জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর চারটি– সংবিধান, নির্বাচন, দুদক ও পুলিশ তাদের প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে। বাকি ১১টির প্রস্তাব আগামী মাসের মাঝামাঝি পাওয়া যাবে বলে জানা গেছে। গত দেড় দশকে ছলচাতুরীর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাতির ঘাড়ে চেপে বসা শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকার উৎখাতের পর আর যাতে এ ধরনের সরকার ক্ষমতায় না আসে, সে জন্যই মূলত সংস্কার প্রস্তাব। তবে এ কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশের দাপ্তরিক নাম, মূল চার নীতিসহ কিছু সুপারিশের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে আলোচনা জরুরি।
জুলাই-আগস্টে এ দেশের রক্তাক্ত রাজপথের অভিজ্ঞান থেকে আমরা নিশ্চিত, এ দেশে আর কোনো ব্যক্তিকে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রাখা যাবে না। বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার আওতা যতদূর চোখ যায়, তা-ও পেরিয়ে যায়। তিনি একই সঙ্গে সংসদ নেতা, দলেরও প্রধান; বস্তুত তিনি দল ও দেশের দণ্ডমুণ্ডের একক অধিকর্তা হয়ে বসেন। রাষ্ট্রের যাবতীয় দপ্তর, সংসদ, বিশ্ববিদ্যালয়, সংবাদমাধ্যম– দিনরাত প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবার-স্বজনের মহিমা কীর্তনে ব্যস্ত থাকে। প্রধানমন্ত্রী তখন আর কোনোরকম জবাবদিহির আওতায় নিজেকে দেখতে চান না; বাংলাদেশ হয়ে ওঠে তাঁর ও পারিষদবর্গের ভোগ-বিলাসের অন্তহীন উদ্যান। প্রধানমন্ত্রীর জনতার কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর সাহস হয় না, তাই ছলচাতুরীর নির্বাচনই হয়ে ওঠে অন্বিষ্ট। গত দেড় দশক শেখ হাসিনার শাসনামল এমন প্রধানমন্ত্রিত্বের অতুলনীয় উদাহরণ।
গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কারে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার প্রস্তাবনা তাই সংগত ও জরুরি। কমিশন প্রস্তাব করেছে, এক ব্যক্তি দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না; প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক দলের প্রধান বা সংসদ নেতাও হতে পারবেন না। একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে যাতে রাষ্ট্রক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে না পারে, সে জন্য থাকবে ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’। কমিশন আরও সুপারিশ করেছে, ‘আইনসভার নিম্নকক্ষের নাম হবে জাতীয় সংসদ এবং উচ্চকক্ষ সিনেট। জাতীয় সংসদের আসন হবে ৪০০। এর মধ্যে ১০০ নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত হবেন। বাকি ৩০০ বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবেন। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর ১০ শতাংশ প্রার্থী হতে হবে তরুণ।’ (সমকাল, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫) 

রাজনৈতিক দলগুলোর ১০ শতাংশ প্রার্থী হতে হবে তরুণ? এর মানে কী? রাজনীতিতে কোটা প্রথার মাধ্যমে জোর করে তরুণদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে? অবশ্যই তরুণরা রাজনীতিতে আসবেন; তাদের প্রাধান্যও দিতে হবে। ঠিক আছে, কিন্তু জোর খাটিয়ে কেন? তরুণদের যোগ্য হয়ে উঠতে হবে রাজনীতির জন্য। প্রস্তুত হতে হবে, শিক্ষায়-জ্ঞানে নিজেকে পূর্ণ করেই মাঠে নামতে হবে। যে কোটাবিরোধী আন্দোলনের মহাপরিণতি চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান, তারপর কাঙ্ক্ষিত সংস্কারলব্ধ রাজনীতিতে ‘তারুণ্যের কোটা’– তরুণ প্রজন্মের চিন্তা-চেতনার সঙ্গেই সাংঘর্ষিক। 

