পুরুষ মানুষ পরিবারের সবার জন্য নিজের ব্যক্তিগত সব সুখ বিসর্জন দিয়ে দেবেন। তাঁকে দায়িত্ব নিতে হবে মা-বাবা, ভাইবোন সবার। দায়িত্ব নিতে হবে তাঁর স্ত্রী, সন্তান এবং শ্বশুরবাড়ির। একজন পুরুষ অবশ্যই তাঁর আবেগ নিয়ন্ত্রণ করবেন। তাঁকে অবশ্যই ব্যক্তিগত সব সুখ-দুঃখ ভুলে একজন ‘শক্ত পুরুষ’ হতে হবে, যিনি শত কষ্টেও ভেঙে পড়বেন না। যিনি পরিবারের সবার আনন্দ নিশ্চিত করতে নিজের জীবনের সব সুখ কোরবানি দিতে পর্যন্ত দ্বিধা করেন না। এমনকি জীবনসঙ্গীকেও বিসর্জন দিতে পারেন।

এ রকম অনেক ঘটনা এ সমাজে অহরহ ঘটছে। যেখানে বাড়ির বড় ছেলে বা দায়িত্বশীল ভাইটি পরিবারের সবার কথা ভাবলেও তিনি নিজের সবচেয়ে কাছের প্রিয় মানুষটি, এমনকি নিজের সঙ্গিনীকে রেখে দেন দ্বিতীয় প্রায়োরিটিতে আর নিজেকে রাখেন সবার শেষে। পরিবারের সবার চাহিদা পূরণ হওয়ার পর বাবা তাঁর প্রয়োজনীয় জিনিসটি কেনেন; কখনও হয়তো সেটিও কেনেন না। পুরুষ মানুষের কাঁদতেও মানা। তাদের ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয় তাঁর ‘মেল ইগো’ আঘাতপ্রাপ্ত হবে যদি নিজের ভেতর একটি শক্ত দেয়াল তৈরি করতে না পারে। যদি তাঁর দুর্বলতা বাইরের কেউ বুঝে ফেলে, তবে তো সেটি তাঁর জন্য ভীষণ লজ্জাকর। একজন পুরুষকে হতে হবে খুবই দৃঢ় এবং শক্ত। এই দৃঢ়তা প্রমাণ করতে অনেক পুরুষ জলাঞ্জলি দেন তাঁর স্বপ্নের সঙ্গীকে পর্যন্ত। একতরফা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে কত নিরপরাধ মেয়ের কপালে জোটে তালাকনামার তকমা। বউয়ের কথা মতো চললে এই সমাজ তাঁকে বলে ‘বউপাগলা’; আবার সেই ছেলেই যদি মায়ের কথামতো চলেন তখন তাঁকে বলা হয় ‘মাম্মাস বয়’। একজন পুরুষের জন্য তাঁর জীবনে এই দুই নারীর প্রভাব অপরিসীম। অথচ কখনও কখনও পুরুষকে বেছে নিতে হয় যে কোনো একটি। এটি যে একজন পুরুষের জন্য কতটা কষ্টকর, কতটা যন্ত্রণার, সেটি যারা এই শাখের করাতের ভেতর দিয়ে গেছেন এবং এখনও যাচ্ছেন তারাই বুঝবেন।

আমরা সবসময়ই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার শিকার নারীকেই ভাবি অথচ এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শিকার  একজন পুরুষও। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একজন পুরুষকে ‘পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ’ বা ‘বেডা’ হিসেবেই দেখতে চায় এবং সেই ‘বেডাগিরি’ প্রমাণ করার জন্য একজন পুরুষকে আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে হয়। তা ধরে রাখার যুদ্ধে কখনও কখনও সে পুরুষটিরও ক্লান্তিবোধ হয়, সেই পুরুষটিরও একটি ভরসার কাঁধ প্রয়োজন হয়, কখনও বা সেই পুরুষটিরও মন খুলে কাঁদতে ইচ্ছে করে। তিনি সেটি পারেন না। এ না পারাটাই জোর করে তাঁর আবেগ এবং মনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে চেপে রাখতে রাখতে একটা সময় হয় সেই পুরুষটি মানসিক রোগী হয়ে যান অথবা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কাছের মানুষগুলো হয়তো তাঁকে ভালোবাসে; অথচ তাঁর হাসি মুখের আড়ালে কষ্টগুলোকে বুঝতেও পারেন না।

