আজ আমরা যারা কিংবদন্তি ভাস্কর নভেরা আহমেদের নাম জানি, তাঁর  উত্থান হয়েছিল অনগ্রসর ও শিক্ষায় পশ্চাৎপদ এক সমাজে। তখনকার সমাজের গড়ন, বর্তমানের মতো এত অগ্রসর ছিল না। কারণ তখন শিল্পচর্চার খুব সহায়ক পরিসর ছিল না। পারিবারিক আর সামাজিক প্রথার দেয়াল ডিঙিয়ে শিল্পচর্চা যে কারো জীবনের অংশ হতে পারে সে কল্পনাও ছিল সাধ্যের অতীত। সেই সাধ্যের অতীতের আগল ভেঙেছেন মুষ্টিমেয় যে ক’জন শিল্পী, তাদের ভেতর অন্যতম প্রধান চরিত্র নভেরা আহমেদ। এমন কি, বর্তমানে আমরা যে শিল্পকলা সম্পর্কে আলোচনার সুযোগ পেলাম, সেটার বিদ্যাপীঠ থেকে নানাব্যক্তিক পাটাতনও সৃষ্টি করেছিলেন পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশের প্রথমদিকের শিল্পীরাই। তাদের সৃষ্টির পথই আজ আমাদের অগ্রসর হওয়ার পাথেয়। সে পথের অনন্য স্রষ্টা নভেরা আহমেদই হলেন বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যকলার প্রাথমিক রূপকার।     

বালিকাবেলা থেকে নভেরা আহমেদ [১৯৩৯—২০২৫] ছিলেন বামপিঠে স্বভাবের। ইচ্ছার বিরুদ্ধে পা বাড়াতেন না বিশেষ। যা বলতেন তা-ই করার স্বভাবী লোক তিনি। লোকে এমন স্বভাবীকে বলেন ‘স্বাধীনচেতা’। মানে ব্যক্তির আবেগ, ইচ্ছা আর সংবেদনশীলতাকে আমলে রাখতেন তিনি। কেউ কেউ বলতে পারেন ‘রোমান্টিসিজম’ বা ‘বাসনাবাদ’ ছাড়া নভেরার স্বভাব অন্য কিছু নয়। দর্শনশাস্ত্র বলে, বাসনা আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছার কাছাকাছি একটা অর্থ বহন করে। আমরা বলব, তারও বেশি কিছু। অর্থশাস্ত্র বলে ‘বাসনা’ মানে লোকে যেখানে ‘বাস করে না’। বাড়িয়ে বললে ‘বাস না করা অপর জগৎ’। যেখানে সে আকাঙ্ক্ষা মাড়িয়ে পৌঁছাতে চায়। মানে ইচ্ছার অর্গল ডিঙানো পথ। প্রশ্ন হলো—ইচ্ছা ডিঙিয়ে সে কোথায় যায়? উত্তর সহজ—জাতি মাড়িয়ে সে আত্ম অনুসন্ধানের পরিচয় খোঁজে। সংবেদনশীল ইচ্ছাকে যুক্তিতে খাড়া করে। এমন যুক্তির কাঠগড়ায় ব্যক্তির পয়লা আত্মপরিচয় খাড়া হয়। প্রশ্ন জাগে, বামপিঠে ব্যক্তি নভেরার আত্মপরিচয় কোন কাঠে গিয়ে ঠেকে? নভেরা আহমেদের ডাকনাম ‘বুনো’। নামডাকের পেছনে একচিল্লা কাহিনি আছে। কাহিনিকার নভেরার অর্ধাঙ্গ ফরাসি শিল্পী গ্রেগোয়া দ্য ব্রুনস। সন-তারিখ হিসাব কষলে গ্রেগোয়ার কথা অতি কাহিনি কিংবা নতুন মিথ বলেই মনে হতে পারে! গ্রেগোয়ার কাহিনিতে গেল শতাব্দীর তিরিশের দশকে মাত্র সাত বছরের এক বাঙালি শিশুর ভাস্কর হওয়ার বাসনায় গো-ধরা, এ-এক আশ্চর্য আধুনিকতা বটে!

নভেরা আহমেদের উন্মেষকালে দেখা যাবে—শিল্পচর্চায় পশ্চাৎপদ বাঙালি মুসলমান সমাজের আরেক কার্যকারণ। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজেও ছিল চাহিদামাফিক পেশার প্রতি আকর্ষণ। বাবা-মা পড়াতে চান আইনশাস্ত্র আর নাবালিকা নভেরা পড়তে চান ভাস্কর্য। মনোবাঞ্ছার বাসনায় জেদি নভেরা ঘরের সব জিনিস ভাঙেন। সেই থেকে তাঁর নামডাক হয় ‘বুনো’। বুনো কি পদ আর পদার্থ? বাংলায় বুনো শব্দের নানা অর্থ। চলতি বাংলায় বুনো মানে বনে যে থাকে। আরও অর্থ আছে—‘জংলি’, ‘অসভ্য’, ‘বর্বর’ ইতি আদি। কিন্তু পারিবারিক ভাবলে বুনো নামটি বেশ আহ্লাদি। স্নেহভরা আদুরে আদুরে ভাব। মানে ব্যক্তির স্বভাব নামের অভাব পূরণ করে। মানে স্বভাব প্রকৃতিই ব্যক্তির নাম ঠিক করে। প্রেমিক গ্রেগোয়া উপমা দিয়েছেন খুব সুন্দর। নভেরার স্বভাবকে তিনি বলেছেন, ‘জঙ্গলের বুনো চিতার মতো’! বোঝা যায়, গ্রেগোয়া অনড় বাসনা অর্থে উপমা ব্যবহার করেছেন। বামপিঠে নভেরাও ছিলেন তা-ই! বেলাশেষে নভেরার ইচ্ছার কাছে তাঁর বাবা পরাস্ত হননি। বাবা লন্ডনে পাঠালেন আইন পড়তে। কিন্তু নভেরা পড়েছেন ভাস্কর্যকলায়। প্রকৃতির সঙ্গে স্বভাব মিললে ব্যক্তির জয় হয়। নভেরা আহমেদের বেলায় তা-ই ঘটেছে।


