বয়সের কারণে নির্বাচনে প্রার্থিতা থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল জো বাইডেনকে। তাঁর প্রশাসনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে করা হয় প্রার্থী। প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হন বড় ব্যবধানে। বাইডেনের প্রেসিডেন্ট মেয়াদে শুরু হয় গাজা যুদ্ধ, যা প্রাণ কেড়ে নেয় ৪৬ হাজারের বেশি মানুষের। আহত হন ১ লাখ ১০ হাজারের বেশি মানুষ। গাজা উপত্যকা পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। এমন গণহত্যা-ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকাতে না পারার অভিযোগ নিয়েই হোয়াইট হাউস ছেড়েছেন জো বাইডেন। তাঁর সময়ে রক্তক্ষয়ী ইউক্রন যুদ্ধেরও সূত্রপাত। 

মেয়াদের শেষদিকে বাইডেনের জনপ্রিয়তা তলানিতে গিয়ে ঠেকে। ইসরায়েলকে অস্ত্র ও অর্থ সহযোগিতা দেওয়া এবং যুদ্ধ থামাতে ব্যর্থ হওয়ায় বিশ্বজুড়ে তাঁর সমালোচনা শুরু হয়। নিজ দেশে আরব মার্কিনিদের কাছে তিনি অজনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। জনপ্রিয়তা হারায় তাঁর দল ডেমোক্রেটিক পার্টি। এর প্রতিফলন দেখা গেছে কমলা হ্যারিসের হারের মধ্য দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোতে বড় জয় পান রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। ঐতিহ্যগতভাবে ডেমোক্রেটিক পার্টির ভোটার মুসলিম ও আরব মার্কিনিরা এবার সমর্থন করেন ট্রাম্পকে। এসব কিছুর পেছনে গাজায় নজিরবিহীন নৃশংসতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সিএনএনের এক জরিপে দেখা গেছে, বাইডেন মাত্র ৩৬ শতাংশ জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন তাঁর অনুমোদনের হার ছিল ৬০ শতাংশ। গণমাধ্যমটি লিখেছে, বাইডেনের চার বছরের মেয়াদে মার্কিনিরা সফলতার চেয়ে ব্যর্থতাকেই বড় করে দেখছে।

গত সপ্তাহে গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয় কাতারের রাজধানী দোহায়। ওই চুক্তি সম্পাদনে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভেন উইটকফ বড় ভূমিকা রাখেন। কিন্তু পরে বাইডেন ও তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন চুক্তির কৃতিত্ব দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করেন। যেসব শর্তে চুক্তি হয়েছে, তা গত বছরের মে মাসেই নির্ধারিত ছিল। ১৫ মাস চুক্তি করতে ব্যর্থ বাইডেনকে ‘অকৃতজ্ঞ’ বলেও বর্ণনা করেছেন ট্রাম্প। বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েন ব্লিংকেনও। তাঁকে ‘অপরাধী’ এবং ‘গণহত্যার সহযোগী’র মতো শব্দও শুনতে হয়।
বাইডেন যে পশ্চিমা পাটাতনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেটিও আর বেশিদিন টিকছে না। এরই মধ্যে ব্রিটেনে রক্ষণশীল ঋষি ‍সুনাক সরকারের পতন হয়েছে। পদত্যাগ করেছেন কানাডার জাস্টিন ট্রুডো। জার্মানিতে ওলাফ শোলৎজের মসনদ কাঁপছে। একই অবস্থা ফ্রান্সের ইমানুয়েল মাখোঁর।

যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, যা বাইডেনের জনপ্রিয়তার ওপর প্রভাব ফেলেছে। সে সঙ্গে বেড়েছে ধনী-গরিবের বৈষম্য। ব্লুমবার্গের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জো বাইডেনের মেয়াদে ধনকুবের মার্কিনিরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে, যদিও সমাপনী ভাষণে তিনি ‘অলিগার্ক’দের নিয়ে সতর্ক করে গেছেন। গত চার বছরে ১০০ জন মার্কিন ধনকুবের অতিরিক্ত দেড় ট্রিলিয়ন ডলারের মালিক হয়েছেন।
বাইডেনের মেয়াদেই ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায় রাশিয়া। ওই যুদ্ধ এখনও চলছে। এসব কিছু মিলিয়ে আপাতত ‘মানবতাবাদী’ বাইডেন ইতিহাসের অন্যতম ‘যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট’ হিসেবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁকে স্মরণ করা হবে গাজা আগ্রাসনে ইসরায়েলের গণহত্যার সহযোগী হিসেবে।

ফৌসিসহ বেশ কয়েকজনকে আগাম ক্ষমা
ফৌজদারি মামলার হুমকিতে থাকা বেশ কয়েকজনকে আগাম ক্ষমা করেছেন সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তাদের মধ্যে ড.

