শ্রমিক অসন্তোষে গতকাল বুধবার ফের অশান্ত হয়ে ওঠে গাজীপুর ও সাভারের আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে দফায় দফায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালায় বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের কর্মহীন কয়েক হাজার বিক্ষুব্ধ শ্রমিক। লাঠিসোটা নিয়ে মহাসড়কে থাকা শতাধিক যানবাহনে গণভাঙচুর চালানো হয়। আগুন দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি গাড়িতে। খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হন তিন সংবাদকর্মী। মালভর্তি ট্রাক ও যাত্রীবাহী বাসও আগুন থেকে রক্ষা পায়নি। এতে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।  

এক পর্যায়ে শ্রমিকরা গাজীপুরের তেঁতুলবাড়ি এলাকায় গ্রামীণ ফেব্রিক্স অ্যান্ড ফ্যাশন লিমিটেডের কারখানার গেট ভেঙে ভেতরে ঢোকে। পরে ওই কারখানায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। 

এদিকে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সময় মহাসড়কের উভয় পাশে বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। দুর্ভোগে পড়েন ঘরমুখী হাজারো মানুষ। 

এর আগে গাজীপুরের সারাব এলাকায় বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১৬ কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে গতকাল বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। বিকেলে চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা। এ সময় হাজারো শ্রমিক মহাসড়কে শুয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। আন্দোলনকারী শ্রমিকদের দাবি, বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের সব কারখানা খুলে দেওয়া, ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু, এলসি খুলে দেওয়া এবং অন্যান্য বকেয়া পরিশোধ করতে হবে। একই দাবিতে মঙ্গলবার দুপুরে শ্রীপুর এলাকার সানসিটি মাঠে বেক্সিমকোর ৪২ হাজার শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সমাবেশ করেছেন। বুধবার ৩টার মধ্যে কারখানা খুলে দেওয়ার আলটিমেটাম দিয়েছিলেন তারা। অন্যথায় ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

শ্রম সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান সমকালকে বলেন, শ্রমিকদের শান্ত থাকার অনুরোধ করা হয়েছে। সরকার চেষ্টা করছে কারখানাগুলো বিক্রি করে নতুন মালিকানায় কত দ্রুত খুলে দেওয়া যায়। এ নিয়ে ৫টি বৈঠকও হয়েছে। আগামী সপ্তাহে আবারও বৈঠক আছে। সরকারের চেষ্টা এবং আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। ৫ মাস ধরে শ্রমিকদের বেতন দিয়ে আসছে সরকার। এর মধ্যে কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। কারখানাগুলোর মালিক নেই এখন। অথচ এক জনতা ব্যাংকের কাছেই ২৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ। 

সচিব বলেন, আন্দোলনরত শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। শ্রমিকদের শান্ত থাকার অনুরোধ করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার আবারও তাদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। তবে মূল সমস্যা হচ্ছে, শ্রমিকদের মধ্যে ষড়যন্ত্রকারী ঢুকে পড়েছে। এ কারণে কারখানা খুলে দেওয়ার প্রচেষ্টার মধ্যেই অযৌক্তিক আন্দোলন হচ্ছে।

রাত ৮টার দিকে গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মো.

আবু তালেব সমকালকে বলেন, ‘আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছি। এখন যান চলাচল স্বাভাবিক আছে। শ্রমিকরা বেশ কিছু যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছেন। ঘটনাস্থলে বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন আছে।’ 

কাশিমপুর থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, শ্রমিকদের একটি পক্ষ চন্দ্রা-নবীনগর সড়ক অবরোধ করে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। এক পর্যায়ে তারা সড়কে যানবাহন ভাঙচুর শুরু করে। এ সময় কিছু দুষ্কৃতকারী একটি ট্রাক ও তিনটি বাসে অগ্নিসংযোগ করে। 