অনেক ভালোবেসে বিয়ে করে ঘরে এনেছিলেন রাহাত (ছদ্মনাম) কলিকে (ছদ্মনাম); অথচ বিয়ের এক বছরের মাথায় সামান্য এক পারিবারিক ভুল বোঝাবুঝির জেরে কলিকে ডিভোর্স দেন রাহাত। একসময় রাহাত বুঝতে পারেন ভুল তাঁরই। তারপর তিনি সারাজীবন এই অপরাধে ভুগতে থাকেন, তিনি একটি নিরপরাধ মেয়েকে শুধু সমাজ ও পরিবারের কথা ভেবে ভুল বুঝে জীবন থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। রাহাতের মুখের সেই উজ্জ্বল হাসি তাঁর পরিবার আর কখনও দেখেনি। তিনি সারাটি জীবন কলিকে ভুলতে পারেননি।
আসিফ (ছদ্মনাম) স্ত্রী ও মায়ের দ্বন্দ্ব মেনে নিতে না পেরে আত্মহননকেই বেছে নেন। কেননা, তারা দু’জনেই যে কোনো একজনকে বেছে নিতে বলেছিলেন। সেটি আসিফের পক্ষে ছিল অসম্ভব। কেননা, তিনি তো দু’জন নারীকেই ভালোবাসেন। অথচ অবাক ব্যাপার– এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একজন পুরুষকে ভাবতে বাধ্য করেন, তিনি শক্তিশালী এবং তাঁকে পরিবারের পক্ষেই দাঁড়াতে হবে, না হলে লোকে বলবে– দেখেছ, তিনি কেমন বউ পাগল। অথচ তিনি তখন ‘বেডাগিরি’ দেখানোর মোহে ভুলে যান, তাঁরও একটি হৃদয় আছে এবং সেই হৃদয়ের কিছু চাওয়া-পাওয়া আছে, তাঁরও কষ্ট আছে, ভালো লাগা আছে, তাঁরও এক টুকরো বারান্দায় চাঁদ দেখতে দেখতে প্রিয়জনের সঙ্গে চা খাওয়ার অধিকার আছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ফাঁদে পড়ে জীবনের অনেক বড় খুশি বিসর্জন দিতে হয় পুরুষকে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা শুধু নারীকেই ক্ষতবিক্ষত করে তা নয়; একজন 
পুরুষের জীবনকেও ভেতর থেকে দুমড়েমুচড়ে দেয়। v

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: বন দ একজন প র ষ র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

