেল ডিসেম্বরে ঢাকা সফররত আইএমএফ প্রতিনিধি দল এনবিআরের শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর খাতের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে আইএমএফ কর অব্যাহতি সুবিধা কমিয়ে রাজস্ব বাড়ানোর জন্য চাপ দেয়। একই সঙ্গে কর-জিডিপি অনুপাত আগের শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আরও শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত দেওয়া হয়। টাকার অঙ্কে যা ১২ হাজার কোটির বেশি।
অর্থাৎ এ অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার সঙ্গে বাড়তি ১২ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে। এই শর্ত পূরণেই কর বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। গত চার মাসে বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ বাড়াতে এবং দর স্থিতিশীল রাখতে সাত পণ্যে (চাল, আলু, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, চিনি, ডিম ও খেজুর) আমদানি, স্থানীয় ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে শুল্ক-কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। ফলে বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায় কমেছে। অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা হলেও গত নভেম্বর পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে মাত্র ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। এই রাজস্ব ঘাটতি মেটাতেই কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাড়তি শুল্ক-কর বাড়াবে ঝুঁকি
প্রতিবেদনে মাঝারি ও উচ্চ– এ দুই ধরনের ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। মাঝারি ঝুঁকি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে– অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করের ছুতা তুলে পণ্য ও সেবার দাম বাড়িয়ে বাজারকে অস্থিতিশীল করতে পারে। উচ্চ ঝুঁকিটি হলো– সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। এই জনরোষকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল সরকারবিরোধী আন্দোলনের সুযোগ নিতে পারে।
ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে গোয়েন্দা সংস্থাটি প্রতিবেদনে তিনটি সুপারিশ তুলে ধরে। তা হলো বহুল ব্যবহৃত পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে সহনীয় মাত্রায় শুল্ক আরোপ; রাজস্ব বাড়াতে সফটওয়্যারভিত্তিক অটোমেশন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ভ্যাটের আওতাযোগ্য সব প্রতিষ্ঠান থেকে কর আদায় এবং আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মত নিয়ে সাধারণ মানুষের আর্থিক সক্ষমতা মূল্যায়ন করে তা বাস্তবায়ন।
এদিকে শুল্ক-কর বাড়ানোর পর থেকেই সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় এর প্রভাব পড়বে না বলে দাবি করে আসছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তবে গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাওয়ার পর কিছু কিছু পণ্যে শুল্ক-কর কমানোর বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান, অর্থ সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। সেই বৈঠকের সিদ্ধান্তের আলোকে গতকাল কয়েকটি পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর পুনর্বিবেচনা করেছে এনবিআর।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: শ ল ক কর ব ড় ন কর ব ড় ন র ক ষ কর দশম ক ব যবস র ওপর সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেনি, কোনো সম্ভাবনাও নেই: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেনি, কোনো সম্ভাবনাও নেই বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.)। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দেশে কোনো ধরনের জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেনি এবং এ ধরনের কোনো সম্ভাবনাও নেই।
আজ বুধবার দুপুরে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় ও ঈদ পুনর্মিলনীর উদ্দেশ্যে রাজধানীর ছয়টি থানা (খিলক্ষেত, ভাটারা, বাড্ডা, রামপুরা, হাতিরঝিল ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল) পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। পরে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা জানান তিনি।
জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, বর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক, যা আরও উন্নতির অবকাশ রয়েছে। এটাকে আস্তে আস্তে আরও ভালোর দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, রাজধানীর বেশ কয়েকটি থানা ভাড়া ভবনে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন জনগণের সমস্যা হচ্ছে, অন্যদিকে থানাগুলোও কাঙ্ক্ষিত মানের সেবা দিতে পারছে না।
তিনি বলেন, আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব থানাগুলোকে নিজস্ব জায়গায় ভবন নির্মাণপূর্বক স্থানান্তরের চেষ্টা করছি। ভালো জায়গায় থানা হলে জনগণের যেমন সুবিধা হবে, তেমনি থানাগুলো আরও সক্রিয় হবে ও কার্যক্রম চালাতে সুবিধা হবে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেন, সবাই কিন্তু ছুটিতে আছে। একমাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছুটিতে নেই। জনগণের জানমাল রক্ষাসহ সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে তারা নিরলস দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সাধারণ জনগণ যাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সজাগ ও সক্রিয় রয়েছে।
এ সময় উপদেষ্টা আরও জানান, কোনো নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষ যাতে হয়রানির শিকার না হয় সেজন্য পুলিশকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এটাও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যেন কোনো সন্ত্রাসী ও অপরাধী ছাড় না পায়। যারা দুষ্কৃতকারী তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।