প্রশ্ন উঠতে পারে, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য রাজনীতিকরা কি সকলে যোগ্য? নিশ্চয়ই নয়। প্রার্থিতার যোগ্যতা সম্পর্কে রাষ্ট্রের আরও স্পষ্ট অবস্থান জরুরি। মানবতাবিরোধী আদালতে দণ্ডিতরা রাজনীতিতে নিষিদ্ধ হবেন মর্মে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছে, ঠিক আছে। তবে নির্বাচনে অবাধে অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে জিতে আসার যে রীতি, তা ভেঙে দেওয়ার সুস্পষ্ট উদ্যোগ দেখা গেল না। নির্বাচনে নির্দিষ্ট অঙ্কের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করলেই প্রার্থিতা বাতিলসহ জেল-জরিমানার শাস্তির মুখে পড়বেন সংশ্লিষ্ট প্রার্থী– এ ধরনের কঠোর নিয়ম জারি জরুরি। অবাধে কালো টাকা বানিয়ে নির্বাচনে তা ছড়িয়ে সহজে সংসদে ঢুকে আরও কালো টাকা বানানোর সহজ তরিকার চির উচ্ছেদ করতে হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীরা হলফনামায় যে হিসাব জমা দেবেন, তার ব্যত্যয় সন্ধানে বিশেষ কমিটি গঠন করতে হবে। হলফনামায় গরমিলের কারণে প্রার্থিতা বাতিলের প্রচলিত আইনকে কঠোর, গতিময় ও তাৎক্ষণিক করে তুলতে হবে। 

২.


প্রস্তাব করা হয়েছে, ২১ বছর হলে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া যাবে। না, এটি ঠিক হবে না। এই বয়সে একজন তরুণ বা তরুণী কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত; তাকে আরও গড়ে ওঠার পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। কারণ, জ্ঞান ও প্রজ্ঞাভিত্তিক সমাজই ন্যায়ভিত্তিক সমাজের সূতিকাগার। বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক কর্তব্য– ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন সম্পূর্ণ করা। শিক্ষা গ্রহণ যদি সমাজে ‘দ্বিতীয় প্রসঙ্গ’ হয়ে ওঠে, বিশেষত আমাদের মতো পশ্চাৎপদ সমাজে, তবে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে উঠবে। বিজ্ঞান, আবিষ্কার, গবেষণায় উজ্জীবিত তারুণ্যের অংশগ্রহণ আলোকিত সমাজের প্রাণ। অন্তত ২৫ বছর বা স্নাতক শেষ করেই একজন তরুণের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করা উচিত। 

৩.
‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ করার প্রস্তাবও করেছে। তবে ইংরেজি সংস্করণে ‘রিপাবলিক’ ও ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ শব্দগুলো থাকবে। 

‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ বাদ দিয়ে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দ বদল ছাড়া আর কী উদ্দেশ্যে হতে পারে? মানুষ অভিধান খুলে দেশের নাম উচ্চারণ করবে? মাতৃভাষা, জাতীয় সংগীত, দেশের নাম– আজন্ম স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার অংশ। বদলে ফেলতে হবে কেন? 

সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির মধ্যে তিনটি– জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। সেই সঙ্গে গণতন্ত্র বহাল রেখে আরও চারটি– সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ও বহুত্ববাদসহ মোট পাঁচ মূলনীতি সুপারিশ করে কমিশন বলছে, ‘১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনস্বরূপ সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে এই পাঁচটি নীতি প্রস্তাব করা হয়েছে।’ (প্রথম আলো, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫)
জনআকাঙ্ক্ষা ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে চলে গেছে বলে সংস্কার কমিশনের ধারণা। আর সমাজতন্ত্র? সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের মধ্য দিয়ে কি বোঝা যায়? সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাদ দিতে হবে কেন? জাতীয়তাবাদেই বা অনাস্থার রহস্য অগম্য। সব মিলিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের ফসল যে সংবিধান, তার মূল চার নীতির তিনটি বাদ দেওয়ার প্রস্তাব আসলে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও পরম্পরা পাশ কাটানোর অপচেষ্টা।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানের জন্ম থেকেই পূর্ব অংশের সঙ্গে পশ্চিম অংশের উপনিবেশমূলক আচরণ বৈষম্যের সৃষ্টি করে। পশ্চিম পাকিস্তানের ধারাবাহিক শোষণ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্ট বিক্ষোভ, গণঅভ্যুত্থান ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমেই স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভব; এর স্মারক সংবিধানের মূল চার নীতি। এসব বদলের চেষ্টা না করে মূল ক্ষেত্রে মনোযোগ দেওয়া উচিত সংশ্লিষ্টদের। 
মূল ক্ষেত্র, অর্থাৎ যাতে কোনো ব্যক্তি যেন দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা না হয়ে ওঠেন! ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। কেউই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়; প্রত্যেককে যথাসময়ে নির্বাচনী কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। জনতার রায় নিয়ে তাকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এই আসল কাজ সম্পূর্ণ হলেই দেশ গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা করবে। এ জন্য দেশের নাম বা সংবিধানের মূল চার নীতি বদলানোর প্রয়োজন নেই। 

