‘‘আমার সম্পূর্ণ নাম শুভ্রা আফরিন নূর আলম। আমি একজন আন্তঃলিঙ্গীয় মানুষ। আমার বয়স ৩৪ বছর। যে ক’দিন জীবনে বাকি আছে, এ পরিচয় নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই।’’ এভাবেই দৃঢ় কণ্ঠে নিজ অস্তিত্বের জানান দেন নূর আলম। ইন্টারসেক্স বাংলাদেশ কমিউনিটির প্রতিষ্ঠাতা তিনি। গোটা বাংলাদেশ থেকে এখন পর্যন্ত নিজ উদ্যোগে তিন শতাধিক আন্তঃলিঙ্গীয় মানুষ একত্র করতে পেরেছেন তিনি। চলার জন্য নূর আলমের পাশে কোনো বন্ধু পাননি। পেয়েছেন অমানবিক যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণার কথা যখন বলেন তাঁর গলা ধরে আসে। তবুও তিনি বলেন, জন্মের পর থেকে মানুষের জিহ্বার তীক্ষ্ণ ছুরি থেকে শুরু করে সার্জারির টেবিলে ছুরির ফলায় বিদীর্ণ হওয়ার স্মৃতিগুলো।
পরিবারের তৃতীয় সন্তান শুভ্রা আফরিনের জন্ম নেওয়ার মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই জীবনে অভিশাপ হয়ে নেমে আসে একই সঙ্গে চারটি অপারেশন। যখন তাঁর কিছুই বোঝার বয়স হয়নি, তখনই সমাজ তাঁকে লিঙ্গভেদে নারী-পুরুষ বানাতে ব্যস্ত হয়ে যায়। নারীর মতো হয়ে বেড়ে ওঠা শুভ্রা আফরিন জীবনে দ্বিতীয়বার ৯ বছর বয়সে একই সঙ্গে দুটি অপারেশনের জন্য সার্জারির টেবিলে যান। যেখান থেকে ফেরার পর তাঁকে নূর আলম ও পুরুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে হয়। সমাজ ও পারিপার্শ্বিক চাপে পুরুষ হিসেবে বেড়ে উঠলেও, শারীরিক গঠন হতে থাকে নারীসুলভ এবং তৃতীয়বারের মতো ১৮ বছর বয়সে অপারেশনের টেবিলে নিয়ে তাঁর স্তন ফেলে দিয়ে পুরুষালী চলাচলের জন্য উপযুক্ত করতে উঠেপড়ে লাগে পরিবার ও সমাজ। তখনই ১৮ বছর বয়সী নূর আলম সিদ্ধান্ত নেন– তাঁর শরীর, তাঁর ইচ্ছা। তিনি আর কোনো কিছুর চাপে আটকে থাকবেন না। থাকবেন নিজের মতো। অপারেশনের আগের রাতে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে এতদিন পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগবিহীন মানুষটি হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন তাঁর মতো মানুষগুলোকে। ভেতরে জমে থাকা অজস্র প্রশ্নের উত্তর খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। নূর আলম মাঝেমধ্যেই না চাইতেও নিজেকে আলাদা হিসেবে আবিষ্কার করেন। সমাজই তাঁকে এ আবিষ্কার করায়।
অনেকটা চিৎকার করেই নূর আলম বলেন, ‘ছোটবেলায় মেয়ে ও ছেলে হিসেবে দুইভাবেই আকিকা দেওয়া হয় আমার। নামও রাখা হয়। প্রতিনিয়ত নানা ঘটনা ও মানসিক চাপ নিয়ে বেড়ে উঠেছি আমি। এখনও দুঃস্বপ্নের মতো লাগে।’ এমন দুটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘স্কুলে থাকতে অন্য শিক্ষার্থীরা দেয়ালে ছেলে চিহ্নিত করে ছবি আঁকত। আমার বেলায় সেই চিহ্নিতকরণ থাকত না। ওরা বলত, এটাই নূর আলম। সব থেকে ভয়াবহ বিষয় হলো, মক্তবে হুজুররা পড়ানোর থেকে বেশি আগ্রহ বোধ করতেন আমার গোপনাঙ্গ দেখার জন্য। এরকম করে আমি ক্লাস নাইনের বেশি আর পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারিনি। এ জন্য কি আমি দায়ী? এখনও এই ২০২৫ সালে এসে অনেক হাসপাতালে গেলে দেখা যাবে অন্তত ১০ থেকে ১২ জন শিশু ভর্তি আছে ছুরি-কাঁচির নিচে যাওয়ার অপেক্ষায়। তাদের লিঙ্গ নির্ধারণ করা হবে এর মাধ্যমে। আমাদের দেশে আন্তঃলিঙ্গীয় মানুষ কী– এ সম্পর্কে সাধারণ মানুষই শুধু নয়, এমন অনেক চিকিৎসকও আছেন; যারা প্রকাশ্যে বলেন, সঠিক সময়ে সার্জারি করালে আমাদের দেশে হিজড়ার সংখ্যা নাকি শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে; যা একদমই বাস্তবতা বিবর্জিত বক্তব্য।’
