দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই পুলিশ সম্পর্কে  উঁচু বা ইতিবাচক ধারণা পোষণকারী মানুষ খুব বেশি নেই। বাংলাদেশও তার মধ্যে পড়ে। দীর্ঘ দিনের ঔপনিবেশিক শাসনের লিগ্যাসি থেকে বেরিয়ে আসতে দেশগুলোর শাসকগোষ্ঠীর অনীহা এবং সামগ্রিকভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব প্রধানত এর জন্য দায়ী। কারণ এ পরিস্থিতি প্রশাসনের মতো পুলিশ বাহিনীর মধ্যেও পেশাদারিত্ব গড়ে উঠতে দেয় না। তা কোনো বাহিনীর মধ্যে জনগণের প্রতি দায় ও দরদও গড়ে তোলে না।  তবুও এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কোনো বিপদ-আপদ বা দুর্ঘটনা ঘটলে মানুষ সবার আগে পুলিশকেই স্মরণ করে। আশা করে, পুলিশ তার সাহায্যে এগিয়ে আসবে। এর পেছনে কারণ হলো, আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পুলিশই হলো জননিরাপত্তা বিধান ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রথম ও প্রধান হাতিয়ার। এ প্রেক্ষাপটে পুলিশকে বলা যায় এক প্রকার নেসেসারি ইভিল বা প্রয়োজনীয় বালাই; যাকে ছাড়ানোও যায় না, আবার ছেড়েও থাকা যায় না।

এই উপমহাদেশে পুলিশ বাহিনীর গোড়াপত্তন হয় ১৮৬১ সালের ৫ নম্বর আইনের মাধ্যমে, যাকে সাধারণ মানুষ ‘পাঁচ আইন’ নামেই জানে। সেই  সময় থেকেই পুলিশ বাহিনী সরকারের আজ্ঞাবহ লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করে আসছে। শুধু পুলিশ কেন; ঔপনিবেশিক ধারায় সৃষ্ট সব সংস্থাই কাজটি করেছে। কিন্তু দিন শেষে পুলিশের দোষই মানুষ বেশি দেখে। পুলিশ মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় সরাসরি সম্পৃক্ত, সরকারের আর কোনো সংস্থা তা নয়। বলা যায়, পুলিশের বিকল্প কেবলই পুলিশ।

পুলিশ সম্পর্কে যত নেতিবাচক কথাই বলা হোক,  ১৯৭১ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঊষালগ্নে পুলিশ বাহিনীই রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে ৩০৩ রাইফেল হাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। পরবর্তী ৯ মাসের  মুক্তিযুদ্ধেও কয়েক হাজার পুলিশ সদস্য শহীদ হয়েছেন। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস লিখতে গেলে অবশ্যই এসব পুলিশ সদস্যকে স্মরণ করতে হবে। 
স্বাধীন বাংলাদেশে এত ত্যাগ-তিতিক্ষার পুলিশ বাহিনী নিঃসন্দেহে অনেক জনঘনিষ্ঠ হতে পারত। কিন্তু দুঃখজনক, স্বাধীনতার পর যারাই ক্ষমতায় এসেছে তারাই পুলিশকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছে, যা আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনামলে অত্যন্ত ন্যক্কারজনক হয়ে ওঠে। তারা পুলিশকে অনেকটা দলীয় ক্যাডার বাহিনীতে পরিণত করে, যার চরম রূপ দেখা গেছে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে ব্যাপক নিহত-আহতের ঘটনায়। 

ওই আন্দোলনের সময় পুলিশের বিরুদ্ধে  আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার সঙ্গে নির্মম আচরণের অভিযোগ যেমন উঠেছে, একইভাবে উচ্ছৃঙ্খল জনতা কর্তৃক পুলিশের ওপর আক্রমণের অভিযোগও কম নয়। আন্দোলনের সময় সরকারি হিসাবে ৪২ পুলিশ নিহত হওয়ার কথা বলা হলেও, অনেকের মতে, সংখ্যাটা কয়েক হাজার। অভ্যুত্থানের নেতৃস্থানীয়রাই টেলিভিশন টকশোতে স্বীকার করেছেন– পুলিশ হত্যা না করলে নাকি অভ্যুত্থান সফল হতো না। এই সময়ে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে ১৩ পুলিশ সদস্যের মৃত্যু সম্পর্কে স্থানীয় এক বিএনপি নেতা সেদিনও অনুরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এমনকি খোদ রাজধানীতে অফ-ডিউটি পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করে বিদ্যুতের খাম্বার সঙ্গে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এসবের ফলে সার্বিকভাবে পুলিশ বাহিনীর মাঝে এক ধরনের ট্রমা জন্ম নিয়েছে, যার রেশ এখনও চলমান। তাদের পরিবার-পরিজনও এ ট্রমা থেকে মুক্ত নয়। এখনও অনেকের মাঝে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এমন আতঙ্ক কাজ করা স্বাভাবিক যে, ভবিষ্যতে অন্য কোনো সরকারের সমর্থকরা তাদের বর্তমান সরকারের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে! এ অবস্থায় তাদের পক্ষে স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন যে কঠিন, তা বলাই বাহুল্য। 

আইনসংগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বহু ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে সংশ্লিষ্ট আসামি ও তার স্বজনের কাছ থেকে এখনও বিগত সরকারের দোসর আখ্যা পেতে হয়। বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে ছাত্র মিছিলে পুলিশের বর্বরোচিত হামলা যে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের ওই তকমা থেকে বাঁচার কৌশল নয়, তা-ই বা কে বলতে পারে!