অ্যান্থনি ফৌসি ও জয়েন্ট চিফের সাবেক চেয়ারম্যান মার্ক মাইলিও আছেন। এক বিবৃতিতে হোয়াইট হাউস জানায়, যে কর্মকর্তাদের ক্ষমা করা হয়েছে তারা হাউস সিলেক্ট কমিটিতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। সেই সঙ্গে সদস্য ও কর্মীরাও আছেন ক্ষমার আওতায়। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনায় ট্রাম্পের ভূমিকা নিয়ে তারা তদন্ত করেছিলেন।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণহত য

এছাড়াও পড়ুন:

ফিলিস্তিনিরা হামাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন?

এ সপ্তাহের শুরুর দিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার সড়কে কয়েক শ ফিলিস্তিনি নেমে এসে ইসরায়েলি বর্বর গণহত্যার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন। এ সময় তাঁরা অবরুদ্ধ গাজা থেকে হামাসের নিয়ন্ত্রণ অবসানের দাবি জানান। উত্তর গাজার বেইত লাহিয়ায় অনুষ্ঠিত হওয়া বৃহত্তম একটা প্রতিবাদ, যেখানে ৫০০ জন বিক্ষোভকারী অংশ নেন।

কিছুসংখ্যক মানুষ হামাস ও ফিলিস্তিন প্রতিরোধ আন্দোলনের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। বক্তাদের মধ্যে একজন বলেন, ‘আমরা বেইত লাহিয়ার মানুষেরা শান্তির পক্ষে। আমরা শান্তি ভালোবাসি এবং আমরা চাই এই যুদ্ধের অবসান হোক।’

ইসরায়েলি, ইসরায়েলপন্থী মিডিয়া এবং ফিলিস্তিন প্রতিরোধ আন্দোলনের বিরুদ্ধে থাকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বরা ফিলিস্তিনিদের এই প্রতিবাদকে ব্যবহার করে। এটিকে ফিলিস্তিন প্রতিরোধ আন্দোলনকে, বিশেষ করে হামাসকে, আক্রমণ করার একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।  

এমনকি ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কার্টজ এই বিক্ষোভে উল্লাস প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে বর্ণবাদী রাষ্ট্র হামাসকে পরাজিত করার প্রচেষ্টায় তাদেরকে বাজি ধরছে।

পাঁচ মাস আগে ইসরায়েলে একজন সাংবাদিক বলেছিলেন, ইসরায়েলি লোকেরা তাঁদের ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধ নিয়ে বিরক্ত এবং সে কারণে তাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছেন এবং যুদ্ধ শেষ করার দাবি জানাচ্ছেন। এরপর তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, ‘গাজার লোকেরা কবে হামাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন?’ তিনি আমাকে বলেছিলেন, ইসরায়েলি নেতারা সেই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছেন।

প্রকৃতপক্ষে, গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা চলছে। ইসরায়েলি নেতারা ও তাঁদের মিত্ররা অবরুদ্ধ ছিটমহলে ইসরায়েলি সেনারা যেসব যুদ্ধাপরাধ করে চলেছেন, তার জন্য হামাস এবং ফিলিস্তিন প্রতিরোধ আন্দোলনকে দায়ী করে চলেছেন। গাজাকে ইসরায়েলি রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার তাঁদের পূর্বপরিকল্পনায় ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য তাঁরা এটা সাজিয়েছেন।

ফিলিস্তিনিরা যদি তাঁদের অস্ত্র ত্যাগ করেন এবং বৈধ প্রতিরোধ বন্ধ করেন, তাহলে সেটা হবে না। প্রতিরোধ আমাদের মর্যাদা, প্রতিরোধ আমাদের সম্মান। আমাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের একমাত্র রাস্তা প্রতিরোধ।

একজন ফিলিস্তিনি, আরেকজন ফিলিস্তিনি—ইসরায়েল কখনো এভাবে ভাগ করে না। তারা সব ফিলিস্তিনিকে শত্রু বলে মনে করে এবং সবাইকে নির্মূল করা উচিত বলে মনে করে। কারণ হলো, তাঁদের জোর করে নিজেদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করার পরও, তাঁদের জমি চুরি করার পরও এবং তাঁদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর পরও তাঁরা প্রতিরোধ ছেড়ে দেননি।