প্রত্যক্ষদর্শী ও শ্রমিকরা জানান, বেক্সিমকোর ১৬ কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে গতকাল চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়কের চক্রবর্তী মোজার মিল এলাকায় জড়ো হন অন্তত ১৫ হাজার শ্রমিক। এক পর্যায়ে তারা যান চলাচল বন্ধ করে দেন। আগুন ধরিয়ে দেন যাত্রীবাহী অন্তত চারটি বাসে। লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন গাড়িতে ভাঙচুর চালাতে শুরু করেন। অন্তত ১০০ গাড়ি তারা ভাঙচুর করেছেন। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল বিকেল ৩টায় সব শ্রমিক একজোট হয়ে রাস্তায় নামেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন স্থানীয় বাড়িওয়ালা ও দোকানি-কর্মচারী। 

শ্রমিক আরজু মিয়া বলেন, ‘পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আমরা আর বাঁচতে পারছি না। দীর্ঘদিন এখানে চাকরি করছি। এখন কর্মহীন। কারখানা খুলে দেওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো।’ শ্রমিক রহিমা খাতুন বলেন, ‘আশেপাশের সব কারখানা চলতে পারলে আমাদেরটা বন্ধ হবে কেন? আমাদের চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক, না হয় খুলে দেওয়া হোক আমাদের প্রিয় কর্মস্থল।’ 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অবরোধের সময় গণমাধ্যম কর্মীরা খবর সংগ্রহ করতে গেলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা দীপ্ত টিভির গাজীপুর প্রতিনিধি মো. জাহাঙ্গীর আলমকে মারধর করেন। শ্রমিকরা জাহাঙ্গীরের ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি ভাঙচুর করে। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা অন্য সহকর্মী বাংলাভিশনের ক্যামেরাম্যান আমির হোসেন রিয়েল ও প্রতিদিনের বাংলাদেশের কালিয়াকৈর প্রতিনিধি আবু সাইদকেও মারধর করা হয়। 

জানা যায়, চক্রবর্তী এলাকায় প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ফেব্রিক্স অ্যান্ড ফ্যাশন নামে একটি শিল্পকারখানায় প্রথমে শ্রমিকরা ভাঙচুর চালায়। পরে তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। গ্রামীণ ফ্যাশনের জেনারেল ম্যানেজার তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘কারখানার বাইরে শ্রমিক বিক্ষোভের কথা শুনে ৪টার আগেই আমাদের প্রতিষ্ঠান ছুটি দেওয়া হয়। সোয়া ৫টার দিকে গেট ভেঙে শত শত বিক্ষুব্ধ লোকজন কারখানায় ঢুকে পড়ে। নিচতলায় আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।’ গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের জোনপ্রধান মো. মামুনুর রশিদ বলেন, ‘আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।’

ঘটনাস্থলে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আসতে কিছুটা দেরি হওয়ায় পুলিশ জলকামানের পানি ছিটিয়ি গ্রামীণ ফ্যাশনের আগুন নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করে।’ 

সন্ধ্যায় ওই প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা যায়, পুড়ে সব কাপড় ও মেশিনপত্র ছাই হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ না থাকায় অন্ধকারের মধ্যে আগুন নেভানোর চেষ্টা চলছে। 

বেক্সিমকো কারখানার শ্রমিকদের অন্দোলনে উত্তাল ছিল আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলও। গতকাল বিকেলে শ্রমিকরা নবীনগর-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চক্রবর্তী ও আশপাশের এলাকায় অবরোধ শুরু করেন। এ সময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা মহাসড়কে দুটি বাসসহ কয়েকটি ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয়। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এতে মহাসড়কের দুই পাশে শত শত যানবাহন আটকা পড়লে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।  

শ্রমিক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দাবি মেনে নেওয়া না হলে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।’ ডিইপিজেড ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার প্রণব চৌধুরী জানান, মহাসড়কে বাস ও ট্রাকে আগুন লাগানোর খবর পাওয়ার পর দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছি। পরিবহন শ্রমিক আব্দুল খালেক জানান, শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায়ে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে মহাসড়ক বেছে নেয়। তারা যানবাহন ভাঙচুর করে, আগুন দেয়। এতে পরিবহন শ্রমিক ও মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। 

গত ১৫ ডিসেম্বর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সভার পর বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১৬ কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। বন্ধের কারণ হিসেবে সরকার জানায়, কারখানাগুলোতে ক্রয়াদেশ না থাকা ও ব্যাংকে ঋণখেলাপি থাকায় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা যাচ্ছে না। 

