পরিবারের সবচেয়ে কাছের মানুষটা এখন সবচেয়ে দূরে। আর কখনো ফিরেও আসবে না। দুই সন্তান বেড়ে উঠছে স্বজনদের কাছে। তারা সর্বোচ্চটাই করছেন। তবুও তারা বলছেন, সব চাহিদা পূরণ করতে পারলেও মায়ের অভাব পূরণ করা কী সম্ভব?

বলছিলাম চিত্রনায়িকা রাইমা ইসলাম শিমুর কথা। তিন বছর আগে ২০২২ সালের ১৭ জানুয়ারি সকাল ১০টায় কেরানীগঞ্জ থেকে শিমুর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। শিমুকে হত্যার ঘটনায় তার ভাই হারুনুর রশীদ কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় মামলা করেন। শিমুকে খুনের সংশ্লিষ্টতায় স্বামী সাখাওয়াত আলী নোবেল ও তার বন্ধু এস এম ফরহাদকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা বর্তমানে কারাগারে আছেন। 

এদিকে শিমুর দুই সন্তান-মেয়ে অজিহা আলিম রিদ ও ছেলে রায়ান। তারা শিমুর ছোট বোনের কাছেই থাকছে। শিমুর স্বজনরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন তাদের ভালো রাখার।

শিমু হত্যা মামলাটি ঢাকার ৪র্থ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। সর্বশেষ গত ১৩ জানুয়ারি মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ছিলো। ওইদিন মামলার দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা কেরানীগঞ্জ মডেল থানার সাব-ইন্সপেক্টর শহিদুল ইসলাম সাক্ষ্য দিয়েছেন। আগামি ১৬ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য করেছেন আদালত।

মামলা সম্পর্কে শিমুর ভাই হারুনুর রশীদ বলেন, “আমরা চেয়েছিলাম আরও দ্রুত গতিতে মামলাটি নিষ্পত্তি হোক। কিন্তু দেখতে দেখতে অনেকটা সময় পার হয়ে গেলো। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার শেষ হবে।” 

বোন হত্যার ন্যায়বিচার চেয়ে তিনি বলেন, “আদালতের কাছে আমাদের একটাই দাবি থাকবে আসামির যেন সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হয়। তিন বছর হয়ে গেছে। আশা করবো, এ বছরের মধ্যে বিচারটা যেন শেষ হয়।”

গত চার বছর বোনকে ছাড়া কঠিন সময় পার করেছেন উল্লেখ করে হারুনুর রশীদ বলেন, “আমার বোনকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়বিচার করবেন। বোনকে অনেক মিস করি। শিমুর ছেলে-মেয়েকে বুঝ দেওয়ার মতো আমার কাছে কোনো ভাষা নাই। তারা সব সময় মায়ের কথা মনে করে। সব চাহিদা পূরণ করতে পারলেও মায়ের অভাব তো আমার পক্ষে পূরণ করা সম্ভব না। এটা কী পূরণ করা সম্ভব? ছেলেটা ছোট, এখনো একা একা কান্নাকাটি করে। তারা মাকে অনেক মিস করে।”

তিনি বলেন, “আসামি (নোবেল) কত নিষ্ঠুর! জেলে থেকে মেয়েকে দেখে নেওয়ার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে। জেল থেকে বের হয়ে মেয়েকে মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছে। আমরা তার কঠিন সাজা চাই।”

শিমুর বোন ফাতেমা বেগম বলেন, “আমরা আশা করেছিলাম মামলাটার বিচার আরও আগে শেষ হবে। আমরা ন্যায়বিচার পাবো। কিন্তু দেশের যে অবস্থা হয়েছিলো একারণে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ন্যায়বিচার আশা করছি। সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসির প্রত্যাশা করি।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “মা তো মা-ই। সন্তানেরা মায়ের কথা বলবে, মনে করবে। আমরা সবটা দিয়েও তো মায়ের অভাব পূরণ করতে পারবো না। তবুও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, ওদের ভালো রাখার। ব্ল্যাড কানেক্টেড, স্মৃতিতে তো মা থেকে যাবে।”

ফাতেমা বেগম বলেন, “আজ আমার ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে। আমরা সব আত্মীয়-স্বজন এক হয়েছি। সবাই বোনের কথা বলে। সে থাকলে আনন্দটা আরও বেশি হতো। মেয়েটা কান্না করে। বলে, আম্মু নেই!” 

সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মোহাম্মদ সৈকত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, “মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষ ১৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করেছে। আর বাকি রয়েছে তদন্ত কর্মকর্তা। আশা করছি, খুব শিগগিরই মামলাটির বিচার শেষে রায় ঘোষণা করবেন বিচারক।” 

তিনি বলেন, “সাক্ষীদের জবানবন্দিতে আসামিদের নাম উঠে এসেছে। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে আশা করতেই পারি।”

আসামিপক্ষের আইনজীবী আবদুর রহমান (জীবন) বলেন, “শিমুর মিসিংয়ের বিষয়টা প্রথমে তার পরিবারকে জানায় জহিরুল ইসলাম আদর। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেননি বা সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি নেননি। সে কিভাবে সবার আগে এটা জানলো, মোবাইল ট্র্যাকিংও করেনি। আমরা তাকে সাক্ষী হিসেবে আদালতে উপস্থাপনের আবেদন করেছি। এছাড়া প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সাক্ষীকে পুনরায় জেরা করার আবেদন করেছি। এখনো আদেশ পাইনি। ব্যস্ততার কারণে খবরও নিতে পারিনি। আদরের সাথে শিমুর বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্ক ছিলো বলে আসামি নোবেল জানিয়েছে। এটা নিয়ে তাদের মধ্যে ঝামেলা চলছিলো। যাই হোক। আসামিদের নির্দোষ প্রমাণে চেষ্টা করছি। আশা করছি, সবাই ন্যায়বিচার পাবেন।”

জানা যায়, গত বছর ১৭ জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে স্থানীয়ভাবে সংবাদ পেয়ে কলাতিয়া ফাঁড়ির পুলিশ এবং কেরানীগঞ্জ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ ও কেরানীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হযরতপুর ইউনিয়ন পরিষদের আলীপুর ব্রিজ থেকে ৩০০ গজ উত্তর পাশে পাকা রাস্তা সংলগ্ন ঝোপের ভিতর থেকে বস্তাবন্দি অবস্থায় অজ্ঞাতনামা ৩২ বছর বয়সী এক নারীর মৃতদেহ উদ্ধার করে। মৃতদেহের পরিচয় শনাক্ত করার জন্য আঙ্গুলের ছাপ নেওয়া হয়। পোস্টমর্টেমের জন্য মৃতদেহটি মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে মৃতদেহের নাম পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়। তদন্তকালে জানা যায়, মৃতদেহটি চিত্রনায়িকা রাইমা ইসলাম শিমুর। দাম্পত্য কলহের জেরে ১৬ জানুয়ারি সকাল আনুমানিক ৭-৮ টার মধ্যে যেকোনো সময় খুন হন শিমু।

শিমুকে হত্যার ঘটনায় তার ভাই হারুনুর রশীদ কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন।

মামলাটি তদন্ত করে ২০২২ সালের ২৯ আগস্ট কেরানীগঞ্জ মডেল থানার পরিদর্শক শহিদুল ইসলাম দুই জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন। ওই বছরের ২৯ নভেম্বর দুই আসামির বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। মামলাটিতে চার্জশিটভূক্ত ৩৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। 

ঢাকা/টিপু

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স ক ষ য গ রহণ ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

অক্সিজেনের অভাবে রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ, হাসপাতাল ঘেরাও স্বজনদের

রাজশাহী মহানগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকায় মুঞ্জু হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্স না থাকায় অক্সিজেনের অভাবে বেনু বেগম (৭০) নামে অস্ত্রোপচারের এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আজ বুধবার সকাল ৮টার দিকে তিনি মারা যান।

বেনু বেগমের বাড়ি রাজশাহী মহানগরীর বোয়ালিয়া থানার সুজানগর মিতালী ক্লাব এলাকায়। তিনি মৃত মতিনের কন্যা এবং মৃত বশির আহম্মেদের স্ত্রী।

বেনু বেগমের স্বজনদের অভিযোগ, পায়ের হাড় ভেঙে গেলে গত ৬ এপ্রিল বেনু বেগমকে রাজশাহীর মঞ্জু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে তার পায়ে অস্ত্রোপচার করেন ডা. হাবিবুল হাসান। কিন্তু অস্ত্রোপচার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা তাকে কোনো পর্যবেক্ষণে না রেখে সরাসরি ওয়ার্ডে রাখা হয়। আজ বুধবার সকাল ৮টার দিকে বেনু বেগমের প্রচণ্ড শ্বাস কষ্ট দেখা দেয়। এ সময় তার জরুরি অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক ও নার্স ছিল না, ছিল না অক্সিজেনের সিলিন্ডারও। একপর্যায়ে ছটফট করতে করতে রোগী বেনু বেগম মারা যান। 

নিহত রোগীর ছেলে মো. সনি অভিযোগ করে বলেন, ‘রাতে ডা. হাবিবুল হাসান নামের এক চিকিৎসক মায়ের অস্ত্রোপচার করেন। অস্ত্রোপচার পরবর্তী তাকে পোস্ট অপারেটিভ রুমে রাখা হয়নি, সরাসরি ওয়ার্ডে রাখা হয়। সকালে মায়ের শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাকে অক্সিজেন দেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু হাসপাতালে ডাক্তার-নার্স কেউ ছিলেন না। কোনো চিকিৎসক-নার্স না পেয়ে আমরা অক্সিজেন সিলিন্ডার খুঁজেও পেলাম না। পরে অক্সিজেনের অভাবে মা মারা যান।’

এদিকে অবহেলায় বিনা বেগমের মৃত্যুর ঘটনায় রোগীর স্বজনরা হাসপাতাল ঘেরাও করে ভাঙচুরের চেষ্টা করেন। এ সময় হাসপাতালের পরিচালক মিঠুন কুমারসহ অন্যান্য স্টাফরা পালিয়ে যান। পরে সেখানে ছুটে যান পুলিশ সদস্য ও সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর বিএনপি নেতা বেলাল আহমেদ। এ সময় হাসপাতালের মালিকপক্ষের সঙ্গে তারা প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক করেন। 

বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বিএনপি নেতা বেলাল আহমেদ বলেন, ‘অক্সিজেনের অভাবে রোগী মারা গেছেন। এখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ক্ষমা চেয়েছে, তাই পরিবার ক্ষমা করে দিয়েছে। মামলা করলে লাশ ময়নাতদন্ত করতে হবে। এসব ঝামেলায় আমরা যাব না। তাই আমরা লাশ নিয়ে চলে যাচ্ছি। এটাই সমঝোতা বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

এদিকে হাসপাতাল পরিচালক মিঠুন কুমারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। 

তবে মুঞ্জু হাসপাতালে দায়িত্বরত ও রংপুর মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি পরিচয় দেওয়া চিকিৎসক শহিদুল ইসলাম রবিন বলেন, ‘আমি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আরএস হিসেবে আছি। এখানে মব হচ্ছে শুনে, দৌড়ে এলাম মব ঠেকাতে। রোগীর লোকজন যেসব অভিযোগ করেছে, তা সত্য নয়। পোস্ট অপারেটিভ রুম, অক্সিজেন, নার্স সবই আছে। রোগীর হয়তো অন্য কোনো সমস্যা ছিল, তাই শ্বাসকষ্টে মারা গেছেন।’

রোগীর অপারেশন করা চিকিৎসক ডা. হাবিবুল হাসানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি তা ধরেননি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গৃহবধূর লাশ উদ্ধার, পরিবার বলছে ‘এআইয়ে বানানো আপত্তিকর ভিডিওর’ জেরে আত্মহত্যা
  • এআই’র তৈরি ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ায় আত্মহত্যা করেন সুলতানা, দাবি স্বজনদের
  • অক্সিজেনের অভাবে রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ, হাসপাতাল ঘেরাও স্বজনদের