Samakal:
2025-01-31@13:03:05 GMT

জনপ্রশাসন সংস্কার কোন পথে?

Published: 19th, January 2025 GMT

জনপ্রশাসন সংস্কার কোন পথে?

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের গন্তব্য কোথায়?
মোসলেহ উদ্দিন আহমদ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরই রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি ওঠে। ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সংস্কারের রূপরেখা নির্ধারণের জন্য সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে এখন পর্যন্ত মোট ১১টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ইতোমধ্যে প্রকাশ হয়েছে। আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন আগামী ৩১ জানুয়ারি তাদের রিপোর্ট দেওয়ার কথা। 


প্রাসঙ্গিকভাবে বিগত তিন দশকে বিশ্বব্যাপী নানা দেশের সরকার কর্তৃক গৃহীত জনপ্রশাসন সংস্কার বা প্রশাসনিক সংস্কারের প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করা দরকরা। তাদের প্রস্তাবে আমরা মূলত কয়েক ধরনের অভিলক্ষ্য দেখতে পাই– ১.

‘মিনিমাম গভর্নমেন্ট, ম্যাক্সিমাম গভর্ন্যান্স’ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারের আকার ও পরিসর কমিয়ে বেসরকারিকরণ/আউটসোর্সিংয়ে গুরুত্ব প্রদান, ২. আর্থিক ক্ষমতা ও প্রশাসনিক কর্তৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণ, ৩. সরকারি আমলাতন্ত্রের দক্ষতা বৃদ্ধি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং মনোজাগতিক পরিবর্তন ঘটিয়ে জনস্বার্থ সংরক্ষণকারীতে রূপান্তর, ৪. বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অধিদপ্তরের পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসসহ কাঠামোগত পরিবর্তন, ৫. সরকারি কর্মের অধিকতর দক্ষ ব্যবস্থাপনা, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা আনয়ন।


বিশ্বব্যাপী সংস্কার কমিশনের অভিলক্ষ্যগুলোর সঙ্গে আমাদের জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের অভিলক্ষ্য তুলনা করলে এটি পরিষ্কার হবে যে, আমাদের কমিশনের মনোযোগ ও পরিধি তুলনামূলকভাবে সংকীর্ণ। এটা ঠিক যে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা ভিন্নতার কারণে একেক দেশের সংস্কার এজেন্ডা একেক রকম হওয়াই স্বাভাবিক। তথাপি আমাদের দেশের সংস্কার কমিশনের এই সংকীর্ণ মনোযোগের পেছনে রয়েছে অন্য একাধিক কমিশন, যেমন– পুলিশ সংস্কার কমিশন, নির্বাচন সংস্কার কমিশন; যাদের লক্ষ্যের সঙ্গে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের কাজের তাত্ত্বিক ওভারল্যাপ আছে। পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যেসব সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে এবং তাদের পূর্ববর্তী কাজের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে সেটা অনুসরণের প্রবণতা থেকেও এই সংকীর্ণতার জন্ম হতে পারে।


প্রশ্ন হলো, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের এই ‘স্কোপ’ বা পরিধি কি কমিশন গঠনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য– বিদ্যমান বাংলাদেশকে নতুন বাংলাদেশে রূপান্তর অর্জনে সহায়ক হবে? দক্ষতা, নিরপেক্ষতা, জবাবদিহিতা ও জনকল্যাণমনস্কতার বাইরে কি আমলাতন্ত্রে আর কোনো সমস্যা আছে; যেটি কাঙ্ক্ষিত নতুন বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
যেহেতু কমিশন এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের রিপোর্ট দাখিল করেনি সেহেতু কমিশন গঠনের সময় প্রজ্ঞাপনে উল্লিখিত ‘স্কোপ’-এর বাইরে আর কী কী লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে কমিশন কাজ করছে, সেটি বলা দুষ্কর। আশ্চর্যের বিষয় হলো, রিপোর্ট দাখিলের আগেই গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে আমরা কিছু সম্ভাব্য প্রস্তাবের কথা কমিশনপ্রধান ও সদস্য সচিবের মুখ থেকে জানতে পেলাম। এর মাঝে উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ৫০% এবং অন্যান্য ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ৫০% কর্মকর্তাকে উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান নিয়ে ক্যাডার কর্মকর্তারা দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা উপসচিব পদে শতভাগ পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার দাবি তোলেন এবং তাদের বক্তব্য অনুসারে কমিশনের এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে সরকারি কর্মে ক্যাডার বৈষম্য কমবে। অন্যদিকে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের দাবি হলো, উপসচিব পদ শতভাগ প্রশাসন ক্যাডারের সহজাত পদ। ফলে তাদের মতে অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের এই পদে পদোন্নতি পাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের জন্য বৈষম্যমূলক।