মোহ কাঠের নৌকা: বাস্তবতার এক প্রতিচ্ছবি

‘মোহ কাঠের নৌকা’ উপন্যাসে আধুনিক সমাজের জটিলতা, পেশাগত টানাপোড়েন, ব্যক্তিগত সংকট ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে।
কেন্দ্রীয় চরিত্র রবীন গ্রাম থেকে শহরে এসে উচ্চশিক্ষা শেষে এক অখ্যাত অনলাইন সংবাদমাধ্যমে যোগ দেয় বড় স্বপ্ন নিয়ে। বাস্তবতা তাকে হতাশ করে তোলে। অফিসের রাজনীতি, অনিয়মিত বেতন ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা তাকে এক ধরনের পেশাগত দুঃখবোধে ফেলে। এ ছাড়া রবীনের জীবনে একের পর এক সংকট আসে– নিজের একাকিত্ব, পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব, সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং সমাজের নানা অসংগতি। একসময় তার পরিচয় হয় জলি নামে এক মেয়ের সঙ্গে, যার বাবা গুমের শিকার। জলি চরিত্রের মাধ্যমে লেখক তুলে ধরেন গুম হওয়া পরিবারের কষ্ট, অনিশ্চয়তা ও অবহেলার যন্ত্রণা। অন্যদিকে, গ্রামের স্মৃতি রবীনের মনে গভীরভাবে গেঁথে থাকলেও বাস্তবতা সেখানে গিয়ে বদলে গেছে। বিদেশের অর্থে বদলে যাওয়া গ্রামীণ সমাজ, পারিবারিক মূল্যবোধে পরিবর্তন এবং দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য তাকে আরও ব্যথিত করে তোলে। রবীনের জীবনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রুবি– এক ব্যাংক কর্মকর্তা, যে নিজেও জীবন সংগ্রামে এগিয়ে এসেছে। রুবির মা চায় রবীনের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে হোক। সম্ভবত রুবিও তা চায়। জীবনের নানা দোলাচলের মধ্যে রুবিই রবীনের জীবনে একমাত্র স্থিরতার প্রতীক হয়ে ওঠে। প্রশ্ন থেকে যায়, রবীন কি পারবে এই ‘মোহ কাঠের নৌকা’য় উঠে জীবনের নিরাপদ তীরে ভিড়তে? নাকি বাস্তবতার ঢেউ সেই নৌকাকে ডুবিয়ে দেবে?
রবীন: রবীন একজন স্বপ্নবান যুবক, যে সাংবাদিকতা দিয়ে সমাজে কিছু পরিবর্তন আনতে চায়। চারপাশের বাস্তবতায় ধীরে ধীরে তার ভেতরের স্বপ্নগুলো নিঃশব্দে ভেঙে পড়ে। রবীনের চরিত্রে দেখা যায় একজন সাধারণ ছেলের ভেতরের গভীর অনুভব, লড়াই আর স্বপ্নভাঙার হতাশা। সে জীবনের কাছে হেরে গিয়েও চুপচাপ বাঁচতে থাকে– যেমনটা করে অসংখ্য বাস্তব মানুষ।
রুবি: রুবি একজন সফল নারী– প্রাইভেট ব্যাংকের কর্মকর্তা। প্রেম, পারিবারিক টানাপোড়েন আর অতীতের জটিল স্মৃতি তাকে সব সময় তাড়া করে। মা অনেক ত্যাগে তাকে গড়েছেন, কিন্তু সেই মাও অসুখী। রুবির চরিত্রে উঠে এসেছে নারীর আত্মত্যাগ, গভীর আবেগ, জীবনের এমন অনিশ্চয়তা; যা মানুষকে ভেতর থেকে ভেঙে দেয়।
মানবসমাজের সহজাত প্রবণতা হলো, আমরা সত্যের মুখোমুখি হতে চাই না। আমরা চোখ ফিরিয়ে নিতে চাই কঠিন বাস্তবতা থেকে। অথচ    ‘ মোহ কাঠের নৌকা’ সেই তেতো সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়। এই উপন্যাস কেবল একটি গল্প নয়, বরং আমাদের সময়, সমাজ এবং সম্পর্কের এক নির্মোহ আয়না। এদের মধ্য দিয়ে সমাজের মধ্যবিত্ত মানসিকতা, অতিমাত্রায় আত্মমর্যাদা বোধের চাপ এবং সম্পর্কের টানাপোড়েন অত্যন্ত সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে। লেখক এই উপন্যাসে একটি সময়কে ধরার চেষ্টা করেছেন যেখানে শহর ও গ্রামের দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থা, আর্থসামাজিক অসংগতি, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ব্যক্তিগত জীবনের অস্থিরতাগুলো একসঙ্গে চিত্রায়িত হয়েছে। 
সময়ের এই চলমান প্রবাহে লেখক সম্পর্কের জটিলতা নিয়েও অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি মন্তব্য রেখেছেন– ‘আশ্রয়হীন মানুষরা আশ্রয়ের তিল পরিমাণ সন্ধান পেলেই ভুলে যায়, সব আশ্রয় তার জন্য ইতিবাচক নাও হতে পারে।’
এই বাক্যটিই যেন উপন্যাসের সারকথা হয়ে ওঠে। বাস্তবতা ও অনুভূতির দ্বন্দ্বে মানুষের ভেতরের একাকিত্ব, অস্থিরতা ও টিকে থাকার লড়াই– সবই মূর্ত হয়ে উঠেছে এই উপন্যাসে। এ ধরনের বাস্তবভিত্তিক উপন্যাস পাঠকের কাছ থেকে কিছুটা ধৈর্য দাবি করে। কারণ– এখানে রোমাঞ্চ নেই, নেই চমকজাগানো মোড়। অনেকটা যেন নিরবধি বয়ে চলা নদীর মতো, যার স্রোতের গভীরতা উপলব্ধি করতে হয় ধীরে ধীরে। মনে হয়েছে, ‘মোহ কাঠের নৌকা’ শুধু উপন্যাস নয়, এটি সমাজের বিবেকের কাছে একটি প্রশ্নপত্র– যেখানে এই সমাজে কি সত্যিই কারও নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার নৌকা আছে, নাকি বাস্তবতার ঢেউয়ে সবকিছুই তলিয়ে যায়?
যারা বাস্তববাদী সাহিত্য, সাংবাদিকতার ভেতরকার জটিলতা কিংবা সমাজের দ্রুত পরিবর্তনের অভিঘাত নিয়ে ভাবতে ভালোবাসেন, তারা এই উপন্যাস পাঠে গভীর আনন্দ পেতে পারেন। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ১১০ বছর আগে যেমন ছিল জব্বারের বলীখেলা
  • নৈঃশব্দ্যের টংকার
  • মোহ কাঠের নৌকা: বাস্তবতার এক প্রতিচ্ছবি
  • হামাস যেভাবে ইসরায়েলের ‘অপরাজেয়তার মিথ’ ভেঙে দিল
  • হরমোন গুরুত্বপূর্ণ, তাই এ নিয়ে সচেতন হোন
  • দেশে ধনীদের তালিকা হয় না কেন
  • প্রেমিক মারা গেছেন, সব ঋণ শোধ করলেন চীনা নারী
  • গলা টিপে ধরা ও মারধরের অভিযোগে সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ওপেনারের শাস্তি
  • নিজের যত্ন নিন
  • জনসমর্থন নেই-এমন কাজ করলে ব্যবস্থা: নেতাকর্মীকে তারেক রহমান