‘নতুন’ তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে পুরাতন পর্যবেক্ষণ
Published: 18th, January 2025 GMT
বহুল আলোচিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। বস্তুত ঘরোয়া আলোচনায় রিভারাইন পিপলের সহযোদ্ধাদের একাধিকবার বলেছি, অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম সুযোগেই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে হাত দিতে পারে। এর কারণ বোঝার জন্য ভূরাজনীতি বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
‘আইস ব্রেক’ করেছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। রংপুর সফরে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতি আছে। তারা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন (প্রথম আলো, ৩০ নভেম্বর ২০২৪)।
২০ জানুয়ারি বেইজিং সফর সামনে রেখে পররাষ্ট্র-বিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গত বুধবার এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বিষয়ক সমঝোতা স্মারকের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। সেটা আমরা নবায়ন করব। এটা হবে প্রথম কাজ। সুনির্দিষ্ট প্রকল্পের ব্যাপারে তো আরও বিস্তারিত আলোচনা লাগবে। (এখন টিভি, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫)।
বৃহস্পতিবার রাজধানীতে অনুষ্ঠিত বাপা-বেন সম্মেলনে বিষয়টি নিয়ে আরও বিস্তারিত বলেন পানিসম্পদ এবং বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ‘আমরা চীনা দূতাবাসকে জানিয়েছি যে, আমরা সময় বাড়াতে রাজি আছি। কিন্তু একটা শর্ত জুড়ে দিয়েছি। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় তিস্তা মহাপরিকল্পনা বিষয়ে তিস্তাপাড়ের মানুষের মতামত শুনবে, সে জন্য গণশুনানির আয়োজন করবে। জনগণের মতামত প্রকল্পে প্রতিফলনের নিশ্চয়তা দেবে পাওয়ার চায়না। এটা আমাদের প্রস্তাবনা হিসেবে গেছে। যতদূর জানি, পাওয়ার চায়না এই শর্তে সম্মত আছে। আমাদের চেষ্টা থাকবে যাতে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে পারি। পরবর্তী সরকার এসে সেটা বাস্তবায়ন করবে’ (ফেসবুক লাইভ, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫)।
আমরা জানি, চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না- ‘পাওয়ার চায়না’ নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা খাতে সক্রিয়। এর সিস্টার কনসার্ন ‘সিনোহাইড্রো’ পদ্মা সেতু প্রকল্পের নদী শাসনের ঠিকাদারি পেয়েছিল। প্রসঙ্গত, তিব্বত অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্রের উজানের অংশে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সঙ্গেও জড়িত পাওয়ার চায়না। এমনকি তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রের মিলনস্থলে বাম তীরের কুড়িগ্রাম ও ডান তীরের গাইবান্ধার মধ্যে নির্মিত সেতুটির নির্মাতা চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডও পাওয়ার চায়নার জ্ঞাতি বোন।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা-বিষয়ক নথিপত্রে দেখা যায়, ২০১৯ সালের মে মাসে ‘প্রিলিমিনারি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল’ বা উন্নয়ন প্রকল্পের প্রাথমিক প্রস্তাব (পিডিপিপি) প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। আনুষ্ঠানিক নাম ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেন্সিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট’ (টিআরসিএমআরপি)। বাংলায় তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প। প্রকল্পটির পৃষ্ঠপোষক মন্ত্রণালয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা পানি উন্নয়ন বোর্ড। ওই বছরের জুন মাসের মধ্যে প্রস্তাবটি চূড়ান্ত হলেও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে সেটা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয় ২০২০ সালের ২৩ জুলাই।
