জনপ্রশাসন সংস্কারের উপযুক্ত সময় এখনই
Published: 21st, January 2025 GMT
স্বাধীনতার পর ৫৩ বছরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কমিশন গঠন করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রশাসন ক্যাডারের হাতে থাকায় কমিশনগুলোর মতামত ও জনকল্যাণকর সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের ওপর এতটাই নির্ভরশীল হতে দেখা গেছে, তারা প্রশাসন দ্বারা প্রায় শাসিতই হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আগের নাম ছিল সংস্থাপন মন্ত্রণালয়। কিন্তু নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়! আগের সরকার কখনোই বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের লাগাম টেনে ধরার সাহস করেনি তাদের দুর্বলতার কারণে। কিন্তু ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর বর্তমান সরকার যেসব সংস্কার কমিশন গঠন করে, এর মধ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সবচেয়ে বেশি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এই কমিশন থেকে জনগণের প্রত্যাশা বেশি। কারণ এই কমিশন মোহমুক্তভাবে জনগণের সেবার মানের বিষয় চিন্তা করে সীমাহীন ক্ষমতার প্রশাসনকে ভারসাম্যপূর্ণ ও জনবান্ধব প্রশাসনে রূপান্তরে সংস্কার করবে, এটাই সবাই বিশ্বাস করেন। সিভিল সার্ভিসের ২৬টি অংশীজন ক্যাডার থেকে সরকারের বিশেষ পদ বা সিনিয়র সার্ভিসে মেধার ভিত্তিতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়ার এই সুযোগ আর কোনোদিন আসবে না। কারণ রাজনৈতিক সরকারের মতো এই সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার মতো কোনো বিনিময় প্রয়োজন নেই বলে সবাই বিশ্বাস করেন।
বাংলাদেশ সরকার জনগণের সেবা নিশ্চিতে সময় নির্ধারণ করে সিটিজেন চার্টার প্রস্তুত করলেও সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী কোনো সেবা কোনো দপ্তরে পাওয়া যায় না বললেই চলে। সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের জন্য শুদ্ধাচার চর্চার পুরস্কার প্রদান করা হলেও সততার জন্য এই পুরস্কার প্রদান না করে যেসব কর্মকর্তা বিভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে কাজ করতেন, তাদের এই পুরস্কারে ভূষিত করা হতো। শ্রেষ্ঠ, দক্ষ ও চৌকস অফিসার পরিচয় তাদেরই মেলে, যারা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে লিপ্ত থাকত। নথির বিষয় যা-ই হোক, ন্যায্য কিংবা অন্যায্য; নথির পেছনের ব্যক্তি ও শক্তির পর্যালোচনা করে নথি পাস হতো। নথির শম্বুকগতির কারণে নথির প্রচলন গতি বা ডিসিশন টার্নওভারের হার অসন্তোষজনক এবং যেসব নথি তিনজন কর্মকর্তার স্বাক্ষরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব, তা পাস হতে মাঠ পর্যায়ে কমপক্ষে তিনজন, অধিদপ্তর পর্যায়ে অফিস সহকারী, গবেষণা কর্মকর্তা, সহকারী পরিচালক, উপপরিচালক, পরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও মহাপরিচালক পর্যায়ে স্বাক্ষর হয়ে সচিবালয়ে উপস্থাপন হতে প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব বা সিনিয়র সচিব পর্যায়ে স্বাক্ষর হয়ে চিঠি হয় আবার কোনো নথি এসব ধাপ পার হয়ে উপমন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি পর্যায়ে গিয়ে নিষ্পত্তি হয়।
এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় চলে যায় বছরের পর বছর। জনগণ দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কর্মকর্তার সারিতে ঘুরপাক খেতে থাকেন। তারা প্রত্যাশিত সেবা পান না। সেবা তাদের কাছে অধরাই রয়ে যায়। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের কারণে সরকারি সেবার মান উল্লেখযোগ্যভাবে নিম্ন হচ্ছে। সরকারের সেবার ফি আদায় ও পরিশোধে জটিলতাও সীমাহীন। অনলাইন ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করে সহজে জটিলতা নিরসন করা গেলেও সেগুলো করা হয়নি। এ কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া অতিশয় কেন্দ্রীকরণ, নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহিতে দুর্বলতা, দৃষ্টিভঙ্গিগত অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে। যেমন শিক্ষা ক্যাডারের মাঠ পর্যায়ের বহু উপজেলার সরকারি কলেজের চার-পাঁচটি বিষয়ের কোনো শিক্ষক নেই; পাঠদান পর্যন্ত হয় না। আবার বিভাগের এক বিষয়ে ২০ জন আছেন। যিনি ঢাকায় আছেন, ২০ বছর ঢাকায়; যিনি উপজেলায়, তিনি সারাজীবন উপজেলায়। চাকরিতে বদলি টার্নওভার খুব কম হওয়ায় গতিশীলতা হারিয়ে যাচ্ছে। এসব বিষয় শিক্ষা ক্যাডারের আওতার বাইরে হওয়ায় সচিবালয়ে পত্র প্রেরণ করলেও কোনো সাড়া নেই। হাজারো সমস্যা জিইয়ে রাখার মূল কারণ ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং পেশাগত ক্যাডারের নিয়ন্ত্রণ পেশাগত ক্যাডারের হাতে না থাকা।
স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, দক্ষতা, কার্যকারিতা, গতিশীলতা, নৈতিকতাসহ সুশাসন নিশ্চিতে জনপ্রশাসন সংস্কারে যেসব বিষয় বিবেচনা করতে হবে– দুর্বলতা চিহ্নিতকরণ, জনপ্রশাসন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তকরণ, দুর্নীতিমুক্ত জনপ্রশাসন গঠন, অন্য দেশের মডেল অনুসরণ নয় বরং বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্য সংগ্রহ করে সংস্কার, মেধাবীদের বাছাই করতে জেনারেল ক্যাডার ও পেশাগত ক্যাডারের নিয়োগ প্রক্রিয়া কোনোক্রমেই ক্ষুদ্র হওয়া উচিত নয়, জনপ্রশাসন-বেসরকারি খাত এবং একাডেমিয়ার সমন্বয়ে মনোযোগ বৃদ্ধি, সেবার মান উন্নয়নে মনোযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। জনপ্রশাসনে মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন তরুণদের ক্যাডার হয়ে সৎভাবে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। কর্মকর্তাদের নেতৃত্বের গুণাবলি চর্চায় মনোযোগ দিতে হবে এবং কর্মকর্তাদের আচরণে আমূল পরিবর্তন করতে হবে।
জনগণের সেবা সহজীকরণ করতে হলে মেধাবীদের সেবা দেওয়ার সুযোগ করে দিতে ‘ক্যাডার যার, মন্ত্রণালয় তার’ অর্থাৎ ‘কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয়’ গঠন করে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হবে। জনপ্রশাসনের কাজের পরিধি প্রকৃতি বিবেচনায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘কর্মচারী বিষয় মন্ত্রণালয়’ ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘জেলা কর্মচারী বিষয় কার্যালয়’ রাখলে সবচেয়ে ভালো হয়। আমি মনে করি, দক্ষ, মেধাবী, দুর্নীতিমুক্ত, সেবামুখী, জবাবদিহিমূলক, স্বচ্ছ জনপ্রশাসন গড়ে তুলতে জনপ্রশাসন সংস্কারের উপযুক্ত সময় এখনই।
মো.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ক ক ষমত র সরক র র জনগণ র মন ত র পর য য়
এছাড়াও পড়ুন:
ড. ইউনূস গণঅভ্যুত্থানের ফসল, নেতা নন: ফরহাদ মজহার
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গণঅভ্যুত্থানের ফসল কিন্তু নেতা নন বলে মন্তব্য করেছেন কবি ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার। ড. মোহাম্মদ ইউনূসের সমালোচনা করে তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শক্তি, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা, ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ এক হয়ে লড়েছিল। কিন্তু ড. ইউনুস আমাদের জুলাই ঘোষণাপত্র দেননি। এজন্য আমাদের হাতে বিপ্লবের কোনও দলিল নাই। ড. ইউনূস জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র দিতে দেননি। এটা তিনি মহাভুল করেছেন। আগামী দিনে জনতাকে এর ফল ভোগ করতে হবে।
সোমবার বিকেল ৫টার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবনে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। ‘গণঅভ্যুত্থান : বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তর’ শীর্ষক সভাটি আয়োজন করে সেন্টার ফর হেরিটেজ স্টাডিজ।
গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র না থাকায় আমরা দুর্বল হয়েছি উল্লেখ করে এই চিন্তক বলেন, এই অভ্যুত্থানের গণ অভিপ্রায় হচ্ছে গণসার্বভৌমত্ব। এর প্রথম ধাপ হবে সংবিধানে গণসার্বভৌমত্ব উল্লেখ করা। কিন্তু আমরা হাসিনার সংবিধানটাই ছুড়ে ফেলতে পারিনি। এর বদলে আমরা করেছি একটি সংস্কার কমিশন। এর নেতৃত্বে যারা রয়েছেন তারা অভ্যুত্থান যারা ছিলেন না তারা। কমিশনগুলো জনগণের কাছে থেকে তাদের কথা শোনেনি। এতে আমরা ক্রমশ দুর্বল হয়েছি। ফলে, যারা আপনাদের অশান্তিতে রেখেছে আপনারা তাদের বিচার করতে পারবেন না। তাই গণ সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাষ্ট্রে নতুন স্বাধীন গঠনতন্ত্র লাগবে।
জনগণের সার্বভৌমত্বকে মূল্যায়ন করে বর্তমান সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং নতুন সংবিধানে তিনটি বিষয় উল্লেখ করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের ৭২ সালের সংবিধান জনগণ করেনি। ৭১ এর ১০ এপ্রিলের ঘোষণাপত্রের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার বাদ দিয়ে ‘সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ’সহ ৪টি মূলনীতি করা হয়েছিল। এই সংবিধানকে বাতিল করে জনতার অভিপ্রায়ের নতুন গঠনতন্ত্র চাই। জনতার অভিপ্রায়ের জন্য ৩টি বিষয় সংবিধানে উল্লেখ করতে হবে।
দাবি তিনটি হলো- প্রথমত, রাষ্ট্র এমন কোন আইন বা নীতি করতে পারবে না যাতে ব্যক্তির অধিকার হরণ করা হয়। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র এমন কোন আইন বা নীতি করতে পারবে না যাতে প্রাণ- প্রকৃতি- পরিবেশ ধ্বংস হয়। তৃতীয়ত, রাষ্ট্র এমন কোনো আইন বা নীতি গ্রহণ করতে পারবে না যাতে জীবন ও জীবিকা ধ্বংস হয়।
পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সেখানে ধর্মের প্রসঙ্গে চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার বলেন, আমরা আধুনিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রে ইসলামের খোঁজ করি। আধুনিক রাষ্ট্র ক্যাপিটাল দিয়ে চলে। আমরা সারাক্ষণ ক্যাপিটালের অধীনে থাকি। পুঁজিবাদের অধীনে থেকে ধর্ম প্রতিষ্ঠা হবে না। আগামী দিনের লড়াই হবে এই পুঁজির বিরুদ্ধে। এই লড়াইয়ে জাতীয়তাবাদে বিভক্ত করে আলাদা হওয়া যাবে না। কারণ দুনিয়াতে জাতীয়তাবাদের যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে। এই সময়ের লড়াই হবে সেটা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, সেখানে কোনও জাতিবাদ থাকবে না।
তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থান বলতে আসলে কী বুঝায়, এটা আসলে আমাদের সমাজে পরিষ্কার ধারণা নেই। সর্বশেষ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সামনের সাড়িতে অনেক মেয়ে ছিল, কিন্তু তারা হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেল? তারা আর রাজপথে নেই। কারণ, তারা রাজপথে আর নিরাপদবোধ করছে না। আমাদের দেশের জনগণের মধ্যে রাষ্ট্র আর সরকারের পার্থক্য স্পষ্ট না। ফলে দেশ সামনের দিকে এগোতে পারছে না।
দেশে স্টারলিংক আনার সমালোচনা করে লেখক ফরহাদ মজহার বলেন, ড. ইউনুস স্টারলিংক দেশে এনেছেন। এতে কী লাভ হবে? আপনার নিরাপত্তা, আপনার সিকিউরিটি কোনও কিছুই আর আপনার থাকবে না। সবকিছু ইলন মাস্ক জানবে। আর ইলন মাস্ককে জানেন তো? তিনি ট্রাম্পের সমর্থক। আর ট্রাম্প ইসলাম ঘৃণা করেন। উনি ঘোরতর ইসলামবিরোধী। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের কথা বলে ভাবছেন- আমি চাকরি পাবো! অনেক বেতন পাবো!
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসঊদ। উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী আফরিনা আফরিনের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক মাহবুব সিদ্দিকি।