আদিবাসীদের স্বীকৃতি ও তাদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ১৮৩ নাগরিকের বিবৃতি
Published: 19th, January 2025 GMT
সমকাল প্রতিবেদক
পাঠ্যপুস্তকে ও সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দাবি এবং আদিবাসীদের ওপরে হামলা ও আক্রমণের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন ১৮৩ জন বিশিষ্ট নাগরিক। আজ রোববার গণমাধ্যমে পাঠানো এক নাগরিক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমরা দেশের সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনাবলিতে উদ্বিগ্ন। নিম্নস্বাক্ষরকারী নাগরিকরা একটি উগ্র জাতিবাদী ভুঁইফোঁড় সংগঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দসম্বলিত গ্রাফিতি সরিয়ে ফেলা, বিক্ষোভরত আদিবাসী ছেলেমেয়ের ওপরে সংগঠনটির সন্ত্রাসীদের ন্যক্কারজনক আক্রমণ এবং এর প্রতিবাদে ‘সংক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা’র শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ বাহিনীর হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
বলা হয়েছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর ভর করে জেঁকে বসা আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ ছিল পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের। ফ্যাসিবাদী শাসকের পতন ঘটেছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার এখনো অবসান ঘটেনি। অভ্যুত্থানের পরে উগ্র জাতিবাদী ফ্যাসিবাদী শক্তিকে নব উদ্যমে পাহাড়ে আগ্রাসন চালাতে দেখা যাচ্ছে। গত বছর ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালায় সেটেলার বাঙালির আক্রমণে ও সেনাবাহিনীর গুলিতে চার জন আদিবাসী মর্মান্তিক হত্যার শিকার হন। আদিবাসীদের বাড়িঘর, দোকানপাট ও বৌদ্ধ বিহারে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়।
এতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ও ২৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে বান্দরবানের লামা উপজেলার ত্রিপুরা পাড়ার আদিবাসীরা পাশের পাড়ায় বড়দিনের উৎসবে গেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয় পাড়ার ১৭টি ঘর। রাষ্ট্রীয় মদদে আমাদের দেশের আদিবাসীদের ওপরে তীব্র আক্রমণ-নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ঢাকায় আমরা ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ নামে একটি ভুঁইফোঁড় উগ্র জাতিবাদী সংগঠনের আবির্ভাব দেখতে পারছি, যারা নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ এবং রচনা পাঠ্যপুস্তকের পেছনের প্রচ্ছদ থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দসম্বলিত গ্রাফিতি সরিয়ে ফেলার দাবি জানায়।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এনসিটিবি সেই গ্রাফিতি সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। একই সঙ্গে এনসিটিবি চেয়ারম্যান গণমাধ্যমে জানান, ‘.
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, উদাহরণস্বরূপ, তৃতীয় শ্রেণির শিশুদের পাঠ্য ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ে রয়েছে, ‘আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলাদেশের মানুষ বাংলায় কথা বলে…। এছাড়াও অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষাও রয়েছে।’ পাঠ্যপুস্তকের এই অপরায়ন ও বৈষম্যের মূলে রয়েছে ১৯৭২ সালে প্রণীত ও ১৭ বার সংশোধিত জাতিবাদী সংবিধান, যেখানে আদিবাসীদের জাতিসত্ত্বার কোনো স্বীকৃতি নেই। যেখানে আদিবাসীদের পরিচিত করা হয়েছে ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী, সম্প্রদায়’ হিসেবে।
আরও বলা হয়েছে, ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ নামক উগ্র জাতিবাদী সংগঠনটি ফ্যাসিবাদী এই সংবিধানকেই ঢাল বানিয়েছে। শুধু তাই নয়, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের স্লোগান ‘তুমি কে, আমি কে, বাঙালি বাঙালি’ বলেই তারা আদিবাসীদের ওপরে আক্রমণ চালিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ছিল যে, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বহুত্ববাদী সমাজ গঠন, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই চালানো হচ্ছে এই আক্রমণ। এ আক্রমণ কেবল উগ্র জাতিবাদী-ফ্যাসিবাদী সংগঠনটির এবং পতিত ও নব্য ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক শক্তির নয়, বরং প্রবলভাবে রাষ্ট্রশক্তিও এই আক্রমণে শরিক। তারই প্রমাণ মেলে ১৫ জানুয়ারিতে আদিবাসীদের ওপরে হামলার সময় পুলিশ বাহিনীর নির্লিপ্ত দর্শকের ভূমিকা। ১৬ জানুয়ারিতে এর প্রতিবাদে ‘সংক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা’র শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপরে পুলিশ বাহিনীর বেধড়ক লাঠিচার্জ, জলকামান, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে।