পাল্টাপাল্টি দাবির এই ডামাডোলে যে প্রশ্নটি হারিয়ে গেছে, তা হলো ৫০-৫০ এই বণ্টন কমিশনের কোন অভিলক্ষ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত? তারপরও ৫০-৫০ বণ্টনের প্রাসঙ্গিকতা এ মুহূর্তে বাংলাদেশে প্রশ্নাতীত। সেই প্রাসঙ্গিকতা ধরে এই বিতর্কের একটু ভেতরে ঢোকা আবশ্যক। বাংলাদেশ সরকারের নীতি প্রণয়ন করে মূলত মন্ত্রণালয় বা বিভাগসমূহ যার মূল নেতৃত্ব থাকে মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রীর হাতে আর সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে কর্মরত কর্মকর্তারা সরকারের পলিসি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণে মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রীকে সহায়তা করেন। যেহেতু দেশের উন্নয়ন, সরকারি সেবার মান, শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা, সামাজিক বৈষম্য হ্রাস ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় লক্ষ্যমাত্রার বিষয়ে নীতি প্রণয়নের সঙ্গে উপসচিব পদে কর্মরত কর্মকর্তারা যুক্ত থাকেন, সেহেতু এই পদে কর্মরতরা কেমন হবেন– এই বিষয়ে আমাদের ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে।


তাই নীতি প্রণয়নে সহায়তাকারী উপসচিব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মেধা প্রাধান্য পাবে, প্রাসঙ্গিক অভিজ্ঞতা যার সাথে পলিসিমেকিংয়ের সংযোগ আছে, সেই অভিজ্ঞতা প্রাধান্য পাবে, প্রাধান্য পাবে দক্ষতা। এই প্রাধান্যগুলোর পাশাপাশি সব ক্যাডারের প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করা গেলে তা হবে সোনায় সোহাগা। যেসব দেশে পলিসি বাস্তবায়নকারীদের মধ্য থেকেই পলিসি প্রণয়নে সহযোগীদের বাছাই করা হয়, যেমন– ভারত ও পাকিস্তান সেসব দেশে উপসচিব বা সমতুল পদে নিজ নিজ দেশের প্রশাসন ক্যাডার/সার্ভিসের সদস্যদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। ভারতে উপসচিব পদে ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের (আইএএস), (যা বাংলাদেশের প্রশাসন ক্যাডারের সমতুল্য) সদস্যদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। একইভাবে পাকিস্তানে পাকিস্তান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের (পিএএস) কর্মকর্তাদের সচিবালয়ের উচ্চ পদে প্রাধান্য দেওয়া হয়। একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সিভিল সার্ভিসে স্পেশালিস্টদের জন্যও পলিসি প্রণয়নে উচ্চ পদে যুক্ত হওয়ার সুযোগ ক্রমেই বাড়ছে। সেই হিসেবে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে বিদ্যমান ২৫% নিয়োগের যৌক্তিকতাও বিদ্যমান। এই বিবেচনা করে এই বিষয়ে করা রিট মামলায় আপিল বিভাগ ইতোমধ্যে বিদ্যমান বণ্টনকেই সাম্যমূলক ও যৌক্তিক বলে রায় দিয়েছেন।


এই হার ৫০ শতাংশ হলে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য, বিশেষ করে নবীন কর্মকর্তাদের জন্য একটা বৈষম্য সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। ক্যাডার অফিসারদের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা ৫ম (পঞ্চম) গ্রেডে উপসচিব পদে পদোন্নতি পান। তারা ৫ম গ্রেডে আর অন্য কোনো পদে পদোন্নতি পান না। ৫ম গ্রেড বা তদূর্ধ্ব পদে যেতে হলে তাদের উপসচিবের পদসোপান অতিক্রম করা বাধ্যতামূলক। অন্যদিকে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য যেমন পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ৫ম গ্রেডে পদোন্নতির দুটো সুযোগ থাকে, একটি পুলিশ সুপার পদে এবং অন্যটি উপসচিব পদে। ফলে সুযোগের সংখ্যা বিবেচনা করলে এখানে একটি বৈষম্য স্পষ্ট। 

অধ্যাপক ড. মোসলেহ উদ্দিন আহমদ: লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
muslehua@du.ac.bd
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সরক র র প রণয়ন মন ত র

এছাড়াও পড়ুন:

মানুষের মতো আইনগত অধিকার পেল নিউজিল্যান্ডের পাহাড়

মানুষের মতো আইনগত অধিকার পেল নিউজিল্যান্ডের একটি পাহাড়। বহু বছর পর এমন আইন প্রণয়ন করা হয়। এর মানে তারানাকি মাউঙ্গা (মাউন্ট তারানাকি) নিজের মালিকানা কার্যকরভাবে পাবে। এটি পরিচালনায় একসঙ্গে কাজ করবে স্থানীয় উপজাতি, ইউয়ি এবং সরকারের প্রতিনিধিরা। খবর বিবিসির

