এ যেন ঘোড়ার আগেই লাগাম কেনা। চাহিদা না বাড়লেও একের পর এক গড়ে তোলা হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র। সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন না করেও ব্যবসায়ীরা পেয়ে গেছেন টাকা। জনগণের টাকার এমন শ্রাদ্ধ হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে। এ সময়ে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের পকেটে গেছে। খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে অস্বাভাবিক হারে। এতেই শেষ নয়; অসম চুক্তি, ভুল নীতি ও অনিয়মের কারণে আরও দুই যুগের বেশি সময় দেশবাসীকে টানতে হবে ঘানি।

বর্তমানে চাহিদার চেয়ে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৫৪ শতাংশ বেশি। বেসরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ না কিনলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিদ্যুৎ খাতের সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার বিগত সরকারের চুক্তি খতিয়ে দেখতে জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি গঠন করেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার এই চক্র থেকে সহসাই মুক্তি মিলবে না। 

বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৭ হাজার ৭৯০ মেগাওয়াট। দেশে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুতের চাহিদা থাকে গরমে– এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে। 
বিদ্যুৎ বিভাগ গত বছর গরমে সর্বোচ্চ চাহিদা ধরেছিল ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। তবে এখন পর্যন্ত দৈনিক সর্বোচ্চ উৎপাদন ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। এ বছরের গরমে সর্বোচ্চ চাহিদা যদি ১৮ হাজার মেগাওয়াট ধরা হয়, তাহলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এর চেয়ে ৯ হাজার ৭৯০ মেগাওয়াট বেশি। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা ৫৪ শতাংশ বেশি। রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণের বিবেচনায় চাহিদার চেয়ে উৎপাদন সক্ষমতা কিছুটা বেশি থাকতে হয়। একে রিজার্ভ মার্জিন বলে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে রিজার্ভ মার্জিন হিসাবে চাহিদার ২০ শতাংশ বেশি থাকা উচিত। সে হিসেবে বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতা হওয়ার কথা ২১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। পিডিবির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, রিজার্ভ মার্জিন ২০ শতাংশের আশপাশে থাকা ভালো। এর বেশি হলে ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি দিতে হবে। আর কম হলে লোডশেডিং হবে।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাড়ার মূল কারণ ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা, ভুল নীতি ও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সক্ষমতা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এ বিষয়ে বলেন, উৎপাদন সক্ষমতা বেশি থাকার কারণে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) খরচ বেশি হচ্ছে। বছর বছর ভর্তুকি বাড়ছে। খরচ সামলাতে অস্বাভাবিক হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। 

যেভাবে মুনাফা লুটেছে বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীরা
আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ খাতে ডজনখানেক কোম্পানি ফুলেফেঁপে উঠেছে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। তাঁর অফিস থেকেই তাঁর নির্দেশনায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ দেওয়া হতো পছন্দের কোম্পানিকে। বিশেষ আইনের সুযোগ নিয়ে টেন্ডার ছাড়াই নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে চুক্তি সই হতো, প্রয়োজন না থাকলেও মেয়াদ বাড়ানো হতো। 

এমন সুবিধা পাওয়া কেন্দ্রগুলোর একটি যুক্তরাষ্ট্রের এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল। তাদের ঘোড়াশাল ১৪৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি ২০১০ সালের আগস্টে উৎপাদনে আসে। কেন্দ্রটির জন্য এগ্রিকোর বিনিয়োগ ছিল ৫৬০ কোটি টাকা। তিন বছর মেয়াদি কেন্দ্রটির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চালানো হয়। এই আট বছরে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা, যা বিনিয়োগের প্রায় সাড়ে চার গুণ। এভাবেই বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীরা শত শত কোটি টাকা নিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনেও এমন চিত্র উঠে এসেছে।  
এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দিয়ে কমিশন বাণিজ্য হয়েছে। এর মাধ্যমে ৩০০ কোটি ডলার নয়ছয় হয়েছে। বিনা দরপত্রে চুক্তি করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি চার্জ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। কয়েকবার চুক্তি নবায়নের সময়ও তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আমলা, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড.

তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঘনিষ্ঠতা ব্যবসায়ীদের সুবিধাজনক (বাড়তি) দর, শর্ত ইত্যাদি আদায়ের সুযোগ করে দিত। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া এ ধরনের চুক্তি সম্ভব নয়।

বেশির ভাগ কেন্দ্রের সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার হয়নি
পিডিবির তথ্যমতে, ২০০৯-১০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১৫ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। পরিসংখ্যান বলছে, বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়েছে। যদিও এ সময় বেশির ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার হয়নি। কিছু কিছু কেন্দ্র বছরে সক্ষমতার ২-৩ শতাংশ উৎপাদন করেছে। তবে কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার ৮০ শতাংশ ব্যবহৃত হবে, এমন শর্তেই চুক্তির সময় ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয়।

২০০৯-১০ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১ হাজার ৮৭৮ মেগাওয়াট। ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ১ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে ৮ হাজার ৪১১ মেগাওয়াট হয়। চলেছিল সক্ষমতার ৪২ শতাংশ। ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ অস্বাভাবিক বাড়তে থাকে। ২০২২-২৩-এ বেসরকারি কেন্দ্রের সক্ষমতা হয় ১২ হাজার ৪১৫ মেগাওয়াট। উৎপাদনে ছিল সক্ষমতার ৪৫ শতাংশ, ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় ১৭ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছর বেসরকারি খাতের কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা হয় ১৬ হাজার ৩৬৯ মেগাওয়াট, ক্যাপাসিটি চার্জের জন্য খরচ হয় ২৭ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা। হুট করে ক্যাপাসিটি চার্জ দ্বিগুণ হওয়ার কারণ আদানি, পায়রা, রামপাল, মাতারবাড়ী, এস আলমসহ বড় কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এগুলো চালু হলেও দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা সেভাবে বাড়েনি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের সক্ষমতার মাত্র ৩৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। 

আওয়ামী লীগের ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো
পিডিবির তথ্যমতে, গত ১৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে শীর্ষে রয়েছে সামিট গ্রুপ। বর্তমানে গ্রুপটির ১ হাজার ৯৮১ মেগাওয়াটের আটটি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনছে পিডিবি। 
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের ঘনিষ্ঠদের এই ব্যবসায়ী গ্রুপ গত দেড় দশকে শুধু বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে আয় করেছে ১৪ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। 
বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ইউনাইটেড গ্রুপ পাঁচটি কেন্দ্রের জন্য ১৫ বছরে ১০ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে। সামিট আর ইউনাইটেডের যৌথ বিদ্যুৎ কোম্পানি খুলনা পাওয়ারে (কেপিসিএল) দুই গ্রুপের ৩৫ শতাংশ করে শেয়ার রয়েছে। কেপিসিএল এ পর্যন্ত চার্জ নিয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা।

সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গ্রুপ বাংলা ক্যাট পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে ৬ হাজার ৩১২ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে। আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাংলা ক্যাটের ৪৯ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। তা থেকে আরও কয়েকশ কোটি টাকা নিয়েছে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে। 

আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা নূরে আলম সিদ্দিকীর ডরিন গ্রুপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এ পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ৩ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। সাবেক মেয়র আনিসুল হকের মোহাম্মদী গ্রুপ তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৩ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে। এ ছাড়া হোসাফ গ্রুপ ৫ কেন্দ্রের জন্য ১৫ বছরে ৩ হাজার ৮৫ কোটি টাকা, কনফিডেন্স গ্রুপ ৪ কেন্দ্রের জন্য ২ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা, ইয়ুথ গ্রুপ তিনটি কেন্দ্রের জন্য ২ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা, ম্যাক্স গ্রুপ ২ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা, বারাকা গ্রুপ ২ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা, প্যারামাউন্ট ১ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা, শিকদার গ্রুপ ১ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা, আনলিমা গ্রুপ ১ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা, এনার্জিপ্যাক ১ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা, সিনহা গ্রুপ ১ হাজার ৪১০ কোটি টাকা এবং রিজেন্ট গ্রুপ ১ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে। এই কোম্পানিগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের সুনজরে থেকে সুবিধা ভোগ করেছে। 