বিশিষ্ট নাগরিক বলেন, আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, ‘উপজাতি’ বা ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’র মত অবমাননাকর শব্দ সংবিধান ও পাঠ্যপুস্তক থেকে সরানোই যথেষ্ট নয়। ‘আদিবাসী’ শব্দটি কেবল ‘ভিন্ন’ বা ‘অন্যান্য’ নৃ-গোষ্ঠী দিয়ে প্রতিস্থাপনযোগ্য শব্দ নয়।
তারা আরও বলেন, আদিবাসী (indigenous) শব্দের অর্থ কোনো জাতি কত আগে থেকে একটা দেশে বাস করছে তা নয়, বরং কোনো একটি ভৌগোলিক অঞ্চলে (যেমন পার্বত্য অঞ্চলে, কিংবা সমতলের বিভিন্ন বন-জঙ্গল, চর বা দ্বীপাঞ্চলে) যারা প্রাক-ঔপনিবেশিক আমল থেকে যুগ যুগ ধরে কেবল বাসই করছে না, সে অঞ্চলের প্রকৃতির সঙ্গে শক্তিশালী বন্ধনে আবদ্ধ, যাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে। যাদের স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক, সামাজিক, এমনকি রাজনৈতিক ব্যবস্থাও টিকে আছে ও যারা নিজেদের এই স্বাতন্ত্র্য টিকিয়ে রাখতে চায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ আধিপত্যকারী জাতিগোষ্ঠী থেকে ভিন্ন যেকোনো জনগোষ্ঠী যারা নিজেদেরকে “আদিবাসী” হিসেবে পরিচত করতে চায়, তারাই ‘আদিবাসী’। ‘আদিবাসী’র এই সংজ্ঞানুসারে বাংলাদেশের আধিপত্যকারী বা প্রধান (dominant) বাঙালি জাতিকে ‘আদিবাসী’ বলার কোনো উপায় বা কারণ নেই।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমাদের আদিবাসী জাতিসমূহকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে পার্বত্য অঞ্চল বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোন আশংকাও নেই। কেননা, বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমার মধ্যেই আদিবাসীরা নিজস্ব ভূমি তথা তাদের নিজস্ব জীবন, সম্পদ ও সংস্কৃতি রক্ষার অধিকার চাইছেন। এটি তাদের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে আদিবাসীদের স্বীকৃতির বিরুদ্ধে ও তাদের অধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো আধিপত্যবাদী ও জাতিবাদী রাজনীতি বাংলাদেশের জন্যে আত্মবিধ্বংসী, যা দেশের বহুবর্ণিল ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে অস্বীকার করার মাধ্যমে শক্তিলাভ করে।
বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, সাম্প্রতিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ছবি, গ্রাফিতি, প্রতিবাদী ভাষ্য ইত্যাদি থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দটিকে মুছে দেওয়া সেই রাজনীতির অংশমাত্র। এই রাজনীতি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বকেই মানতে চায় না এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে একটি একক জাতি, জনগোষ্ঠী এবং সংস্কৃতির মালিকানায় রাখার আগ্রাসী আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে। এই রাজনীতিই বস্তুত ফ্যাসিবাদ তৈরি করে, আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মাঝে ফ্যাসিবাদকে জিইয়ে রাখে।
বিশিষ্ট নাগরিকরা মনে করেন, আমরা মনে করি, এহেন জাতিবাদী-ফ্যাসিবাদী রাজনীতির কবর রচনা করেই কেবলমাত্র জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক একটি বহুত্ববাদী সমাজ গঠন করা সম্ভব।
আমরা এই বিবৃতির মাধ্যমে নিম্নলিখিত দাবিসমূহ উত্থাপন করছি-
পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দসম্বলিত গ্রাফিতি বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সামনে আদিবাসীদের সমাবেশের ওপরে ন্যক্কারজনক হামলার সঙ্গে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। সংক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার মিছিলের ওপরে হামলাকারী পুলিশ কর্মকর্তা ও নির্দেশপ্রদানকারী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দসম্বলিত গ্রাফিতি সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে এবং এনসিটিবি’র নতজানু চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। পাঠ্যপুস্তক থেকে আদিবাসীদের অপরায়ন ও বিমানবিকীকরণের যাবতীয় প্রকাশভঙ্গি দূর করতে হবে এবং আদিবাসীদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
আদিবাসীদের যথাযথ সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। সংবিধানে নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশী পরিচয় থাকলেই চলবে না, জাতি হিসেবে বাংলাদেশের সব জাতিসত্ত্বার স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে। সংবিধানে ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’ এর বদলে ‘আদিবাসী’ পরিচয় প্রদান করতে হবে এবং সব ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও শিল্পকলাসমূহের পরিপোষণ ও উন্নয়নের পাশাপাশি আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও বিকাশের অঙ্গীকার সম্বলিত বিধান রাখতে হবে।
জাতিসংঘের ‘ডিক্লারেশন অন দ্য রাইটস অফ ইন্ডিজেনাস পিপলস’ (২০০৭) সনদে পরিপূর্ণভাবে অনুস্বাক্ষর করতে হবে। আদিবাসীদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
পার্বত্য অঞ্চল থেকে সেনাবাহিনী ও অলিখিত সেনাশাসন অপসারণ করতে হবে।
বিবৃতি যারা সাক্ষর করেছেন- মিশিগানেরগ্র্যান্ড ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটি অধ্যাপক আজফার হোসেন, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট রাহাত মুস্তাফিজ, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট অনুপম সৈকত শান্ত, লেখক ও গবেষক নাদিয়া ইসলাম, জনভাষ্যের সদস্য কৌশিক আহমেদ, অ্যাক্টিভিস্ট পূরবী তালুকদার, মার্কেটিং অফিসার, স্কয়ার ফার্মাসিটিকেলসের মার্কেটিং অফিসার তাইনুর রহমান, কবি ও অধিকার কর্মী ফেরদৌস আরা রুমী, লেখক ও সাংবাদিক আরিফ রহমান, ব্যবসায়ী জামাল আবেদীন ভাস্করসহ ১৮৩ জন নাগরিক।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
বৈষম্যবিরোধীদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান অগ্রহণযোগ্য
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যে গণঅভ্যুত্থান হয়, তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতার ফসল, সন্দেহ নেই। আন্দোলনটি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহের আগে নেহাতই সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা অবসানের দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল, যদিও ১৪ জুলাই দেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বক্তব্যটি আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে কয়েকজন সমন্বয়ককে ডিবি হারুনের অফিসে ধরে নিয়ে গিয়ে ‘মিডিয়া-ডিনার’ খাওয়ানোর দৃশ্য এবং সমন্বয়কদের একজনকে দিয়ে লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় আন্দোলন সমাপ্ত করার ঘোষণা দিতে বাধ্য করা জনগণের ক্রোধকে দ্রুত ঘনীভূত করে। অন্যদিকে আন্দোলন মোকাবিলার জন্য পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মাস্তান বাহিনীকে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের, যার ফলে সারাদেশে এক দিনেই শতাধিক আন্দোলনকারীর প্রাণহানি ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে কারফিউ জারি করে তা বলবৎ করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু কারফিউ প্রায় ১০ দিন চলার পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ৩ আগস্ট দুপুরে সামরিক বাহিনীর ঢাকায় অবস্থিত সব অফিসারের সভা (দরবার) ডাকেন। সভায় প্রধানত জুনিয়র অফিসাররা মতামত ঘোষণা করেন– সেনাবাহিনী জনগণের বিপক্ষে গুলি চালাবে না। সেনাপ্রধান তাদের মত মেনে নেন। সেনাবাহিনীর এই সিদ্ধান্ত জানাজানি হওয়ার পর ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিশাল সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা সরকারের পদত্যাগ চেয়ে এক দফা দাবি ঘোষণা করেন। তাদের ঘোষিত ৬ আগস্টের ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিকে এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে ৪ আগস্ট আবারও ছাত্রলীগ-যুবলীগ-পুলিশের যৌথ বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা। ওই দিনও শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। ওই দিন দেশের প্রায় ৪০০ থানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়। উপরন্তু, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় আক্রমণ চালিয়ে ১৩ জন ও নরসিংদীতে ৬ জন পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সাহস হারিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে থানা থেকে পালিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ বুঝে যায়, শেখ হাসিনার পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এ প্রেক্ষাপট তুলে ধরার কারণ এটা বলা, গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মানুষের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, শেখ হাসিনাকে উৎখাত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে কারা রয়েছে– সেটা তাদের কাছে বিবেচ্য ছিল না। শেখ হাসিনার স্থানে কে ক্ষমতায় আসবে– সেটাও তাদের ভাবনায় ছিল না। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের সাড়ে পাঁচ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর জনগণের সিংহভাগ বুঝতে পারছে– বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রভাবশালী সমন্বয়কদের বড় অংশ একটি বিশেষ মতের। আন্দোলনের সময় তারা তাদের পরিচয় সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাদের অনেকেই ছদ্মবেশে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক পরিচয় পর্যন্ত ধারণ করেছিলেন। এখন শীর্ষ সমন্বয়করাই বলে বেড়াচ্ছেন, আন্দোলনের ভ্যানগার্ড ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির, যদিও লাখ লাখ জনতার মিছিল সংঘটিত করার পেছনে ছাত্রশিবিরের কোনো দলীয় তৎপরতার চিহ্নই ছিল না।
এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে– সরকারে অন্তর্ভুক্ত ছাত্রনেতারাসহ অন্যান্য নেতৃস্থানীয় সমন্বয়ক, যারা বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে ইতোমধ্যে জনপরিসরে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন; তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিবিরের লোক। এই ব্যাপারটি এখন জাতির সামনে একটি মহাবিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে। কারণ তারা জাতির প্রধান ঐতিহাসিক অর্জন ও আদর্শ ‘মুক্তিযুদ্ধ’কে মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর বলে মনে হচ্ছে। বিষয়টি সিংহভাগ সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৭১ সালে কারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তা কারও অজানা নয়। তারা গণহত্যাকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ হিসেবে ‘আলবদর’ ও ‘আলশামস’ গঠন করেছিল। এই আলবদর ও আলশামস বাহিনীর ক্যাডাররা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ঘাতকদের সশস্ত্র সহায়তাকারী, গোয়েন্দা বাহিনী ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি নিজেরাও অত্যন্ত নৃশংস ঘাতকের ভূমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল রাও ফরমান আলীর নীলনকশা অনুসারে এই আলবদর বাহিনীর ক্যাডাররাই দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠেছিল।
মুক্তিযুদ্ধ নিছক একটি গণঅভ্যুত্থান ছিল না। ছিল এক জনযুদ্ধ, যেখানে ধনী-গরিব-মধ্যবিত্ত সব অংশের প্রায় সব সদস্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিল। এ কথা সত্য, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে দুই বা আড়াই লাখ মানুষ। কিন্তু ভারতের মাটিতে গড়ে ওঠা শরণার্থী শিবিরের এক কোটিরও বেশি মানুষ বলতে গেলে সরাসরি এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। দেশের ভেতরে কত লাখ পরিবার যে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছে, তার কোনো হিসাব নেই। সর্বোপরি এ যুদ্ধের প্রস্তুতি চলেছে পাকিস্তানি শাসনের প্রায় ২৩ বছর ধরে। ফলে এর স্মৃতি, আবেগ ও চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলবে।
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি যদি মনে করে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী সমন্বয়কদের মদদ পেলেই তারা জনগণকে ধোঁকা দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা স্বীয় কবজায় রাখতে পারবে– তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদেরও বলতে চাই, তাদের এই বিশেষ মহলকে তোষণ এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্য ও অবস্থান দেশের সিংহভাগ জনগণ মোটেও পছন্দ করছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার কমিশনগুলো গঠন করেছে, সেগুলোর প্রতিবেদনে যদি মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার কিংবা খাটো করার কোনো প্রয়াস দৃশ্যমান হয়, তাহলে তাদেরও জনরোষ মোকাবিলা করতে হবে। সম্প্রতি ছাত্রদের ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বেশ হইচই হলো। বলা হচ্ছে, সব রাজনৈতিক দলের মত নিয়ে এই ঘোষণাপত্র সরকার দেবে। এই ঘোষণাপত্র আদৌ আলোর মুখ দেখবে কিনা, আমরা জানি না। তবে এতে যদি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন সংবিধানকে ‘ছুড়ে ফেলা’র মতো কোনো কোনো সমন্বয়কের দম্ভোক্তির প্রতিফলন ঘটে, তাহলে জনগণ এর উদ্যোক্তাদের শুধু রুখে দাঁড়াবে না, ছুড়েও ফেলতে পারে– আগেভাগেই এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করছি।
অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি