‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ কি জনতার মুক্তির সনদ হবে?
Published: 17th, January 2025 GMT
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং তাদের জাতীয় নাগরিক কমিটি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রোক্লেমেশন (ঘোষণাপত্র) ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে ঘোষণার কথা জানানোর পরপরই দেশের রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। প্রথমত, দেরিতে হলেও জনগণের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার লিখিত রূপ হিসেবে জুলাইয়ের একটি ঘোষণাপত্র তো আমাদের দরকার। সেটি ৫ থেকে ১০ আগস্ট ঘোষণা হলেই ভালো হতো। যে কোনো বড় ঘটনার প্রোক্লেমেশন লাগে, এটি ছাড়া সে ইভেন্ট হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই পায় ছোট আকারে। তা ছাড়া বৈপ্লবিক কায়দায় দেশের জরাজীর্ণ পদ্ধতি পরিবর্তন করে গণতান্ত্রিক ধারা চালু করতে হবে। এ জন্যই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র দরকার।
এর মাঝেই প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জানানো হয়, সব রাজনৈতিক দল এবং ছাত্রদের সঙ্গে আলাপ করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকারই জুলাই প্রোক্লেমেশন ঘোষণা করবে। শিক্ষার্থীরা ৩১ ডিসেম্বর প্রোক্লেমেশনের ঘোষণা দিত, তাতে যতটুকু প্রাণ এবং ‘স্পিরিট’ থাকত, কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন এ সরকার এবং রাজনৈতিক দল মিলে যে ঐকমত্যের প্রোক্লেমেশন দেবে, তাতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আর কোনো বিপ্লবী সম্ভাবনা দেখা যাবে না। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রোক্লেমেশন সরকার ঘোষণা দিতেই পারে। পাঁচ মাস পর রাজনৈতিক দলসহ আন্দোলনের নানা গ্রুপ যেভাবে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং মতাদর্শিক লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে, সেখানে সরকার সবার সঙ্গে আলাপ করে এ ঘোষণা দিলে জনতার জুলাই অভিপ্রায় ঠিকমতো সেখানে প্রতিফলিত হবে কিনা, তাই দেখার বিষয়। আমার মতে, আন্দোলনের মূল কারিগর ছাত্রদের নিজেদের থেকে আলাদা করে ঘোষণা থাকা দরকার। এই আলাদা ঘোষণাই জুলাই অভিপ্রায়কে বাঁচিয়ে রাখবে। তাদের রাজনীতিও দাঁড়াবে।
জুলাইকে ক্ল্যাসিক অর্থে বিপ্লব বলা হচ্ছে না, তবে এটি স্রেফ গণঅভ্যুত্থানও না। এটি এই দুয়ের মাঝামাঝি ব্যাপার। জুলাই মূলত ফ্যাসিবাদবিরোধী এবং নিওকলোনিয়াল আগ্রাসনবিরোধী একটা পোস্ট-মডার্ন গণঅভ্যুত্থান, যাকে সফল করলে তা হয়ে উঠবে নিউ ফর্ম অব ডেমোক্রেটিক রেভলিউশন। এ ব্যাপারটা ধরতে পারবে এ অভ্যুত্থানের ভ্যানগার্ড যারা তারা। রাজনৈতিক দলগুলো চাচ্ছে এখন এই গণঅভ্যুত্থানকে রেজিম চেঞ্জে পর্যবসিত করে পুরোনো ধারার সুপারফিশিয়াল সংস্কার করে এগোতে। ফলে প্রোক্লেমেশন তৈরিতে তাদের সঙ্গে মিলেমিশে যে ঐকমত্যে পৌঁছানো হবে, তা হবে আপস এবং বেহাত বিপ্লবের দলিল। যারা জুলাইয়ের মতো এত বড় গণঅভ্যুত্থানকে ‘ডেমোক্রেটিক বিপ্লবে’র রূপ দিতে চান না এবং সেটি ঠেকানোর জন্য বারবার জুলাইকে শুধু হাসিনা পতনের অভ্যুত্থান আকারে দেখিয়ে ফ্যাসিবাদী পদ্ধতি এবং জুলুমতন্ত্রের কাঠামো রক্ষার কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের সম্মতিতে যে প্রোক্লেমেশন আসবে– তা আসলে জুলাইকে ধারণ করতে পারবে বলে মনে হয় না।
