ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলররা গা-ঢাকা দেন। পরে নগরের সেবা স্বাভাবিক রাখতে দেশের সব সিটি করপোরেশনে মেয়রের জায়গায় আমলাদের প্রশাসক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। আর কাউন্সিলরের দায়িত্ব পান আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারা। বর্তমানে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রশাসক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সাত দপ্তরপ্রধান নেই। আর উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহীসহ নেই দুটি দপ্তরপ্রধান। ফলে অভিভাবকহীন দুই সিটিতে সেবায় বিঘ্ন ঘটছে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ১৯ আগস্ট দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ডিএসসিসির দায়িত্ব দেওয়া হয় অতিরিক্ত সচিব ড.
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ডিএসসিসিতে নিয়োগ পাওয়ার পর ওই দুই প্রশাসকের একজনও সপ্তাহে দু’দিনের বেশি নগর ভবনে আসতেন না। আবার এই দু’দিনও ২-১ ঘণ্টার বেশি সময় দিতেন না তারা। সিটি করপোরেশনে মেয়র বা প্রশাসকের পরই প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান ২৪ ডিসেম্বর অবসরে যান। এর পর নতুন করে কাউকে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাও ৩১ ডিসেম্বর অবসরে গেছেন। এ ছাড়া প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, প্রধান অডিট কর্মকর্তা ও প্রশাসকের পিএস বদলিজনিত কারণে করপোরেশন ত্যাগ করলেও, নতুন করে কাউকে পদায়ন করা হয়নি।
ডিএসসিসি সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, চাকরি স্থায়ীকরণ, পদোন্নতি আর বদলিকে কেন্দ্র করে করপোরেশনে প্রশাসক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, সচিবসহ অন্য কর্মকর্তার কক্ষে কর্মচারী ও শ্রমিক দলের কয়েকটি গ্রুপ হট্টগোল করে। টেন্ডারকে কেন্দ্র করে বহিরাগতরাও করপোরেশনের ভেতরে দ্বন্দ্বে জড়ায়। কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের কক্ষে বিশৃঙ্খলার ঘটনাও ঘটে। এসব কারণে করপোরেশনে প্রশাসকসহ অন্য পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা আসতে চাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা।
এদিকে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যান। এর পর সেখানে কাউকে পদায়ন করা হয়নি। এ ছাড়া ডিএনসিসির প্রধান নিরীক্ষা কর্মকর্তা ও আইন কর্মকর্তার পদ শূন্য।
সংকট উত্তরণে গত ৩০ অক্টোবর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে করপোরেশনসহ পৌরসভাগুলোতে দ্রুত স্থায়ী প্রশাসক নিয়োগ করা হবে বলে জানিয়েছিলেন সাবেক স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ। আর কোনো অগ্রগতি নেই।
দুই সিটি করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা ও প্রকৌশলী সমকালকে বলেন, মেয়র কাউন্সিলরহীন করপোরেশনে এখন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ‘চেইন অব কমান্ড’ নেই। উন্নয়ন কাজের নথি অনুমোদন হচ্ছে না। আবার পদোন্নতি আর টেন্ডারের জন্য বহিরাগতরা যখন-তখন এসে হট্টগোল বাধাচ্ছেন। এতে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। আবার ৫ আগস্টের পর করপোরেশনের ছোটখাটো বিষয়ে মামলা হচ্ছে। এসব বিষয়ে আইন কর্মকর্তার পরামর্শ জরুরি। অর্থছাড় আর অডিটের মতো পদগুলোতে ক্যাডার কর্মকর্তা না থাকায় সেখানেও সমস্যা হচ্ছে।
ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সচিব মোহাম্মদ বশিরুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘প্রশাসকসহ দপ্তরপ্রধানের কয়েকটি পদ না থাকায় কাজে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। এসব পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে আমাদের রুটিন কাজ চলছে। মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, দ্রুতই এসব পদে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হবে।’
ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সচিব মোহাম্মদ মাসুদ আলম সিদ্দিক বলেন, ‘শীর্ষ পদ আর টেকনিক্যাল পদগুলো খালি থাকায় বাড়তি সময় নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ে এসব পদে দ্রুত পদায়নের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করতে গিয়ে যাচাই-বাছাই চলছে। দ্রুত এসব পদে পদায়নের কাজ করছেন তারা।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ড এনস স ড এসস স সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ইডির চেয়ার দখলের ঘটনায় আরও দুই প্রকৌশলী বরখাস্ত, থানায় মামলায়
