বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং তাদের জাতীয় নাগরিক কমিটি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রোক্লেমেশন (ঘোষণাপত্র) ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে ঘোষণার কথা জানানোর পরপরই দেশের রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। প্রথমত, দেরিতে হলেও জনগণের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার লিখিত রূপ হিসেবে জুলাইয়ের একটি ঘোষণাপত্র তো আমাদের দরকার। সেটি ৫ থেকে ১০ আগস্ট ঘোষণা হলেই ভালো হতো। যে কোনো বড় ঘটনার প্রোক্লেমেশন লাগে, এটি ছাড়া সে ইভেন্ট হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই পায় ছোট আকারে। তা ছাড়া বৈপ্লবিক কায়দায় দেশের জরাজীর্ণ পদ্ধতি পরিবর্তন করে গণতান্ত্রিক ধারা চালু করতে হবে। এ জন্যই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র দরকার। 

এর মাঝেই প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জানানো হয়, সব রাজনৈতিক দল এবং ছাত্রদের সঙ্গে আলাপ করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকারই জুলাই প্রোক্লেমেশন ঘোষণা করবে। শিক্ষার্থীরা ৩১ ডিসেম্বর প্রোক্লেমেশনের ঘোষণা দিত, তাতে যতটুকু প্রাণ এবং ‘স্পিরিট’ থাকত, কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন এ সরকার এবং রাজনৈতিক দল মিলে যে ঐকমত্যের প্রোক্লেমেশন দেবে, তাতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আর কোনো বিপ্লবী সম্ভাবনা দেখা যাবে না। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রোক্লেমেশন সরকার ঘোষণা দিতেই পারে। পাঁচ মাস পর রাজনৈতিক দলসহ আন্দোলনের নানা গ্রুপ যেভাবে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং মতাদর্শিক লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে, সেখানে সরকার সবার সঙ্গে আলাপ করে এ ঘোষণা দিলে জনতার জুলাই অভিপ্রায় ঠিকমতো সেখানে প্রতিফলিত হবে কিনা, তাই দেখার বিষয়। আমার মতে, আন্দোলনের মূল কারিগর ছাত্রদের নিজেদের থেকে আলাদা করে ঘোষণা থাকা দরকার। এই আলাদা ঘোষণাই জুলাই অভিপ্রায়কে বাঁচিয়ে রাখবে। তাদের রাজনীতিও দাঁড়াবে। 

জুলাইকে ক্ল্যাসিক অর্থে বিপ্লব বলা হচ্ছে না, তবে এটি স্রেফ গণঅভ্যুত্থানও না। এটি এই দুয়ের মাঝামাঝি ব্যাপার। জুলাই মূলত ফ্যাসিবাদবিরোধী এবং নিওকলোনিয়াল আগ্রাসনবিরোধী একটা পোস্ট-মডার্ন গণঅভ্যুত্থান, যাকে সফল করলে তা হয়ে উঠবে নিউ ফর্ম অব ডেমোক্রেটিক রেভলিউশন। এ ব্যাপারটা ধরতে পারবে এ অভ্যুত্থানের ভ্যানগার্ড যারা তারা। রাজনৈতিক দলগুলো চাচ্ছে এখন এই গণঅভ্যুত্থানকে রেজিম চেঞ্জে পর্যবসিত করে পুরোনো ধারার সুপারফিশিয়াল সংস্কার করে এগোতে। ফলে প্রোক্লেমেশন তৈরিতে তাদের সঙ্গে মিলেমিশে যে ঐকমত্যে পৌঁছানো হবে, তা হবে আপস এবং বেহাত বিপ্লবের দলিল। যারা জুলাইয়ের মতো এত বড় গণঅভ্যুত্থানকে ‘ডেমোক্রেটিক বিপ্লবে’র রূপ দিতে চান না এবং সেটি ঠেকানোর জন্য বারবার জুলাইকে শুধু হাসিনা পতনের অভ্যুত্থান আকারে দেখিয়ে ফ্যাসিবাদী পদ্ধতি এবং জুলুমতন্ত্রের কাঠামো রক্ষার কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের সম্মতিতে যে প্রোক্লেমেশন আসবে– তা আসলে জুলাইকে ধারণ করতে পারবে বলে মনে হয় না। 