আন্দোলনে যোগ না দেওয়ায় হামলা 

বিক্ষোভে যোগ না দেওয়ায় গতকাল সকালে গাজীপুরের কালিয়াকৈরের কামরাঙ্গীরচলা এলাকার ল্যাভেন্ডার গার্মেন্টে হামলা-ভাঙচুর হয়েছে। এ সময় দু’জন আহত হন। 

এটিএস অ্যাপারেলস কারখানার শ্রমিকরা সড়কে নিরাপত্তার দাবিতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক আধা ঘণ্টা আটকে বিক্ষোভ করেন। এ সময় এটিএস অ্যাপারেলস কারখানার আশপাশের কারখানার শ্রমিকদের আন্দোলনে অংশ নিতে আহ্বান জানানো হয়।  ল্যাভেন্ডারের শ্রমিকরা আন্দোলনে যেতে অনীহা দেখান। পরে শ্রমিকরা ক্ষিপ্ত হয়ে ল্যাভেন্ডারের প্রধান গেট ভেঙে ভেতের ঢুকে পড়ে। নিরাপত্তাকর্মী ও কারখানা কর্তৃপক্ষ বাধা দিলে উত্তেজিত শ্রমিকরা  দু’জনকে পিটিয়ে আহত করে। পরে শ্রমিকরা কারখানায় হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করে। এ ঘটনার পর ওই কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী, শিল্প পুলিশ ও থানা পুলিশ গিয়ে হামলাকারীদের ধাওয়া দিলে তারা সরে যায়। 

ল্যাভেন্ডার গার্মেন্টস লিমিটেড কারখানার নিরাপত্তা বিভাগের সুপারভাইজার মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, মঙ্গলবার বহিরাগত শ্রমিকরা প্রথমে প্রধান ফটকের কাউন্টারে হামলা করে। তাদের বাধা দিলে গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে কারখানায় ভাঙচুর করে। 

কারখানার মানবসম্পদ ও প্রশাসন (এইচআর অ্যান্ড অ্যাডমিন) বিভাগের ব্যবস্থাপক আখতারুজ্জামান বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, ৩ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। 

ল্যাভেন্ডার গার্মেন্টসের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) সৈয়দ আবু জাফর জানান, বহিরাগত কয়েকশ শ্রমিক আমাদের কারখানায় এসে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গতক ল ব ব যবস থ এল ক য় র ধ কর এ সময় অবর ধ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

চ্যাম্পিয়ন্স লিগ প্লে অফে রিয়াল-ম্যানসিটি মুখোমুখি 

চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রিয়াল মাদ্রিদ ও ম্যানচেস্টার সিটির খারাপ সময় যেন শেষই হচ্ছে না। নতুন ফরম্যাটের গ্রুপ পর্বে খারাপ সময় পার করেছে দু’দলই। ম্যানসিটি গ্রুপের শেষ ম্যাচে জিতে প্লে অফ নিশ্চিত করেছে। 

রিয়াল মাদ্রিদের প্লে অফে উঠতে খুব বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। তবে সেরা আটে থেকে সরাসরি শেষ ষোলো নিশ্চিত করতে পারেনি কার্লো আনচেলত্তির দল। 

সেরা আটে থাকতে না পারার শাস্তিই যেন পেয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। সেরা ষোলোয় যাওয়ার লড়াইয়ে প্লে অফ খেলতে হবে রিয়ালের। ওই লড়াইয়ে ম্যানচেস্টার সিটিকে পেয়েছে লস ব্লাঙ্কোসরা। 

আগামী ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের প্লে অফের প্রথম লেগ মাঠে গড়াবে। ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি মাঠে গড়াবে প্লে অফের দ্বিতীয় লেগ। শেষ ষোলোর লড়াই ৪ ও ৫ মার্চ এবং ১১ ও ১২ মার্চ মাঠে গড়াবে। 

কোয়ার্টার ফাইনাল হবে ৮ ও ৯ এপ্রিল এবং দ্বিতীয় লেগ হবে ১৫ ও ১৬ এপ্রিল। এছাড়া ২৯ ও ৩০ এপ্রিল সেমিফাইনালের প্রথম লেগ এবং ৬ ও ৭ মে দ্বিতীয় লেগ মাঠে গড়াবে। ৩১ মে হবে ফাইনাল। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