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) নির্বাহী পরিচালক (ইডি) অতিরিক্ত সচিব শফিকুল ইসলামকে বের করে দিয়ে চেয়ার দখলের ঘটনায় অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খানকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ার পর আরও দুই প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একইসঙ্গে ঘটনায় ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগে শোকজ করা হয়েছে বিএমডিএর চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামানকে। পাশাপাশি ঘটনা তদন্তে গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। কমিটি আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এ ঘটনায় ২৫ মার্চ রাজশাহী নগরের রাজপাড়া থানায় একটি মামলাও হয়েছে। মামলা পর থেকে অভিযুক্তরা গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে আছেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের সই করা পৃথক অফিস আদেশে বাধ্যতামূলক অবসর ও বরখাস্ত করা হয়।
সাময়িক বরখাস্ত দুই কর্মকর্তা হলেন- নির্বাহী প্রকৌশলী সেলিম রেজা ও সহকারী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ। বরখাস্ত হওয়া সেলিম রেজা সিরাজগঞ্জে কর্মরত। তিনি কোনো অনুমতি ছাড়াই কর্মস্থল থেকে রাজশাহীতে চলে এসেছিলেন। অতিরিক্ত সচিবকে হেনস্তার সঙ্গে তার জড়িত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে মন্ত্রণালয়। এজন্য তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিএমডিএর চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামানকে মন্ত্রণালয়ে ডেকে ওই ঘটনার জন্য ভর্ৎসনা করা হয়। আসাদুজ্জামানে ইন্ধনে ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটনার পরও তিনি কিছু বহিরাগত ব্যক্তি দিয়ে মানববন্ধনসহ নানা ষড়যন্ত্র করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সংস্থার প্রধান হিসেবে এ বিষয়ে তার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
বিএমডিএর ইডি শফিকুল ইসলামকে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক হিসেবে বদলি করা হয়। কিন্তু রিলিজ অর্ডার না পাওয়ায় তিনি দপ্তর ছাড়তে পারছিলেন না। এর মধ্যে ২৩ মার্চ দুপুরে একদল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে ইডির দপ্তরে ঢুকে পড়েন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খান। তারা তাকে জোরপূর্বক দপ্তর ত্যাগ করতে বাধ্য করেন। পরে অফিস আদেশ ছাড়াই ইডির চেয়ারে বসে পড়েন জাহাঙ্গীর আলম খান।
ঘটনার পরপরই কৃষি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন অতিরিক্ত সচিব শফিকুল ইসলাম এবং ২৫ মার্চ রাজশাহী নগরের রাজপাড়া থানায় একটি মামলা করেন।
এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, মন্ত্রণালয়ের রিলিজ স্লিপ না পাওয়ায় বিএমডিএ থেকে তিনি অবমুক্ত হতে পারছিলেন না। রিলিজ স্লিপ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে বিএমডিএতে দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার জন্য মৌখিক নির্দেশ দিয়েছিল মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খানের নেতৃত্বে তার অনুসারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাকে বিএমডিএ ছেড়ে যেতে চাপাচাপি করছিলেন।
তিনি তাদের রিলিজ স্লিপ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তারা কোনো কথা শোনেননি। এমনকি অফিস ত্যাগ করার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে ৩০ মিনিট সময় চাইলেও তা দেওয়া হয়নি। এ সময় জোর করে তার থেকে স্বাক্ষর নেওয়া হয় বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
মামলার এজাহারভুক্ত আসামিরা হলেন- বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খান, উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মেহেদী, সহকারী মেকানিক মো. আপেল, মেহেদী হাসান, গুদামরক্ষক মো. নুরুজ্জামান, মজিবুর রহমান, আব্দুল কাইয়ুম খান, ক্যাশিয়ার শফিকুল ইসলাম, গাড়িচালক মো. শাহাবুল, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শমসের আলী ও নির্বাহী প্রকৌশলী তরিকুল ইসলাম। এতে অজ্ঞাতনামা আরও ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আশরাফুল আলম বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তারা আত্মগোপন আছেন। অফিসও ছুটি হয়ে গেছে। এ জন্য কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।
এদিকে বৃহস্পতিবার ঘটনা তদন্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে কৃষি মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আহমেদ ফয়সল ইমামকে আহ্বায়ক ও উপসচিব মো. মনিরুজ্জামানকে সদস্যসচিব করা হয়েছে। অন্য চার সদস্যের মধ্যে আছেন বিএমডিএ পরিচালনা বোর্ডের সদস্য সাইফুল ইসলাম ও মো. জাফরুল্লাহ। কমিটিতে জেলার একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে রাখতে বলা হয়েছে।
বিএমডিএ পরিচালনা বোর্ডের সদস্য সাইফুল ইসলাম বলেন, বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালকের পদটি একটি প্রশাসনিক পদ, যা মন্ত্রণালয় থেকে নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু তাকে চেয়ার থেকে টেনে নামানো এবং সেই চেয়ার দখল করা চাকরিবিধির গুরুতর লঙ্ঘন। দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় শক্ত পদক্ষেপ নিয়েছে, যা দরকার ছিল। তদন্তের মাধ্যমে জাহাঙ্গীর আলম খানের অন্য সহযোগীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তারা আশা করছেন।