পত্রের বিষয় হিসেবে লেখা হয়, ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেন্সিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট শীর্ষক প্রকল্পের চীনা অর্থায়ন প্রস্তাব প্রেরণের জন্য তথ্য প্রেরণ’। এতে বলা হয়, উপর্যুক্ত বিষয়ে ও সূত্রে প্রাপ্ত ইআরডির পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেন্সিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট’ শীর্ষক প্রকল্পে চীনা অর্থায়নের প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণের লক্ষ্যে নীতিগতভাবে অনুমোদিত পিডিপিপি, ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট এতৎসঙ্গে সংযোজিত হলো।’ প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৯৮৩ দশমিক ২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
নথিতে আরও বলা হয়, যথানিয়মে ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগ পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়নার ‘নন-বাইন্ডিং’ বা বাধ্যবাধকতাহীন সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে পরবর্তী সময়ে পক্ষে-বিপক্ষের বিতর্ক, চীন-ভারত দ্বৈরথ, বাংলাদেশের দোটানার ইতিহাস সবারই জানা। বিস্তারিত পড়তে পারেন ‘তিস্তা নিয়ে ভারত-চীন দ্বৈরথে নতুন অধ্যায়’ (সমকাল, ১২ মে ২০২৪)।
সর্বশেষ গত বছর ৮-১০ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফর নির্ধারিত ছিল। সেখানেই তিস্তা মহাপরিকল্পনা-বিষয়ক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু দৃশ্যত ভারতের চাপে তড়িঘড়ি করে ২১-২২ জুন দিল্লি সফর করেন তিনি। ওই সফরে দুই পক্ষের ‘অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি’ ঘোষণার ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, ‘উন্নয়ন সহযোগিতার অংশ হিসেবে পারস্পরিক সম্মত সময়সীমার মধ্যে ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমরা তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনাগত উদ্যোগ গ্রহণ করব।’
সফরটির পর এক নিবন্ধে লিখেছিলাম, ‘এবারের সফরে তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুটি কার্যত হিমাগারে চলে গেল। বরং উজানের দেশ থেকে পানিপ্রাপ্যতার অনিশ্চয়তায় বাংলাদেশ যে নিজস্ব সীমানার মধ্যে চীনের সহায়তায় একটি কারিগরি সমাধানের কথা ভাবছিল, সেটাই ভারত বাস্তবায়ন করে দিতে চাইছে। বলা বাহুল্য, চীনকে সরিয়ে দিয়ে’ (তিস্তা পরিস্থিতি তাহলে কী দাঁড়াল, সমকাল, ২৪ জুন ২০২৪)।
আর ১৪ জুলাই গণভবনের সেই ‘ভাগ্যনির্ধারণী’ সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমি এখানে প্রাধান্য দেব যে, এটা ইন্ডিয়া করুক। কারণ তিস্তার পানিটা ইন্ডিয়াই আটকে রেখেছে। চীন তো রেডি! কিন্তু আমি চাচ্ছি যে, এটা ইন্ডিয়া করে দিক। তাহলে এই প্রজেক্টের জন্য যা (পানি) দরকার, ইন্ডিয়া দিতে থাকবে। ঠিক আছে? সাফ সাফ কথা, রাখঢাক নাই!’ (ইউটিউব থেকে শ্রুতিলিখন)।
ওই সংবাদ সম্মেলনেই ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ সংক্রান্ত বক্তব্যের জের ধরে দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে এবং জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে সরকার ক্ষমতাচ্যুত এবং খোদ শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়।
এখন এটা স্পষ্ট, অন্তবর্তী সরকার ডিসেম্বরের মধ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে চায়। আগের সমঝোতা স্মারকে প্রকল্পটি ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। নবায়নের পর এর নতুন মেয়াদ কবে, এখনও জানা যায়নি। ভারতের প্রতিক্রিয়াও হয়তো অচিরে জানা যাবে।
