পূর্বাচলে বিশেষায়িত হাসপাতালের জন্য চীনকে জমি দিতে চায় সরকার
Published: 19th, January 2025 GMT
চীনের সহযোগিতায় ঢাকার পূর্বাচলে একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণের জন্য জমিসহ অন্যান্য সুবিধা দিতে প্রস্তুত বাংলাদেশ।
রবিবার (১৯ জানুয়ারি) পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ও চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের সৌজন্য সাক্ষাতে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, পররাষ্ট্র উপদেষ্টার চীন সফরে রেল, স্বাস্থ্য ও পানি বিষয়ক সহযোগিতাকে গুরুত্ব দেবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশি নাগরিকদের উন্নতমানের চিকিৎসার জন্য চীনের কুনমিংয়ে তিন থেকে চারটি অত্যাধুনিক হাসপাতাল নির্ধারণ করে দেওয়ার অনুরোধ জানাবে ঢাকা। বাংলাদেশ রেলওয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগের আওতায় যাত্রীদের জন্য আরও রেলওয়ে কোচ যুক্ত করার জন্য চীনের সহায়তা চাইবেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
আলোচনায় চীনের রাষ্ট্রদূত জানান, চীনা ঋণের সুদের হার কমানোর বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে বেইজিং।
বৈঠকে চীনা রাষ্ট্রদূত উপদেষ্টাকে ২০ থেকে ২৪ জানুয়ারি চীনে তার প্রথম আসন্ন দ্বিপক্ষীয় সফরের বিষয়ে অবহিত করেন। রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার নেতৃত্বে আনুষ্ঠানিক আলোচনার সময় চীনা নেতাদের সঙ্গে আলোচনার বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত করেন।
আলোচনায় উপদেষ্টা বিভিন্ন বিভাগে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা সম্প্রসারণের গুরুত্বও তুলে ধরেন। তিনি বাংলাদেশ রেলওয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগের আওতায় যাত্রীদের জন্য আরও রেলওয়ে কোচ যুক্ত করার জন্য চীনের সহায়তা কামনা করেন।
স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, ঢাকার পূর্বাচলে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশেষায়িত চীনা হাসপাতাল তৈরি করার জন্য জমি এবং অন্যান্য সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত রয়েছে বাংলাদেশ। চীনের কুনমিংয়ে অন্তত তিন থেকে চারটি শীর্ষ স্থানীয় হাসপাতাল মনোনীত করার জন্য অনুরোধ করেছেন, যাতে বাংলাদেশি নাগরিকরা সেখানে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা নিতে পারেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করেন, আহত শিক্ষার্থীরা দ্রুত চীনে তাদের চিকিৎসা পাবেন।
চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে চীন সবকিছুই করবে।
রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে আরো জানান, আসন্ন সফরের সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাঠানো জলবিদ্যুৎ সংক্রান্ত তথ্য বিনিময়ের বাস্তবায়ন পরিকল্পনা সংক্রান্ত সমঝোতা স্বাক্ষর করতে চীন প্রস্তুত।
সফরের গুরুত্ব তুলে ধরে রাষ্ট্রদূত উপদেষ্টাকে জানান, তার দেশের জনগণ চীনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে স্বাগত জানাতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। চীন বাংলাদেশের সবসময়ের পরীক্ষিত বন্ধু এবং সরকার নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে। তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন যে চীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সম্মান করে।
তিনি বলেন, চীন বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা, সংস্কার এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও উন্নয়ন উদ্যোগের জন্য তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখবে।
ভালো বন্ধু ও প্রতিবেশীর চেতনায় বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে চীন জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের তাদের মাতৃভূমিতে দ্রুত প্রত্যাবাসনে তার সমর্থন অব্যাহত রাখবে।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য রোডম্যাপ তৈরির গুরুত্বের ওপর আলোকপাত করে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ আশা করে চীন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য একটি শক্তিশালী ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে।
চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে মো.
