মিয়ানমারের আরাকান তথা রাখাইন অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এবং আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ চলমান। বিষয়টি সারা বিশ্ব জানে। সন্নিহিত অঞ্চল হিসেবে আমরাই বেশি করে জানি। কারণ রাখাইনে দু’পক্ষের সংঘাতে আমরাই বেশি ভুক্তভোগী। সেখানকার সংঘর্ষের জেরে কখনও কখনও উড়ে আসা মর্টার শেল, গোলাগুলি আমাদের ভূমিতে এসে পড়ছে। তাদের যুদ্ধবিমান বা হেলিকপ্টার আমাদের আকাশসীমায় সময়ে সময়ে ভুল করে বা ইচ্ছাকৃতভাবে প্রবেশ করেছে। মিয়ানমারের পরাস্ত বর্ডার গার্ড পুলিশ আশ্রয়ের জন্য দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, এও আমাদের সবার জানা। এখন বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার তথা রাখাইনের যে সীমান্ত এর পুরোটাই আরাকান আর্মির দখলে। 

এসব জানা সত্ত্বেও বাংলাদেশের তিনটি কার্গো ট্রলার বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার তথা রাখাইন থেকে পণ্য পরিবহনের জন্য সেখানে গমন করে। যথারীতি পণ্যবোঝাই কার্গো ট্রলারগুলো বাংলাদেশে আসার পথে আরাকান আর্মির হাতে আটক হয়। এখন বিভিন্ন মাধ্যমে খবর আসছে, আরাকান আর্মি এসব ট্রলারকে ছাড়ার বিনিময়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করছে। শেষ পর্যন্ত চাঁদা পরিশোধের মাধ্যমে সম্ভবত কয়েকটি ট্রলার ছাড়া পেয়েছে; অন্যগুলোও একই ব্যবস্থায় হয়তো ছাড়া পাবে।

প্রশ্ন হলো– প্রায় যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ট্রলারগুলো সেখানে গেল কীভাবে? কার অনুমতিতে? ট্রলারগুলোর মালিক সে অঞ্চলে নিরাপত্তা ঝুঁকি সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে অবগত ছিলেন কি? এ ক্ষেত্রে ট্রলার মালিক বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নিরাপত্তা চেয়েছিলেন কিনা? আরাকান আর্মির কাছ থেকে বল প্রয়োগে ট্রলারগুলো ছাড়াতে গেলে বাংলাদেশের জন্য যে অনভিপ্রেত নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়, সেটির দায় কে নেবে? আবার ‘মুক্তিপণ’ দিয়ে ট্রলারগুলো ছাড়িয়ে আনার মাধ্যমে আরাকান আর্মিকে যে বার্তা দিতে পারি, সেটি মোটেও আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার অনুকূল নয়।
প্রথমত, আরাকান আর্মি এখন থেকে তাদের নাগালে গেলে যে কোনো বাংলাদেশি ট্রলার বা জাহাজ আটকের দুঃসাহস দেখাবে। সে ক্ষেত্রে বারবার আমাদের বর্তমানের মতো অনভিপ্রেত সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে এবং মুক্তিপণ দিয়ে পরিত্রাণ পেতে হবে। 

বস্তুত, আরাকান আর্মিকে মুক্তিপণ দেওয়ার মধ্য দিয়ে ভয়ংকর ভুল বার্তা দেওয়া হয়; তারা ইচ্ছা করলে বাংলাদেশি স্বার্থে আঘাত হানতে পারে। বলাবাহুল্য, আরাকান আর্মি ভবিষ্যতে বর্তমান ট্রলার ঘটনার মতো ঘটনা ঘটালে বাংলাদেশ তখনও নিশ্চুপ বসে থাকবে না। এ নিরাপত্তার ঝুঁকিটিই আমরা হয়তো অজান্তে ও অবহেলায় সৃষ্টি করে যাচ্ছি।  
অতীতের অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশি বেসরকারি মালিকানাধীন এমভি আরজু মনি কার্গো জাহাজটি সোমালি জলদুস্যরা হাইজাকের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ মুক্তিপণ দাবি করে। জাহাজের মালিক বিভিন্ন মাধ্যমে জলদুস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে মুক্তিপণ দিয়ে জাহাজটি মুক্ত করেন। একই মালিকের দ্বিতীয় জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ২০২৪ সালে আবার একই সোমালি জলদুস্যদের দ্বারা ‌হাইজাক হয়। এবারও বিপুল অঙ্কের ডলার মুক্তিপণ প্রদানের মাধ্যমে জাহাজটি মুক্ত করা হয়।