একটা বড় অংশের লোকেদের স্মৃতিশক্তি খুবই স্বল্পমেয়াদি। তাঁরা আমাদের বিরুদ্ধ ইসরায়েলি নৃশংসতাগুলো এবং ইসরায়েলি নেতাদের অপমানজনক মন্তবগুলো এবং মিথ্যা দাবিগুলো মনে রাখতে অক্ষম। অতএব তাঁরা সেই ইসরায়েলি নেতাকে জানতে আগ্রহী না–ও হতে পারেন, যিনি বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের সেরা বন্ধু হলো সেই ফিলিস্তিনি, যিনি মারা গেছেন।’

গণহত্যা শুরুর পর একটি টেলিভিশন ভাষণে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইহুদি বাইবেল থেকে ধার নিয়ে ফিলিস্তিনিদের ‘আমালেক’ বলেছিলেন। এটি ইঙ্গিত করে যে সেখানে একটি আদেশ ছিল, যা নির্ধারণ করে যে ফিলিস্তিনিদের অবশ্যই ইহুদিদের দ্বারা ধ্বংস করতে হবে।

নেতানিয়াহুর সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত ফিলিস্তিনিদের ‘নরপশু’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। এর মাধ্যমে গাজায় বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার যৌক্তিকতা দিতে চেয়েছিলেন।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি দখলকৃত জায়গায় এ সবকিছুর সরবরাহ অবশ্যই জনগণকে বিনা মূল্যে দিতে হবে।

এরপর নেসেটের (ইসরায়েলের আইনসভা) উপ–স্পিকার নিসিম ভাতুরি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লেখেন, ইসরায়েলের একটি সাধারণ লক্ষ্য হচ্ছে, ‘গাজাকে দুনিয়ার মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা।’ গাজার এতিহ্যবিষয়ক মন্ত্রী আমিচায় ইলিয়াহু গাজায় পারমাণবিক বোমা ফেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, গাজায় একজনও বেসামরিক নাগরিক নেই।

গাজার বাসিন্দাদের জোর করে উচ্ছেদ করে দেওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ইসরায়েলের যোগাযোগমন্ত্রী শোহলো কারহি ফিলিস্তিনিদের দ্রুত বের করে দেওয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিলে ফিলিস্তিনিরা মিসরে যেতে বাধ্য হবেন।

ইসরায়েলি নেতাদের কাছে ফিলিস্তিনি মানেই শত্রু। তাঁরা ফিলিস্তিনিদের নির্বিচারে হত্যা করছেন। কোনো প্রতিরোধযোদ্ধা নেই, সেটা জানার পরও তাঁরা সেই সব এলাকাকে টার্গেট করছেন।

বিক্ষোভকারীরা শান্তির দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা হয়তো ভুলে গেছেন যে ১৯৯৩ সাল থেকে আমাদের শান্তিতে বাস করা উচিত ছিল। কেননা, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন ফাতাহকে নিরস্ত্রীকরণের মধ্য দিয়ে ১৯৯৩ সালে পিএলও ওসলো শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। আমাদের তাতে কী হয়েছে? তারা আমাদের খুন করা অব্যাহত রেখেছে।

ফিলিস্তিনিদের প্রমাণ করতে হবে না যে তারা শান্তিপূর্ণ লোক। সেটা প্রমাণ করতে হবে ইসরায়েলিদের। যা–ই হোক, বিশ্বের ভণ্ড পরাশক্তি ও আরব নেতারা যতক্ষণ ইসরায়েলকে সমর্থন করে যাবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত সেটা হবে না।

ফিলিস্তিনিরা যদি তাঁদের অস্ত্র ত্যাগ করেন এবং বৈধ প্রতিরোধ বন্ধ করেন, তাহলে সেটা হবে না। প্রতিরোধ আমাদের মর্যাদা, প্রতিরোধ আমাদের সম্মান। আমাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের একমাত্র রাস্তা প্রতিরোধ।

মোতাসেম আ দল্লউল গাজার মিডল ইস্ট মনিটরের সংবাদদাতা
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই হত্যাকাণ্ড কি জেনোসাইডের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে
  • শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে: তাজুল
  • শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে
  • গণহত্যা মামলা: হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্তের খসড়া রিপোর্ট প্রসিকিউশনে
  • ফিলিস্তিনিরা হামাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন?
  • গণহত্যাকারীদের বিচার হতেই হবে: জামায়াতের আমির