কথাটি অত্যুক্তি নয়—বাংলাদেশের চিত্রকলার উন্মেষ ভারতীয় চিত্রকলার বিকাশের পটভূমিতেই। দেশভাগের আগে ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোয় অখণ্ড ভারতের সংস্কৃতি চারুবিদ্যার যে মনন সৃষ্টি করেছে, তারই প্রভাব বলয়ে বাংলাদেশের শিল্পকলা প্রসারিত হয়। ঔপনিবেশিক বাংলাদেশে আধুনিক চিত্রকলা চর্চার কাঠামোগত আকার দেন কিংবদন্তি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। শিল্পাচার্যের হাতেই রূপ পায় চারুবিদ্যাপিঠ। ভাস্কর নভেরা আহমেদ জয়নুলের অনুজ। তবে সমকালীন শিল্পী। জয়নুল আবেদিন যেমন বাংলাদেশের চিত্রকলার অর্গল খুলেছেন, ঠিক তেমনি নভেরা আহমেদ ভাস্কর্যশিল্পের প্রথম দিগ্বলয়ী শিল্পী। জয়নুল আর নভেরা দু’জন দুই মাধ্যমের শিল্পী। জয়নুল চিত্রশিল্পী আর নভেরা ভাস্কর্যশিল্পী। ফলে শিল্পের সুষমা আর কাঠামোগত জগৎ আলাদা। সৌন্দর্যের রূপ রূপায়ণের বেলায়ও ভিন্ন ভিন্ন। সেটা কেমন? বাংলাদেশের চিত্রকলায় ইউরোপীয় প্রভাব কখনো সরাসরি আবার কখনো পরোক্ষভাবে সাঙ্গ পায়। প্রথম সারির শিল্পী জয়নুল আবেদিনের বিকাশ ব্রিটিশ ভারতের চারুবিদ্যার ঔপনিবেশিক কাঠামোয়। বলা চলে, ইউরোপীয় পরোক্ষ আধুনিকতায় জয়নুল চারুবিদ্যা সাজিয়েছেন। জয়নুল পশ্চিমের সঙ্গে দেশীয় উপাদানের আধুনিক মেলবন্ধন ঘটান। কারণ সৌন্দর্য প্রভাবের সঙ্গে শিল্পের দেশীয় উপাদানের সম্পর্ক সর্বদাই ধনাত্মক বটে। তাতে নিজের নতুন আত্মপরিচয় ঘটে। মনে হতে পারে, আকারে কিংবা ফর্মে আধা-ইউরোপীয় আর আধা-দেশীয় শিল্প বটে! কিন্তু নভেরার বেলায়ও সেটা সম্পূর্ণ আলাদা নয়। 

‘কাব্যকলা’ বইয়ে আরিস্তোতল বলেছেন, ‘অনুকরণ পদার্থ হচ্ছে প্রকৃতির স্বভাব।’ কারণ মানুষ যা দেখে, দৃশ্য বা বস্তুর উৎপাদন, নির্মাণ, ভোগ কিংবা উপভোগের ভেতর দিয়ে তা শেখে। কেন? বিদ্যার্থী নভেরার আধুনিকতা তালিম ভারতে নয়, পশ্চিমেই। ভাস্কর নভেরার শিল্পের উন্মেষ ঘটে পাক-উপনিবেশ আমলে। জয়নুল আর নভেরা—দুজন মহান শিল্পীর শিল্পের প্রকরণ-কৌশল প্রায় পশ্চিমাই। দু’জনেই পুব আর পশ্চিমের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন, যা উপাদানের স্থানিকতার সঙ্গে পশ্চিমা শিল্পের কৃৎকৌশল বটে! তা নিয়ে নানা সমালোচনা সম্ভব। কিন্তু যেখানে আনুষ্ঠানিক শিল্পবিদ্যা চর্চাই নেই, সেখানে আধুনিক শিল্প কাঠামোর সঙ্গে পুবের উপাদান মিলিয়ে নতুন শিল্প প্রকরণ সৃষ্টি কম কথা নয়। সেই সৃষ্ট ক্যানভাসের চিত্রকলায় প্রথম জয়নুল আবেদিন আর ভাস্কর্যে প্রথম নভেরা আহমেদ। খোদ জয়নুলই নভেরার প্রথম শিল্প প্রদর্শনী ‘ইনার গেইজ’কে বলেছিলেন, ‘ছোট-খাটো বিপ্লব’!