এ দেশের মানুষ ১৮৫৭, ১৯৪৭, ১৯৭১, ১৯৯০ এবং ২০২৪-এ রক্তাক্ত এবং বীরোচিত আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের পরও তার জীবন, স্বাধীনতা ও সুখের কোনো অধিকার পায়নি। এক আমলাতন্ত্র যেভাবে দেশের মানুষের ওপর বসে আছে, এ দেশের এমপিরা যেভাবে জমিদারসুলভ আচরণ করে, এ দেশের পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনী যে ঔপনিবেশিক ফর্মে আছে, তাতে কোনোভাবেই জীবন ও স্বাধীনতার সুরক্ষা সম্ভব নয়; সুখের কথা তো পরে। এ দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব সেবা খাতে দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের অবাধ লুণ্ঠনকে নিশ্চিত করার জন্য ‘নিওলিবারেল পলিসি’ বাস্তবায়ন চলছে। এখন চব্বিশের রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের পর পুরোনো জুলুমতন্ত্র, লুটপাটতন্ত্র, শোষণযন্ত্র সব অক্ষত রেখেই নামকাওয়াস্তে দায়সারা কিছু ‘সুপারফিশিয়াল’ সংস্কার করে নির্বাচন করে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের জন্য ক্রমাগত চেষ্টা চালাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। 

আমরা চেয়েছিলাম পদ্ধতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন, অথচ আনা হয়েছে সংস্কারের ঘুমপাড়ানি আলাপ। এখন সেই সংস্কারও করতে দিচ্ছে না। শহীদদের কবরে ঘাস জন্মানোর আগেই ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদনের নেশায় পেয়ে বসেছে রাজনীতিবিদদের। এই পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই প্রোক্লেমেশন দেরিতে হলেও দরকারি কাজ। এখানে দায়সারা গোছের সংস্কারের কথা না বলে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মানে দেশের ঔপনিবেশিক ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের (আমলাতন্ত্র, পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী, সেনাবাহিনী, ইউনিভার্সিটি, স্থানীয় প্রশাসন, সরকার ব্যবস্থা) খোলনলচে পাল্টানোর ঘোষণা দিতে হবে এবং রাষ্ট্র পুনর্গঠনের ঘোষণাই হবে প্রধান দাবি। এসব না করে শুধু এই সরকারের বৈধতা এবং সবার মতামত নিয়ে সংস্কারের দাবি জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে নব্বইয়ে পর্যবসিত করবে।

এখন দেখার বিষয় সামনে সরকার ঘোষিত জুলাই প্রোক্লেমেশনে কী থাকে? এই প্রোক্লমেশন যদি দেশের ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বিলোপ সাধন করার জন্য বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে জনতার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়, মানে সরকার/সংসদ নয়; বরং পিপল মানে ব্যক্তিই সার্বভৌম– এই ঘোষণা দেয়, তাহলে এটি হবে যুগান্তকারী ব্যাপার। ব্যক্তির মর্যাদা এবং বিকাশকে নিশ্চিত করার জন্য, তার শরীর এবং আত্মার সম্ভাব্য বিকাশের জন্য জনপ্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচার, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রে একটি জনবান্ধব নীতি, পলিসি, কাঠামো তৈরি করতে হবে। এই লক্ষ্যেই দেশের নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করতে হবে। রাষ্ট্র গঠনের রূপরেখা এবং জনগণের রাজনৈতিক বাসনা যদি এই প্রোক্লেমেশনে থাকে তাহলে জুলাই ঘোষণাপত্র হয়ে উঠবে এ দেশের মানুষের মর্যাদা এবং মুক্তির সনদ। 

বাংলাদেশের সংবিধানে সরকার অথবা সংসদকেই সার্বভৌম করা হয়েছে। ফলে এখানে প্রায়োরিটি হচ্ছে সরকারের স্থিতিশীলতা অথবা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনগণের অধিকার সুরক্ষা নয়। ফলে সরকারের সুরক্ষা এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা/শৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণকারী আইনকানুন প্রণয়ন এবং তার প্রয়োগ আমরা দেখেছি। ফলে আমি মনে করি, জুলাই অভ্যুত্থানের যে প্রোক্লেমেশন দেওয়া হবে, সেখানে অবশ্যই বলতে হবে যে সরকার অথবা সংসদ নয়, জনগণই সার্বভৌম। তাই গণসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠাই হবে নতুন বাংলাদেশের গঠনতন্ত্র এবং রাজনৈতিক চর্চার ভরকেন্দ্র। দেশে যে সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র এবং সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ চালু আছে তা রদ করে গণসার্বভৌমত্ব অথবা ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করতে হবে। এ দেশের সরকার এবং রাষ্ট্রযন্ত্র নাগরিকের অধিকার এবং বিকাশ পরিপন্থি কোনো আইন প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়ন করতে পারবে না। সরকার যদি নাগরিক অধিকার হরণ করে তাহলে সেই সরকারের বিরুদ্ধে গণবিপ্লব ন্যায়সংগত বলে সাংবিধানিকভাবেই গৃহীত হবে। 
জুলাই প্রোক্লেমেশনে শ্রেণি প্রশ্ন হাজির করতে হবে। দেশের চলমান সংবিধান, আইন, কাঠামোতে শ্রমজীবী এবং নিম্নবর্গের অধিকার নিশ্চিতের কাঠামোগত কোনো রূপরেখা নেই। এই ঘোষণাপত্রে অধিকার রক্ষা হবে তার সুস্পষ্ট রূপরেখা দরকার। দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং জাতিগোষ্ঠীকে কীভাবে আস্থায় এনে তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার সুরক্ষা হবে তার ব্যাপারে আলাদা করে নির্দেশনা থাকা দরকার। এ ছাড়া জুলাই প্রোক্লেমেশনে জাতীয় স্বাধীনতা সুরক্ষা, জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ এবং সম্পদের সুষম বণ্টন এসব ব্যাপারে ঘোষণা থাকা দরকার।

যোবায়ের আল মাহমুদ: সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মাসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন জ ল ই গণঅভ য ত থ ন র র র জন ত ক সরক র র জনগণ র র জন য দরক র

এছাড়াও পড়ুন:

অভ্যুত্থান থেকে জন্ম নিল এনসিপি

অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে আত্মপ্রকাশ করেছে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। গণঅভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেওয়া দলটির নেতারা ঘোষণা করেছেন, তারা অন্য কোনো দেশ নয়, তারা হবেন বাংলাদেশপন্থি। তাদের লক্ষ্য ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ তথা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আর তা পূরণে নতুন সংবিধান প্রণয়নে সংসদের আগে গণপরিষদ নির্বাচন চান জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নায়করা। 

শেখ হাসিনার পতন ঘটানো গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের উদ্যোগে গঠিত এনসিপির ঘোষণাপত্রে এসব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বড় জমায়েতের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছে ইতিহাসের মেরূকরণ পাল্টে দেওয়া দলটি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদদের আত্মত্যাগকে সার্থক ঘোষণা দিয়ে তারা বলেছেন, ভারতপন্থি, পাকিস্তানপন্থি রাজনীতির ঠাঁই বাংলাদেশে হবে না। 

সাতচল্লিশ, বায়ান্ন, একাত্তর এবং চব্বিশকে ধারণ করা বাংলাদেশপন্থি রাজনৈতিক শক্তির ঐক্য চেয়ে সংসদের আগে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে এনসিপি। দলটি সরকারের আনুকূল্যে তথা ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে গঠিত হচ্ছে বলে সমালোচকরা বললেও, তা নাকচ করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার পদ ছেড়ে আসা নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বাধীন দলটির নেতারা। অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারের উপদেষ্টাদের আমন্ত্রণ করা হলেও তাদের কেউ আসেননি। 

আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে এনসিপি নেতারা বলেন, গণপরিষদে নতুন সংবিধান রচিত হবে। যার মাধ্যমে গড়ে উঠবে কাঙ্ক্ষিত প্রজাতন্ত্র। যেখানে সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত হবে। পরিবারতন্ত্র নয়, মেধা ও যোগ্যতায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে। বাংলাদেশের ক্ষমতায় কে যাবে, তা ভারত নির্ধারণ করবে না। 
ভারতীয় ‘আধিপত্যবাদের’ বিরোধিতা করা এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান স্লোগান ছিল– ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ উচ্চারিত হয়েছে এর পরেই। আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অভাবনীয় পতন ঘটানো গণঅভ্যুত্থানের স্লোগান– ‘ক্ষমতা না জনতা, জনতা জনতা’; ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’; ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’ স্লোগানও দেওয়া হয় আত্মপ্রকাশ মঞ্চ থেকে। 

জমকালো মঞ্চ, বড় উপস্থিতি
মানিক মিয়া অ্যাভিনিয়ে মূল সড়কে তৈরি করা হয় মঞ্চ। এতে গতকাল সকাল থেকেই মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পূর্বমুখী মঞ্চের সামনে শহীদ পরিবার ও আহত, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিশিষ্ট নাগরিক এবং কূটনীতিকদের আসন ছিল।

মঞ্চের সামনের চেয়ার ফাঁকা থাকলেও আসাদ গেট থেকে খেজুর বাগান পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের সর্বত্রই ছিল ছোট ছোট জমায়েত, জটলা। এনসিপি নেতারা দাবি করেছেন, লাখো মানুষের জমায়েত হয়েছে আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে। অন্যান্য রাজনৈতিক সমাবেশের সঙ্গে তুলনায় এনসিপি জমায়েতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল বেশি। বিপুল সংখ্যক তরুণী, কিশোরী আসেন সমাবেশে। সপরিবার ও শিশুসন্তানদের নিয়ে সমাবেশে আসতে দেখা গেছে অনেককে।

ঢাকার বাইরে থেকে হাজারো বাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির (জানাক) নেতাকর্মী আসেন দলের আত্মপ্রকাশ সমাবেশে। গণঅভ্যুত্থানের নেতাদের দুই প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগেই গঠিত হয়েছে এনসিপি। গত বুধবার আত্মপ্রকাশ করা গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি না করার ঘোষণা দিলেও এনসিপির আত্মপ্রকাশে উপস্থিতি ছিলেন শিক্ষার্থীদের এই সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।

বিকেল ৩টায় আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান শুরুর কথা থাকলেও শুক্রবার সকাল থেকেই নেতাকর্মীরা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে আসতে শুরু করেন। সড়কে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান নেন। মঞ্চের সামনে জুমার নামাজে অংশ নেন তারা। 

জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যরা অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন। জুমার নামাজের পর থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসতে শুরু করেন। বিকেল ৩টার দিকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে আসেন নেতাকর্মীরা। আগতদের প্রায় সবাই ছিলেন তরুণ-তরুণী। বয়স্ক মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে হাতেগোনা। কয়েকটি মিছিল ঘোড়ার গাড়ি, বাদ্যযন্ত্র নিয়ে আসে। লোকসমাগমে এনসিপি সরকারি আনুকূল্য পেয়েছে বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। পিরোজপুর থেকে পাঁচটি বাস জেলা প্রশাসক রিকুউজিশন করে দেন অনুষ্ঠানে আগতদের।
বিকেল সোয়া ৪টায় পবিত্র কোরআন, গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক পাঠের মাধ্যমে শুরু হয় আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান। এর পর জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। এর পর জুলাই শহীদদের স্মরণে নীরবতা পালন করা হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক তরিকুল ইসলামের সঞ্চালনায় বক্তৃতা করেন গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের মা-বাবা এবং পরিবারের সদস্যরা। নতুন দলের নাম, আহ্বায়ক পদে নাহিদ ইসলাম এবং সদস্য সচিব পদে আখতার হোসেনের নাম ঘোষণা করেন ৫ আগস্ট শহীদ ইসমাইল হোসেন রাব্বির বোন মিম আক্তার। তিনি সেদিন ভাইয়ের লাশ কাঁধে নিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন শেখ হাসিনার পতনে।
পরে আংশিক কমিটির নাম ঘোষণা করেন আখতার হোসেন। সামান্তা শারমিন ও আরিফুল ইসলাম আদিব যুগ্ম আহ্বায়ক, ডা. তাসনিম জারা ও নাহিদা সারওয়ার নিভা জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব, হাসনাত আবদুল্লাহ মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল), সারজিস আলম মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল), মুহাম্মদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী মুখ্য সমন্বয়কারী এবং আবদুল হান্নান মাসউদ জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পেয়েছেন। পরে অন্য যুগ্ম আহ্বায়ক, যুগ্ম সদস্য সচিব, সংগঠক, সমন্বয়কারীসহ ১৫১ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়।

নতুন দলের নেতারা যা বললেন
সব শেষে বক্তৃতা করেন ৩ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে শেখ হাসিনার পতনের ঐতিহাসিক এক দফার ঘোষক নাহিদ ইসলাম। উত্তাল জুলাইয়ের মতো মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ভারত ও পাকিস্তানপন্থি রাজনীতির ঠাঁই হবে না। আমরা বাংলাদেশকে সামনে রেখে, জনগণের স্বার্থ সামনে রেখে রাষ্ট্র বিনির্মাণ করব। আগামীর কথা বলতে চাই। পেছনের ইতিহাস অতিক্রম করে সম্ভাবনার বাংলাদেশের কথা বলতে চাই।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ‘তুমি কে, আমি কে, বিকল্প, বিকল্প’ স্লোগানটি তুলে ধরে নাহিদ ইসলাম বলেন, বিকল্পের জায়গা থেকে এই নতুন দলের আত্মপ্রকাশ। আজকের মঞ্চ থেকে শপথ– বাংলাদেশকে বিভাজিত করা যাবে না।

এর পর দলের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। সেখানে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সূচনা বলে উল্লেখ করেন। গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সব আশঙ্কার অবসান ঘটানোর আহ্বান করা হয়।

নাহিদ ইসলাম বলেন, দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। আমাদের দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় গড়ে তোলা ও তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে আমাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার। এর মধ্য দিয়েই কেবল আমরা একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারব।
নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে জুলাই গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের বিচার সম্ভব হবে জানিয়ে আখতার হোসেন বলেন, একটি নতুন সংবিধানের বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। স্বপ্ন বাস্তবায়নে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানান তিনি।

সামান্তা শারমিন বলেন, বাংলাদেশে গত ৫৩ বছরে একটি ‘বাইনারি’ ছিল। হয় একে, নয় ওকে বেছে নিতে হবে। দেশের মানুষ দুর্নীতি, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজমুক্ত সমাজ চায়।
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ৫ আগস্ট দুঃশাসনের কবর রচনা করেছি। সংসদে কে যাবে, তা নির্ধারণ করবে জনতা। ক্ষমতার মসনদে কে বসবে, তা নির্ধারণ করবে এই ভূখণ্ডের মানুষ। বাংলাদেশের গণভবনে কে যাবে, তা ভারত থেকে ঠিক হবে না।

সারজিস আলম বলেন, যারা বড় রাজনৈতিক দল, তারা যদি ছোট দলকে এগিয়ে যেতে না দেয়, তাহলে আবার স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে। খুনি হাসিনাকে দেখে যেন আমরা সেই শিক্ষা নিতে পারি। পরিবারতন্ত্র এখানেই শেষ, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে হবে আগামীর রাজনীতি।

নাসীরুদ্দীন বলেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন পর্যন্ত যারা সহযোগিতা করেছেন, তাদের সবার ত্যাগের মূল্যায়ন করা হবে। বিভাজনের রাজনীতি বাদ দিয়ে আগামীতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
আর যেন রক্তপাত না হয়– প্রত্যাশা জানিয়ে গণঅভ্যুত্থানের ছয় বছর বয়সী শিশু জাবির ইব্রাহিমের বাবা নওশের আলী বলেন, আমার দেশ যেন এনসিপির কাছে নিরাপদ থাকে। 