এই অবসরে আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বাংলাদেশের দুই বৃহৎ ও প্রভাবশালী প্রতিবেশীর দ্বৈরথমূলক এই প্রকল্প একাধিক ধাপে ও বহুপক্ষীয় হওয়াই বাঞ্ছনীয়। প্রথম ধাপে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় পানি বণ্টন চুক্তি হতে হবে, যাতে উভয় দেশের অববাহিকাভিত্তিক অধিকার নিশ্চিত হয়। কারণ উজান থেকে পানির নিশ্চয়তা পাওয়া না গেলে ভাটিতে প্রকল্প ‘বাস্তবায়ন’ করে লাভ নেই। এ ধরনের প্রকল্পের পরিণতি কী হয়, তিস্তারই ডালিয়া ব্যারাজ তার নিদারুণ উদাহরণ। দ্বিতীয় ধাপে, বহুপক্ষীয় প্রকল্পের মাধ্যমে তিস্তা সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা হতে পারে। সেখানে ভারত, চীন ছাড়াও বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো আন্তর্জাতিক অর্থকরী সংস্থাগুলো থাকতে পারে।
বাপা-বেন সম্মেলনেই পানিসম্পদ উপদেষ্টা বলেছেন, এডিবি বাংলাদেশে নদী পুনরুদ্ধার বিষয়ে আগ্রহী। আমার ধারণা, বিশ্বব্যাংকও আগ্রহী হবে। চীন ও ভারত তো আগেই আগ্রহ ব্যক্ত করে ব্যগ্র হয়ে আছে। চীন, ভারত, বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং বাংলাদেশ– পঞ্চপক্ষীয় সহযোগিতায় যদি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়, এর চেয়ে দারুণ আর কিছু হতে পারে না।
আর নবায়নমুখী তিস্তা মহাপরিকল্পনাটি খোদ তিস্তার প্রতিবেশ ও পরিবেশের জন্য কতটা উপযোগী; বিকল্প পরিবেশসম্মত ব্যবস্থা রয়েছে কিনা, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। সময় ও সুযোগ হলে আগামী কোনো নিবন্ধে বিষয়টি আলোচনার আশা রইল।
শেখ রোকন: লেখক ও নদী গবেষক
skrokon@gmail.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রকল প র উপদ ষ ট র জন য সরক র ব ষয়ক সমঝ ত প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
ইউক্রেনে জেলেনস্কির বিকল্প নেতা খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র!
ইউক্রেনে শান্তিচুক্তির জন্য দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির পদত্যাগ করা লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালৎস। তিনি বলেছেন, ‘ইউক্রেনের একজন নেতা প্রয়োজন, তিনি আমাদের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন। তিনি শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করতে পারবেন এবং এই যুদ্ধ থামাতে পারবেন।’ খবর- সিএনএন
গণমাধ্যমের সামনেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির নজিরবিহীন বাগবিতণ্ডার পর এ কথা বললেন তিনি। বাগবিতণ্ডার এ ঘটনাটি নিয়ে নানা আলোচনা চলছে বিশ্বজুড়ে। ওই ঘটনার পর ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে ঐতিহাসিক চুক্তি হওয়ার কথা ছিল, সেটিও বাতিল হয়ে যায়। আর এর পরই ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কোন পথে, তা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা।
এই প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। শুক্রবারের ওই ঘটনায় সাবেক ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গড়া ওয়াশিংটন-কিয়েভ সম্পর্ক ভেঙে পড়েছে। এই প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে আবারও এক টেবিলে বসার ইঙ্গিত দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন ও রাশিয়া-দুই পক্ষই আলোচনায় না বসলে যুদ্ধ থামবে না। হোয়াইট হাউসে শুক্রবার ট্রাম্প-জেলেনস্কি বিতণ্ডার পর থেকে ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আর কথা হয়নি। যুদ্ধ থামানোর জন্য রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে আনতে হবে। তবে তাদের প্রতি বৈরী মনোভাব রাখলে, মস্কোকে আলোচনায় যুক্ত করা সম্ভব হবে না। কোনো চুক্তি করার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই মনোভাবই দেখিয়ে আসছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, সবকিছু আবার শুরু হতে পারে। আশা করি, তিনি (জেলেনস্কি) এটা বুঝতে পারবেন যে আমরা আসলে আরও হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর আগে, তাঁর দেশকে সাহায্যের চেষ্টা করছি।’