ভাস্কর নভেরা আহমেদ সত্যিই কি ‘ছোট-খাটো বিপ্লব’? খুব যে শ্রেণি সংগ্রামের চেতনা থেকে নভেরা শিল্প সৃষ্টি করেছেন, তা নয়। এমন নয় যে শিল্পে ‘শ্রেণি বিপ্লব’ করেছেন তিনি। শিল্প নির্মাণে শিল্পীর সর্বদা শ্রেণি সচেতন হবে এমন বিধি নেই। তিনি চাননিও হয়তো। চেতনাগত জায়গা থেকে আবহমান আর প্রকৃতিবাদী ছিলেন তিনি। অনগ্রসর একটা সমাজে তাঁর শিল্প সমাজ আর সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটায়। কেননা তাঁর ভাস্কর্য রাষ্ট্র-সমাজ আর সংস্কৃতিকে আমূল বদলে দেয় না, একটা গতিমুখের সন্ধান দেয়। কারণ পাক-আমলে পূর্ববাংলায় নভেরার হাতেই প্রথম ভাস্কর্যের উদ্বোধন হয়। তবে নভেরার ক্ষেত্রে দুটো জিনিস কাজ করেছে। প্রথম জীবনে জাতীয়তাবাদ, দ্বিতীয় জীবনে ছেনেছুনে বৈশ্বিক—সেটা কীভাবে? 

জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে শিল্পে রাজনৈতিক দায় অনেক। জাতীয়তাবাদ স্থানিক আকাঙ্ক্ষার সংস্কৃতি। আত্মপরিচয়ের সন্ধান করে। শিল্পে সেটা জনমানস নির্মাণ করে। সেই অর্থে রাজনীতি সচেতন তো বটেই, রাজনৈতিক দায় এড়িয়ে যাননি ভাস্কর নভেরা আহমেদ। সমাজ আর সংস্কৃতি রূপান্তরের প্রশ্নে একধাপ আগানো ছিলেন তিনি। বিশেষ করে, ভাষার অধিকার আন্দোলনের শহীদের বেদি নির্মাণে অগ্রগণ্য দুজন শিল্পীর একজন নভেরা আহমেদ। দু’জনের মধ্যে কে প্রথম, কে দ্বিতীয় সেই তর্ক এখন বাতুলতা মাত্র নয়। কারণ নভেরার প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি এখনো আসেনি। তবে ইতিহাস তার প্রয়োজনে সত্যটুকু খুঁজে নেবে একদিন। কেননা ইতিহাসে সত্য শূন্যস্থানের অধিক। ইতিহাস সর্বদা বর্তমান থাকে। সেটা অতীত সৃষ্টি আর নির্মাণকে সামনেই আনে। সত্যের প্রয়োজনেই ইতিহাস তার শূন্যস্থান পূরণ করে। স্থানিকতা আর রাজনীতির কারণে শিল্পের মান ক্ষুণ্ন হোক নভেরা সেটা চাননি। তিনি প্রকৃতির সঙ্গে শিল্পের সম্বন্ধ রচনা করেছেন। কারণ প্রকৃতির উপাদান আর দৃশ্যজগৎ হুবহু হাজির করেননি তিনি। আগলে নিয়েছেন পশ্চিমা শিল্পের ভাষা। শিল্পের ভেতর প্রয়োগ করেছেন দেশীয় উপাদন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিল্পের জাগতিক উপাদানকে বদলে দিয়েছেন। শিল্পের বদল সৃষ্টির সৌন্দর্যের সঙ্গে গাঁথা। নভেরার শিল্পে সৌন্দর্য কী? 

রাজনৈতিক মনস্কতার বাইরে নভেরার শিল্পের সৌন্দর্যের দুটো দিক আছে। এক মনোজগৎকে নাড়িয়ে দেওয়া আর দৃশ্যকল্পের জগৎকে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলা। ব্যক্তির প্রয়োজনের অধিক কল্পনাশ্রয়ী জগৎ সৃষ্টি করা। সে জগৎ বস্তু চ্যুতি নয়, চ্যুত বস্তুর প্রতিনির্মাণ; যা সরল সংবেদনশীল নতুন আকার দেয়। ফলে শিল্প তাঁর কাছে সৌন্দর্যের এক বৈশ্বিক আকার। 


১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীন হয়। ব্রিটিশ শাসকের দাওয়া দ্বিজাতি তত্ত্বে ভাগ হয় ভারত ও পাকিস্তান। ফলে কাল বিকাশের দিক থেকে ব্রিটিশ কলোনিয়াল যুগ বলয়ের শিল্পী নভেরা আহমেদ। কারণ ব্রিটিশ শাসকরা উপমহাদেশ ছাড়লেও তার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর আইনগত কাঠামোই বলবৎ ছিল দেশ দুটিতেই। দেশ ভাগের ‘যুগ-যন্ত্রণা’, ‘হিন্দু-মুসলমান বিভাজন’ কিংবা ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নানা রাজনৈতিক বাতাবরণ তাঁর শিল্পকর্মে বিশেষ নাই বললে চলে। এটা শিল্পে না থাকাটা দোষের নয়! নভেরাও হয়তো চাননি এই পথে তাঁর শিল্পকর্ম দানা বাঁধুক। মূলত মূলধারার রাজনৈতিক চেতনা থেকে উৎসারিত যে শিল্প তা থেকে সচেতনভাবে নিজেকে বিযুক্ত রেখেছেন তিনি। তবে হলফ করে বলা যায়, ভাস্কর্য শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে নভেরা একাডেমিক পদ্ধতিকেই অনুসরণ করেছেন। কেননা তাঁর শুরুর দিককার শিল্পকর্ম প্রাতিষ্ঠানিক ফর্মের বাইরের জিনিস নয়। ইংল্যান্ডের বিদ্যালয়ে শিক্ষার কারণে পশ্চিমা আধুনিকতা তাঁর শিল্পকর্মকে আচ্ছন্ন করে রাখে। বিশেষত পশ্চিমের আধুনিক স্কাল্পচারিস্ট হেনরি মুর আর বারবারা হেপওর্থের শিল্পকর্মের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। লক্ষ্য করার বিষয়, এই প্রভাব অনুকরণ নয়। ফর্ম বা ধরনের বিষয়। আদল বা আকার নয়। দর্শনশাস্ত্রে আদল আর প্রভাব এক ভাব নয়। আদল মাত্র অনুকরণই। মানে একই গঠন রূপে যার বিকাশ। আর প্রভাব ভাবের অপর রূপ। প্রভাব আদলকে বদলে দেয়। শিল্পের ইতিহাসের দিকে তাকালে এই প্রভাব নতুন প্রকরণেরও জন্ম দেয়। তবে না পারাটা শিল্পীরই অক্ষমতা বৈ, অন্যকিছু নয়। শিল্পী নভেরার শিল্পকর্মে আদলের ব্যাপারে সেটা সর্বৈব সত্য নয়। তবে মুরের ঘরানা হিসেবে নভেরার শিল্পকর্মকে বিবেচনা করা যেতে পারে। ভাস্কর্য নির্মাণেও পুরোদস্তুর প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন নভেরা আহমেদ। 


একবাক্যে সবাই স্বীকার করেন, নভেরা আহমেদ আধুনিক ভাস্কর ও শিল্পী। পশ্চিমা আধুনিক ভাস্কর্যরীতির প্রধান ভিত্তি তিনটি—নগরায়ন, কারখানা বিপ্লব ও চিন্তার ইহজাগতিকতা। তার নানা শাখা-প্রশাখা আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, নভেরা কোন ধরনের আধুনিক? আমাদের বিবেচনায় নভেরার ভাস্কর্য চিন্তায় গোড়ায় আছে ‘মডার্ন কনস্ট্রাকটিভিস্ট আর্ট’। বিংশ শতকের আদিতে ইউরোপে এই আন্দোলন শুরু হলেও রাশিয়ায় এই শিল্পান্দোলন নতুন রূপ পায়। বিশেষত রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লবের পর স্থাপত্য আর শিল্পকলায় বিমূর্ত ভাবধারাকেই কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এই শিল্পান্দোলন। প্রখ্যাত শিল্পী ভ্লাদিমির তাতলিন, কাসিমির মেলভিচ, আলেকজান্দ্রা এক্সটার, রবার্ট অ্যাডামস, এল লিসিৎকির নেতৃত্বে ১৯১৩ সাল থেকে ১৯৪০ নাগাদ চলে এই আন্দোলন। শিল্প আন্দোলনের ক্ষেত্রে এটা ছিল রাশিয়ার আভাগার্দ। ভ্লাদিমির তাতলিনের ১৯১৯ সালের ‘মনুমেন্ট টু দ্য থার্ড ইন্টারন্যাশনাল’ শিল্পসভায় ‘বাস্তব স্থানে বাস্তব বস্তু’র ধারণাকে সামনে আনেন। বিমূর্ত এই ভাবধারা ছিল মূলত স্বল্পাবেগী, নিরীক্ষামূলক শিল্পের জ্যামিতিক ফর্ম। কনস্ট্রাকটিভিস্ট তাতলিনরা এই আন্দোলনে নিছক বস্তু নির্ভর বিমূর্ত শিল্পের চর্চা করেছিলেন। অন্যদিকে একই ভাবধারায় পাবলো পিকাসো ভাস্কর্যে মানবিক বিমূর্ততার চর্চা করেছিলেন। 

আধুনিক এই কনস্ট্রাকটিভিস্ট আন্দোলন কিছুটা প্রভাব ফেলে কিউবিজমের ওপরই। ইন্ডিভিজুয়াল ফর্মের এইসব শিল্পকর্ম নতুন মাধ্যমেই (নিউ মিডিয়া) প্রকাশ পায়। বলা চলে, সহজ (ন্যাচারাল) চিন্তা প্রসূত শিল্পের সুশৃঙ্খল শৈলী তৈরি করা। হেনরি মুর, বারবারা হেপওর্থ কিংবা পাবলো পিকাসোর কিছু ভাস্কর্যে সেই ভাবধারার সহজ প্রকাশ ঘটান। মানে মানবিক বিমূর্ত অবজেক্টে সূক্ষ্মতম বা নিপূণ সৌন্দর্য সৃষ্টি করেন। শিল্পী নভেরা আহমেদ এইসব শিল্পীর প্রভাবকেই বহন করেছেন। যেই ক্ষেত্রে মুর কিংবা বারবারা সহজ প্রকৃতির, সেই ক্ষেত্রে নভেরা অনেকটাই সরল (নাইভ) প্রকৃতির। সহজ এই অর্থে, বস্তু চেতনাগত জায়গায় ভাবগত রূপ লাভ। বস্তু উপর ভাব আর চিন্তার ভাষা সহযোগে ভর করে। আর সরল (নাইভ) এই অর্থে, বস্তু ভাবগতভাবে অপর ভাব না নিয়ে ভাবেরই সরল প্রভাব বলয়ে থাকা। তাঁর এই সরলতার দেখা মেলে ‘কম্পোজিশন’ সিরিজের ভাস্কর্যগুলো। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, নভেরার এই রূপ মুরেরই ‘সরল রূপ’। কারণ নভেরা মুরের স্ট্রাকচার ভাঙেননি। সরলধারা বহন করেছেন তিনি। কেননা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘সহজ আকার’ বা ‘ইউনিভার্সাল অবজেক্ট’ শিল্পের গঠন-প্রণালী প্রভাবকে স্পষ্ট করে তোলে। কারণ নভেরার ‘কম্পোজিশন’ সিরিজের শিল্পকর্মে দেখা মিলছে, ত্রিডি ডাইমেনশনের ভাস্কর্য। মানবিক বিমূর্ত আকারের এই ভাস্কর্যগুলো চতুর্দিক থেকে দেখা যায়। বিশেষত ফিগার বা অবজেক্টের মাঝখানে ফুটো করে অপর প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছেন তিনি। এই ধরনের ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে দুটো জিনিস ঘটে। 

প্রথমত, ‘আকার’ বা ‘অবজেক্ট’ নিছক ‘আকার’ বা ‘অবজেক্ট’ আকারে থাকে না। আকার জমিনেরই অবজেক্ট স্পেসেরই অংশ হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, অবজেক্টের ভেতরকার শূন্যস্থানে অন্য স্পেস বা প্রকৃতি ভর করে। অবজেক্টের পেছনের অবজেক্টও একইসঙ্গে হাজির হয়। তবে শূন্যস্থান দিয়ে আলোর প্রতিসরণ বা প্রকৃতির অপর রূপে অবজেক্ট বা ফিগার নান্দনিক রূপ লাভ করে। মানে প্রকৃতির এক-শয্যার ভেতর প্রতি-শয্যা সৃষ্টি করা। বিমূর্ত কল্পনার এই পদ্ধতি হেনরি মুরের শিল্পকর্মে দেখা যায়। নভেরার কোনো কোনো কাজে হেনরি মুরের শয্যার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তবে তিনি দেশজ উপাদানের সংস্কৃতিতে নতুন ভাস্কর্য সৃষ্টি করেছেন।  সেই অর্থে নভেরা সহজ নয়, সরল। সহজ যেমনি ভাব বিলয়ে নতুন ভাব সৃষ্টি করে, সরল অনুরূপ তেমনটি নয়। সরল ভর বিন্দুর উপরই গড়ায়। সরলে বস্তুর আকার অপর বস্তুর স্বর বা ভাষার ভার বহন করে। বিশেষত মুখাবয়বের বিমূর্ততার কারণেও এই প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। শিল্পে প্রভাব মন্দ কিছু নয়। প্রভাব চিন্তার গতিমুখ চিহ্নিত করে। মানে শিল্পী উন্মেষ কালকে ঐতিহাসিকভাবে রূপান্তর করে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে নভেরার ভাস্কর্যের ভিন্নতা কোথায়?

‘কম্পোজিশন’ সিরিজে নভেরার ফারাক ভাস্কর্য গঠনের স্টাইলে আর ম্যাটেরিয়ালে। ফিগারের ক্ষেত্রে মুর যেখানে বৃত্তাকার জ্যামিতিক ফর্মে ভাস্কর্য গড়েন, নভেরা সেখানে গড়েন উলম্ব বা খাড়া প্রকৃতির ভাস্কর্য। নভেরার ভাস্কর্যের ফিগার বিমূর্ত। গড়নে হালকা প্রকৃতির। ভাস্কর্যের ফিগারের ক্ষেত্রে দেখা যায়, টানটান মাথা থেকে দেহ ‘জিরাফের গলা’র মতো লম্বা। উলম্ব আর খাড়া প্রকৃতির। এই ধরনের ভাস্কর্য ভর কেন্দ্রে এক ধরনের টেনশন সৃষ্টি করে। কেননা ভর বিন্দুর ভার হতে ফিগারের গড়ন লম্বা মনে হয়। নভেরার এই ফর্মকে বদলিয়ে ফিগারের গঠনের সাথে মিলিয়েছেন বাংলাদেশের নাইভ আর্টের। টেপা পুতুলে ফিগারের যে সরল ভঙ্গি সেটা আধুনিক মেজাজে ব্যবহার করেছেন। কেনো নভেরার ভাস্কর্যের ফিগার আধুনিক? 

ম্যাটেরিয়ালের দিক দিয়ে ট্যাপা পুতুল মাটির তৈরি ভঙ্গুর প্রকৃতির। ফলে এগুলো ক্ষণস্থায়ী। ট্যাপা পুতুলে ফিগারের গঠন বাস্তবধর্মী। অনেকাংশে স্টিল লাইফের মতো। নভেরা সেই ক্ষেত্রে ভিন্ন প্রকৃতির। ম্যাটেরিয়াল হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছেন সিমেন্ট। স্থাপত্যের স্থায়ীত্ব তাঁর ভাস্কর্যের নাইভ বা সরল আকারকে স্থায়ী করে তুলেছেন তিনি। শিল্পকে বাস্তব আকার থেকে বাড়িয়ে তোলার যে সৌন্দর্য সেখানে তিনি অনন্য হয়ে আছেন। দর্শনের দিক থেকে বলা যায়, বাস্তবের আকার দিব্য-ইমেজেরই প্রতিস্থাপন। সৌন্দর্যও তখন বাস্তবের রূপ। বাস্তবের আকার যখন অপর আকার নেয়, তখন ‘প্রয়োজনের বাড়া সৌন্দর্য আকারে ধরা’ দেয়। বাস্তব মানে ধরা আকার। ধরা ভাবের এই অধরা রূপকে আমরা বলছি, বিমূর্ত রূপ। নভেরার ভাস্কর্যের এতেই বাড়তি রূপেই নিহিত।

৬    
১৯৬০ সালে প্রথম ঢাকায় নভেরা আহমেদের একক ভাস্কর্য প্রদশর্নী হয়। ‘ইনার গেইজ’ বা ‘মনোলোক’ নামের এই প্রদর্শনী তাঁকে চরম খ্যাতি এনে দেয়। নামায়নের ক্ষেত্রে ‘ইনার গেইজ’ বা ‘মনোলোক’ ভাবধারাও মন্দ নয়। বস্তুর অচেতন থেকে যে ভাষা তৈরি হয় সেটাই তো ‘মনোলোক’। আমরা হয়ত বলতে পারতাম, ‘মনের আলো’। সদা দীপ্ত থাকা জ্যোতি। সেও এক অপার সম্ভাবনা। তো ঢাকায় পূর্ণাঙ্গ আর্ট কলেজ হবার ৪ বছর আগেই এই প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। কেননা ১৯৬৪ সালে ভাস্কর্য বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। ফলে নভেরা প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যায়তনিক সময়ের আগেই ভাস্কর্য শিল্পী হিসেবে ‘মাইলফলক’ হয়ে আছেন। তৎকালীন লাহোর আর্ট কাউন্সিলের সেক্রেটারি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, সাংবাদিক এস এম আলী ও আবদুস সালামের লেখা ওই প্রদর্শনীর ক্যাটালগে ছাপা হয়। দুয়েকটা উদাহারণ টানছি। কারণ যেই অর্থে বলা হয়, ‘নভেরা আহমেদ শিল্পী হিসেবে সমকালে অবহেলিত ছিলেন’ কথাটা সর্বাংশে ঠিক নয়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন লিখেছেন, ‘১৯৫৭ সালে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের দেয়ালে উদ্ভাসিত ফ্রিজ ও ১৯৫৮ সালে খোলা আকাশের নিচে ভাস্কর্য—পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পাঙ্গনে নভেরা আহমেদের এ দুটো শিল্পকর্মকে ছোট বিপ্লবই বলা যায়।’ জয়নুলের ‘বিপ্লব’ সংস্কৃতির কেন্দ্র থেকে দেখা শ্রেয়। শিল্প বিপ্লবের পাত্র নয়, সংস্কৃতির নব-রূপান্তর বৈ মাত্র। ফলে জয়নুলের ‘বিপ্লব’ আদিখ্যেতা সংস্কৃতির ক্রিয়া হিসেবে জায়মান। ফয়েজ আহমদ ফয়েজের মত, ‘কৃত-কৌশলের দিক থেকে নভেরা আহমেদ বিমূর্তবাদী।’ পাকিস্তান অবজারবারের সম্পাদক আবদুস সালামের ভাষ্য, ‘নিপূণ, সৌষ্ঠব আর আধ্যাত্মিকতায় ভরা তার এমন কাজ, এদেশে হালনাগাদ একদমই বিরল।’

উদাহরণ আরও টানা যেত। আমরা সে পথ মাড়াইলাম না। প্রকৃতি আর প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে নতুন চিন্তা নিয়েই নভেরার শিল্পকর্ম দৃশ্যমান। তাঁর কাজে আধ্যাত্মিকতার চেয়ে বাস্তবধর্মীতাই বেশি। কারণ নভেরা কাজের ভেতর দিয়ে পশ্চিমা চিন্তার সঙ্গে দেশীয় উপাদানের শিল্প সম্পর্ক উৎপাদন করতে চেয়েছেন। তিনি সফলও হয়েছেন বিস্তর। এটি তাঁর শিল্পের কাঠামোগত ধরন। কেননা ১৯৬১ সালে ‘চাইল্ড ফিলোসফার’ ভাস্কর্যটির নামকরণই বড় সাক্ষ্য। ‘অল পাকিস্তান পেইন্টিং এন্ড স্কাল্পচার এক্সিবিশনে’ ভাস্কর্যটি শ্রেষ্ঠ পুরস্কারও লাভ করে। বাস্তবধর্মী এই কাজটি জ্যামেতিক ফর্মের। মাথা ত্রিভূজ আকৃতির। চোখ আর দেহ উপবৃত্তাকার। পুরো ভাস্কর্যে ফিগারের গঠনও ত্রিভূজের মতো কৌণিক অবস্থানকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মুখাবয়বের বাস্তবধর্মী ভাস্কর্যের আরেকটি হচ্ছে ‘বুদ্ধ’। প্রাতিষ্ঠানিক ফর্মের বাইরে কাজটি দেখলে মনে হবে, গৌতম বুদ্ধ ধ্যানরত ফিগার। দর্শনশাস্ত্র বলে, ধ্যান অচেতনেরই বিন্দুবিসর্গ। যা ব্যক্তির বাস্তবতাকে অতিক্রম করে। যা ব্যক্তিসত্তা হিসেবে হাজির না থেকে অধরা সত্তার সাথে লীন হয়ে যায়। অধরা পরকে আপন করে। মানে সত্তার মহামিলন। যেন নভেরার ‘বৌদ্ধ’ ভাস্কর্যটি আবেগমিশ্রিত ধ্যান। চোখ মুদে থাকা বুদ্ধের মুখায়বয়ব এক ধরনের নৈঃশব্দ্য সৃষ্টি করে। ভাবের প্রকাশে যেন নিপতনে সিদ্ধ হওয়া ফিগার।

তাঁর কোনো কোনো স্কাল্পচারে নামের ক্ষেত্রে বৈসাদৃশ্য আছে। জাতীয় জাদুঘরের ক্যাটালাগে ভাস্কর্যটির নাম ‘বুদ্ধ’। আর আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘নভেরা আহমেদ’ বইয়ে ছাপা হয়েছে ‘শান্তি’। একই ভাস্কর্যের দুই নাম গবেষণার দুর্বলতা বলা যায়। সে যাই হোক! ভাস্কর্যটি শীর্ষ বিন্দু হতে আনুভূমিক এবং খাড়া। ফর্ম দীর্ঘাকায় সমবাহু ত্রিভূজের ন্যায়। বিমূর্ত ফর্মের এটা দেখতে বৌদ্ধিক স্তুপা বা মিনারসদৃশ। গগনমুখী শীর্যবিন্দু দেখলে মনে হয়, শান্তিই আহবান করছে। এই ধরনের ফর্ম প্রাচীন গির্জা বা মন্দিরের ক্ষেত্রে দেখা যায়। অপরাপর ভাস্কর্যের ইমেজ হিসেবে নভেরা গরু, ছাগল, হাতি ঘোড়া, পেঁচা, মাছ, পাখি, সাপ আর বাংলার লোক সংস্কৃতির বস্তুগত উপাদান ব্যবহার করেছেন। এই উপাদানকে তিনি কখনো কখনো বস্তুর আকার বিচ্যুত করে বিমূর্ত রূপ দেন। কখনো কখনো বস্তুর প্রতি-রূপই রেখেছেন। বিশেষত ভাস্কর্যের ম্যাটেরিয়ালের দিক থেকে তাঁর সিমেন্টের কাজ বেশি। স্টিল আর ব্রোঞ্জের কাজও আছে। তুলনায় কম। 

উপাদানের দিক থেকে বিবেচনা করলে নভেরাকে মনে হবে ‘জাতীয় ভাবধারা’র শিল্পী। কিন্তু নভেরা সর্বাংশে তা নন। ভাস্কর্যের মধ্যে দিয়ে তিনি আধুনিক চিন্তা সত্তায় ব্যক্তির নিঃসঙ্গতাকে উদযাপন করেছেন। ব্যক্তির রূপকে সামষ্টিকতার রূপ আকারে দেখেছেন। সামষ্টিকতার ভেতর ব্যক্তির একক বিকাশ দেখতে চেয়েছেন। ব্যক্তির একক নিঃসঙ্গতা, ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে পরিবার, ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে প্রকৃতির যে সম্পর্ক সেটাই নভেরার ভাস্কর্যে দৃশ্যমান। যেন ব্যক্তির মুক্তি ঘটলে আপামর সমাজের মুক্তি ঘটবে। আধুনিক চিন্তা-চেতনার সমাজ-কাঠামোর এই আকাঙ্ক্ষা তাঁর ভাস্কর্যকে নৈঃশব্দ্যে পর্যবশিত করেছে। নিছক ব্যক্তি যদি রূপক হয়, তাহলে সৌন্দর্যও ব্যক্তির একক রূপ। সমষ্টির সৌন্দর্য যদি ব্যক্তির রূপক হয় তাহলে সমাজে সৌন্দর্য সামষ্টিক হয়ে ওঠে। ফলে শিল্পী হিসেবেও তিনি মিনিমালিস্ট। নভেরার ভাস্কর্যের সৌন্দর্যও ব্যক্তির উৎকর্ষতার ফল। নভেরা আধুনিক এই জন্য যে, ব্যক্তিকে সামষ্টিকের সৌন্দর্যে তুলেছেন। উদাহারণ হিসেবে ‘মাদার এন্ড টু চাইল্ড’, ‘মা ও শিশু’, ‘স্ট্যান্ডিং ওমেন’, ‘হেড অব ওমেন’ ও ‘ফামিলি’ সিরিজের কাজ ব্যক্তি সৌন্দর্যের রূপক হয়ে আছে।

১৯৭০ সালের অক্টোবরে ব্যাংককে একক প্রদর্শনী হয় তাঁর। প্রদর্শনীতে ছিল ব্রোঞ্জ, স্টিল, শিট মেটাল, ওয়েলডেড ও স্টিইনলেস স্টিলের ভাস্কর্য। ম্যাটেরিয়ালের কারণে তাঁর ভাস্কর্যের গড়নে পরিবর্তন আসে। ঘটেছে ফর্মের ভাঙাগড়া। ব্রোঞ্জের তৈরি ‘মূর্তি’ নামের ভাস্কর্যটিতে দেখা যায়, দৈহিক গড়ন মসৃণ নয়, খোদাই করা। একটা মাংসহীন আবক্ষ মেরুদণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। দার্ঢ্য বস্তুর যে ভঙ্গি সেটাই ভাস্কর্যটিতে দৃশ্যমান। বস্তুর অমরতা যেমন বস্তুকে ঐতিহাসিকতা দেয়, ঠিক তেমনি এক শিল্পকর্ম। তাঁর তৃতীয় প্রদর্শনী হয় প্যারিসে, ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে। ‘নৃত্যহীন’ নামের ভাস্কর্যে দেখা যায়, এক পায়ের উপর ভর বিন্দু। অন্য পা শূন্যে তোলা। দৈহিক বিচ্যুতির যে রূপ সেই রূপ বেদনা নিমগ্ন এক বিমূর্ত মানুষের অবয়ব। কিংবা ‘সূর্যমুখি নারী’ যেন কোনো এক আলোর কাছে মুক্তি খুঁজছেন। কেননা ব্যক্তির স্বাধীনতার বাসনা অপর যুক্তির পরে খাড়া। প্রকৃতি ব্যক্তির চিন্তার জন্ম দেয়। আর ব্যক্তির চিন্তা প্রকৃতিকে পাল্টায়। নভেরার ভাস্কর্য যেন সেই পথই ধরে আছে।

৭  
শিল্প বাজারে নভেরা আহমেদকে নিয়ে নানা মিথ চালু। তবে মিথের উড়ুখই নিয়ে কথা নয়। কথা হলো—প্রথাগত সমাজে রীতি আর অনুশাসনের বাইরে থাকতে চেয়েছেন তিনি। নানা সামাজিক কুসংস্কার আর প্রথাবিরোধী সংস্কারে অগ্রগামী থেকেছেনও তিনি। ফলে কিংবদন্তির জীবন তাঁকে অনেক দূর নিয়ে গেছে। শেষ জীবনে থিতু হয়েছিলেন ফরাসি দেশে। যাপন করেছেন শিল্পীর জীবন। ‘জাতীয় ভাবধারা’র সঙ্গে ‘পাশ্চাত্য ভাবধারা’র ভেদাভেদ ঘুচিয়ে শিল্পে-জীবনে জায়মান থাকা চাট্টিখানা কথা নয়। ফলে জীবনে বহু উঁচু-নিচু পরিখা পাড়ি দিতে হয়েছে তাঁকে। তবে সংগ্রামী নভেরা আহমেদ কি নারীবাদী? ‘এটা কি তবে শিল্প’ পুস্তককে সিনথিয়া ফ্রিল্যান্ড অনুশাসিত সমাজের নারীবাদীদের ভাগ করেছেন দুভাগে। এক ভাগে ‘নারীর মিলন’ আর অপর ভাগে অনুশাসনের ‘ধারণা বদলে দেওয়ার নিরীক্ষা’। নভেরা জীবনকে বেছে নিয়েছিলেন ‘ধারণা বদলে দেওয়ার নিরীক্ষায়’। ফলে নভেরা সবসময় আমাদের কাছে নতুন রূপে হাজির হয়েছেন। ভবিষ্যতেও হাজির থাকবেন। হাজির যেভাবে—ফারসি ‘নভেরা’ শব্দের অর্থ ‘নতুন দিন’। সত্যিই নভেরার আধুনিক ভাস্কর্য একটা নতুন দিন এনেছিল পূর্ব বাংলা, তথা বাংলাদেশে। নভেরা আহমেদ থাকবেন নতুন দিনের শিল্পে আর সুন্দর সুষমায়। 

[কিংবদন্তি ভাস্কর নভেরা আহমেদকে নিয়ে বিদ্যমান প্রবন্ধটি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত ‘৬ষ্ঠ জাতীয় প্রদর্শনী ২০২৪’-এর আলোচনা সভায় পঠিত।  তাঁর জন্ম সাল পাসপোর্ট থেকে নেওয়া হয়েছে। যদিও পারিবারিক হিসেবে তাঁর জন্ম ১৯৩০ সালে।] 
 

তারা//

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ই ভ স কর য ক ভ স কর য র চ ত রকল র জন ত ক আহম দ র শ ল পকল আর প র ত র এক র গঠন ধরন র র অপর প রথম র একক ইউর প

এছাড়াও পড়ুন:

সামারিক শক্তিতে মিয়ানমারের চেয়ে ২ ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ

চলতি বছর সামরিক শক্তির দিক থেকে মিয়ানমারের চেয়ে দুই ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। চলতি সপ্তাহে সামরিক শক্তি পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার প্রকাশিত সূচকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই র‌্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সামরিক বাজেট। সেনাবাহিনীর আকার, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর শক্তিকেও বিবেচনা করা হয়েছে সমীক্ষায়।

গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ারের সূচক অনুযায়ী, বিশ্বে সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, এরপরে পরে রয়েছে রাশিয়া, চীন, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া। পরমাণু শক্তিধর হলেও পাকিস্তানের অবস্থান ১২ নম্বরে। তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে ৩৫তম অবস্থানে। বাংলাদেশের আগে রয়েছে উত্তর কোরিয়া ও আর্জেন্টিনা। আর বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমার রয়েছে ৩৭তম অবস্থানে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৬ কোটি ৬১ লাখ মানুষ সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে মোট সেনা সংখ্যা ১ লাখ ৬৩ হাজার। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে রয়েছে ১৭ হাজার ৪০০ সদস্য এবং নৌবাহিনীতে রয়েছে ২৫ হাজার ১০০ সেনা। 

অন্যদিকে, মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যা ৫ কোটি ৭৫ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হওয়ার যোগ্য। মিয়ানমারের সক্রিয় সৈন্য সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার। মিয়ানমারের রিজার্ভ সৈন্য রয়েছে ২০ হাজার। দেশটির বিমানবাহিনীতে রয়েছে ১৫ হাজার সদস্য এবং নৌবাহিনীতে রয়েছে ১৬ হাজার সেনা। 

ঢাকা/শাহেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