বিশ্বের সামনে গাজা পুনর্বাসনের চ্যালেঞ্জ
Published: 20th, January 2025 GMT
প্রথম মেয়াদ বিভিন্ন কারণে সমালোচিত হলেও আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের আগেই ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পন্ন করলেন। ১১ জানুয়ারি তাঁর বিশেষ দূত স্টিভেন উইটকে তিনি ইসরায়েলে পাঠান। উইট প্রেসিডেন্ট নেতানিয়াহুকে তাঁর (ট্রাম্প) স্পষ্ট বার্তা ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি চান’ পৌঁছে দেন, যা প্রত্যাখ্যান করার কোনো উপায় ইসরায়েলের ছিল না। অবশেষে ১৫ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র, মিসর ও কাতারের উপস্থিতিতে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রাথমিকভাবে এ চুক্তির মেয়াদ ৬ সপ্তাহের জন্য। চুক্তির প্রথম ধাপে হামাস ৩৩ জন ইসরায়েলি বন্দি মুক্তি দেবে। একজন বন্দি মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েল ৩০ জন বন্দি মুক্তি দেবে। ১৯ জানুয়ারি স্থানীয় সময় বেলা ১১টায় চুক্তি কার্যকরের পর হামাস ৩ জন ইসরায়েলি নারী বন্দি মুক্তি দেয়।
গাজা যুদ্ধের প্রথম থেকেই সব আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তি উপেক্ষা করা হয়। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ বেসামরিক লোকজন, অ্যাম্বুলেন্স, শিশু ও বৃদ্ধদের লক্ষ্যে পরিণত করেছে। নির্বিচারে বেসামরিক জনগণ ও স্থাপনার ওপর হামলা করেছে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়া পর্যন্ত হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়াসহ (৩১ জুলাই নিহত) ৪৬ হাজার ৯১৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১ লাখ ১০ হাজার ৭৫০ জন আহত হয়। তবে যুদ্ধে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানের চেয়ে ৪১ শতাংশ বেশি বলে ৯ জানুয়ারি চিকিৎসা-বিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে গাজায় ৪ লাখ ৩৬ হাজার ভবন সম্পূর্ণ ও আংশিক ধ্বংস হয়েছে, যা গাজার মোট ভবনের ৭০ শতাংশ। গাজার ২৩ লাখ অধিবাসীর মধ্যে ১৯ লাখ অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত (আইডিপি) অথবা প্রতিবেশী দেশে উদ্বাস্তু (শরণার্থী) হয়েছে, যা গাজার মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ। গাজার ৬৭ শতাংশ আবাদি জমি ৮৫ হাজার টন বোমার বিস্ফোরণে এখন চাষাবাদের অযোগ্য। গাজার অবশিষ্ট হাসপাতালগুলোর ৫০ শতাংশই বন্ধ অথবা বন্ধপ্রায়, যা জ্বালানি অনিশ্চয়তা না কাটালে বন্ধ হয়ে যাবে যে কোনো সময়।
জেনেভা কনভেনশন (১৯৪৯) অনুসারে যুদ্ধ বা আন্তর্জাতিক সংঘাতে যুদ্ধাহত, যুদ্ধবন্দি এবং বেসামরিক মানুষ ও স্থাপনার নিরাপত্তা দিতে কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী ১৯৬টি দেশগুলো অঙ্গীকারবদ্ধ। কনভেনশন অনুসারে যুদ্ধকালে সাংস্কৃতিক সম্পত্তি ও ঐতিহ্য, ধর্মীয় কেন্দ্র/উপাসনালয়, হাসপাতাল, সশস্ত্র বাহিনীর মেডিকেল ইউনিটের যানবাহন, অ্যাম্বুলেন্স, রেড ক্রস স্থাপনা ইত্যাদির সুরক্ষা প্রদানে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো অঙ্গীকারবদ্ধ। উপরন্তু কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী যুদ্ধে লিপ্ত রাষ্ট্রগুলো আরও কিছু বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যেমন আহত সৈন্যের সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং নির্বিঘ্ন ওষুধ, পানি, খাদ্য পরিবহন ইত্যাদি। বাস্তবে আইডিএফ অ্যাম্বুলেন্স, মসজিদ, চার্চ, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ঐতিহাসিক স্থাপনা, স্কুল, বাড়িঘরসহ বেসামরিক স্থাপনা সবকিছুতেই আক্রমণ করছে। অনেকবার আইডিএফ ত্রাণ পরিবহনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। কেবল বেসামরিক জনগণই শুধু নয়, হত্যা করেছে ১৩ হাজার ৩১৯ শিশুকে। বেঁচে থাকা ৯০ শতাংশ শিশু এখন পুষ্টিহীনতার শিকার।
আইডিএফের আগ্রাসনে নিহত হয়েছে ১ হাজার ৬০ জন চিকিৎসক এবং ৩৪১ জন ত্রাণকর্মী। এমনকি মৃত সৈন্য ও বেসামরিক মানুষকেও অসম্মান দেখিয়ে গাড়ির সামনে ঝুলিয়ে ছুটে চলে জেনেভা কনভেনশনকে উপেক্ষা করেছে। উল্লেখ্য, ইসরায়েল ১৯৫১ সালে জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষর করে। আইডিএফ শরণার্থীদেরও নিরাপদ থাকতে দেয়নি। অধিকাংশই একাধিকবার স্থানান্তরিত হয়েছেন, যা ১৯৫১ সালের জাতিসংঘ রিফিউজি কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কনভেনশনের প্রথম অঙ্গীকারই– শরণার্থীদের নিজ আশ্রয়স্থল থেকে বিতাড়িত করা যাবে না; তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