ভারতের ব্যবসায়ীরাও সুবিধা পেয়েছে
২০১৩ সাল থেকে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করা হয়। এখন সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে ২ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ। আদানির বিদ্যুৎ বাদে ভারতের সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে আমদানির পরিমাণ ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট। এই বিদ্যুৎ কিনতে গত ১১ বছরে খরচ হয়েছে ৪১ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১৬ হাজার ১০১ কোটি টাকা। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তিগুলোর কয়েকটির মেয়াদ ২০৩৩ ও একটির ২০৩৯ সালের দিকে শেষ হবে।

আছে আরও বিভিন্ন দেশের কোম্পানি
আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে ভারত ছাড়া অন্যান্য দেশের কোম্পানির মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩০২ মেগাওয়াট। এই কেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ২৭ হাজার ১১৭ কোটি টাকা।

যুক্তরাষ্ট্রের এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনালের ঘোড়াশাল কেন্দ্রসহ সাতটি কেন্দ্রের সক্ষমতা ছিল ৪৮০ মেগাওয়াট। ২০২২-২৩ অর্থবছরের মধ্যে বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে মোট খরচ হয়েছে ৮ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা। সিডিসি মালয়েশিয়া ১৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে ৭ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের এপিআর এনার্জি পাঁচ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ২ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। এই কেন্দ্রটি প্রায় সময়ই বন্ধ থাকত। শ্রীলঙ্কার কোম্পানি ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে ১ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এনইপিসি কনসোর্টিয়াম ২০০৯-১০ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত ১০ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ১ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। ভারতীয় শাপুরজি পালনজি এক বছরেই ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ১ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা।

বোঝা জনগণের ঘাড়ে
অপরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির দায় শেষ পর্য‌ন্ত গিয়ে পড়ে ভোক্তার ওপর। ২০০৯ সালে বিদ্যুতের খুচরা দাম ছিল প্রতি ইউনিট ৩ টাকা ৭৩ পয়সা। গত ১৫ বছরে প্রতি ইউনিটের খুচরা দাম বেড়ে হয়েছে ৮ টাকা ২৫ পয়সা। 

গত দুই অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো রামপাল, পায়রা, এস আলম, আদানির মতো বড় কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। এসব কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা বেশি, ক্যাপসিটি চার্জও বেশি। আদানি গ্রুপ দেড় বছরেই ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ৫ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা। চীন ও বাংলাদেশের যৌথ বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা তিন বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ১২ হাজার ৪২ কোটি টাকা। চালুর পর বেশির ভাগ সময় বসে থাকা (চলেছে সক্ষমতার ২১%) বাঁশখালীর এস আলম কেন্দ্রটি এ পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ৩ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। ভারত-বাংলাদেশের যৌথ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ১ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে। এই কেন্দ্রগুলো ২০৪৮ সালের দিকে বন্ধ হবে। বিদ্যুতের চাহিদা সেভাবে না বাড়লে আরও দুই দশক ধরে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা টানতে হবে পিডিবিকে।
সামিট, ইউনিক ও রিলায়েন্সের তিনটি গ্যাসভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র গত বছর উৎপাদনে আসে। গ্যাস সংকটে কেন্দ্রগুলো প্রায় প্রতিদিনই বন্ধ থাকে। মাঝে মাঝে গ্যাস পেলে কেন্দ্রগুলো আংশিক চালানো হয়। মাত্র ছয় মাসেই ইউনিকের কেন্দ্রটির জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে খরচ হয়েছে ৪৭৭ কোটি টাকা। ২২ বছর মেয়াদের এসব কেন্দ্র ২০৪৫ সাল পর্যন্ত চলবে। 
পটুয়াখালীতে চীন-বাংলাদেশের আরও একটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে। এর চুক্তি শেষ হবে ২০৫০ সালে। নির্মাণাধীন আরও কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, যেগুলো ২০২৬-২৭ সালের দিকে চালু হবে। চলবে ২০৪৯ সাল পর্যন্ত।

সমাধান সহজ নয়
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সমঝোতার ভিত্তিতে সম্পাদিত বিদ্যুৎ চুক্তিগুলো নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে রামপাল ও আদানির চুক্তি বাতিলের জন্য বিভিন্ন সময় নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিশেষ বিধান বাতিল করেছে। এই আইনের অধীন সম্পাদিত বিদ্যুৎ চুক্তিগুলো খতিয়ে দেখতে গঠিত জাতীয় কমিটি বড় ১১টি কোম্পানির বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে কাজ করছে। শিগগির তাদের প্রতিবেদন বিদ্যুৎ বিভাগে জমা দেবে। সূত্র জানায়, কমিটি কয়েকটি চুক্তির ক্ষেত্রে বেশ কিছু অনিয়ম পেয়েছে। তবে সেগুলোর জন্য চুক্তি বাতিল করা কঠিন। বিষয়গুলো আরও খতিয়ে দেখতে আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থার সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।

কমিটির সদস্য এবং বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক আবদুল হাসিব চৌধুরী তাদের এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য সম্পর্কে বলতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, একটি চুক্তি বাতিল করতে চাইলে কিছু যৌক্তিক কারণ লাগে। কোনো পক্ষ যদি চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে বা চুক্তি স্বাক্ষরে অনিয়মের প্রমাণ মেলে, তাহলে তা নিয়ে পর্যালোচনা করা যাবে। ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা থেকে মুক্তির উপায় কি– এ প্রশ্নের জবাবে হাসিব চৌধুরী বলেন, চুক্তি পর্যালোচনা ছাড়াও পুরোনো ও অদক্ষ কেন্দ্র বাতিল, চুক্তির মেয়াদ নবায়ন না করা, একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আর নতুন কেন্দ্রের চুক্তি না করে রিজার্ভ মার্জিন কমিয়ে আনা। এ ছাড়া শিল্পায়নসহ নানা উদ্যোগের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানো হলে বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতার বোঝা ধীরে ধীরে কমে আসবে।

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ক ন দ র র জন য ল গ সরক র র ব যবস য় র ত ১৫ বছর ল র জন য ব সরক র র পর ব ব যবহ আওয় ম আমদ ন হওয় র

এছাড়াও পড়ুন:

শতভাগ রপ্তানিমুখী প্লাস্টিকপণ্য উৎপাদনে যাচ্ছে আরএফএল

শতভাগ রপ্তানিমুখী গৃহস্থালি প্লাস্টিক উৎপাদনে ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে দেশের শীর্ষস্থানীয় গৃহস্থালি প্লাস্টিকপণ্য উৎপাদন, বিপণন ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আরএফএল। পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত মেশিনারিজ আনা হবে চীন থেকে। সে জন্য চীনের হাইতিয়ান গ্রুপের সঙ্গে আজ রোববার বড় চুক্তি করতে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। আরএফএল গ্রুপ এ তথ্য জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে এখন নতুন বিনিয়োগ কম হচ্ছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ২১ কোটি ৩০ লাখ ডলারের, যা গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারের। এ সময়ে এফডিআই কমেছে ৭১ শতাংশ। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে আরএফএল গ্রুপের নতুন বিনিয়োগ উৎপাদনমুখী শিল্পের জন্য ইতিবাচক। 

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ জানিয়েছে, রপ্তানি বাড়াতে নতুন এই বিনিয়োগ করছেন তারা। কারখানা স্থাপন হবে গাজীপুরের কালীগঞ্জে আরএফএল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে। সেখানে যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো নির্মাণে সব মিলিয়ে বিনিয়োগ হবে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। আগামী এপ্রিল-মে মাস থেকে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হবে। নতুন কারখানায় যেসব প্লাস্টিকপণ্য উৎপাদন হবে, তার সবই রপ্তানি হবে। এটি হবে প্রতিষ্ঠানটির প্রথম শতভাগ রপ্তানিমুখী কারখানা। নতুন কারখানায় অন্তত আড়াই হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। এখান থেকে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব হবে। ক্রেতাদের চাহিদামতো বিভিন্ন ডিজাইনের কনটেইনার, টয়েজ, টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যারসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন হবে। এ বিনিয়োগের ফলে আরএফএলের বার্ষিক রপ্তানি বাড়বে ৩০ শতাংশের মতো।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন,  চীন, ভারতসহ কয়েকটি দেশের পণ্যে শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে রপ্তানি বাজারে সুযোগ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোর। এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে আরএফএল। চীনের একটি রপ্তানিমুখী কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানি থেকে ৬০ লাখ ডলারের পণ্যের ক্রয়াদেশ পেয়েছে তারা। পুরোনো ক্রেতাদের মাধ্যমেই এই ক্রয়াদেশ এসেছে। পোশাক খাতের বাইরে কোম্পানির এটি সবচেয়ে বড় ক্রয়াদেশ। কারখানায় উৎপাদন শুরু হওয়ার আগেই এ ধরনের ক্রয়াদেশ প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে। 
এ বিষয়ে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, নতুন কারখানা হবে শতভাগ কমপ্লায়েন্ট। ক্রেতা দেশগুলোতে প্লাস্টিকের আধুনিক যেসব পণ্যের চাহিদা রয়েছে, এখানে সেগুলোই উৎপাদন করা হবে। উৎপাদিত সব পণ্যই রপ্তানি করা হবে। কোনো পণ্য স্থানীয়ভাবে বিক্রি করা হবে না। 
উৎপাদনে যাওয়ার আগেই রপ্তানি আদেশ পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার উল্লেখ করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চীনের পণ্যে শুল্ক বসানোসহ নানা বিধিনিষেধ আরোপ করতে যাচ্ছে। তাতে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি কমে যেতে পারে। এই সুযোগে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি বাড়াতে পারবে। ইতোমধ্যে ৬০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানির আদেশ পাওয়া কারখানার যাত্রাকালে খুবই ইতিবাচক। 

আরএফএল গ্রুপের রপ্তানি 
আরএফএল গ্রুপ ২০০৭ সালে ভারতে গৃহস্থালি প্লাস্টিকপণ্য পাঠানোর মাধ্যমে রপ্তানি শুরু করে। এরপর থেকে প্রতিবছরই তাদের প্লাস্টিকপণ্য রপ্তানি বাড়ছে। রপ্তানিতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ২০ শতাংশ। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে প্লাস্টিকপণ্য রপ্তানি করে আরএফএল। ৩০ ক্যাটেগরিতে ৫০০ পণ্য রপ্তানি করা হয়। যেমন– গৃহস্থালি প্লাস্টিক, বাইসাইকেল, মেলামাইন, গৃহনির্মাণ সামগ্রী, পলিব্যাগ, হ্যাঙ্গার, নন-লেদার ফুটওয়্যার, প্লাস্টিক ফার্নিচার। এসব পণ্য রপ্তানি করে আরএফএল গ্রুপ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ১০ কোটি ডলার আয় করেছে। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় ভারতে। এরপর রয়েছে জার্মানি, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, কোরিয়া, স্পেন, যুক্তরাজ্য এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। 
যুক্তরাষ্টের ওয়ালমার্ট, কানাডার ডোলারামা ও লবলোজ, ফ্রান্সের ক্যারিফোর, জার্মানির লিডল, অস্ট্রেলিয়ার টার্গেট, কোরিয়ার লোকসি এবং যুক্তরাজ্যের উলওয়ার্থস ও আর্গসের মতো প্রসিদ্ধ সুপারশপগুলোতে আরএফএল পণ্য পাওয়া যায়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সংশোধিত এডিপি ৪৯ হাজার কোটি টাকা কমল
  • ফেব্রুয়ারিতে ২৫৩ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স
  • পাওনা আদায়ে রিংশাইন টেক্সটাইলের ৬টি প্লটের বরাদ্দ বাতিল
  • প্রবাসী আয় বেড়েছে ১৭ শতাংশ
  • ফেব্রুয়ারির ইতিহাসে রেকর্ড রেমিট্যান্স
  • রোজার আগের মাসে প্রবাসী আয় ২৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে
  • রিং সাইনের অর্ধবার্ষিকে লোকসান বেড়েছে ৬ শতাংশ
  • এডিপি বাস্তবায়নে সুপারিশ উপেক্ষিত, ৩ বছরে ব্যয়ের লক্ষ্য ৯,০৮,৬০০ কোটি টাকা
  • রিংসাইন টেক্সটাইলের দ্বিতীয় প্রান্তিক প্রকাশ
  • শতভাগ রপ্তানিমুখী প্লাস্টিকপণ্য উৎপাদনে যাচ্ছে আরএফএল