কথিত দুর্বৃত্তের হাতে পুলিশ সদস্যের প্রাণ হারানো কিন্তু এখনও বন্ধ হয়নি। গত ৯ জানুয়ারি নেত্রকোনার দুর্গাপুরে দুর্বৃত্তদের এলোপাতাড়ি কোপে মো.

শফিকুল ইসলাম (৪৮) নামে এক পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। একই দিনে শরীয়তপুরের জাজিরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আল-আমিনের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ (সমকাল, ৯ জানুয়ারি)। পুলিশ একে আত্মহত্যা বললেও জনমনে অন্য সন্দেহ বিরাজমান। কারণ যা-ই হোক, এসব ঘটনা যে পুলিশ সদস্যদের মাঝে গভীরতর ভীতির জন্ম দিচ্ছে– তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই পুলিশ বাহিনীতে কার্যকর সংস্কার আনতে হলে আগে এ ট্রমা থেকে তাদের বের করে আনতে হবে।

এও মনে রাখা দরকার, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়ের সঙ্গে, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী সবকিছুকে উপযোগী করে তোলার নামই সংস্কার। এটি কোনো ওয়ান স্ট্রোক বা এক ধাক্কায় শেষ করার মতো পদক্ষেপ নয়। হঠাৎ এক দিনে বা এক বছরে সবকিছু বদলে দেওয়া যাবে না। তাই এই মুহূর্তে দরকার পুলিশ বাহিনীকে স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে আনা। সরকার, পুলিশ ও জনগণ– এই তিনটি  সত্তা যদি পরস্পরকে আস্থায় নিতে না পারে তাহলে পুলিশ বাহিনীর ট্রমা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। 

স্বীকার্য, ঔপনিবেশিক লিগ্যাসি এবং দলীয়করণের কারণে অনেক পুলিশই বিতর্কিত কাজে জড়িয়ে গেছে। তা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে গোটা ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে, যেখানে সব ধরনের প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠে পুলিশকে পুলিশের মতো কাজ করতে দেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাদের যেন অতীতের মতো কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর লাঠিয়াল হিসেবে কাজ না করতে না হয়, সে জন্য উপযুক্ত আইনি সুরক্ষাও দরকার। কোনো অপারেশনের রোগীকে যেমন যে কোনো সার্জারি বা অপারেশনের আগে তার শারীরবৃত্তীয় স্বাভাবিকতা নিশ্চিত করতে হয়, তেমনি পুলিশ প্রশাসনেও যে কোনো ধরনের সংস্কার সাধন করতে গেলে প্রথমেই পুলিশকে জুলাই-আগস্ট ট্রমা থেকে বের করে আনতে হবে।

মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ 
কর্মকর্তা ও কলাম লেখক
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প ল শ সদস য সরক র র

এছাড়াও পড়ুন:

রোজা শুরুর আগেই লেবু শসা ও বেগুনে উত্তাপ

অন্য বছরের তুলনায় এবার রোজার আগে বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম বলা চলে এক প্রকার স্বাভাবিক। তবে কয়েকটি পণ্যে রোজার আঁচ লেগেছে। বিশেষ করে এ তালিকায় রয়েছে লেবু, বেগুন, শসাসহ ইফতারিতে ব্যবহার হয় এমন পণ্য। চাহিদা বাড়ার সুযোগে পণ্যগুলোর দর কিছুটা বেড়েছে।

শুক্রবার ছুটির দিনে কারওয়ান বাজারসহ রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে এমন চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। শনিবার চাঁদ দেখা গেলে রোববার থেকে শুরু হবে পবিত্র মাহে রমজান। এর আগে সবাই অগ্রিম বাজার করে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। এর কিছুটা প্রভাবও পড়েছে বাজারে।

খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা বলেন, এখন লেবুর মৌসুম নয়। ফলে প্রায় এক মাস ধরে দর বাড়তি। এ ছাড়া বেগুন, শসাসহ যেগুলোর দাম বেড়েছে তার মূল কারণ ক্রেতাদের বেশি পরিমাণে কেনা। রোজার আগমুহূর্তে প্রতিবছরই এসব পণ্যের দর বাড়ে। তবে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে সামনের দিনগুলোতে দর বাড়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে করেন তারা।

শরবত তৈরির অন্যতম উপাদান লেবু। রমজানে ইফতারে কমবেশি সবাই শরবত খাওয়ার চেষ্টা করেন। ফলে লেবুর চাহিদা বেড়ে যায়। আর এ সুযোগে বাড়তি দাম নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে প্রতি হালি শরবতি বা সুগন্ধি লেবু বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা এবং আকারভেদে অন্য লেবুর হালি বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকায়। মাসখানেক আগে অন্তত ১০ থেকে ১৫ টাকা কমে কেনা গেছে লেবুর হালি। তবে এখনও বাড়লেও গত বছরের এ সময়ের তুলনায় কিছুটা কম রয়েছে দাম।

কারওয়ান বাজারের পাইকারি লেবু ব্যবসায়ী জালাল আহমেদ সমকালকে বলেন, লেবুর উৎপাদন কম। কারণ, এখন লেবুর মৌসুম নয়। তাছাড়া অনেক দিন ধরে বৃষ্টিপাত নেই। এ জন্য ফলন ভালো হচ্ছে না। সেজন্য বাজারে লেবু কম আসছে। কিন্তু রোজার কারণে মানুষ আগেভাগে লেবু কিনছেন। মূলত এ জন্য দর বাড়তি।

বাজারে এখন ভরপুর শসা রয়েছে। হাইব্রিড ও দেশি শসার পাশাপাশি ছোট আকারের খিরাও পাওয়া যাচ্ছে। হাইব্রিড শসা ও খিরার কেজি ৪০ থেকে ৬০ টাকা কেনা গেলেও দেশি জাতের শসা কিনতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা। সপ্তাহখানেক আগে এসব শসা অন্তত ১০ থেকে ৩০ টাকা কমে কেনা গেছে। অবশ্য, এ দর গেল রমজানের চেয়ে বেশ কম। গত বছর এ সময় শসার কেজি সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ছুঁয়েছিল।

এখনও টমেটোর ভর মৌসুম চলছে। ফলে বাজারে দেশি টমেটোর পর্যাপ্ত সরবরাহ দেখা গেছে। সেজন্য দাম এখনও নাগালে। কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৪০ টাকায়।
বেগুনি তৈরি করতে লম্বা বেগুনের দরকার হয়। সেজন্য রোজার সময় লম্বা বেগুনের চাহিদা বেড়ে যায়। যার প্রভাব পড়েছে দামে। পাঁচ-ছয় দিন আগেও প্রতি কেজি লম্বা বেগুন কেনা গেছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। প্রায় দ্বিগুণের মতো দর বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। তবে পাড়া-মহল্লায় ভ্যান থেকে কিনতে গেলে ক্রেতাকে কেজিতে বাড়তি গুনতে হচ্ছে অন্তত আরও ১০ টাকা। বছরের অন্য সময়ে গোল বেগুনের দর বেশি থাকলেও এখন স্বাভাবিক। প্রতি কেজি কেনা যাবে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়।

কারওয়ান বাজারের খুচরা সবজি বিক্রেতা ইয়াকুব আলী বলেন, এখনও শীতের সবজিতে বাজার ভরপুর। লম্বা বেগুনের চাহিদা বেশি। এ কারণে কেউ কেউ দর বেশি নিচ্ছে। তবে অন্য জায়গায় দর বাড়লেও কারওয়ান বাজারে বাড়েনি বলে দাবি করেন এই বিক্রেতা।

গাজরের সরবরাহ রয়েছে বেশ ভালো। ফলে দর বাড়ার তালিকায় উঠতে পারেনি মিষ্টি জাতীয় সবজিটি। প্রতি কেজি গাজর কেনা যাচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। গত বছরের তুলনায় এ বছর কম দরে মিলছে পেঁয়াজ। মানভেদে দেশি প্রতি কেজি পেঁয়াজ কেনা যাচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়।

রমজানে কাঁচামরিচের চাহিদা বেশি থাকে। তবে এবার ঝালজাতীয় পণ্যটির দর নাগালের মধ্যেই রয়েছে। কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকায়। মাস দুই-তিনেক ধরে এ দরের আশপাশেই বিক্রি হচ্ছে মরিচ।

এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ও ঢাকা বিভাগীয় প্রধান বিকাশ চন্দ্র দাস সমকালকে বলেন, রোজা উপলক্ষে রোববার থেকে ঢাকা মহানগরে ১০টি বিশেষ তদারকি দল মাঠে নামবে। তারা বিভিন্ন বাজারে তদারকি করবে। রমজানজুড়ে চলবে এ তদারকি কার্যক্রম। রোববার সকালে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কারওয়ান বাজারে এ তদারকি কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • প্রেমিকার সাবেক স্বামীর ফাঁদে প্রাণ গেছে তাজকীরের
  • সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও পুরোপুরি কার্যকর হয়নি: রিজভী
  • কাজ না করে আবহাওয়ার দিকে তাকিয়ে কর্মকর্তারা
  • বিজিএমইএ নির্বাচনে ৬৯০ ভুয়া ভোটার
  • ভারতের কারণে অস্ট্রেলিয়ার পর দ. আফ্রিকাও গেল দুবাইতে
  • কখনও বলিনি আমি আর অভিনয় করব না: নাঈম
  • রোজা শুরুর আগেই লেবু শসা ও বেগুনে উত্তাপ