যুদ্ধবিরতি শুরু হলেও যুদ্ধ শেষ হয়নি। ইসরায়েল ও হামাস উভয়ই একে অন্যকে হুমকি দিয়েছে– যুদ্ধবিরতির শর্ত পূরণ না হলে যে কোনো সময় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘিত হবে। এমনই পরিস্থিতিতে গাজার ৯১ শতাংশ মানুষ এখন খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে আছে। যুদ্ধে গাজার ৫ হাজার ৩২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (৯৫ শতাংশ) ধ্বংস হয়েছে। ফলে ৬ লাখ ৬০ হাজার শিশু এখন শিক্ষাবঞ্চিত। গাজার ১৯ লাখ আইডিপি বা উদ্বাস্তু বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকলেও তাদের ঘর এখন শুধুই ধ্বংসস্তূপ; জাতিসংঘের হিসাব অনুসারেই তা পরিষ্কার করতে কমপক্ষে ১৫ বছর সময় লাগবে।
আশা করা যায়, জাতিসংঘ, রেড ক্রস ও সব আন্তর্জাতিক সংস্থা এখন গাজা পুনরুদ্ধারে (রিকভারি) এগিয়ে আসবে। দীর্ঘ ১৫ মাস অমানবিকতার শিকার গাজাবাসীর জন্য এখন প্রয়োজন নিরাপদ বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্য নিরাপত্তা। পাশাপাশি প্রত্যেক মানুষের জন্য দরকার মনোসামাজিক সহায়তা (সাইকো-সোশ্যাল সাপোর্ট-পিএসএস), যে কোনো দুর্যোগ-পরবর্তীকালীন পুনরুদ্ধার উদ্যোগে যা অগ্রাধিকারযোগ্য। জাতিসংঘের এক হিসাব অনুযায়ী, গাজার ১০ লাখ শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা দরকার। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে পিএসএস আইডিএফ সদস্যদের জন্যও প্রযোজ্য। গণমাধ্যমের সংবাদে বলা হয়েছে, গাজায় আগ্রাসনের জন্য অনুশোচনায় ভুগছে ইসরায়েলি সৈন্যরা; এমনকি ৩৮ জন আইডিএফ সদস্য আত্মহত্যা করেছে। অনেকে মানবতাবিধ্বংসী যুদ্ধে অংশ নিতে অস্বীকার করেছে। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন ও অঙ্গীকার অনুসারে তাদেরও (যারা যুদ্ধে আর অংশগ্রহণ করবে না) সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে সাময়িক নয়, স্থায়ী যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সংলাপ অব্যাহত রাখা চাই, যাতে নতুন করে আর মানবতা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি না হয়।
এম.
ও মানবিক-বিষয়ক বিশ্লেষক
halim_64@hotmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র জন য প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
ইউক্রেনে জেলেনস্কির বিকল্প নেতা খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র!
ইউক্রেনে শান্তিচুক্তির জন্য দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির পদত্যাগ করা লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালৎস। তিনি বলেছেন, ‘ইউক্রেনের একজন নেতা প্রয়োজন, তিনি আমাদের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন। তিনি শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করতে পারবেন এবং এই যুদ্ধ থামাতে পারবেন।’ খবর- সিএনএন
গণমাধ্যমের সামনেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির নজিরবিহীন বাগবিতণ্ডার পর এ কথা বললেন তিনি। বাগবিতণ্ডার এ ঘটনাটি নিয়ে নানা আলোচনা চলছে বিশ্বজুড়ে। ওই ঘটনার পর ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে ঐতিহাসিক চুক্তি হওয়ার কথা ছিল, সেটিও বাতিল হয়ে যায়। আর এর পরই ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কোন পথে, তা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা।
এই প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। শুক্রবারের ওই ঘটনায় সাবেক ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গড়া ওয়াশিংটন-কিয়েভ সম্পর্ক ভেঙে পড়েছে। এই প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে আবারও এক টেবিলে বসার ইঙ্গিত দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন ও রাশিয়া-দুই পক্ষই আলোচনায় না বসলে যুদ্ধ থামবে না। হোয়াইট হাউসে শুক্রবার ট্রাম্প-জেলেনস্কি বিতণ্ডার পর থেকে ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আর কথা হয়নি। যুদ্ধ থামানোর জন্য রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে আনতে হবে। তবে তাদের প্রতি বৈরী মনোভাব রাখলে, মস্কোকে আলোচনায় যুক্ত করা সম্ভব হবে না। কোনো চুক্তি করার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই মনোভাবই দেখিয়ে আসছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, সবকিছু আবার শুরু হতে পারে। আশা করি, তিনি (জেলেনস্কি) এটা বুঝতে পারবেন যে আমরা আসলে আরও হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর আগে, তাঁর দেশকে সাহায্যের চেষ্টা করছি।’