নূর আলম আরও বলেন, ‘আমার বলতে দ্বিধা নেই। আমি একজন আন্তঃলিঙ্গীয় মানুষ এবং একই সঙ্গে আমার ভেতর কোনো যৌন আবেগ নেই। অর্থাৎ আমি ইন্টারসেক্স মানুষ ও এসেক্সসুয়াল। কোনো মানুষকে ভালো লাগা পর্যন্তই আমি যেতে পারি। তারপর যেন একটা অদৃশ্য দেয়াল।’
পারিবারিকভাবে সবাই ওপরে ওপরে খুবই আন্তরিক নূর আলমের সঙ্গে। আবারও একটা তথাকথিত সমাজের অদৃশ্য বাধার দেয়াল চলে আসে যখন সামাজিক কোনো আয়োজন হয় পরিবার থেকে। দেশের বাইরে থাকা বাবা, ভাইকে ফোন দিয়ে পারিবারিক আয়োজনের কথা জানানো হয়; তারা আসতে পারবে না সেটি জানা সত্ত্বেও। পাশে থাকা নূর আলমকে আমন্ত্রণ জানানো হয় না কোনো আয়োজনে। না জেনে ভুলক্রমে আয়োজনে চলে গেলেও তাঁকে সবার আড়ালে নিয়ে আসা হয়। এভাবেই কেটে যাচ্ছে নূর আলমের জীবন। কিন্তু তিনি চান, তাঁর মতো শিশুগুলো যেন দুর্বিষহ জীবনের মধ্য দিয়ে না যায়। তাদের জীবনটাও যেন স্বাভাবিক ও সুন্দর হয় আট-দশটা মানুষের মতো। অবহেলা, ভুল চিকিৎসা ও শিক্ষা থেকে যেন ঝরে না পড়ে কেউ। অন্তত ১৮ বছর পর্যন্ত যেন একজন মানুষ নিজের মতো করে জীবন ধারণ করতে পারেন। তারপর সেই মানুষ নিজে সিদ্ধান্ত নেবেন, তাঁর লিঙ্গীয় পরিচয় কী হবে। এটি একান্ত তাঁর ব্যক্তিগত জায়গা। ভীষণ স্বপ্নালু এক মানুষ নূর আলমের এমনটাই চাওয়া।
দিনশেষে এ মানুষগুলোও অনেকটা রাতে ফোটা শুভ্র ফুলের মতোই। এক সময় পর্যন্ত তারা নীরবে থেকে যায় সবার মধ্যে। আবার নীরবে ঝরে পড়ে সবার মধ্য থেকেই। v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন র আলম র র জন য র বয়স
এছাড়াও পড়ুন:
জামালপুরে ট্রাকের ধাক্কায় সিএনজির ৫ যাত্রী নিহত
জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলায় ট্রাকের ধাক্কায় সিএনজিতে থাকা পাঁচ জন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় একজন আহত হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) সন্ধ্যা ৬টার দিকে উপজেলার মহাদান ইউনিয়নের কড়োগ্রাম এলাকায় জামালপুর-টাঙ্গাইল মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন- এনাম ফকির, সিএনজি চালক আব্দুর রাজ্জাক, আরিফুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর আলম ও আব্দুল করিম আলাল।
জামালপুর সদর উপজেলার নারায়ণপুর তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ মো. লুৎফর রহমান জানান, মধুপুর থেকে ছেড়ে আসা জামালপুরগামী একটি সিএনজি অটোরিকশাকে মধুপুর থেকে ছেড়ে আসা দ্রুত গতির একটি ট্রাক সামনে থেকে ধাক্কা দেয়। এতে সিনএজি অটো রিকশায় থাকা ঘটনাস্থলেই চার জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আহত দুজনকে উদ্ধার করে স্থানীয়রা।
উদ্ধারকৃতদের মধ্য এনাম ফকির স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালে মারা যায়। এনামের বাবা আমজাদ ফকির গুরুতর আহত অবস্থায় জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
মালপুর সদর উপজেলার নারায়ণপুর তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ মো. লুৎফর রহমান বলেন, “ঘটনার খবর পেয়ে এখান থেকে চার জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। একজন হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা গেছে। মরদেহ উদ্ধার করে আইনানুগ প্রক্রিয়া করা হচ্ছে।”
ঢাকা/শোভন/এস