জাহাজটি মুক্ত হওয়ার পর থেকে সেই সময় আমাদের মিডিয়া যেভাবে এটিকে বিরোচিত ঘটনা আখ্যায়িত করে, তা ছিল বিস্ময়কর। জাহাজটি কখন কোন দিন দুবাই এসে পৌঁছেছে, কখন বঙ্গোপসাগর অভিমুখে যাত্রা করেছে এবং পরিশেষে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছছে– এর বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়। চট্টগ্রামে আসার পর জাহাজের নাবিকদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ, চট্টগ্রামের তৎকালীন মেয়রের উপস্থিতিতে বিরোচিত সংবর্ধনা সবই করা হয়। যেন ওই জাহাজের নাবিকরা সমুদ্র জয় করে এসেছেন। অথচ কেউ একবারও প্রশ্ন তোলেননি– এ জাহাজ ছাড়াতে দেশের কত মিলিয়ন ডলার সোমালি ডাকাতদের মুক্তিপণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। জাহাজটি প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া জলদস্যুপ্রবণ ওই অঞ্চল হয়ে কেন আসছিল? জাহাজটি জলদস্যুর কবলে পড়ার পরপরই আমাদের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমনভাবে প্রতিদিন পত্রপত্রিকায় বিবৃতি দিচ্ছিলেন যেন বিরাট কূটনৈতিক তৎপরতায় তিনি জাহাজটি ছাড়িয়েছেন। সবই ছিল বোকামি ও দুর্ভাগ্যজনক।

অথচ ২০২৪ সালে ভারতীয় পণ্যবাহী জাহাজ ‘এমভি রুয়েন’ এই একই সোমালি জলদুস্যদের কবলে পড়ে। ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ‘কলকাতা’ দ্রুত অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে এমভি রুয়েনকে শুধু উদ্ধারই করেনি, ৩৫ 

জলদুস্যকেও আটক করে। এ থেকে জলদুস্যদের ভারত স্পষ্ট বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছে, ডাকাতের সঙ্গে আপস নয়। অথচ আমরা আপস করেছি আমাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দস্যুদের হাতে তুলে দিয়ে।
প্রসঙ্গক্রমে আরও একটি দস্যুপনার কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই। আমি তখন মিয়ানমারে আমাদের মিশনপ্রধান হিসেবে কর্মরত। আমার কাছে খবর আসে 
মিয়ানমারের কুখ্যাত ‘বগি জহির’ এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ বাংলাদেশি একটি ফিশিং ট্রলার আটকে রেখেছে। ট্রলারটি ছাড়ার জন্য তারা বাংলাদেশি মালিকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করছে। বগি জহিরের পেছনে ইন্ধনদাতা হিসেবে আছে সে দেশের গোয়েন্দা সংস্থার একটি অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দল। এ খবর পাওয়ার পর আমি বাংলাদেশি ওই ট্রলারের মালিকের সঙ্গে স্বপ্রণোদিত হয়ে 
যোগাযোগ করি। অনুরোধ করি, তিনি যেন জাহাজের কাগজপত্রের একটি সেট আমার কাছে পাঠান। 

ট্রলারের মালিক কাগজপত্র পাঠালে দেখি, ট্রলারটি বাংলাদেশ ফিশারিজ করপোরেশনের ঋণে ক্রয় করা। ওই কাগজপত্র নিয়ে আমি সোজা মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় সেনাপ্রধানের কাছে উপস্থিত হয়ে তাঁকে জানাই, বাংলাদেশ সরকারের মালিকানাধীন একটি ফিশিং ট্রলার মুক্তিপণ দাবি করে বগি জহির এবং তার দল আটকে রেখেছে। তিনি সবকিছু জেনে এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন বলে আমাকে আশ্বস্ত করেন। 

