রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনাসহ বেশ কিছু বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ যৌক্তিক বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তবে রাষ্ট্রের নাম ও মূলনীতি পরিবর্তন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রয়োজনীয়তা, প্রার্থীর বয়সসীমা ও তরুণ-তরুণীদের জন্য ১০ ভাগ প্রার্থিতা সংরক্ষণসহ বেশ কিছু বিষয়ে কমিশনের সুপারিশের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের মতে, সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সার্বভৌম। অধ্যাদেশ দিয়ে সংবিধান সংশোধন বা পরিবর্তন করা যায় না। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়টি নির্বাচিত পরবর্তী সরকারের এখতিয়ার। সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আরও আলোচনা প্রয়োজন। জনমতকেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা না হলে সংস্কারের বিষয়টি আরও জটিল হতে পারে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও এর কার্যকারিতা নিয়ে সমকালকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় আইন বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন।
বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড.
সংস্কার কমিশনের কিছু প্রস্তাবের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করে শাহ্দীন মালিক বলেন, পৃথিবীতে দেশের সাংবিধানিক নাম বদলানোর উদাহরণ খুব বেশি নেই। মূলনীতির ক্ষেত্রেও তাই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মূলনীতিতে সমাজতন্ত্র ছিল না। সেখানে এটি যুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু কোনো মূলনীতি বাতিল করা হয়নি। তবে মূলনীতির কার্যকারিতা আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য নয়। এখন যদি আমাদের মূলনীতি পরিবর্তন হয়, তা আপত্তিতেও টিকবে না। পরবর্তী সময়ে দেখা যাবে, অন্য সরকার সেটি পুনর্বহাল বা ভিন্নভাবে পরিবর্তন করবে। তাই এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যেটা বারবার বদলানোর পরিস্থিতি হয়। অর্থাৎ, মীমাংসিত বিষয়গুলো যদি পরিবর্তন করা হয়, তাহলে অনেক কিছুই অস্থিতিশীল হয়ে যাবে। এটা রাষ্ট্র বা জনগণের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন সমকালকে বলেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যসহ সংস্কার কমিশন বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। এতে কিছু ভালো সুপারিশ রয়েছে। বিএনপিও রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফা সুপারিশ করেছে। দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হওয়া যাবে না, এমন সুপারিশ আছে। এটি কমিশনের সুপারিশেও আছে। তাই কমিশনের সুপারিশ এবং বিএনপির সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই নির্বাচিত সংসদ লাগবে। তিনি আরও বলেন, সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশের বিষয়ে জনগণ কী চায়, সেটা বুঝতে হবে। আর এটি বুঝতে হলে দ্রুত নির্বাচন করা দরকার। কারণ, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাবেন রাজনীতিবিদরা।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে এখন আলোচনার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি সমকালকে বলেন, ‘সংবিধান সংশোধন যারা করছেন, অর্থাৎ বর্তমান সরকারের এটি করার কোনো ক্ষমতা নেই। সংবিধান সংশোধন কখনও অধ্যাদেশ জারি করে কার্যকর করা যায় না। তাই সংবিধানসহ অন্যান্য সংস্কার কমিশন যেসব সুপারিশ দিয়েছে, তা কার্যকর করতে হলে অবশ্যই সংসদ কার্যকর থাকতে হবে। সেখানেও এই সুপারিশগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশে কিছু বিষয় আছে যেগুলো জনগণ চায়, অর্থাৎ জনপ্রিয় ইস্যু। প্রধানমন্ত্রী দু’বারের বেশি থাকতে পারবেন না। নির্বাচন হতে হবে দল নিরপেক্ষভাবে, অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীনে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা। এই প্রস্তাবনাগুলোর জন্য কমিশন ধন্যবাদ পেতে পারে। তবে কমিশনের কিছু সংশোধনী প্রস্তাব ও সুপারিশ অত্যন্ত নিন্দনীয়।
তাঁর মতে, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পরবর্তী সরকারগুলোর মূল ভিত্তি। এটা বাদ দেওয়ার পাশাপাশি সংবিধানের প্রস্তাবনা পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। কারণ, ১৯৭০ সালের নির্বাচিত গণপরিষদ রচিত সংবিধানের প্রস্তাবনার ভিত্তিতে রাষ্ট্র কাঠামো সৃষ্টি হয়েছে। তাই এটি কখনও পরিবর্তনযোগ্য নয়। উপরন্তু মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি মুক্তিযুদ্ধের মূল স্পিরিটকে অস্বীকার করার শামিল, যা কখনও কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দেশের জনগণও এটি হতে দেবে না।
