‘সামষ্টিক অভিপ্রায়’ কি সবার প্রতিনিধিত্ব করে?
Published: 17th, January 2025 GMT
বাংলাদেশের ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে আখ্যায়িত; যেখানে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ একটি কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে একত্র হয়েছিল। এর নেতারা এটিকে সামষ্টিক অভিপ্রায় বা ইচ্ছার বিজয় বলে বর্ণনা করেছেন; যা হবস, লক ও রুশোর সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব দ্বারা অনুপ্রাণিত একটি ধারণা। ব্যক্তিরা সাধারণ কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য যৌথ চুক্তির ভিত্তিতে সরকার গঠন করে বলে এই দার্শনিকরা কল্পনা করেন। ধারণাটি অনুপ্রেরণামূলক হলেও বহু চিন্তাবিদ এটির কঠোর সমালোচনা করেন। তাদের বক্তব্য, এটি প্রায়ই অসমতা ঢেকে রাখে; ভিন্নমত দমন করে এবং মানব আচরণের জটিলতাকে সরলীকরণ করে।
২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের জন্য এই সমালোচনা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ, এটি একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গড়ে তোলার কঠিন পথে যাত্রা শুরু করেছে। অনেকে এই গণঅভ্যুত্থানকে জঁ-জাক রুশোর ‘সাধারণ অভিপ্রায়’ ধারণার একটি আদর্শ উদাহরণ বলে মনে করেন, যেখানে ব্যক্তিরা ব্যক্তিগত স্বার্থকে পাশে রেখে সামষ্টিক কল্যাণের জন্য একত্র হয়। ফ্রেডরিখ নিৎশে সামষ্টিক অভিপ্রায় ধারণাটি প্রায়ই নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা মতাদর্শের আধিপত্য লুকিয়ে রাখে বলে সতর্ক করেন। বাংলাদেশে শিক্ষার্থী, শহুরে অভিজাত এবং শ্রমজীবী শ্রেণির কিছু অংশ এ গণঅভ্যুত্থানে অত্যন্ত দৃশ্যমান ছিল। গণঅভ্যুত্থানে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ভূমিকা রাখলেও তাদের নেতৃত্ব এবং দৃশ্যমানতা সীমিত বলেই মনে হয়েছে। ফলে তাদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব যথাযথভাবে হবে কিনা, তা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। একইভাবে তাদের ভূমি অধিকার ও রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি সম্পর্কিত দীর্ঘদিনের অভিযোগ নিরসনের ব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যেও সংশয় থাকা অমূলক নয়। নিৎশের দৃষ্টিতে, প্রকৃত সামাজিক অগ্রগতি কেবল সামষ্টিক ঐক্য ও সংহতির মধ্যে নয়; বরং ব্যক্তিত্ব বিকাশে এবং উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া রীতি-নীতি ও আদর্শকে চ্যালেঞ্জ করার মধ্যে নিহিত।
এখানে কার্ল মার্ক্সের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁকে অনুসরণ করে বলা যায়, অনেক রাজনৈতিক ও দার্শনিক তত্ত্ব, যেমন সামাজিক চুক্তি ধারণা, প্রায়ই ক্ষমতা ও শ্রেণির অন্তর্নিহিত বাস্তবতাকে আড়াল করে।
গণঅভ্যুত্থানে শ্রমজীবী শ্রেণির অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। তাদের উপস্থিতি কেবল প্রতীকী ছিল না; এটি আন্দোলনের গতিপথ নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে মার্ক্স সতর্ক করেন, এটি শ্রমজীবী শ্রেণির দাবিগুলো পরবর্তী সরকারের অগ্রাধিকারে থাকার নিশ্চয়তা দেয় না। ইতিহাসেও এর উদাহরণ কম নয়। পোশাক শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরে ন্যায্য মজুরি এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশের দাবি জানিয়ে আসছে। এ দাবিগুলো কি এবার পূরণ হবে? মার্ক্সের বিশ্লেষণ বলে, কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া, যারা আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল, তারা একই শোষণমূলক ব্যবস্থায় বন্দি হয়ে থাকতে পারে।
ডেভিড হিউম সামাজিক চুক্তি তত্ত্বের মূল ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ করেন। তাঁর মতে, ইচ্ছাকৃত চুক্তি বা সম্মতির ধারণা একটি বিমূর্ত এবং কল্পনাপ্রসূত কাঠামো; যা সরকার কীভাবে গঠিত হয়, তার বাস্তবতার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। হিউম মনে করেন, সরকার যুক্তিসংগত বা অন্তর্ভুক্তিমূলক চুক্তির মাধ্যমে নয়; বরং ঐতিহাসিক ঘটনাক্রম, ক্ষমতার লড়াই এবং প্রথার ধীরে ধীরে বিবর্তনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে যে এটি সত্যিই সব নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করে কিনা? পূর্ববর্তী শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আন্দোলনে নাগরিকদের একতাবদ্ধ করলেও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিস্তারিত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনা এতে অনুপস্থিত ছিল। হিউমের সমালোচনা তুলে ধরে যে নতুন নেতৃত্ব যদি বাদ পড়া গোষ্ঠীগুলোর উদ্বেগের কার্যকর সমাধান করে সমর্থন অর্জন করতে না পারে, তবে বৈধতার প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ বৈধতা কাল্পনিক চুক্তির চেয়ে বাস্তব উপযোগিতা এবং জনসমর্থনের ওপর বেশি নির্ভর করে।
এ ক্ষেত্রে মিশেল ফুকোর ক্ষমতা বিশ্লেষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা দেয়। ফুকোর মতে, ক্ষমতাকে সহজেই একীভূত বা হস্তান্তর করা যায় না; এটি সম্পর্ক, প্রতিষ্ঠান এবং নিয়মের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং কার্যকর হয়। একটি নতুন সরকারকে বৈধতা দেওয়ার জন্য সামষ্টিক অভিপ্রায় ধারণার ব্যবহার কর্তৃত্ব সংহত এবং ভিন্নমত দমন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। প্রতিশোধ এবং পাল্টা প্রতিশোধের চক্রে আবদ্ধ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইতিহাস প্রায়ই এটিকে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। বিরোধী কণ্ঠস্বর দমনের চেষ্টা করলে নতুন সরকার সেই অন্যায়গুলোকেই ফের প্রতিষ্ঠিত করার ঝুঁকি তৈরি করবে, যা দূর করার জন্য গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল। এতে বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামো ভাঙার পরিবর্তে আরও দৃঢ় হতে পারে।
হবস, লক ও রুশোর মতো চিন্তাবিদরা বিশ্বাস করেন, মানুষ ব্যক্তিগত আবেগকে দূরে সরিয়ে যৌক্তিকতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আবার এডমান্ড বার্ক মনে করেন, মানব আচরণ প্রায়ই বিশুদ্ধ যুক্তির চেয়ে আবেগ, ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট দ্বারা প্রভাবিত হয়। তিনি বিপ্লবী আন্দোলনের বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায়ই তাৎক্ষণিক ক্ষোভ থেকে উদ্ভূত হয়; যা গভীর চিন্তাপ্রসূত পরিকল্পনার চেয়ে আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান সফলভাবে নিপীড়ক সরকারকে অপসারণ করতে পারলেও অর্থনৈতিক বৈষম্য, মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, নিরাপত্তা, সংখ্যালঘু অধিকার এবং পরিবেশ সংকটের মতো জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বিস্তারিত রোডম্যাপ দিতে এখনও সক্ষম হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না।
এ সমালোচনাগুলোকে অতিমাত্রায় তাত্ত্বিক মনে হলেও এগুলো বাংলাদেশের ভবিষ্যতের স্বার্থেই বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। সফল হতে চাইলে নতুন সরকারকে অবশ্যই বৈধতার জন্য সামষ্টিক অভিপ্রায় ধারণার ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে এমন নীতিমালা তৈরি করতে হবে, যা কেবল আন্দোলনে সবচেয়ে দৃশ্যমান গোষ্ঠীগুলোরই নয়, বরং সব নাগরিকের প্রয়োজনকে সত্যিকার অর্থে প্রতিফলিত করবে। শ্রমিকদের মজুরি এবং কর্মপরিবেশের বাস্তব উন্নতি করতে হবে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অভিযোগগুলো আমলে নিতে হবে। জাতীয় রাজনীতিতে উপেক্ষিত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন এবং অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার ওপরে গুরুত্ব দিতে হবে।
এ ছাড়া সরকার যেন সামষ্টিক অভিপ্রায় ধারণাটিকে ক্ষমতা সংহতকরণ বা ভিন্নমত দমন করার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার না করে, তা নিশ্চিত করা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা সমাজের সব অংশের অংশগ্রহণ এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করে। বাংলাদেশে অতীতে ক্ষমতার পালাবদলে প্রতিশোধ ও পাল্টা প্রতিশোধের যে চক্র দেখা গেছে, তা ভাঙতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং ভিন্নমতাবলম্বী ও বিরোধী সমর্থকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক নীতি এড়ানোও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান যদি সত্যিই সফল হতে চায়, তবে এর নেতাদের স্লোগান এবং বিমূর্ততার বাইরে গিয়ে এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে; যা সত্যিকার অর্থে অন্তর্ভুক্তিমূলক, অংশগ্রহণমূলক এবং সব বাংলাদেশির প্রয়োজনের প্রতি জবাবদিহিমূলক। তাদের ব্যর্থতায় আন্দোলনটি আরেকটি ক্ষণস্থায়ী আশায় পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে; যা জনসমাজে নিতান্তই আরেকটি অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি এবং আরও গভীর বিভাজনের চিহ্ন রেখে যাবে।
ড.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন র গণঅভ য ত থ ন ন শ চ ত কর র জন ত ক জনগ ষ ঠ পর ব শ র জন য সরক র ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে রাজনীতিকদের কী লাভ?
অবাক হওয়ার ব্যাপার– রাজনীতিকরা কেউ কেউ অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করেছেন! এমনকি কোনো কোনো রাজনৈতিক দল গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন ‘অনির্বাচিত’ আখ্যা দিচ্ছে। যদিও নাগরিকদের বড় অংশ এই সরকারের ওপরেই আস্থা রাখছে। নাগরিকদের ধারণা জন্মেছে, সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র পরিচালনায় আসবে, রাষ্ট্র সংস্কারে তাদের ইচ্ছা বা সক্ষমতার ঘাটতি আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেও গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব প্রকট। যদিও রাজনৈতিক দলগুলো এর কারণ খোঁজায় খুব আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না।
আওয়ামী লীগবিহীন রাজনৈতিক পরিবেশে বর্তমানে বিএনপির ভালো অবস্থানে থাকার কথা। কিন্তু তারা দৃশ্যত চাপের মধ্যে। এমনকি নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপিও মানুষের একচেটিয়া সমর্থন পাচ্ছে, বলা যাবে না। তার মানে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নির্দিষ্ট সমর্থক গোষ্ঠী ছাড়া সাধারণ নাগরিকরা রাজনীতিবিদদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। বিপরীতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি নাগরিকদের আস্থা ক্রমে বাড়ছে। এটা স্পষ্ট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর মানুষের আস্থা আরও বাড়তে থাকবে। অন্যদিকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতিতে গুণগত সংস্কার আনতে না পারলে দলীয় কর্মী-সমর্থকের বাইরে সাধারণ নাগরিকদের সমর্থন কমতে থাকবে। রাজনৈতিক দলগুলোতে এখনও সেকেলে ধাঁচের ব্যক্তি-তোষণ, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতি চালু আছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো অভ্যন্তরীণ সংস্কার। দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করতে হবে। নেতাকর্মীর বক্তব্যে সুস্থ ধারার রাজনীতির ছাপ থাকতে হবে। তারা ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে কীভাবে ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ হিসেবে গড়ে তুলতে চান, তা পরিষ্কার করে বলতে হবে। রাজনীতির প্যাটার্নই বদলাতে হবে।
বস্তুত পুরোনো রাজনৈতিক দলের নেতারা এখনও নব্বই দশকের রাজনীতি করছেন। তাদের বয়ানের মধ্যে কোনো নতুনত্ব নেই। তাদের বক্তব্য সচেতন নাগরিকরাও সেভাবে শুনছেন না। বিএনপি বা জামায়াতের প্রথম সারির নেতাদের রাষ্ট্র গঠন নিয়ে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক ভাবনা শোনা যায় না। এমনকি বিএনপির ৩১ দফাও নিজ দলের মধ্যে আলোচনায় আসছে না সেভাবে। আবার সরকারের বিভিন্ন কমিশনের প্রস্তাবিত সংস্কার প্রশ্নে অনেক জরুরি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারছে না। এটি রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতাই বটে। তরুণ প্রজন্মের কাছে এই রাজনীতি কোনো আকর্ষণ তৈরি করছে না।
গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে সবাই আশা করেছিল, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে। সেটি আসেনি। সাধারণ মানুষ যে কারণে হতাশ। তারা এক রাজনৈতিক দলের বদলে আরেক রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজি ও লুটপাট দেখতে চায় না। মানুষের মধ্যে নতুন চাওয়া তৈরি হয়েছে। তারা আর রাজনৈতিক হানাহানি, মারামারি দেখতে চায় না। তাই নাগরিকদের অনেকেই এখন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে গঠিত সরকার বনাম অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে তুলনা করছে। এই তুলনা অবশ্যই রাজনৈতিক নেতৃত্বের ধারাবাহিক ব্যর্থতারই ফল!
বিপরীত দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ, কথা, শরীরী-ভাষা, বিবৃতি, অফুরন্ত কর্মস্পৃহা মানুষের মধ্যে, শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ব্যাপক আশার সঞ্চার করেছে। বিশেষত বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ক্রমে বাড়ছে। কারণ, তারা এ রকম উজ্জ্বল নেতৃত্ব গত কয়েক দশকে দেখেনি। তাই তারা এখন তুলনা করতে পারছে।
আমি প্রায় প্রতিদিন শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলি। জনসাধারণের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে এত প্রাণহানির পর মানুষ আর পেশিশক্তিনির্ভর, সন্ত্রাসনির্ভর, চাঁদাবাজিনির্ভর রাজনীতি দেখতে চায় না। তারা সন্ত্রাসী, চাটুকার পরিবেষ্টিত রাজনীতিবিদদের গলাবাজি শুনতে চায় না। তারা দেখতে চায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি, অর্থনীতিতে গতি, বাজারের স্থিতিশীল অবস্থা, ব্যাংকে লুটপাট বন্ধ, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতিশীলতা।
প্রথমদিকে স্থবিরতা থাকলেও অর্থনীতি আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে; বিদেশি বিনিয়োগ ইতিবাচকভাবে বৃদ্ধির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমান সরকার ভারত, পাকিস্তান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার সঙ্গে যে কৌশলী কূটনীতি চালিয়ে যাচ্ছে, সেটাও গণমানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন পরিস্থিতিতে রাজনীতিবিদদের উচিত ছিল পুরোনো রাজনীতি ঝেড়ে ফেলে নতুন রাজনীতির ক্যারিশমা দেখানো। কিন্তু সেই প্রজ্ঞা, সদিচ্ছা, প্রচেষ্টা দেখা যায়নি; টেকসই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করার ব্যাপারে কর্মস্পৃহা দেখা যায় না।
প্রশ্ন হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার কি অনন্তকাল থাকবে? সেটা কেউ চাইবে না; জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই হবে। তার আগে রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে এবং শাসন ব্যবস্থায় জরুরি মৌলিক সংস্কার করতেই হবে। গণঅভ্যুত্থান সেই ম্যান্ডেট এই সরকারকে দিয়েছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনীতিকদের নিজের কোয়ালিটি বাড়াতে হবে, যদি তারা টিকে থাকতে চান। দলের মধ্যে ইতিবাচক সংস্কার করতেই হবে। এখনও সেকেলে ধাঁচের রাজনীতি থেকে বের হতে না পারলে এবং জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় একনিষ্ঠ হয়ে কাজ না করলে সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যাবে না। আর অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে বসে থেকে বিশেষ কোনো ফায়দা নেই।
শেখ নাহিদ নিয়াজী: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
nahidneazy@yahoo.com