ঝিমিয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গন
Published: 19th, January 2025 GMT
চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে আগে প্রতি মাসে অন্তত একটি নাটক হলেও মঞ্চায়িত হতো। শীত-বসন্তসহ বিভিন্ন উৎসব মৌসুমে হতো নাট্য উৎসবসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। গত মে মাসেও পাঁচটি ও জুনে এখানে চারটি নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে। গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর যেন ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। নাটক মঞ্চায়ন যেমন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কমেছে, তেমনি কমেছে অন্যান্য সাংস্কৃতিক কার্যক্রমও। আগস্ট-পরবর্তী সময়ে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত শিল্পকলা একাডেমিতে মঞ্চায়িত হয়েছে মাত্র চারটি নাটক। এর মধ্যে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও ডিসেম্বর মাসে কোনো নাটকই মঞ্চায়িত হয়নি।
জেলা শিল্পকলা একাডেমি সূত্র বলছে, গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত সেখানে সংগীত, নৃত্য, নাটক মিলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে প্রায় ৪৫টি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৫টি, ফেব্রুয়ারিতে ৪টি, মার্চে একটি, এপ্রিলে ২টি, মে মাসে ১০টি, জুনে ৬টি, জুলাই ও আগস্টে ৩টি, সেপ্টেম্বরে ৫টি ও অক্টোবরে ৮টি সংগীত, নৃত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে। নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে হয়েছে ১২টি সংগীত, নৃত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ফেব্রুয়ারিতে তিনটি চিত্র প্রদর্শনী আয়োজন করেছিল প্রিয়প্রাঙ্গণ, শিল্পী শুভাশীষ ও চট্টগ্রাম আর্ট স্কুল। মার্চ মাসে স্কেচ গ্যালারি ও শিল্পী রিগানের চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন হয়। গত অক্টোবরে ইসলামী ছাত্রশিবির সেখানে আয়োজন করে আলোকচিত্র প্রদর্শনী। নভেম্বর মাসে দুটি ও ডিসেম্বর মাসে তিনটি চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে।
অভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে চট্টগ্রাম থিয়েটার ইনস্টিটিউটেও। আগস্ট-পূর্ববর্তী ছয় মাসে সেখানে ১৫টি নাটক মঞ্চায়িত হলেও পরের ছয় মাসে হয়েছে মাত্র ৪টি। উচ্চাঙ্গ, রবীন্দ্র, নজরুল এবং লালনভিত্তিক বিভিন্ন সংগীতের অনুষ্ঠান নিয়মিতই হতো থিয়েটার ইনস্টিটিউটে। ৫ আগস্টের পরে সেই চিত্র একেবারে বিপরীত। চট্টগ্রামের উল্লেখযোগ্য নাট্যদল তীর্যক, নান্দিকার, মঞ্চমুকুট, কথক নাট্য সম্প্রদায়, অনন্য, অরিন্দমসহ সক্রিয় সংগঠনগুলোকে গত পাঁচ মাসে নাটক মঞ্চায়ন করতে দেখা যায়নি থিয়েটার ইনস্টিটিউটে।
থিয়েটার ইনস্টিটিউটে ক্ল্যাসিক্যাল, উচ্চাঙ্গ সংগীত, রবীন্দ্র ও নজরুল এবং লালনভিত্তিক বিভিন্ন সংগীতের অনুষ্ঠানও আয়োজিত হয়ে থাকে। গত বছরের প্রথম তিন মাসে সেখানে পাঁচটি সংগীতানুষ্ঠান হয়েছে। অন্যদিকে এপ্রিল, মে ও জুন মাসে হয়েছে প্রায় ২০টি সংগীতানুষ্ঠান।
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে জুলাই, আগস্ট মাসে কোনো সংগীতানুষ্ঠান হয়নি। সেপ্টেম্বরে একটি, অক্টোবরে তিনটি, নভেম্বরে তিনটি ও ডিসেম্বরে পাঁচটি সংগীতভিত্তিক অনুষ্ঠান হয়েছে।
অক্টোবরের রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে অনুষ্ঠান
আয়োজিত হলেও, লালনভিত্তিক কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। সাধারণত অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে এখানে লালনভিত্তিক সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে।