এ দেশের মানুষ ১৮৫৭, ১৯৪৭, ১৯৭১, ১৯৯০ এবং ২০২৪-এ রক্তাক্ত এবং বীরোচিত আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের পরও তার জীবন, স্বাধীনতা ও সুখের কোনো অধিকার পায়নি। এক আমলাতন্ত্র যেভাবে দেশের মানুষের ওপর বসে আছে, এ দেশের এমপিরা যেভাবে জমিদারসুলভ আচরণ করে, এ দেশের পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনী যে ঔপনিবেশিক ফর্মে আছে, তাতে কোনোভাবেই জীবন ও স্বাধীনতার সুরক্ষা সম্ভব নয়; সুখের কথা তো পরে। এ দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব সেবা খাতে দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের অবাধ লুণ্ঠনকে নিশ্চিত করার জন্য ‘নিওলিবারেল পলিসি’ বাস্তবায়ন চলছে। এখন চব্বিশের রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের পর পুরোনো জুলুমতন্ত্র, লুটপাটতন্ত্র, শোষণযন্ত্র সব অক্ষত রেখেই নামকাওয়াস্তে দায়সারা কিছু ‘সুপারফিশিয়াল’ সংস্কার করে নির্বাচন করে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের জন্য ক্রমাগত চেষ্টা চালাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো।
আমরা চেয়েছিলাম পদ্ধতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন, অথচ আনা হয়েছে সংস্কারের ঘুমপাড়ানি আলাপ। এখন সেই সংস্কারও করতে দিচ্ছে না। শহীদদের কবরে ঘাস জন্মানোর আগেই ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদনের নেশায় পেয়ে বসেছে রাজনীতিবিদদের। এই পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই প্রোক্লেমেশন দেরিতে হলেও দরকারি কাজ। এখানে দায়সারা গোছের সংস্কারের কথা না বলে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মানে দেশের ঔপনিবেশিক ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের (আমলাতন্ত্র, পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী, সেনাবাহিনী, ইউনিভার্সিটি, স্থানীয় প্রশাসন, সরকার ব্যবস্থা) খোলনলচে পাল্টানোর ঘোষণা দিতে হবে এবং রাষ্ট্র পুনর্গঠনের ঘোষণাই হবে প্রধান দাবি। এসব না করে শুধু এই সরকারের বৈধতা এবং সবার মতামত নিয়ে সংস্কারের দাবি জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে নব্বইয়ে পর্যবসিত করবে।
এখন দেখার বিষয় সামনে সরকার ঘোষিত জুলাই প্রোক্লেমেশনে কী থাকে? এই প্রোক্লমেশন যদি দেশের ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বিলোপ সাধন করার জন্য বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে জনতার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়, মানে সরকার/সংসদ নয়; বরং পিপল মানে ব্যক্তিই সার্বভৌম– এই ঘোষণা দেয়, তাহলে এটি হবে যুগান্তকারী ব্যাপার। ব্যক্তির মর্যাদা এবং বিকাশকে নিশ্চিত করার জন্য, তার শরীর এবং আত্মার সম্ভাব্য বিকাশের জন্য জনপ্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচার, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রে একটি জনবান্ধব নীতি, পলিসি, কাঠামো তৈরি করতে হবে। এই লক্ষ্যেই দেশের নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করতে হবে। রাষ্ট্র গঠনের রূপরেখা এবং জনগণের রাজনৈতিক বাসনা যদি এই প্রোক্লেমেশনে থাকে তাহলে জুলাই ঘোষণাপত্র হয়ে উঠবে এ দেশের মানুষের মর্যাদা এবং মুক্তির সনদ।
বাংলাদেশের সংবিধানে সরকার অথবা সংসদকেই সার্বভৌম করা হয়েছে। ফলে এখানে প্রায়োরিটি হচ্ছে সরকারের স্থিতিশীলতা অথবা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনগণের অধিকার সুরক্ষা নয়। ফলে সরকারের সুরক্ষা এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা/শৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণকারী আইনকানুন প্রণয়ন এবং তার প্রয়োগ আমরা দেখেছি। ফলে আমি মনে করি, জুলাই অভ্যুত্থানের যে প্রোক্লেমেশন দেওয়া হবে, সেখানে অবশ্যই বলতে হবে যে সরকার অথবা সংসদ নয়, জনগণই সার্বভৌম। তাই গণসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠাই হবে নতুন বাংলাদেশের গঠনতন্ত্র এবং রাজনৈতিক চর্চার ভরকেন্দ্র। দেশে যে সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র এবং সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ চালু আছে তা রদ করে গণসার্বভৌমত্ব অথবা ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করতে হবে। এ দেশের সরকার এবং রাষ্ট্রযন্ত্র নাগরিকের অধিকার এবং বিকাশ পরিপন্থি কোনো আইন প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়ন করতে পারবে না। সরকার যদি নাগরিক অধিকার হরণ করে তাহলে সেই সরকারের বিরুদ্ধে গণবিপ্লব ন্যায়সংগত বলে সাংবিধানিকভাবেই গৃহীত হবে।
জুলাই প্রোক্লেমেশনে শ্রেণি প্রশ্ন হাজির করতে হবে। দেশের চলমান সংবিধান, আইন, কাঠামোতে শ্রমজীবী এবং নিম্নবর্গের অধিকার নিশ্চিতের কাঠামোগত কোনো রূপরেখা নেই। এই ঘোষণাপত্রে অধিকার রক্ষা হবে তার সুস্পষ্ট রূপরেখা দরকার। দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং জাতিগোষ্ঠীকে কীভাবে আস্থায় এনে তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার সুরক্ষা হবে তার ব্যাপারে আলাদা করে নির্দেশনা থাকা দরকার। এ ছাড়া জুলাই প্রোক্লেমেশনে জাতীয় স্বাধীনতা সুরক্ষা, জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ এবং সম্পদের সুষম বণ্টন এসব ব্যাপারে ঘোষণা থাকা দরকার।
যোবায়ের আল মাহমুদ: সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মাসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন জ ল ই গণঅভ য ত থ ন র র র জন ত ক সরক র র জনগণ র র জন য দরক র
এছাড়াও পড়ুন:
শাবিপ্রবিতে গণঅভ্যুত্থানের শহীদের স্মরণে দোয়া
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) ২৪ এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে দোয়া ও জিয়াফত অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে ‘বিপ্লবী সংস্কৃতিক মঞ্চ’ এর উদ্যোগে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
এ উপলক্ষে তিনটি গরু ও দুইটি ছাগল জবাই করা হয়েছে। নিবন্ধনের মাধ্যমে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, শাবিপ্রবির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সাজেদুল করিম। বিশেষ অতিথি ছিলেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সৈয়দ সলিম মোহাম্মদ আবদুল কাদির, শাহপরাণ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. ইফতেখার আহমেদ, সিলেট অনলাইন প্রেস ক্লাব সভাপতি গোলজার আহমেদ হেলাল, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর সহধর্মিণী তাহসিনা রুশদীর লুনা, শাবিপ্রবি শিবিরের সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম সুজন প্রমুখ।
অধ্যাপক ড. মো. সাজেদুল করিম বলেন, “ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর তাদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। জাতীয় স্বার্থে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি।”
তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নতুন প্রশাসন শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে, যেন ফ্যাসিজমের পুনরাবৃত্তি না হয়।”
ঢাকা/ইকবাল/মেহেদী