এই আইন প্রণয়নের লক্ষ্য উপনিবেশ আমলে তারানাকি অঞ্চলে ভূমি বাজেয়াপ্ত, অবিচারের শিকার হওয়া মাওরিরা ক্ষতিপূরণ দেওয়া।

আলোচনার জন্য সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী পল গোল্ডস্মিথ বলেছেন, ‘অতীতের ভুলের কারণে যে বেদনা রয়ে গেছে, তা আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। যাতে ইউয়িদের নিজস্ব আকাঙ্ক্ষা ও সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করে তাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমরা সহায়তা করতে পারি।’

গত বৃহস্পতিবার জীবন্ত সত্তা ঘোষণার তারানাকি মাউঙ্গা কালেক্টিভ রিড্রেস বিলটি নিউজিল্যান্ডের পার্লামেন্টে পাস হয়। তাতে পর্বতটি একটি আইনি নাম পেয়েছে এবং এর আশপাশের চূড়া ও জমিকে দেওয়া হয়েছে সুরক্ষা।

পর্বত, পূর্বপুরুষ, জীবিত প্রাণীসহ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে যে মাওরি বিশ্বদর্শন রয়েছে, সেটির স্বীকৃতি মিলেছে বিলটি পাসের মধ্য দিয়ে।

রাজনৈতিক দল থে পাথি মাওরির (মাওরি পার্টি) সহ-নেতা ডেবি নারওয়ে-প্যাকা বলেন, ‘আমাদের মাউঙ্গা টুপুনা (পূর্বপুরুষের পর্বত) অবিচার, অজ্ঞতা ও ঘৃণার শৃঙ্খল থেকে আজ মুক্তি পেয়েছে।’

নারওয়ে প্যাকা নিউজিল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে আটজন তারানাকি ইউয়িদের মধ্যে একজন, যার কাছে পর্বতটি পবিত্র। এলাকাটির আরও শত শত মাওরি নাগরিক বৃহস্পতিবার পার্লামেন্টে উপস্থিত হয়েছিলেন বিলটির আইনি রূপান্তর দেখতে।

বিবিসি লিখেছে, পর্বতটি আর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘এগমন্ট’ নামে পরিচিত হবে না, যে নামটি ১৮ শতকে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ পরিব্রাজক জেমস কুক। এখন এটি ‘তারানাকি মাউঙ্গা’ নামে পরিচিত হবে। আর চারপাশ ঘিরে থাকা জাতীয় উদ্যানটিও পাবে মাওরি নাম।

যে চুক্তির মাধ্যমে নিউজিল্যান্ড একটি দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আদিবাসীরা জমি ও সম্পদের নির্দিষ্ট অধিকার পেয়েছিল; সেই ওয়েটাঙ্গি চুক্তি লঙ্ঘনের জন্য ক্ষতিপূরণের সর্বশেষ প্রয়াস তারানাকি মাউঙ্গা বন্দোবস্ত।

১৮৬০ এর দশকে তারানাকি পর্বত এবং স্থানীয় মাওরিদের কাছ থেকে ১০ লাখেরও বেশি একর জমি বাজেয়াপ্তের ঘটনায় সরকারের তরফে ক্ষমা প্রার্থনার অংশ হিসেবেও দেখা হচ্ছে এই বন্দোবস্তকে।

পল গোল্ডস্মিথ স্বীকার করেছেন যে, ‘চুক্তি লঙ্ঘনের অর্থ হল হোয়ানু (বৃহত্তর পরিবার), হাপু (উপ-উপজাতি) এবং তারানাকির ইউয়ির ব্যাপক পরিসরের ক্ষতি; যা বহু দশক ধরে অপূরণীয় হয়ে দাঁড়ায়।’

তিনি আরও বলেন, পর্বতটিতে প্রবেশাধিকার আর পরিবর্তন হবে না এবং নিউজিল্যান্ডের সব বাসিন্দা এই জায়গাটি পরিদর্শন করতে পারবে এবং আগামী প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্দান্ত এ জায়গাটি উপভোগ করতে পারবে। 

নিউজিল্যান্ডে এর আগেও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের জীবন্ত সত্তার স্বীকৃতি পাওয়ার নজির রয়েছে। ২০১৪ সালে উরেওয়েরা বন প্রথম এই জাতীয় মর্যাদা অর্জন পায়। এরপর ২০১৭ সালে এমন স্বীকৃতি পায় হোয়াংগানুই নদী।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মানুষের মতো আইনগত অধিকার পেল নিউজিল্যান্ডের পাহাড়