শহীদ পরিবারের প্রত্যাশা
শহীদ মোবারকের মা ফরিদা বেগমের প্রত্যাশা, নতুন দল ভালো কিছুই করবে। তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমাগো সন্তানেরা ঝাঁপায়ে পইড়া এ বিজয় নিয়ে আসছে। তাদের কারণে আমরা স্বাধীন। নাহিদ, সারজিসসহ যারা নতুন এই দলে আছে, সবাই যেন সুন্দরভাবে দেশটি পরিচালনা করতে পারে দোয়া করি। দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে উঠুক।’ 
শহীদ ইমাম হোসেনের ভাই রবিউল ইসলাম বলেন, নাহিদ-আখতারদের ডাকে আন্দোলনে নেমেছিলাম। তাদের মাধ্যমে যেন প্রতিটি হত্যার বিচার হয়। আহত-শহীদ পরিবার যেন ন্যায্য অধিকার পায়।
গত ৪ আগস্ট পুলিশের গুলিতে আহত আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আহমেদ বলেন, এসেছি নতুন দলকে সমর্থন দিতে। নতুন দলের কাছে প্রত্যাশা, আগামীর বাংলাদেশে দুর্নীতি থাকবে না। 

ক্রাচে ভর করে এসেছিলেন গণঅভ্যুত্থানে আহত শাকিল হোসেন। ৪ আগস্ট রাজধানীর গুলশানে ছাত্রলীগের হামলায় পা ভাঙে তাঁর। তিনি বলেন, নতুন রাজনৈতিক দলের কাছে প্রত্যাশার জায়গা থেকেই এখানে আসা। ছয় বছর বয়সী শহীদ জাবিরের বাবা মঞ্চ থেকে বলেন, সন্তান হত্যার বিচার চাই। 

সাধারণ মানুষ যা বললেন
মিরপুর থেকে আসা নাজমুল ইসলাম বলেন, দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভিড়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা হচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে নিজেকে শামিল করতে এসেছি। 
আবু ইউসুফ মাসুদ বলেন, তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি হচ্ছে। এর মাধ্যমে মানুষের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন হোক। 
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর ফুটপাতে বসে কথা হয় ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে। নতুন দলের আত্মপ্রকাশ দেখতে এসেছেন তিনি। নতুন রাজনৈতিক দলের প্রত্যাশার বিষয়ে বলেন, আশা করি, নতুন দল দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়বে। ক্ষমতা নয়, ন্যায়ের জন্য লড়াই করবে। 

যারা এসেছিলেন
আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলের শরিক ছাড়া ৩৬ রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ করা হয়। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালাল উদ্দিন আহমেদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন্দ, হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির আহমদ আলী কাসেমী, বিকল্প ধারার নির্বাহী সভাপতি মেজর (অব.) আবদুল মান্নান, বিএলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আবদুল কাদেরসহ বিভিন্ন দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তবে ছিলেন না গণপরিষদ সভাপতি নুরুল হক নুর।
ভ্যাটিকানের রাষ্ট্রদূত কেভিন এস রেন্ডালসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরাও এ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। 

 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা প্রয়োগে নীতিমালা কেন প্রণয়ন করা হবে না: হাইকোর্ট
  • তারুণ্যনির্ভর দলটি তরুণদের নিয়ে কী ভাবছে?
  • কোটার সুবিধা পাবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা
  • ‘দায় ও দরদের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করবে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’
  • উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠনসহ চার দফা দা‌বি গণঅধিকার প‌রিষ‌দের
  • বিশ্বমিডিয়ায় গুরুত্ব পেয়েছে এনসিপির আত্মপ্রকাশের খবর
  • অভ্যুত্থান থেকে জন্ম নিল এনসিপি
  • প্রাথমিক লক্ষ্য গণপরিষদের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন
  • আ’লীগের জোটসঙ্গীরা অকূল পাথারে
  • ১,৪০১ জন ‘জুলাই যোদ্ধার’ তালিকার গেজেট প্রকাশ