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ চীনে বাংলাদেশি পণ্যের ১০০ শতাংশ শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধার প্রশংসা করে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এ বাজারে প্রবেশাধিকার ২০২৯ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
ঢাকা/হাসান/এনএইচ
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর পরর ষ ট র উপদ ষ ট র জন য চ ন উপদ ষ ট ক সহয গ ত
এছাড়াও পড়ুন:
বৈষম্যবিরোধীদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান অগ্রহণযোগ্য
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যে গণঅভ্যুত্থান হয়, তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতার ফসল, সন্দেহ নেই। আন্দোলনটি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহের আগে নেহাতই সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা অবসানের দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল, যদিও ১৪ জুলাই দেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বক্তব্যটি আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে কয়েকজন সমন্বয়ককে ডিবি হারুনের অফিসে ধরে নিয়ে গিয়ে ‘মিডিয়া-ডিনার’ খাওয়ানোর দৃশ্য এবং সমন্বয়কদের একজনকে দিয়ে লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় আন্দোলন সমাপ্ত করার ঘোষণা দিতে বাধ্য করা জনগণের ক্রোধকে দ্রুত ঘনীভূত করে। অন্যদিকে আন্দোলন মোকাবিলার জন্য পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মাস্তান বাহিনীকে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের, যার ফলে সারাদেশে এক দিনেই শতাধিক আন্দোলনকারীর প্রাণহানি ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে কারফিউ জারি করে তা বলবৎ করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু কারফিউ প্রায় ১০ দিন চলার পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ৩ আগস্ট দুপুরে সামরিক বাহিনীর ঢাকায় অবস্থিত সব অফিসারের সভা (দরবার) ডাকেন। সভায় প্রধানত জুনিয়র অফিসাররা মতামত ঘোষণা করেন– সেনাবাহিনী জনগণের বিপক্ষে গুলি চালাবে না। সেনাপ্রধান তাদের মত মেনে নেন। সেনাবাহিনীর এই সিদ্ধান্ত জানাজানি হওয়ার পর ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিশাল সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা সরকারের পদত্যাগ চেয়ে এক দফা দাবি ঘোষণা করেন। তাদের ঘোষিত ৬ আগস্টের ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিকে এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে ৪ আগস্ট আবারও ছাত্রলীগ-যুবলীগ-পুলিশের যৌথ বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা। ওই দিনও শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। ওই দিন দেশের প্রায় ৪০০ থানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়। উপরন্তু, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় আক্রমণ চালিয়ে ১৩ জন ও নরসিংদীতে ৬ জন পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সাহস হারিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে থানা থেকে পালিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ বুঝে যায়, শেখ হাসিনার পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এ প্রেক্ষাপট তুলে ধরার কারণ এটা বলা, গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মানুষের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, শেখ হাসিনাকে উৎখাত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে কারা রয়েছে– সেটা তাদের কাছে বিবেচ্য ছিল না। শেখ হাসিনার স্থানে কে ক্ষমতায় আসবে– সেটাও তাদের ভাবনায় ছিল না। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের সাড়ে পাঁচ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর জনগণের সিংহভাগ বুঝতে পারছে– বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রভাবশালী সমন্বয়কদের বড় অংশ একটি বিশেষ মতের। আন্দোলনের সময় তারা তাদের পরিচয় সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাদের অনেকেই ছদ্মবেশে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক পরিচয় পর্যন্ত ধারণ করেছিলেন। এখন শীর্ষ সমন্বয়করাই বলে বেড়াচ্ছেন, আন্দোলনের ভ্যানগার্ড ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির, যদিও লাখ লাখ জনতার মিছিল সংঘটিত করার পেছনে ছাত্রশিবিরের কোনো দলীয় তৎপরতার চিহ্নই ছিল না।
এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে– সরকারে অন্তর্ভুক্ত ছাত্রনেতারাসহ অন্যান্য নেতৃস্থানীয় সমন্বয়ক, যারা বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে ইতোমধ্যে জনপরিসরে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন; তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিবিরের লোক। এই ব্যাপারটি এখন জাতির সামনে একটি মহাবিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে। কারণ তারা জাতির প্রধান ঐতিহাসিক অর্জন ও আদর্শ ‘মুক্তিযুদ্ধ’কে মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর বলে মনে হচ্ছে। বিষয়টি সিংহভাগ সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৭১ সালে কারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তা কারও অজানা নয়। তারা গণহত্যাকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ হিসেবে ‘আলবদর’ ও ‘আলশামস’ গঠন করেছিল। এই আলবদর ও আলশামস বাহিনীর ক্যাডাররা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ঘাতকদের সশস্ত্র সহায়তাকারী, গোয়েন্দা বাহিনী ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি নিজেরাও অত্যন্ত নৃশংস ঘাতকের ভূমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল রাও ফরমান আলীর নীলনকশা অনুসারে এই আলবদর বাহিনীর ক্যাডাররাই দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠেছিল।
মুক্তিযুদ্ধ নিছক একটি গণঅভ্যুত্থান ছিল না। ছিল এক জনযুদ্ধ, যেখানে ধনী-গরিব-মধ্যবিত্ত সব অংশের প্রায় সব সদস্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিল। এ কথা সত্য, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে দুই বা আড়াই লাখ মানুষ। কিন্তু ভারতের মাটিতে গড়ে ওঠা শরণার্থী শিবিরের এক কোটিরও বেশি মানুষ বলতে গেলে সরাসরি এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। দেশের ভেতরে কত লাখ পরিবার যে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছে, তার কোনো হিসাব নেই। সর্বোপরি এ যুদ্ধের প্রস্তুতি চলেছে পাকিস্তানি শাসনের প্রায় ২৩ বছর ধরে। ফলে এর স্মৃতি, আবেগ ও চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলবে।
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি যদি মনে করে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী সমন্বয়কদের মদদ পেলেই তারা জনগণকে ধোঁকা দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা স্বীয় কবজায় রাখতে পারবে– তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদেরও বলতে চাই, তাদের এই বিশেষ মহলকে তোষণ এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্য ও অবস্থান দেশের সিংহভাগ জনগণ মোটেও পছন্দ করছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার কমিশনগুলো গঠন করেছে, সেগুলোর প্রতিবেদনে যদি মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার কিংবা খাটো করার কোনো প্রয়াস দৃশ্যমান হয়, তাহলে তাদেরও জনরোষ মোকাবিলা করতে হবে। সম্প্রতি ছাত্রদের ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বেশ হইচই হলো। বলা হচ্ছে, সব রাজনৈতিক দলের মত নিয়ে এই ঘোষণাপত্র সরকার দেবে। এই ঘোষণাপত্র আদৌ আলোর মুখ দেখবে কিনা, আমরা জানি না। তবে এতে যদি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন সংবিধানকে ‘ছুড়ে ফেলা’র মতো কোনো কোনো সমন্বয়কের দম্ভোক্তির প্রতিফলন ঘটে, তাহলে জনগণ এর উদ্যোক্তাদের শুধু রুখে দাঁড়াবে না, ছুড়েও ফেলতে পারে– আগেভাগেই এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করছি।
অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি