সুন্দরবনের খালে অবাধে পারশে পোনা নিধন
Published: 21st, January 2025 GMT
সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে অবৈধভাবে প্রবেশ করে একটি চক্র পারশে মাছের পোনা নিধন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ চক্রের সঙ্গে বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কমিউনিটি প্যাট্রলিং গ্রুপের (সিপিজি) একজন প্রভাবশালী সদস্য জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা টাকার বিনিময়ে সুন্দরবন থেকে পারশে মাছের পোনা আহরণ ও পরিবহনের সুযোগ করে দিচ্ছেন বলে জেলেরা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, একটি পারশে পোনা আহরণের বিপরীতে কমপক্ষে ১১৯ প্রজাতির চিংড়ি, ৩১২ প্রাণী কণা ও ৩১টি অন্য প্রজাতির মাছের পোনা ধ্বংস হয়। প্রতিষ্ঠানটি পাইকগাছা নোনাপানি গবেষণা কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত। পোনা শিকারে জড়িত কয়েকজন জেলের ভাষ্য, জানুয়ারি মাসের শুরু থেকে সুন্দরবন-সংলগ্ন কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলার ব্যবসায়ীরা বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পারশের পোনা শিকারে গেছেন।
সিপিজির একজন সদস্যের মধ্যস্থতায় বন বিভাগ থেকে সাদা মাছ পরিবহনের জন্য ট্রলারের অনুমতি নিয়ে পারশের পোনা শিকার করছেন জেলেরা। তাদের এ কাজে সহযোগিতার জন্য মিলন হোসেন নামে বন বিভাগের একজন ফরেস্ট গার্ড (এফজি) মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেন বলে জানা গেছে। একাধিক জেলে জানিয়েছেন, তাঁর মাধ্যমে সবকিছু ম্যানেজ করা হয়।
অবশ্য ফরেস্ট গার্ড মিলন হোসেন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি কখনোই কোনো অবৈধ কাজে জড়িত নই। অনেকে আমার নাম ব্যবহার করে সুবিধা নিতে চায়। বিষয়টি আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানিয়েছি।’
অন্তত ২০ জেলের সঙ্গে কথা বলে পারশের পোনা ধরতে ট্রলার নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করা কয়েকজনের নাম জানা গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন– কয়রার ২ নম্বর কয়রা এলাকার তাজমিনুর রহমান, ৬ নম্বর কয়রা গ্রামের আল আমিন, ঝিলেঘাটা বাজার এলাকার আজিজুল ওরফে ছাতি আজিজুল, জাহিদুল ইসলাম, ৪ নম্বর কয়রা গ্রামের হাবিবুল্লাহ, পাইকগাছার গড়াইখালী গ্রামের ফারুক গাজী ও বাবু এবং দাকোপ উপজেলার নলিয়ান এলাকার জহির উদ্দীন।
পারশে পোনা নিধনের অভিযোগ ওঠা দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাজমিনুর রহমানকে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘কোস্টগার্ড সদস্যদের হাতে দুই ট্রলার ধরা পড়ায় হাত-পা গুটিয়ে বসে আছি। ট্রলার ছাড়াতে পারলে ফের পোনা ধরতে সুন্দরবনে যাব।’
এসব ব্যবসায়ী দ্রুতগামী ট্রলার নিয়ে সুন্দরবনের অভয়ারণ্য এলাকার খালে প্রবেশ করেছেন বলে একাধিক সূত্রে তথ্য মিলেছে। জানা গেছে, পারশের পোনা নিধনকারীরা সুন্দরবনের দুবলারচর, আলোর কোল, বঙ্গবন্ধুর চর, বাটলুরচর, নারিকেলবাড়িয়া, টিয়েরচর, পশুর, আগুনজ্বলা ও মজ্জত নদীতে অবস্থান করেন। প্রতিটি ট্রলারে আট থেকে ১০ জন জেলে, ২০০-৩০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৪০-৫০ মিটার প্রস্থের মনোফিলামেন্ট জাল থাকে। এ জাল একবার টানলে দুই থেকে তিন মণ পারশে পোনা পাওয়া যায়। দু’দিন পরপর এসব ট্রলার পোনা নিয়ে লোকালয়ে ফেরে।
সুন্দরবনে কোনো অভিযান পরিচালনার আগেই মধ্যস্থতাকারী দুই সদস্য জেলেদের জানিয়ে দেন। সতর্ক সংকেত পেয়ে তারা বনের মধ্যে পালিয়ে থাকেন। অভিযান শেষ হলে ফের তারা পোনা ধরতে শুরু করেন। পারশের পোনা নিধনে জেলেরা নিষিদ্ধ মনোফিলামেন্ট বা মশারি জাল ব্যবহার করায় শতাধিক প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের পোনা নষ্ট হচ্ছে। পোনা পরিবহনে দ্রুতগামী ট্রলার ব্যবহার করায় অভয়ারণ্য এলাকায়ও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।
কয়রা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সমীর কুমার বলেন, মনোফিলামেন্ট জাল ব্যবহার করে পারশে পোনা ধরতে গিয়ে অন্য প্রজাতির কোটি কোটি পোনা ধ্বংস করছেন জেলেরা। এতে সুন্দরবন এলাকায় আশঙ্কাজনকহারে মাছের উৎপাদন কমছে।
যোগদানের পর এসব ট্রলার বন্ধ করে দিয়েছেন বলে দাবি সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাসানুর রহমানের। তিনি বলেন, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে কোথাও পারশে পোনা ধরতে দেওয়া হয় না। পশ্চিম সুন্দরবনে ট্রলার প্রবেশের অনুমতি নেই। কেউ আইন অমান্য করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ন দরবন র এল ক র সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
হাতে ভাজা মুড়ি, শাশুড়ির পেশাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অর্চনা
হাঁটতে হাঁটতে তিতাস নদীর পাড় পর্যন্ত যেতেই কানে এলো মুড়ি ভাজার শব্দ। কয়েকজন নারী মুড়ি ভাজছেন। পুরাতন পদ্ধতিতে গরম বালুর সঙ্গে খোলায় ভাজা চালের স্পর্শে হাড়িতে মট-মট শব্দে ফুটে তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু মুড়ি।
এখানে হাতে ভাজা মুড়ির মূল কারিগর অর্চনা দাস (৫৫)।
অর্চনা দাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরশহরের পাইকপাড়া পাটগুদাম রোড দাস পাড়ার ঝান্টু দাসের স্ত্রী। ঝান্টু দাস পেশায় একজন মাছ ব্যবসায়ি। অর্চনা দাসের চার মেয়ে ও একজন ছেলে। চার মেয়েকেই দিয়েছেন বিয়ে এবং ছেলে এই বছর বিবিএ শেষ করেছে।
অর্চনা দাসের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই শাশুড়ি তরঙ্গ বালা দাস হাতে ভাজা মুড়ি ভাজতেন। শাশুড়ি আমাকে খুব ভালোবাসতেন। শাশুড়ির কাছাকাছি থাকতে থাকতে আমিও মুড়ি ভাজা শিখে ফেলেছি। শাশুড়ি ২০১৯ সালে মারা গেলে ছেলেমেয়েরা মুড়ি ভাজতে নিষেধ করেছিল কিন্তু শাশুড়ির ৫০ বছরের পেশাটাকে বাঁচিয়ে রাখতেই মুড়ি ভাজার দায়িত্বটা আমি কাঁধে নেই।”
মুড়ি ভাজতে উপকরণ হিসেবে তিনি বলেন, “হাতে ভাজা মুড়ি ভাজতে দেশি চাউল দিয়েও হয় তবে রমজান আসলে মুড়িগুলো সুন্দর করতে ‘শান্তি সিলভার’ নামে এক কোম্পানির চাউল আছে, সেটা ব্যবহার করি। আমি চালগুলো লবণ পানি দিয়ে মেখে দেই। আমার ভাইয়ের মেয়ে সুলেখা দাস লবণ পানি দেওয়া চালগুলো তাওয়াতে ৪-৫ মিনিট গরম করে। তারপর আমার ভাসুরের ছেলের বউ বন্দনা দাস গরম বালুতে সেই চাউলগুলো ঢেলে চিকন কাঠি দিয়ে হাতে নাড়া দিলেই হয়ে যাচ্ছে হাতে ভাজা মুড়ি।”
অর্চনা দাস বলেন, “আমার শাশুড়ির বাড়িতে এসে আমি দেখেছি ১৯৯০ সালে এক কেজি মুড়ি ২৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতেন। এখন মুড়ি বিক্রি করি ১২০ টাকা দরে।”
দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “এক বস্তা চালের দাম ৩৪০০ টাকা, লবণ লাগে ৩০ টাকা, রিকশাভাড়া ৩০ টাকা, ভাজা খরচ ১৪০ টাকা। এক বস্তা চাউলে ৩৮ কেজি মুড়ি হয়। রমজান মাসে এক দিনে ৬০ কেজি মুড়ি বিক্রি করতে পারি। রমজান মাস ছাড়া ২৫ কেজি বিক্রি হয়।”
পাইকার ব্যবসায়িরা এক কেজি মুড়ি ৯৫ টাকা ধরে কিনে নিয়ে যায় পাইকাররা কেজি প্রতি ১২০ টাকা বিক্রি করেন।
প্রতিবেশি নিদু দাস বলেন, “আমরা ২০ বছর ধরে হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রি করতাম। বর্তমানে শ্রমিক সংকটের কারণে পেশাটাকে ছেড়ে দিয়েছি। আমাদের যা কাস্টমার ছিল এখন অর্চনা থেকে মুড়ি নিয়ে যায়। কেমিকেল মুক্ত হওয়ায় অনেকেই আসে মুড়ি নিতে। রমজান মাসে চাহিদা বেশি থাকে। আগে এখানে ১০টা পরিবারের মতো হাতে ভাজা মুড়ি তৈরি করতেন কিন্তু বর্তমানে লোকবল সংকটের কারণে এই পেশা থেকে মানুষ দূরে চলে গেছে।”
মুড়ি ক্রেতা ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি জাবেদ রহিম বিজন বলেন, “আমি ১০ বছর ধরে তাদের বাড়ি থেকে মুড়ি কিনি। সুস্বাদু ও কেমিকেল মুক্ত হওয়ায় আমার পরিবারের পছন্দ এই মুড়ি। দুই কেজি মুড়ি ২৪০ টাকা দিয়ে কিনেছি।”
কুমারশিল মোড়ের নিউ স্টোরের সত্ত্বাধিকারী হৃদয় রায় বলেন, “পাইকপাড়া থেকে হাতে ভাজা মুড়ি আমরা কিনে রাখি। হাতে ভাজা মুড়ি পুরাতন কাস্টমার যারা আছে তারা কিনে নিয়ে যায়। ক্যামিকেল মুক্ত হওয়ায় অনেকেই নিয়ে যায়।”
ঢাকা/টিপু