তারুণ্য এক দেশলাইয়ের কাঠির মতো। দেশলাই কাঠিতে লুকিয়ে থাকে এমন ক্ষমতা, যা বারুদের সংস্পর্শে এসে জ্বালিয়ে দিতে পারে যে কোনো কিছু। তদ্রূপ তারুণ্যের কর্মক্ষমতা কাজে লাগাতে পারলে অনেক বড় কিছু সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু আমাদের তারুণ্যের অবস্থা কী?
গত বছর পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি, বাংলাদেশের প্রায় ৪১ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়। কাজ কিংবা শিক্ষা– কোনোটার সঙ্গেই নেই তারা। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলওর প্রতিবেদনে এসেছে, বাংলাদেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক শ্রমবাজারের বাইরে। তাদের প্রতিবেদনেও এসেছে, কোনো রকম কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে নেই ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এই কর্মক্ষম মানুষের উল্লেখযোগ্য অংশই তরুণ। তরুণ-তরুণীরা বেকারত্বের বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে বলে আইএলওর বক্তব্য, উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে তারা তুলনামূলক বেশি পিছিয়ে আছে, যা অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সামাজিক সুবিচার ব্যাহত করছে।
গত বছর ৪১ শতাংশ নিষ্ক্রিয় তরুণের খবর প্রকাশ হলে আমি ‘তারুণ্যের নিদারুণ অপচয় এবং আমাদের অসহায়ত্ব’ শিরোনামের নিবন্ধ লিখেছিলাম (সমকাল, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)। আমি বলেছিলাম, আমাদের অসহায়ত্ব এখানেই যে, আমরা মানবজীবনে সবচেয়ে কর্মক্ষম তারুণ্যের সময়কে কাজে লাগাতে পারছি না। বেকারত্বের সাম্প্রতিক যে হার আমরা দেখছি, তা বেদনাদায়ক। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বিবিএসের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, দেশে সাড়ে ২৬ লাখ বেকার। বাস্তবে সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি।
মানুষ বোঝা নয়; সম্পদ। আমাদের এ জনসম্পদকে কাজে লাগাতে না পারার কারণে অনেকে তাদের বোঝা হিসেবে দেখছেন। অথচ তারুণ্যের সম্ভাবনা বিশ্বব্যাপীই আমরা কাজে লাগাতে পারি। গত বছরের আগস্ট মাসে নিউজউইক ‘ম্যাপ রিভিলস কান্ট্রিজ উইথ ডিজঅ্যাপিয়ারিং পপুলেশন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে দেখানো হয়, বিশ্বের ৪০টি দেশে জনসংখ্যা বাড়ার বদলে কমছে। অর্থাৎ অনেক দেশ প্রয়োজনীয় জনসম্পদ পাচ্ছে না; আর আমরা জনসম্পদ থাকলেও তা কাজে লাগাতে পারছি না। এ যেন ‘হায়রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ’। বর্তমান বাস্তবতায় জনসম্পদের পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক চিত্র ও শ্রমবাজার সামনে রাখা জরুরি।
বর্তমানে এমনিতেই অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে ভাটা পড়ায় নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। আবার কর্মক্ষম ও দক্ষ অনেকে প্রত্যাশিত চাকরি না পেয়ে কাজে ঢুকছেন না। অনেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পরও চাকরির প্রস্তুতিতে কয়েক বছর সময় ব্যয় করে ফেলছেন। বিপুল অধিকাংশ তরুণ কর্মসংস্থান হিসেবে চাকরিকেই যখন ‘ক্যারিয়ার’ হিসেবে গ্রহণ করছেন তখন হতাশাও বাড়ছে। কারণ তারুণ্যের প্রধান ‘আকর্ষণ’ সরকারি চাকরিতে পদসংখ্যা নগণ্য। আবার সরকারি অনেক পদ খালি থাকা সত্ত্বেও সেগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। বেকারত্ব কমাতে হলে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা যেমন দরকার, তেমনি এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক বাধা দূর করা এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো জরুরি। এ বিষয়ে আমি লিখেছি, কর্মসংস্থানের সামাজিক বয়ান ভাঙা দরকার (সমকাল, ৩০ অক্টোবর ২০২৪)। কিন্তু কর্মক্ষম জনসংখ্যার হিসাবটা থাকা চাই। দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যার অর্ধেকই হিসাবের বাইরে থাকার মানে হলো, তারা পরিকল্পনারও বাইরে। কেবল তরুণ জনগোষ্ঠী নিয়ে একটা শুমারি বা জরিপ হতে পারে। ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের পরিসংখ্যান সঠিকভাবে সামনে এলে সেভাবে তাদের নিয়ে চিন্তা করা সম্ভব। শিক্ষার ধাপে ধাপে প্রাথমিক, মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক থেকে যেমন শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ে। ঝরে পড়ারাই অনেক সময় হিসাবের বাইরে থেকে যায়। আবার উচ্চ মাধ্যমিকের পর যেভাবে অধিকাংশই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চায়; সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজে পড়ে হলেও গ্র্যাজুয়েট হতে চায়; তা নিয়েও ভাবতে হবে। সবার জন্য স্নাতক শেষ করা জরুরি কিনা কিংবা সেভাবে তাদের চাকরির বাজার প্রস্তুত কিনা, তা ভাবা দরকার। কারণ সাধারণত স্নাতক অনেকেই উদ্যোক্তা হওয়াসহ অনেক কাজ করতে এক ধরনের ‘লজ্জা’ বোধ করেন। ফলে চাকরির পেছনে ঘুরতে গিয়ে বেকার থাকেন এবং এরাও হিসাবের বাইরে থাকেন। আমাদের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও একে আকর্ষণীয় করা যায়নি কেন, তাও ভাবতে হবে।
আইএলও তার প্রতিবেদনে যথার্থই বলেছে, কর্মক্ষম মানুষকে কাজে লাগাতে না পারলে তাতে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সামাজিক সুবিচার ব্যাহত হয়। কর্মক্ষম মানুষ কাজ করতে পারলে একদিকে যেমন তার নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার বদল হয়, তেমনি তার মাধ্যমে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রও উপকৃত হয়। আবার কেউ কাজ করতে বিদেশে গেলে তিনি দেশে যে রেমিট্যান্স পাঠান তাতেও রাষ্ট্র উপকৃত হয়। অর্থনীতির স্বার্থেই তাদের কাজের সুযোগ জরুরি। অন্যদিকে কাজের সুযোগ না পেলে তা সবার জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে এইভাবে– অনেকে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে পারেন। কাজ ও চাকরি না পাওয়ার কারণে অনেকে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে আত্মহননের পথও বেছে নেন। সে জন্যই রাষ্ট্রকে জরুরি ভিত্তিতে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। পারিবারিক সহায়তায় এবং নিজেদেরও উদ্যমী মানসিকতা থাকলে কাজ পাওয়া কঠিন হবে না।
মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
দুর্ঘটনায় আহত অভিনেত্রী খুশি, চোখের ওপর পড়েছে ১০ সেলাই
দুর্ঘটনার শিকার হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন ছোটপর্দার অভিনেত্রী শাহনাজ খুশি। বুধবার সকালে রমনা পার্ক থেকে বাড়ি ফেরার সময় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ধাক্কায় তিনি আহত হন। অভিনেত্রীর ছেলে সৌম্য জ্যোতি সমকালকে বিষয়টি জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, বুধবার সকালে আম্মু রমনা পার্কে হাটতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে বাসায় ফেরার সময় গলির মধ্যে একটি অটোরিকশা তাকে ধাক্কা দিলে আম্মু ছিটকে পড়ে যায় এবং তার ঠিক চোখের ওপর জখম হয়। পরে দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সিটি স্ক্যানসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়েছে। এখন তিনি আপাতত ভালো আছেন।’
এদিকে কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুর্ঘটনার বিষয়টি জানান শাহনাজ খুশি। সেখানে তিনি বলেন, ‘বেশি না, মাত্র ১০টা সেলাই পড়েছে। এ আর এমন কি বলেন? চোখটা অন্ধ হয় নাই, হয় নাই ব্রেইন হ্যামারেজের মত শেষ অবস্থা! সেটাই তো অনেক বেশি পাওয়া! এ তেমন কিছু না, চোখের উপরের সেনসেটিভ জায়গায় মাত্র ১০ টা সেলাই লেগেছে! আমি যে প্রাণে বেঁচে আছি এ জন্য মহান সৃষ্টিকর্তা কাছে শুকরিয়া আদায় করছি!’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘কিচ্ছু চাই না আমি, শুধু যে মায়েরা/বাবারা ছোট্ট বাচ্চাটার হাত ধরে রাস্তা পার হয়ে স্কুলে আসেন অথবা নানান প্রয়োজনে রাস্তায় যান, তাদের সতর্ক করতে পোস্টটা দিলাম। আমি হয়ত ভেঙেচুরে বেঁচে গেছি। কোন বাচ্চা এ আঘাত নিতে পারবে না! ব্যাটারি চালিত অসভ্য/বর্বর যানবাহনটি এবং তার অসভ্য চালক থেকে সর্বদা সতর্ক থাকবেন। যদিও আমি গলির ভেতরের রাস্তায়, প্রাতঃ ভ্রমণ শেষে অতি সর্তকতার সাথেই একেবারে কিনার দিয়ে হেঁটে ফিরছিলাম! ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বীরদর্পে চলে গেছে! ওরা মেধাবী যান চালক, কারো জীবনের ক্ষতির তোয়াক্কা করে না! আপনার এবং আপনার সন্তানের দায়িত্ব একান্তই আপনার। আজ চারদিন পরও মাথার অর্ধেকে কোন বোধশক্তি নাই!
সবশেষে তিনি লিখেছেন, ‘জানি না স্বাভাবিক চেহারায় ফিরবো কিনা, সেটা যদিও ফিরি রক্তাক্ত সেই পথে পড়ে থাকা সকালের ট্রমা অনেককাল ভুলবো না! কাতর অবস্থায় বিছানায় পরে থেকে বারবার একটা প্রশ্ন মনে আসছে, এই যে যত্রতত্র কুপিয়ে জখম, ট্রেন-বাস, রিকশা কিংবা প্রাইভেট গাড়িতে দিনেরাতে ছিনতাই। কার কাছে চাইব আমাদের সন্তানদের নিরাপদ পথচলা।’