আমি পশ্চিমাঞ্চলীয় সেনাপ্রধানের অফিস থেকে শুনি, ট্রলার সিটওয়ে বা আকিয়াবে আটক ছিল। বগি জহিররা তা সেখান থেকে আরও দূরবর্তী ‘পউক্ত’ বলে এক অঞ্চলে নিয়ে গেছে। সে খবরও 
পশ্চিমাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডার জেনে যান। তিনি তাঁর অধীনস্থ ধন্যাবতি নেভাল বেস কমান্ডারকে পউক্ত থেকে ট্রলারটি উদ্ধারের আদেশ দেন। সে অনুযায়ী অভিযান 
পরিচালনার মাধ্যমে ট্রলারটি উদ্ধার করে আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে তা বুঝিয়ে দেন। 

বগি জহির এবং কুখ্যাত দল ম্রাউ থেকে গ্রেপ্তার হন। শুনেছি জহির জেলেই মারা যান। এ ঘটনার পর মিয়ানমারে আর কখনও বাংলাদেশি ট্রলার বা জাহাজ কোনো ধরনের হামলা বা মুক্তিপণের শিকারে পরিণত হয়েছে তা শোনা যায়নি। এতদিন পর আরাকান আর্মির হাতে বাংলাদেশি ট্রলার আটক হলো।
বিষয়টি হালকাভাবে না নিয়ে আরাকান আর্মির কাছে কড়া বার্তা পাঠানো যেমন সমীচীন হবে, তেমনি যারা বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে তাদেরও 
জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। অন্যথায় এসব বিষয় ভবিষ্যতের জন্য খারাপ নজির হয়ে থাকবে। সংশ্লিষ্টরা আরও আশকারা পাবে।

মেজর (অব.

) মো. এমদাদুল ইসলাম: সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক  
emdad555@yahoo.com  

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আর ক ন আর ম আর ক ন আর ম র র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

ইউক্রেনে জেলেনস্কির বিকল্প নেতা খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র!

ইউক্রেনে শান্তিচুক্তির জন্য দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির পদত্যাগ করা লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালৎস। তিনি বলেছেন, ‘ইউক্রেনের একজন নেতা প্রয়োজন, তিনি আমাদের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন। তিনি শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করতে পারবেন এবং এই যুদ্ধ থামাতে পারবেন।’ খবর- সিএনএন

গণমাধ্যমের সামনেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির নজিরবিহীন বাগবিতণ্ডার পর এ কথা বললেন তিনি। বাগবিতণ্ডার এ ঘটনাটি নিয়ে নানা আলোচনা চলছে বিশ্বজুড়ে। ওই ঘটনার পর ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে ঐতিহাসিক চুক্তি হওয়ার কথা ছিল, সেটিও বাতিল হয়ে যায়। আর এর পরই ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কোন পথে, তা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা।

এই প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। শুক্রবারের ওই ঘটনায় সাবেক ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গড়া ওয়াশিংটন-কিয়েভ সম্পর্ক ভেঙে পড়েছে। এই প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। 

যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে আবারও এক টেবিলে বসার ইঙ্গিত দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন ও রাশিয়া-দুই পক্ষই আলোচনায় না বসলে যুদ্ধ থামবে না। হোয়াইট হাউসে শুক্রবার ট্রাম্প-জেলেনস্কি বিতণ্ডার পর থেকে ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আর কথা হয়নি। যুদ্ধ থামানোর জন্য রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে আনতে হবে। তবে তাদের প্রতি বৈরী মনোভাব রাখলে, মস্কোকে আলোচনায় যুক্ত করা সম্ভব হবে না। কোনো চুক্তি করার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই মনোভাবই দেখিয়ে আসছেন।

তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, সবকিছু আবার শুরু হতে পারে। আশা করি, তিনি (জেলেনস্কি) এটা বুঝতে পারবেন যে আমরা আসলে আরও হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর আগে, তাঁর দেশকে সাহায্যের চেষ্টা করছি।’
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