শুধু নগরী নয়; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) এক বছরের অনুষ্ঠান তালিকা পর্যালোচনা করেও পাওয়া গেছে এমন চিত্র। মঞ্চ নাটক, নৃত্য ও সংগীতের মতো অনুষ্ঠানের সংখ্যা সেখানেও কমে গেছে। বেড়েছে সভা-সেমিনার। আবার বিশ্ববিদ্যালয় ও নগরীতে এতদিন যারা নিয়মিত অনুষ্ঠান করেছে তাদের উপস্থিতিও এখন কমে এসেছে।
জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘বছরের এই সময়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যে পরিমাণ সক্রিয় থাকত, এ বছর তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। নিয়মিত যারা অনুষ্ঠান করত তাদের অনেকে এখন নিষ্ক্রিয়। দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে তাদের সক্রিয় হতে হয়তো সময় লাগছে।’
থিয়েটার ইনস্টিটিউটের শৈল্পিক পরিচালক আহমেদ ইকবাল হায়দার বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতার একটা প্রভাব আছে সর্বত্র। আমার উপলদ্ধি বলছে, করোনা-পরবর্তী সময় থেকেই নাটক মঞ্চায়নের সংখ্যা কমেছে। নতুনদের মধ্যে আমরা আগ্রহ তৈরি করতে পারছি না ঠিকভাবে। এটির নানা কারণও রয়েছে।’ রাজনৈতিক পরিস্থিতি যত স্থিতিশীল হবে সংস্কৃতির অঙ্গন তত মুখর হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বেড়েছে আবৃত্তি ও সভা-সেমিনার
থিয়েটার ইনস্টিটিউটের অনুষ্ঠানের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে আবৃত্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন বেড়েছে। এই দুই মাসে তিনটি করে আবৃত্তি অনুষ্ঠান হয়েছে। এছাড়া জানুয়ারি মাসে দুটি, ফেব্রুয়ারি ও সেপ্টেম্বর মাসে একটি করে আবৃত্তি অনুষ্ঠান হয়। সাধারণত শীত মৌসুমে নানা সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের জন্য শিল্পকলা একাডেমি, থিয়েটার ইনস্টিটিউটের হলগুলো সভা-সেমিনারের জন্য পাওয়া কঠিন হতো। সাংস্কৃতিক কার্যক্রম কমে যাওয়ায় সেখানে সভা-সেমিনারের সংখ্যা বেড়েছে।
আগে মাসে সাধারণত পাঁচ থেকে ছয়টি আলোচনা সভা হতো থিয়েটার ইনস্টিটিউটে। অক্টোবর থেকে এখানে সাত থেকে দশটি আলোচনা সভা হয়েছে প্রতি মাসে।
সরব হওয়ার প্রহর গুনছে চবির সাংস্কৃতিক অঙ্গন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হঠাৎ করে অধিকাংশ সাংস্কৃতিক সংগঠন যেন থেকেও নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, আবৃত্তি মঞ্চ, অঙ্গন, উত্তরায়ণ সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদ, বারোমাসি, লোকজ সাংস্কৃতিক সংগঠন, রঁদেভু শিল্পীগোষ্ঠী, আবৃত্তি সংসদ, ভিন্নষড়জসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠনের মধ্যে পাঁচটি জোট গঠন করলেও বাকিগুলো আলাদাভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে। সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নিয়ে তাদের নেতারা বলেছেন, অতীতে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে সরব ছিল, তা গত দশ বছরে কমে গেছে। আগস্টের পর আরও কমেছে কার্যক্রম। বিশ্বদ্যালয়ের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক দল বারোমাসির প্রতিনিধি সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কিছুটা ভিন্নধর্মী সাংস্কৃতিক আয়োজন নিয়ে সরব আছি। প্রশাসনের সহায়তা পেলে আরও সরব হবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।’
উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক পার্থপ্রতিম মহাজন বলেন, ‘সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মধ্যেও বিভাজন আছে। আমাদের পরস্পরকে আরও একত্র হতে হবে। পাঁচ আগস্টের আগেও আমরা অনেক বাধা মোকাবিলা করেছি; এখনও করতে হচ্ছে। আমাদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া কম থাকার কারণে কিছু সংগঠন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।’ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে সহযোগিতা পেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গন আরও সরব হয়ে উঠতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ক ত ক স গঠন ন ষ ঠ ন হয় ছ শ ল পকল এক ড ম আগস ট বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
শাবিপ্রবির সাংগঠনিক সপ্তাহে নবীনদের উচ্ছ্বাস
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) চলছে সাংগঠনিক সপ্তাহ। সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর টেন্টে জমেছে নবীনদের ভিড়। নিজেদের প্রতিভা বিকাশ ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়ে উচ্ছ্বসিত নবীন শিক্ষার্থীরা।
গত ২৪ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এ সাংগঠনিক সপ্তাহের মূল কার্যক্রম শুরু হয় ২৬ জানুয়ারি থেকে। এবারের আয়োজনের বিশেষত্ব হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যান্ডবল গ্রাউন্ডে ৩৭টি সংগঠন একসঙ্গে অংশগ্রহণ করছে, যেখানে আগে অর্জুন তলায় দুই সপ্তাহে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে এ কার্যক্রম পরিচালিত হতো।
এ আয়োজনকে ঘিরে ক্যাম্পাস জুড়ে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। বিভিন্ন সংগঠনের টেন্ট ঘুরে শিক্ষার্থীরা নিজেদের আগ্রহ অনুযায়ী সদস্য হতে ফর্ম সংগ্রহ করছেন। কেউ সংগীত, কেউবা বিতর্ক বা ফটোগ্রাফি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী।
বাংলা বিভাগের নবীন শিক্ষার্থী তানভীর বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বুঝলাম, পড়াশোনার বাইরেও অনেক কিছু শেখার আছে। আমি ফটোগ্রাফি ও বিতর্ক নিয়ে কাজ করতে চাই। তাই এ দুই সংগঠনে সদস্যপদ নিতে ফর্ম নিয়েছি।”
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিয়া জাহান বলেন, “আমি ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলাম। এখানে এসে দেখলাম, অনেক সংগঠন সাংস্কৃতিক চর্চা করে। গানের প্রতি ভালোবাসা থেকেই একটি সংগঠনে সদস্য হয়েছি। পাশাপাশি, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনেও যোগ দিয়েছি, যাতে মানুষের জন্য কিছু করতে পারি।”
সরেজমিনে দেখা যায়, সংগঠনগুলোর সদস্যরাও ব্যস্ত সময় পার করছে। কেউ নতুনদের ক্যাম্পাস ও সংগঠনের নিয়ম জানাচ্ছে, কেউ সাংগঠনিক কার্যক্রমের বিবরণ দিচ্ছে। বিভিন্ন সংগঠন ব্লাড গ্রুপিং, ফটোগ্রাফি ওয়ার্কশপসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যারা জানিয়েছেন, সাংগঠনিক সপ্তাহ শুধু সদস্য সংগ্রহের অনুষ্ঠান নয়, এটি শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশেরও বড় সুযোগ। নতুনদের উচ্ছ্বাস ও অংশগ্রহণই প্রমাণ করে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠনগুলোর অংশ হতে কতটা আগ্রহী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, “আগের বছরগুলোর মতো আলাদা ধাপে সাংগঠনিক সপ্তাহ না করে এবার একসঙ্গে আয়োজন করা হয়েছে। যাতে সব সংগঠন সমানভাবে সদস্য সংগ্রহের সুযোগ পায় এবং নবীন শিক্ষার্থীরাও একসঙ্গে সব ক্লাবের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে।”
ঢাকা/ইকবাল/মেহেদী