মুক্তিযুদ্ধ এ দেশের অস্তিত্বের সারাৎসার– মুক্তিযুদ্ধ থেকে উদ্ভূত প্রতিটি অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা মুক্তিযুদ্ধের প্রতিও প্রত্যেককে দায়বদ্ধ করে। যিনি রাজনীতিক, তিনি যে বয়সেরই হোন না কেন, দেশের প্রতি দায়বদ্ধতাই তাঁর রাজনীতির উৎসমুখ।

মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন স প র শ কর র জন ত ক র জন ত ত ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

বৈষম্যবিরোধীদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান অগ্রহণযোগ্য

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যে গণঅভ্যুত্থান হয়, তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতার ফসল, সন্দেহ নেই। আন্দোলনটি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহের আগে নেহাতই সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা অবসানের দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল, যদিও ১৪ জুলাই দেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বক্তব্যটি আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে কয়েকজন সমন্বয়ককে ডিবি হারুনের অফিসে ধরে নিয়ে গিয়ে ‘মিডিয়া-ডিনার’ খাওয়ানোর দৃশ্য এবং সমন্বয়কদের একজনকে দিয়ে লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় আন্দোলন সমাপ্ত করার ঘোষণা দিতে বাধ্য করা জনগণের ক্রোধকে দ্রুত ঘনীভূত করে। অন্যদিকে আন্দোলন মোকাবিলার জন্য পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মাস্তান বাহিনীকে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের, যার ফলে সারাদেশে এক দিনেই শতাধিক আন্দোলনকারীর প্রাণহানি ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে কারফিউ জারি করে তা বলবৎ করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু কারফিউ প্রায় ১০ দিন চলার পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ৩ আগস্ট দুপুরে সামরিক বাহিনীর ঢাকায় অবস্থিত সব অফিসারের সভা (দরবার) ডাকেন। সভায় প্রধানত জুনিয়র অফিসাররা মতামত ঘোষণা করেন– সেনাবাহিনী জনগণের বিপক্ষে গুলি চালাবে না। সেনাপ্রধান তাদের মত মেনে নেন। সেনাবাহিনীর এই সিদ্ধান্ত জানাজানি হওয়ার পর ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিশাল সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা সরকারের পদত্যাগ চেয়ে এক দফা দাবি ঘোষণা করেন। তাদের ঘোষিত ৬ আগস্টের ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিকে এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে ৪ আগস্ট আবারও ছাত্রলীগ-যুবলীগ-পুলিশের যৌথ বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা। ওই দিনও শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। ওই দিন দেশের প্রায় ৪০০ থানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়। উপরন্তু, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় আক্রমণ চালিয়ে ১৩ জন ও নরসিংদীতে ৬ জন পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সাহস হারিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে থানা থেকে পালিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ বুঝে যায়, শেখ হাসিনার পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। 

এ প্রেক্ষাপট তুলে ধরার কারণ এটা বলা, গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মানুষের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, শেখ হাসিনাকে উৎখাত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে কারা রয়েছে– সেটা তাদের কাছে বিবেচ্য ছিল না। শেখ হাসিনার স্থানে কে ক্ষমতায় আসবে– সেটাও তাদের ভাবনায় ছিল না। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের সাড়ে পাঁচ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর জনগণের সিংহভাগ বুঝতে পারছে– বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রভাবশালী সমন্বয়কদের বড় অংশ একটি বিশেষ মতের। আন্দোলনের সময় তারা তাদের পরিচয় সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাদের অনেকেই ছদ্মবেশে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক পরিচয় পর্যন্ত ধারণ করেছিলেন। এখন শীর্ষ সমন্বয়করাই বলে বেড়াচ্ছেন, আন্দোলনের ভ্যানগার্ড ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির, যদিও লাখ লাখ জনতার মিছিল সংঘটিত করার পেছনে ছাত্রশিবিরের কোনো দলীয় তৎপরতার চিহ্নই ছিল না। 

এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে– সরকারে অন্তর্ভুক্ত ছাত্রনেতারাসহ অন্যান্য নেতৃস্থানীয় সমন্বয়ক, যারা বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে ইতোমধ্যে জনপরিসরে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন; তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিবিরের লোক। এই ব্যাপারটি এখন জাতির সামনে একটি মহাবিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে। কারণ তারা জাতির প্রধান ঐতিহাসিক অর্জন ও আদর্শ ‘মুক্তিযুদ্ধ’কে মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর বলে মনে হচ্ছে। বিষয়টি সিংহভাগ সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৭১ সালে কারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তা কারও অজানা নয়। তারা গণহত্যাকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ হিসেবে ‘আলবদর’ ও ‘আলশামস’ গঠন করেছিল। এই আলবদর ও আলশামস বাহিনীর ক্যাডাররা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ঘাতকদের সশস্ত্র সহায়তাকারী, গোয়েন্দা বাহিনী ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি নিজেরাও অত্যন্ত নৃশংস ঘাতকের ভূমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল রাও ফরমান আলীর নীলনকশা অনুসারে এই আলবদর বাহিনীর ক্যাডাররাই দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠেছিল। 

মুক্তিযুদ্ধ নিছক একটি গণঅভ্যুত্থান ছিল না। ছিল এক জনযুদ্ধ, যেখানে ধনী-গরিব-মধ্যবিত্ত সব অংশের প্রায় সব সদস্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিল। এ কথা সত্য, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে দুই বা আড়াই লাখ মানুষ। কিন্তু ভারতের মাটিতে গড়ে ওঠা শরণার্থী শিবিরের এক কোটিরও বেশি মানুষ বলতে গেলে সরাসরি এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। দেশের ভেতরে কত লাখ পরিবার যে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছে, তার কোনো হিসাব নেই। সর্বোপরি এ যুদ্ধের প্রস্তুতি চলেছে পাকিস্তানি শাসনের প্রায় ২৩ বছর ধরে। ফলে এর স্মৃতি, আবেগ ও চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলবে।
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি যদি মনে করে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী সমন্বয়কদের মদদ পেলেই তারা জনগণকে ধোঁকা দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা স্বীয় কবজায় রাখতে পারবে– তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদেরও বলতে চাই, তাদের এই বিশেষ মহলকে তোষণ এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্য ও অবস্থান দেশের সিংহভাগ জনগণ মোটেও পছন্দ করছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার কমিশনগুলো গঠন করেছে, সেগুলোর প্রতিবেদনে যদি মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার কিংবা খাটো করার কোনো প্রয়াস দৃশ্যমান হয়, তাহলে তাদেরও জনরোষ মোকাবিলা করতে হবে। সম্প্রতি ছাত্রদের ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বেশ হইচই হলো। বলা হচ্ছে, সব রাজনৈতিক দলের মত নিয়ে এই ঘোষণাপত্র সরকার দেবে। এই ঘোষণাপত্র আদৌ আলোর মুখ দেখবে কিনা, আমরা জানি না। তবে এতে যদি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন সংবিধানকে ‘ছুড়ে ফেলা’র মতো কোনো কোনো সমন্বয়কের দম্ভোক্তির প্রতিফলন ঘটে, তাহলে জনগণ এর উদ্যোক্তাদের শুধু রুখে দাঁড়াবে না, ছুড়েও ফেলতে পারে– আগেভাগেই এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করছি।

অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি                                                             

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ছাত্রলীগের ‘ভয়ংকররূপে’ ফেরার বার্তা কী বার্তা দেয়?
  • লাল, কালো, সাদার মন্ত্রে এবারের অমর একুশে বইমেলা
  • শেখ হাসিনার ফাঁসির দাবিতে চট্টগ্রামে অনশনে বৈষম্যবিরোধীরা
  • জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত সবুজের লাশ উত্তোলন 
  • গণমাধ্যম এখন নজিরবিহীন স্বাধীনতা ভোগ করছে: প্রধান উপদেষ্টা
  • গণমাধ্যম নজিরবিহীন স্বাধীনতা ভোগ করছে: প্রধান উপদেষ্টা
  • কোটি টাকা সহায়তা দাবি শহীদ পরিবারের
  • বৈষম্যবিরোধীদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান অগ্রহণযোগ্য
  • শাবিপ্রবিতে গণঅভ্যুত্থানের শহীদের স্মরণে দোয়া