অন্তর্বর্তী সরকার সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে না
Published: 19th, January 2025 GMT
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থা সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, দেশের বিভিন্ন সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা স্বল্প সময়ের মধ্যে সম্ভব নয়। অন্তর্বর্তী সরকার সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। তারা কিছু শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। সমস্যার সমাধানে করণীয় নির্ধারণ করতে পারবে। কিন্তু গুরুদায়িত্ব ভবিষ্যৎ নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের। তাদেরই কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে।
গতকাল শনিবার ‘শ্বেতপত্র এবং অতঃপর: অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, সংস্কার ও বাজেট’ শীর্ষক দিনব্যাপী সিম্পোজিয়ামের সমাপনী অধিবেশনে তিনি এমন মন্তব্য করেন। অর্থনীতি বিষয়ে সরকার গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এর আয়োজন করে। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড.
অধ্যাপক রেহমান সোবহান তাঁর বক্তব্যে ঋণখেলাপি, অর্থ পাচার, ব্যাংক ব্যবস্থার দুরবস্থাসহ দেশের অর্থনীতির নানা দুর্বল দিকের কথা উল্লেখ করে বলেন, এর কোনোটিই নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে চলে এসেছে। বিগত ১৬ বছরের জবাবদিহি না থাকায় সমস্যাগুলো আরও ঘনীভূত হয়েছে। বিগত সরকারের অপশাসন ঋণখেলাপির বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হিসেবে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। পুরো আর্থিক খাত রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালিত হয়েছে।
সমাপনী অনুষ্ঠানের আরেক বক্তা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ঋণখেলাপিরা যাতে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন না পান, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে তাঁর দল। ক্ষমতায় এলে চলমান সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে বিএনপির ভাবনা বিষয়ে তিনি বলেন, দুই বছর আগেই তারা এ বিষয়ে জনগণের সামনে ৩১ দফা প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেছেন। এতে তারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের কথা উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর গণঅভ্যুত্থানের ফলে মানুষের একটি তীব্র আকাঙ্ক্ষা জন্মেছে, তারা পরিবর্তন চায়। জনগণ সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে চায়। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া এ প্রত্যাশা পূরণ করা বেশ কঠিন। এ জন্যই রাজনীতিতে কাঠামোগত কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ এসেছে সংস্কার কমিটির পক্ষ থেকে।
মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যারা নির্বাচন করেন না, কিন্তু দেশের উন্নয়নে সহযোগিতা করতে পারেন, তাদের দ্বিতীয় বা উচ্চকক্ষে নিয়ে আসার চিন্তা রয়েছে। নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে। নির্বাচনে যারা আসবেন এবং আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের সবাইকে নিয়ে সরকার গঠন করা হবে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা হবে।
ক্ষমতায় গেলে বিএনপি সংস্কার কার্যক্রমে করতে পারবে কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে সন্দেহ অমূলক নয়। তবে পারব না, এ কথা বলা যাবে না। চেষ্টা করতে হবে। আমরা জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ। অনেকেই আশা করছেন, ছয় মাসের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার সব পেরে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয়। তাই বিএনপি নির্বাচনে বেশি জোর দিচ্ছে।
সংস্কারের জন্য বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে ছয় মাস সময় দিচ্ছে– এ সময়টা কতটুকু যৌক্তিক অধ্যাপক রেহমান সোবহানের এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, এটা তাদের রাজনৈতিক কৌশল। আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নেওয়া-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদী কোনো গোষ্ঠী আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কিনা, সেটা জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে এ বিষয়ে তারা কিছু বলতে চান না।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সেলিম রায়হান মির্জা ফখরুলের কাছে জানতে চান, বিএনপি কি নিশ্চয়তা দিতে পারে, অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে না। এর জবাবে ফখরুল ইসলাম বলেন, অতীতের সব অভিজ্ঞতা তাদের রয়েছে। এর আলোকেই তারা পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন। দ্রুত নির্বাচন-সংক্রান্ত এক সমন্বয়কের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি বিশ্বাস করে, একটি নির্বাচনকালীন সরকারই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারে। কারণ, তারা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আসে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, যেসব প্রত্যাশা নিয়ে ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থান করেছিল, তার তেমন কিছুই পূরণ হয়নি। শেখ হাসিনার সরকার টাকা ছাপিয়ে মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দিয়েছিল, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও টাকা ছাপিয়েছে। জিনিসপত্রের বাড়তি দামে মানুষ যখন মারাত্মক চাপে, তখন সরকার ভ্যাট ও শুল্ক বাড়িয়ে জনগণের পকেট থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়ার তালে রয়েছে।
তৃতীয় অধিবেশনে অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে আলোচনায় সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. রওনক জাহান প্রশ্ন তোলেন, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের শক্তিশালী চক্রের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিতে পেরেছে বর্তমান সরকার? তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে গেলে তারা প্রভাব খাটায়। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
এ অধিবেশনে জাতীয় পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা অনেক বলা হয়। অথচ বর্তমান সরকারের সময়েও সংস্কারে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, রাজনীতিবিদদের মধ্যে দুর্নীতি আছে। সংসদ সদস্য হতে ৩০০ কোটি টাকা লাগে। এই টাকা তারা কেন খরচ করেন– এর উত্তরে সব জবাব রয়েছে। তিনি বলেন, বিনা টাকায় এমপি হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া দরকার।
আলোচনায় তেল-গ্যাস ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, শেখ হাসিনা এত পরাক্রমশালী হয়ে ওঠার পেছনে ব্যবসায়ী, আমলা এবং উন্নয়ন সহযোগীদের দায় রয়েছে। তারা গত সরকারের কাজকে উন্নয়নের ‘মিরাকল এবং আউটস্ট্যান্ডিং’ বলে হাসিনাকে শক্তি জুগিয়েছে। আমলাতন্ত্র সম্পর্কে তিনি বলেন, আমলাতন্ত্র কৃষ্ণগহ্বর। এখানে সব হারিয়ে যায়। এখানে পরিবর্তন না হলে বাকি আর কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে ড. দেবপ্রিয় বলেন, আমলারা এখনও গগনবিদারী ভূমিকা পালন করছে। তারা এখনও ক্ষমতাবান। যেখানে অর্থনীতি চাপে আছে, সেখানেও তারা এ সরকারের কাছ থেকে মহার্ঘ ভাতা আদায় করে নিতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার পররাষ্ট্রবিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, সরকারি সব অফিসে এখনও স্বৈরাচার রয়েছে। একটা ফাইল যত দিন ইচ্ছা ধরে রাখার সুযোগ রয়েছে তাদের। এ প্রসঙ্গে নির্দিষ্ট কাজ নির্দিষ্ট সময়ে করার ক্ষেত্রে ন্যাশনাল উইন্ডোর প্রস্তুতির কথা জানান তিনি।
ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড অব কোঅপারেশন ড. মিচেল ক্রিজা বলেন, বাংলাদেশকে অবশ্যই পাঁচটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো হচ্ছে– দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, তথ্য-উপাত্তের স্বচ্ছতাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নয়ন করা, বাজার অর্থনীতিকে প্রকৃত অর্থেই কার্যকর করা, পুঁজি বাজারে যাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসতে পারে, তা নিশ্চিত করা ও শ্রম অধিকার প্রশ্নে সংস্কার। তা না হলে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর ইইউতে রপ্তানিতে সমস্যায় পড়তে হতে পারে।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, শ্বেতপত্র প্রতিবেদন এবং এর সুপারিশ বাস্তবায়নে গত দেড় মাসে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বাজেটের জন্য অপেক্ষায় থাকা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না। কারণ, বাজেট হতে আরও ছয় মাস বাকি। অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য ছয় মাস অনেক লম্বা সময়। কারণ, নির্বাচন দিয়ে দায়িত্ব ছাড়তে তাদের ওপর চাপ রয়েছে। এখনই শ্বেতপত্রের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাতটি মেগা প্রকল্প পর্যালোচনা করে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি দেখেছে, ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার প্রকল্পে ১৮ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। নিজেদের লোককে সুবিধা দেওয়ার জন্যই এটা করা হয়েছ। এ রকম প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের প্রভাব যুগ যুগ ধরে থেকে যাবে। পাচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পাচারের অর্থ ফেরত আনা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। বাংলাদেশে আসা পাচারের অর্থ ফেরত দেওয়ার রেকর্ড আছে, সুতরাং বাংলাদেশও পাচারের অর্থ ফেরত পেতে পারে।