অন্যদিকে, এমনভাবে মূলনীতি প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধকালীন বাঙালির চিন্তাচেতনা সঠিক ছিল না। এসব সুপারিশের মাধ্যমে কমিশনের সংশ্লিষ্টরা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সংবিধানসহ যাবতীয় বিষয়কে বিতর্কিত করার হীন চেষ্টা চালিয়েছেন। এ ছাড়া রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংসদ গঠন থেকে শুরু করে কিছু বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানকে কপি-পেস্ট করা হয়েছে। আমাদের দেশের জনগণ এবং সার্বিক ব্যবস্থা এর জন্য উপযোগী কিনা, তা বিবেচনা করা হয়নি।
উচ্চ আদালতে সংবিধান-সংক্রান্ত একাধিক মামলার রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ কমিশনের সুপারিশ প্রসঙ্গে আরও বলেন, একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুযোগ দিতেই নির্বাচনের প্রার্থিতা ১০ ভাগ তরুণ-তরুণীর জন্য সংরক্ষণসহ প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে বয়স ২১ বছর করার কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, তারা কি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে নির্বাচনে যাবে। কারণ, ২১ বছর বয়সে শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি বা স্নাতক পর্যায়ে প্রথম বর্ষে থাকার কথা। এসব হাস্যকর প্রস্তাবনা কমিশনের গ্রহণযোগ্যতাকে দুর্বল করেছে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই পান্না বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং এর মাধ্যমে প্রণীত প্রস্তাবনা, রাষ্ট্রীয় মূলনীতিসহ কিছু বিষয় অপরিবর্তনযোগ্য। ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে এগুলো অর্জিত। এসব বাতিল বা সংশোধন করার অনুমোদন এই সরকারকে কেউ দেয়নি। কমিশনের সুপারিশে ভালোমন্দ যাই থাকুক, তা কার্যকর বা সংস্কারের বিষয় নির্বাচিত সরকারের। এই সরকারের মূল কাজ দ্রুততম সময়ের মধ্যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা। জনগণের এটাই এখন প্রধান আকাঙ্ক্ষা। এসব পদক্ষেপ গ্রহণের অর্থ হচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে আরও কালক্ষেপণ করা। যা কিছু সংস্কার প্রয়োজন তা নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারই সংবিধান অনুযায়ী করবে। এর ব্যত্যয় আইনানুগ কিছুতেই হবে না। কমিশনের কর্মকাণ্ডে বরং একটি বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।
ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ‘সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজন আছে। কমিশনের সুপারিশে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সংকুচিত করা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন, নারীর ক্ষমতায়নে সংরক্ষিত আসনের পাশাপাশি সরাসরি নির্বাচনের বিধানসহ কিছু বিষয় আছে অত্যন্ত যৌক্তিক। তবে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়াটা একেবারেই অযৌক্তিক। এটি মুক্তিযুদ্ধেরও একটা প্রেক্ষাপট।’ সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সংশোধনের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আইনজ ব র ষ ট রপত র জন ত ক সরক র র ক র যকর পরবর ত আইনজ ব র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
মাদারীপুরে আইনজীবী সমিতির সভাপতি ইমদাদুল, সাধারণ সম্পাদক শাকিল
মাদারীপুরে জেলা আইনজীবী সমিতির বার্ষিক নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। দিনভর ভোটের উত্তাপ ছড়ানোর পর রাত ১১টার দিকে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। নির্বাচনে বিজয়ীদের বেশির ভাগই আওয়ামী সমর্থিত।
বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) দিনব্যাপী ভোট অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৩০০ ভোটারের মধ্যে ২৯৩ জনই ভোট দিয়েছেন।
নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সদস্য মোহাম্মদ ইমদাদুল হক খান ১৮২ ভোট পেয়ে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। আর মাদারীপুর পৌর কৃষকলীগের সভাপতি ও আওয়ামীপন্থি আইনজীবী মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন শাকিল ১৯৬ ভোট পেয়ে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন।
অন্যান্য পদে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা হলেন, আওয়ামীপন্থি আইনজীবী সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে আনোয়ার হোসেন আরমিন ও জালালুর রহমান মোল্লা, জুনিয়র সহ-সভাপতি মাহবুব হাসান সরোজ, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাকিলা পারভীন, জুনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান পারভেজ, কোষাধ্যক্ষ সুজন ভৌমিক, সম্পাদক-লাইব্রেরি মুনির হাসান মিঠু, সম্পাদক-মুহুরী কেএম আজিজুল হক মুকুল এবং কার্যকরী সদস্য পদে সৈয়দ তাহমিনা খানম তুলি, এনামুল হক, আব্দুস সালাম, ইকবাল হোসেন ও আবু সুফিয়ান নির্বাচিত হন।
তবে সম্পাদক-আপ্যায়ন পদে বদরুন নাহার কলি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনার অ্যাডভোকেট ফরহাদুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার রাতে ভোট গণনা করে এই ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে দুই প্রার্থীর ভোট সমান হওয়ায় ৬ মাস করে দায়িত্ব পালন করবেন। ফলে তারা এক পদে দু'জনই নির্বাচিত বলে বিবেচিত।
ঢাকা/বেলাল/টিপু