পুঁইশাক চাষে ভাগ্য বদলেছে ত্রিশোর্ধ গৃহবধূ সুফিয়া বেগমের। গত ১০ বছর ধরে সুফিয়া গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের চুপাইর গ্রামে পুঁইশাক চাষ করছেন। তাকে দেখে এখন আগ্রহী হচ্ছেন ওই গ্রামের আশপাশের কৃষকরাও। সুফিয়ার পুঁইশাক চাষ দেখতে ও তার কাছ থেকে পরামর্শ নিতে দূর দূরান্ত থেকে আসছেন কৃষকেরা। 

পুঁইশাক চাষি সুফিয়া বেগম জানান, স্বামী মোমেন দেওয়ান, দুই ছেলে ও তাকে নিয়ে ৪ সদস্যের সংসার। পরিবার পুরোপুরি কৃষি নির্ভর। স্বামী ট্রাকটর দিয়ে নিজের জমি চাষ করার পর ভাড়ায় অন্যের জমি চাষ করে আয় করে থাকেন। পাশাপাশি স্বামীকে সহযোগীতার মানসিকতা নিয়ে তিনি পুঁইশাক চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেন। 

পর পর বেশ কয়েক বছর এই পুঁইশাক চাষে লাভবান হওয়ায় আরো বড় পরিসরে চাষ শুরু করেন। তাকে দেখে গ্রামের ও অন্যান্য এলাকার কৃষকরাও এই পুঁইশাক চাষে আগ্রহী হচ্ছে বলেও জানায় চাষি সুফিয়া। 

সুফিয়া বেগম বলেন, “আমার প্রায় ৪০ শতাংশ জমি আছে, সেখানে আমি গত ১০ বছর ধরে এই পুঁইশাকের চাষ করে আসছি। যেখান থেকে আমি প্রতি বছর ৫০ হাজার টাকা খরচ করে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা আয় করে থাকি।” 

চুপাইর গ্রামের চল্লিশোর্ধ কৃষক মঞ্জুর হোসেন বলেন, “সুফিয়া বেগম পুঁইশাকের চাষ করেছেন। প্রতি বছরই তিনি করে থাকেন এই পুঁইশাকের চাষ। এবারো তার খেতে খুব সুন্দর হয়েছে পুঁইশাক। তিনি এই পুঁইশাক বিক্রি করে খুব লাভবান হয়েছেন। আমার ইচ্ছা আছে আগামী বছর আমিও পুঁইশাকের চাষ করবো।” 

ওই গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ আরেক কৃষক মো.

ইমান আলী মোড়ল বলেন, “সুফিয়া বেগম পুঁইশাকের চাষ করে প্রচুর পরিশ্রম করছেন। প্রতি বছর এই পুঁইশাক চাষ থেকে তার ভাল আয়ও হচ্ছে। তাকে দেখে আমি উদ্বুদ্ধ হচ্ছি। আগামীতে আধা বিঘা জমিতে এই পুঁইশাকের চাষ করার ইচ্ছা আছে।” 

কালীগঞ্জ উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান বলেন, “এ উপজেলার কৃষকরা পুঁইশাকের চাষটা ব্যাপকভাবে আয়ত্ত করতে পেরেছে। এই পুঁইশাকের চাষাবাদটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই পুঁইশাক চাষিরা স্থানীয় বাজারগুলোর চাহিদা মিটিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি করতে পারছে। প্রতিদিন স্থানীয় দোলান বাজার এলাকা থেকে ট্রাক-পিকআপ ভর্তি করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যাচ্ছে।” 

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ ফারজানা তাসলিম বলেন, “একজন সুস্থ মানুষের প্রতিদিন ২০০ গ্রাম শাক-সবজি খাওয়া প্রয়োজন। এর মধ্যে ১০০ গ্রাম শাক ও ১০০ গ্রাম সবজি খেতে হয়। পুঁইশাক একটি জনপ্রিয় শাক। উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নেই শাক-সবজির চাষ হয়ে থাকে। তবে এর মধ্যে জামালপুর ইউনিয়নের কিছু কিছু গ্রাম আছে সেখানে পুঁইশাকের চাষ একটু বেশি হয়।” 

তিনি আরো বলেন, “পুঁইশাকের চাষ খুব সহজেই কৃষক করতে পারে। কৃষকদের কেউ কেউ জমিতে বিছিয়ে পুঁইশাকের চাষ করে আবার কেউ মাচা করেও এই শাকের চাষ করে থাকে। পুঁই যেহেতু শাক জাতীয় সবজি, তাই এটা থেকে আমরা বেশি পুষ্টি পাই। তবে এই পুঁইশাক চাষে রোগবালাইয়ের কিছু আক্রমণ হয়ে থাকে। বিশেষ করে পাতায় দাগ রোগটা পুঁইশাকের বেশি দেখা যায়। আমরা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে এর জন্য সব সময় পরামর্শ দিয়ে থাকি।”

ঢাকা/রফিক/ইমন

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর শ ক র চ ষ কর উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

দেখে এলাম চক্ষু মেলিয়া 

‘‘ইচ্ছে তো হয় সারাটা জীবন
এই পৃথিবীকে
এফোঁড়-ওফোঁড় করে যাই দুই
পায়ে হেঁটে হেঁটে
অথবা বিমানে...’’ 
[মানস ভ্রমণ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যয়]

আমরা বিমানেই যাব ঠিক করলাম। দিনক্ষণও ঠিক হলো। এরই মধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ক্রমে তীব্র হয়ে উঠল। অগাস্টের প্রথম দিনগুলোতে পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হলো যে, ফ্লাইট যাবে কিনা সংশয় দেখা দিলো। সংশয় দূর করার উপায় নেই! ইন্টারনেট নেই, মুঠোফোন বেজে চলে, ওপাশ থেকে রিসিভ হয় না, ‘ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া’ অফিসে গিয়ে জেনে আসব, তাতেও মনের বেজায় আপত্তি। পরিবারের আপত্তি তো আছেই- এর মধ্যে আনন্দভ্রমণ! কদাপি নহে। 

শেষ পর্যন্ত ওদের সঙ্গে সংযোগ হলো। বলল, নতুন তারিখ জানাতে। এ আরেক সংকট! আমরা মানে তিনরতœ। কথাসাহিত্যিক মুম রহমান, প্রকাশক সফিক রহমান এবং অধম এই আমি। ওদের কাজের অবসর মিললে আমার ছুটি মেলে না। আমার ছুটি মিললে ওরা বেজায় ব্যস্ত। সময় মেলানো সহজ নয়। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, সেপ্টেম্বরের শুরুতে উড়ব আমরা। ততদিনে পরিস্থিতি থিতিয়ে আসবে নিশ্চয়ই। মানুষ আশায় বাঁচে। আমরাও সেই আশায় দিন গুনতে লাগলাম।

দিন এগিয়ে আসছে। ভেতরে আনন্দের বুদ্্বুদ টের পাচ্ছি। মুম রহমান পরিকল্পনা আঁটছেন। তিনিই প্রধান পরিকল্পক। আমাদের মুরুব্বি। এরই মধ্যে আমাদের হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ খুলে ফেলেছেন সফিক রহমান। সবাই মতামত দিচ্ছেন। আমি হুঁ হ্যাঁ করছি। অন অ্যারাইভাল ভিসা। প্লেনের টিকিট কনফার্ম। হোটেল বুকিং শেষ- আর চিন্তা কি!

যাত্রার শুরুতে প্রথম কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলল বৃষ্টি। অঝোর বৃষ্টি চারপাশ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় সকালে বৃষ্টি মানেই খিচুড়ি। হেঁসেলের কথা বলছি না, রাজপথের কথা বলছি। অফিসগামী কর্মজীবীদের বিড়ম্বনার শেষ নাই। তাদের পিছু থেমে থেমে আমিও চলছি। মহাসড়কে অজগর নড়ছে না। এয়ারপোর্টের দূরত্ব কম নয়। সুনীলের কবিতা ‘এই পৃথিবীকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে যাই দুই পায়ে হেঁটে হেঁটে’ ভাবছি আর ঘড়ি দেখছি। কিন্তু বৃষ্টি তো হচ্ছে। আমি নিশ্চিত এই ঝুম বৃষ্টিতে কবি হাঁটার রিস্ক নিতেন না। তাছাড়া আমি শতভাগ নিশ্চিত কবি ঢাকার ফুটপাতের অবস্থা জানেন না। হন্টন বহুত দূর কি বাত ভায়া! পায়ের নিচে সর্ষে গড়াগড়ি খাচ্ছে, এখন খোলা ম্যানহোলে পড়ার কোনো মানে হয় না।  

যাক্ বাবা মান বেঁচেছে। আমিই এয়ারপোর্টে ফার্স্ট। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর অপর দুজনের দেখা মিলল। তারাও বাসা থেকে বেরিয়ে একই বিড়ম্বনায় পড়েছেন। যাই হোক, এয়ারপোর্টের কাজগুলো দ্রুত হাতে সারতে হলো। খুব বেশি ঝামেলা হলো না। তবে চেকিং অন্য সময়ের চেয়ে কড়াকড়ি। কিন্তু সে আমাদের জন্য নয়, যাদের জন্য তারা বুঝুক। সব দুশ্চিন্তা রেখেই তো যাচ্ছি। বলা ভালো হাফিয়ে ওঠা প্রাণে মুক্ত বাতাস লাগাতেই এই যাত্রা। বিমানের জানালা খুলে দেওয়ার উপায় নেই। ফলে অপেক্ষা করতেই হচ্ছে। তবে হ্যাঁ, রোদ উঠেছে। চারপাশে রোদের ঝিকিমিকি। আর কে না জানে, ঝুম বৃষ্টির পর রোদ একটু বেশিই চকচক করে।

নেপালের ত্রিভুবন এয়ারপোর্টের কথা শুনেছি। কবুল করছি- ভয়ও পাইয়ে দিয়েছেন অনেকে। নামার সময় বিমানের চাকা মাটি স্পর্শ করার পরপরই হ্যাচকা টানে দুলে উঠলাম। পাশের সিট থেকে মুরুব্বি ইশারা করলেন, বুঝলি কিছু? আমি গলায় আটকে থাকা ভয় চুপচাপ গিলে ফেললাম। শেষ গতিতে মার্বেলের গড়িয়ে যাওয়ার মতো খুব ধীরে এক সময় প্লেন থামল। এবার নামার অপেক্ষা। কিন্তু এ তো আর ‘মতিঝিল ৬ বনানী’ নয়। অপেক্ষা অবধারিত। ঘোষণা হবে। হ্যান্ড ব্যাগ নিতে হবে। দরজা খুলবে। মানুষ নামবে। কিন্তু না। এ দৃশ্য আমি বহুবার দেখেছি। থামার সঙ্গে সঙ্গে একদল যাত্রী উঠে দাঁড়াবে এবং দরজার সামনে গিয়ে জটলা করবে। করবেই। সিটের মাঝখানের সরু পথটুকুও তখন ঘিঞ্জি গলি।  

যত সহজ ভেবেছিলাম, এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসা তত সহজ হলো না। কোন হোটেলে উঠেছি জানাতে হবে। আমরা জানালাম। তারা মানলেন না। বুকিং রিসিট দেখাতে হবে। কিন্তু এ কথা আমাদের তো শাকিল বলেনি! 
শাকিল কে?
পরে বলছি। তখন শুধু মনে হচ্ছিল শাকিলকে পেলে দুমদুম দুটো কিল বসিয়ে দেই। কিন্তু পাবো কোথায়? সে ঢাকায় বসে এভারেস্ট জয়ের আক কষছে। সেই আমাদের নেপাল ভ্রমণের পরামর্শদাতা। এ দিকে আমাদের কারো মোবাইলে নেট নেই। থাকবে কীভাবে, কথা ছিল, এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে সিম কিনব। বিদেশ ভ্রমণে এ হলো পয়লা নম্বর কাজ। অথচ এয়ারপোর্টে জালে আটকা পড়ে আছি। ঝান্ডুদার চুঙ্গিঘরের কা- মনে পড়ল। চুঙ্গিওয়ালাকে শুধালাম, ওয়াইফাই আছে কি না? সদুত্তর পেলাম না। হোটেলের নাম বললাম, বললাম সেখানে দয়া করে ফোন করে জেনে নিন অথবা আমাদের ফোনে ধরিয়ে দিন। চুঙ্গিওয়ালা নিরুপায়। বললাম, আপনার মোবাইলটা অন্তত দিন। ওতে নিশ্চয়ই নেট আছে। চুঙ্গিওয়ালা এবার কানেই শুনতে পেলেন না। তিনি শুধু হাঁকছেন- নেক্সট। 

চোখের সামনে দিয়ে বিমানের সহযাত্রীরা একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় কে একজন বললেন, ও পাশে ল্যান্ড ফোন আছে। কথা বলতে পারবেন। কিন্তু আমাদের তো হোটেলের নম্বর মুখস্থ নাই। নামটা মনে আছে এই ঢের। বিপদে পড়ে মুরুব্বি পায়চারী করছেন। চিত্ত চঞ্চল। আমরা তার পায়ে পায়ে হাঁটছি। মুরুব্বি বললেন, ল্যান্ড ফোনেই চলবে। তিনি নেপালের এক কবিকে ফোন করলেন। পরে আমরা তার আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলাম। সে গল্প ক্রমশ প্রকাশ্য। 

আপাতত এটুকু জানিয়ে দেই, তিনিই আমাদের কাছ থেকে হোটেলের নাম জেনে নেট ঘেঁটে সেখানে ফোন করে বিপদ থেকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করেছিলেন। যাক্ মুক্তি মিলল। দুজন পাসপোর্টে সিল লাগিয়ে চুঙ্গিঘরের পরীক্ষা উতরে গেলেন। আটকে গেলাম আমি। একেই বলে ছড়কট। একবার সঙ্গী হলে কিছুতেই ছাড়ানো যায় না। 

চুঙ্গিওয়ালার কাছে প্রায় দুই ঘণ্টা নানা বিষয়ে সহযোগিতা চেয়েছি, ঋণ তো কিছু হয়েছেই। পাওনাদারের মতো মেজাজ নিয়ে তিনি আমার ভিসা ফর্ম ফিরিয়ে দিলেন। সেখানে কপাল দোষে ভিসার তারিখ ওই যে শুরুতে যে তারিখে প্লেনের টিকিট কেটেছিলাম, সেই তারিখ লেখা। এ-ও ওই শাকিলের অবদান। সে লক্ষ্য করেনি। আমি তো কানা, চোখেই দেখি না। এখন এই চুঙ্গিঘরে বসে কাকে দোষ দেব? চুঙ্গিওয়ালার মেজাজ ভালো নেই; তবুও পুনরায় শরমের মাথা খেয়ে শরণ নিলাম। তিনি হাত প্রসারিত করে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে বহুদূরে একটা বুথ দেখিয়ে দিলেন। মুখে কিছুই বললেন না। আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে সেই পানে ছুটলাম। গিয়ে দেখি লম্বা লাইন। সবাই ভিসা ফরম পূরণ করছেন। সুখ হলো এই ভেবে যে, আমিই একমাত্র ‘গারল’ নই। 

আমি লাইনে দাঁড়ালাম। অনেক দেশের হরেক মানুষ। আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট বলে কথা! ভাষা আলাদা, পোশাক আলাদা, চোখে-মুখে নানা জিজ্ঞাসা লেপ্টে আছে। কিন্তু সৌজন্য এক। কেউ কারো জন্য লাইন ছাড়তে রাজি নয়। আগে আমার কাজ তারপর তোমার। আরে ভাই, সঙ্গের দুজন চুঙ্গিঘর পেরিয়ে গেছে, আমি চোঙ্গায় আটকে আছি- এই দুশ্চিন্তা আমাকে স্থির হতে দিচ্ছে না। 

অবশেষে আমার পালা এলো। সব লিখে ফরম প্রিন্ট করে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে ফিরে এলাম চুঙ্গিওয়ালার দরবারে। কারণ তিনি আগেই বলে দিয়েছেন লাঞ্চ ব্রেকে যাবেন। নেপাল ভ্রমণ না-করতে পারায় আমার হৃদয় ভেঙে গেলে যাক, তার লাঞ্চ ব্রেক কিছুতেই মাটি করা যাবে না। আমি ফরম দিলাম। তিনি সেদিকে ফিরে তাকালেন না পর্যন্ত! খটাস শব্দ তুলে পাসপোর্টে সিল মারলেন। আমি প্লেন ল্যান্ড করার সেই হ্যাচকা টান অনুভব করলাম। ত্রিভুবন পেরিয়ে ছিটকে এসে দাঁড়ালাম এয়ারপোর্টের বাইরে। আমাকে দেখে অন্য দুজন তখনও মিটিমিটি হাসছেন। মুরুব্বি বললেন, কি রে, আগে হোটেলে যাবি, নাকি কিছু খেয়ে নিবি? আমি বললাম, আগে সিম কিনব। 

আমাদের আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল প্রথম দিন আমরা থামেলে কাটাব। সম্ভব হলে পায়ে হেঁটে আশেপাশের জায়গাগুলো ঘুরে দেখব। অর্থাৎ সেদিন বিশ্রাম নেয়াটাই মুখ্য। আমি আবার বরাবরই এ ব্যাপারে মূর্খ। বেড়াতে এসে বিশ্রাম? এসেছি যখন যতটুকু পারি দেখে নেব। কবে আবার আসা হবে ঠিক কি? মুরুব্বি বললেন, আমাদের সব কিছু ভালোভাবে দেখতে হলে আরো একদিন স্টে করতে হবে। তথাস্তু। আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আপত্তি তুললেন বিমান অফিসের কর্মকর্তা। কারণ ফেরার টিকিট তাহলে ক্যানসেল করতে হবে। গুনতে হবে জরিমানা। 

ওহে কাকে ভয় দেখাচ্ছ? অলরেডি দুবার ডেট চেঞ্জ করে জরিমানা গুনেছি, আমাকে ও ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। এসেছি ঘুরতে, ঘুরতে ঘুরতে ভাগ্য যেখানে নিয়ে যায় সেখানেই যাব। কিন্তু যাওয়ার উপায় নাই। এই প্রথম বিতৃষ্ণায় বিমানের ওপর থেকে মন উঠে গেল। ছাদে না হয় নাই যাওয়া গেল, বনেটের ওপর পশ্চাৎদ্দেশ গরম করে, দরজার পাশে রান্নাঘরের পিঁড়ির মতো সুপারভাইজারের ছোট্ট সিট দখলে নিয়ে, নিদেনপক্ষে রেলগাড়িতে ক্যান্টিনে মামারা যেমন মোড়া রাখে, হ্যান্ডশেক করার উসিলায় মুঠোর মধ্যে বিশ টাকা গুঁজে দিলে বসতে দেয়, সেরকম একটা ব্যবস্থা রাখা খুবই উচিত ছিল। 

কর্মকর্তা বললেন, ওই দিন বিমানে দুটো আসন ফাঁকা আছে। অর্থাৎ তিনজনের একসঙ্গে দেশে ফেরা হচ্ছে না।  
মুরুব্বি উঁহুহু... এ হয় না। এসেছি তিনজন, যাব তিনজন। তাহলে পরদিনের কী অবস্থা? কর্মকর্তা এবার একগাল হেসে বললেন, হ্যাঁ, সেদিন তিনটা সিট ম্যানেজ করা যাবে। বললাম, তবে তাই হোক। আমাদের পাঁচ দিনের ট্যুর এক ধাক্কায় গিয়ে ঠেকল সাতদিনে। সেভেন লাকি ডেইস।
হ্যাঁ, সৌভাগ্যই বলতে হবে। সুন্দরবন গেলেই যে আপনি বাঘের দেখা পাবেন এমন নয়। আমার এক সহকর্মী খুলনায় বড় হয়েছেন। বন নিয়ে আগ্রহ আছে। গিয়েছেন অসংখ্যবার। কিন্তু নিজ চোখে বাঘ দেখেননি। দেখেছেন বাঘের গু, পায়ের ছাপ। নেপালও তাই। গেলেই যে আপনি বরফশুভ্র হিমালয়ের পর্বতশৃঙ্গগুলো দেখতে পাবেন এমন নয়। তার জন্য সূর্যদেবকে দাঁত বের করে হাসতে হবে। মেঘের মন খারাপ থাকলে সর্বনাশ! আপনার ভ্রমণ মাটি করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। 

ওয়েদার সাতদিনই আমরা ভালো পেয়েছি। আর পেয়েছিলাম কুমারদাকে। মধ্যবয়সী ট্যাক্সি ড্রাইভার। অমাইক ভদ্রলোক! ঘুরে ঘুরে সব দেখিয়েছেন। যখন যেখানে থামতে বলেছি, বিরক্ত হননি। যা কিছু জানতে চেয়েছি সহাস্যে উত্তর দিয়েছেন। এমনকি কোন জিনিস কোথায় মুফতে মিলবে, খাবার ঠিকঠাক কোথায় পাওয়া যাবে আমাদের চিনিয়েছেন। যেতে যেতে পথেই তার কাছ থেকে জেনেছি নেপালের সংস্কৃতি। একদিন কুমারদাকে নিয়ে নাগরকোট যাচ্ছি সূর্যদয় দেখব বলে। হিমালয়ের কয়েকটি চূড়া নাগরকোট থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। কাঠমা-ু শহর থেকে এর উচ্চতা প্রায় ২ হাজার আটশ ফিট। পর্যটকরা ভোর রাতে এখানে এসে সূর্য ওঠার অপেক্ষা করেন। সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য! সূর্য উঠছে, ক্ষণে ক্ষণে রং বদলাচ্ছে প্রকৃতির। অপার্থিব সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়ছে শৃঙ্গচূড়ায়।   

ভোর হতে দেরি নেই। হাইওয়ে ফাঁকা। তারপরও কুমারদা এক্সেলেটরে চাপ দিচ্ছেন না। গাড়ির গতি সর্বোচ্চ ৪০ কিমি। এ দিকে আমি অধৈর্য সহিসের মতো নিজের পশ্চাৎদ্দেশে নিজেই চাবুক কষছি আর মনে মনে বলছি, কুমারদা গাড়ি হাঁকাচ্ছেন না কেন?
পেছনের সিটে সফিক রহমান তখনও ঘুমে ঢুলছেন। তাকে জোর করে ঘুম থেকে টেনে তুলে এনেছি। জামাকাপড় দিয়ে ভালো করে কান, গলা পেঁচিয়ে নিয়েছেন। তার ঠান্ডার ব্যামো আছে। মুরুব্বি যথারীতি চ্যাটে ব্যস্ত। তিনি যেখানেই যাচ্ছেন ছবি তুলছেন আর বিভিন্ন মোকামে সেন্ট করছেন। তাতে যে জিনিসটি হচ্ছেÑ ও মা! তুমি নেপালে কবে গেলে? আমার জন্য কিন্তু এটা আনতেই হবে। 

বোঝো ঠ্যালা! আমরা গিয়েই থামেলে উঠেছি। মুরুব্বি আমাদের তিনজনের জন্য একই রকম টি শার্ট কিনেছেন। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়। ছবি তুলে লোকজনের মাথা খারাপ করে দেওয়াÑ উস্কানিমূলক পোস্ট! এখন সেই ছবি দেখে দেশ থেকে একেকজন টি শার্টের সাইজ বলে দিচ্ছেন। মুরুব্বি এ ব্যাপারে ঝানু রাজনীতিক। কাউকেই হতাশ করছেন না। কিন্তু আমি পুরোপুরি হতাশ। গাড়ি জোরে চলছে না কেন? কুমারদাকে অভিযোগ করতেই বললেন, ‘হাজার রুপি ফাইন দেনা পারেগা। হাইওয়ে ক্যামেরা হে না ইহাপে।’  

নেপালে যে ক’দিন ছিলাম কাউকে ট্রাফিক আইন ভাঙতে দেখিনি। রাস্তা ভর্তি স্কুটি। ছেলে-মেয়ে-বুড়ো সবাই হাঁকাচ্ছে। থামেলে শুধু একদিন রিকশা দেখেছিলাম। দশ মিনিটের পথ একশ রুপি চাওয়ায় উঠিনি। এতে সে মাইন্ড করেছিল। আমিও মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম। আমরা হলাম রিকশার শহরের মানুষ। আমাদের রিকশাভাড়া শেখাতে এসো না হে- বলে দিয়েছি মুখের ওপর। (চলবে)  
 

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