দেশে নির্বাচন ও সংস্কারকে কেন্দ্র করে বর্তমানে সংঘাতের সৃষ্টি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ড. দেবপ্রিয়। এ ছাড়া ধীরগতির প্রবৃদ্ধি, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের অভাব ও কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জকে জরুরি বিষয় হিসেবে উল্লেখ করে আসন্ন বাজেট নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার আহ্বান জানান তিনি। তাঁর মতে, প্রবৃদ্ধির হার বিশেষ করে ধীর হয়ে পড়ছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও সমস্যা বিদ্যমান।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: শ ব তপত র প র জন ত ক ব যবস থ ন সরক র সরক র র জনগণ র র জন য ত র জন সমস য ফখর ল ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
বৈষম্যবিরোধীদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান অগ্রহণযোগ্য
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যে গণঅভ্যুত্থান হয়, তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতার ফসল, সন্দেহ নেই। আন্দোলনটি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহের আগে নেহাতই সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা অবসানের দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল, যদিও ১৪ জুলাই দেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বক্তব্যটি আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে কয়েকজন সমন্বয়ককে ডিবি হারুনের অফিসে ধরে নিয়ে গিয়ে ‘মিডিয়া-ডিনার’ খাওয়ানোর দৃশ্য এবং সমন্বয়কদের একজনকে দিয়ে লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় আন্দোলন সমাপ্ত করার ঘোষণা দিতে বাধ্য করা জনগণের ক্রোধকে দ্রুত ঘনীভূত করে। অন্যদিকে আন্দোলন মোকাবিলার জন্য পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মাস্তান বাহিনীকে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের, যার ফলে সারাদেশে এক দিনেই শতাধিক আন্দোলনকারীর প্রাণহানি ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে কারফিউ জারি করে তা বলবৎ করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু কারফিউ প্রায় ১০ দিন চলার পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ৩ আগস্ট দুপুরে সামরিক বাহিনীর ঢাকায় অবস্থিত সব অফিসারের সভা (দরবার) ডাকেন। সভায় প্রধানত জুনিয়র অফিসাররা মতামত ঘোষণা করেন– সেনাবাহিনী জনগণের বিপক্ষে গুলি চালাবে না। সেনাপ্রধান তাদের মত মেনে নেন। সেনাবাহিনীর এই সিদ্ধান্ত জানাজানি হওয়ার পর ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিশাল সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা সরকারের পদত্যাগ চেয়ে এক দফা দাবি ঘোষণা করেন। তাদের ঘোষিত ৬ আগস্টের ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিকে এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে ৪ আগস্ট আবারও ছাত্রলীগ-যুবলীগ-পুলিশের যৌথ বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা। ওই দিনও শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। ওই দিন দেশের প্রায় ৪০০ থানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়। উপরন্তু, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় আক্রমণ চালিয়ে ১৩ জন ও নরসিংদীতে ৬ জন পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সাহস হারিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে থানা থেকে পালিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ বুঝে যায়, শেখ হাসিনার পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এ প্রেক্ষাপট তুলে ধরার কারণ এটা বলা, গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মানুষের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, শেখ হাসিনাকে উৎখাত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে কারা রয়েছে– সেটা তাদের কাছে বিবেচ্য ছিল না। শেখ হাসিনার স্থানে কে ক্ষমতায় আসবে– সেটাও তাদের ভাবনায় ছিল না। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের সাড়ে পাঁচ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর জনগণের সিংহভাগ বুঝতে পারছে– বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রভাবশালী সমন্বয়কদের বড় অংশ একটি বিশেষ মতের। আন্দোলনের সময় তারা তাদের পরিচয় সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাদের অনেকেই ছদ্মবেশে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক পরিচয় পর্যন্ত ধারণ করেছিলেন। এখন শীর্ষ সমন্বয়করাই বলে বেড়াচ্ছেন, আন্দোলনের ভ্যানগার্ড ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির, যদিও লাখ লাখ জনতার মিছিল সংঘটিত করার পেছনে ছাত্রশিবিরের কোনো দলীয় তৎপরতার চিহ্নই ছিল না।
এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে– সরকারে অন্তর্ভুক্ত ছাত্রনেতারাসহ অন্যান্য নেতৃস্থানীয় সমন্বয়ক, যারা বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে ইতোমধ্যে জনপরিসরে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন; তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিবিরের লোক। এই ব্যাপারটি এখন জাতির সামনে একটি মহাবিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে। কারণ তারা জাতির প্রধান ঐতিহাসিক অর্জন ও আদর্শ ‘মুক্তিযুদ্ধ’কে মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর বলে মনে হচ্ছে। বিষয়টি সিংহভাগ সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৭১ সালে কারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তা কারও অজানা নয়। তারা গণহত্যাকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ হিসেবে ‘আলবদর’ ও ‘আলশামস’ গঠন করেছিল। এই আলবদর ও আলশামস বাহিনীর ক্যাডাররা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ঘাতকদের সশস্ত্র সহায়তাকারী, গোয়েন্দা বাহিনী ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি নিজেরাও অত্যন্ত নৃশংস ঘাতকের ভূমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল রাও ফরমান আলীর নীলনকশা অনুসারে এই আলবদর বাহিনীর ক্যাডাররাই দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠেছিল।
মুক্তিযুদ্ধ নিছক একটি গণঅভ্যুত্থান ছিল না। ছিল এক জনযুদ্ধ, যেখানে ধনী-গরিব-মধ্যবিত্ত সব অংশের প্রায় সব সদস্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিল। এ কথা সত্য, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে দুই বা আড়াই লাখ মানুষ। কিন্তু ভারতের মাটিতে গড়ে ওঠা শরণার্থী শিবিরের এক কোটিরও বেশি মানুষ বলতে গেলে সরাসরি এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। দেশের ভেতরে কত লাখ পরিবার যে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছে, তার কোনো হিসাব নেই। সর্বোপরি এ যুদ্ধের প্রস্তুতি চলেছে পাকিস্তানি শাসনের প্রায় ২৩ বছর ধরে। ফলে এর স্মৃতি, আবেগ ও চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলবে।
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি যদি মনে করে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী সমন্বয়কদের মদদ পেলেই তারা জনগণকে ধোঁকা দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা স্বীয় কবজায় রাখতে পারবে– তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদেরও বলতে চাই, তাদের এই বিশেষ মহলকে তোষণ এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্য ও অবস্থান দেশের সিংহভাগ জনগণ মোটেও পছন্দ করছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার কমিশনগুলো গঠন করেছে, সেগুলোর প্রতিবেদনে যদি মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার কিংবা খাটো করার কোনো প্রয়াস দৃশ্যমান হয়, তাহলে তাদেরও জনরোষ মোকাবিলা করতে হবে। সম্প্রতি ছাত্রদের ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বেশ হইচই হলো। বলা হচ্ছে, সব রাজনৈতিক দলের মত নিয়ে এই ঘোষণাপত্র সরকার দেবে। এই ঘোষণাপত্র আদৌ আলোর মুখ দেখবে কিনা, আমরা জানি না। তবে এতে যদি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন সংবিধানকে ‘ছুড়ে ফেলা’র মতো কোনো কোনো সমন্বয়কের দম্ভোক্তির প্রতিফলন ঘটে, তাহলে জনগণ এর উদ্যোক্তাদের শুধু রুখে দাঁড়াবে না, ছুড়েও ফেলতে পারে– আগেভাগেই এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করছি।
অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি