ছোটবেলায় বইয়ে পড়েছিলাম এভারেস্ট হচ্ছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। তখন থেকেই বরফ আবৃত পর্বত দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। ২০২০ সালে পর্বতারোহণ ক্লাব বাংলা মাউন্টেইনারিং অ্যান্ড ট্র্যাকিং ক্লাবের (বিএমটিসি) সদস্য হয়েছি। সে সময় ক্লাবের ভাইয়া-আপুদের কাছে হিমালয়ের গল্প শুনে ইচ্ছেটা আরও তীব্র হয়। হঠাৎ একদিন পর্বতারোহী ইকরামুল হাসান শাকিল ভাই জানতে চাইলেন আমি হিমালয়ের অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্পে ট্র্যাকিং করতে চাই কিনা। এ সুযোগটা হাতছাড়া করি কী করে! পরিবারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে একদিন পরই তাঁকে যাওয়ার আগ্রহের কথা জানিয়ে দিলাম। তারিখ ঠিক হলো ২৩ ডিসেম্বর।
সকাল সাড়ে ১০টায় বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে উঠে বসলাম। প্রথমবারের মতো বিদেশ ভ্রমণ, তাও আবার বিমানে, সেটিও প্রথমবারের মতো। বিমানের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছি তুলার মতো মেঘগুলো ভেসে আছে। ঘণ্টাখানেক সময় লাগল কাঠমান্ডু পৌঁছাতে। এই ট্রিপে আমরা চারজন সদস্য বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমি, লেখক ও পর্বতারোহী ইকরামুল হাসান শাকিল ভাই, চিত্রশিল্পী ও সাংবাদিক জাহাঙ্গীর আলম এবং আবু কাওসার ভাই। বিকেলে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা শেষ করে সন্ধ্যায় বাসে উঠে বসলাম পোখারার উদ্দেশে। ২৪ তারিখ ভোরে পৌঁছে গেলাম পোখারায়। সকালের নাশতা করার জন্য বসে আছি একটি ছোট্ট চায়ের দোকানে। হঠাৎ চোখ পড়ল পর্বতচূড়ার দিকে, তুষারের চাদর গায়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে অন্নপূর্ণা রেঞ্জের পর্বতমালা। ভোরের সূর্যের আলোয় সোনালি রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে। আকাশ পরিষ্কার থাকায় এত কাছে দেখা যাচ্ছিল যে একটু হাঁটলেই বুঝি কাছে চলে যাব। এর মধ্যেই আমাদের স্থানীয় গাইড আশীষ ত্রিপাঠী চলে এসেছেন। চা-বিস্কুট খেয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হলো।
দুপুরের আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম ঝিনুতে। এখান থেকেই আমাদের ট্র্যাকিং শুরু। গাড়ি থেকে নেমেই চোখে পড়ল বড় এক ঝুলন্ত সেতু। পাহাড়ি খরস্রোতা নদীর দুই পারের দুই পাহাড়কে এক করেছে। শাকিল ভাই ওপরের দিকে একটি লজ দেখিয়ে বললেন, নদীর ওপারে পাহাড়ের ওপর আমরা আজ দুপুরে খাবার খাব। যাত্রা শুরুর আনন্দে আমি তাড়াহুড়া করে এগিয়ে চলছি লজের দিকে। প্রথমবারের মতো এত বড় ঝুলন্ত ব্রিজ পার হচ্ছি। কিছুটা পথ ওঠার পর খেয়াল করলাম আমি অন্ধকার দেখছি চারপাশ। কেমন যেন লাগছে, সঙ্গে সঙ্গে বসে যাই রাস্তার পাশে। শাকিল পেছন থেকে দ্রুত এসে জিজ্ঞেস করলেন, আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা? আমি কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে; মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দুই-তিন মিনিট বিশ্রাম নেওয়ার পর আবার স্বাভাবিক হয়ে এলো। শাকিল ভাই তাঁর পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘পানি পান করেন, ঠিক হয়ে যাবে। ভয়ের কিছু নেই। এত তাড়াহুড়া করবেন না। এখন আপনি যে উচ্চতায় আছেন এমন উচ্চতায় আগে কখনও ওঠেননি। আমরা এখন অতিউচ্চতায় চলে এসেছি, আস্তে আস্তে হাঁটবেন।’ তাঁর এই কথার পর থেকে আর তাড়াহুড়া করিনি কখনও। আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। এই ভুল আর কখনও করব না।
দুপুরের খাবার শেষে আমাদের ট্র্যাকিং আবার শুরু। এখন একদম খাড়া চড়াই উঠে যেতে হবে। কচ্ছপের মতো ধীরে ধীরে পাহাড়ের গা বেয়ে সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে গেলাম চমরং। আজকের রাত আমরা এখানেই কাটাব। বিকেলে লজের ডাইনিং রুমে আড্ডা দিয়ে আর জাহাঙ্গীর ভাইয়ের গান শুনে সময় পার করে দিলাম। আমার রুমটা ছিল এমন জায়গায়, যার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাছাপুছার পর্বত দেখতে পাওয়া যায়। পাহাড়গুলো দেখে মনে হচ্ছে, কেউ সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখেছে। ডাইনিং রুমগুলোয় বিভিন্ন দেশের পতাকা এবং পর্বতারোহীদের বিভিন্ন পোস্টার লাগানো আছে। সবাই তাদের উপস্থিতি জানান দিতেই স্মারক হিসেবে রেখে যায়।
পরদিন আবার ট্র্যাকিং শুরু হলো। মাঝেমধ্যে চা-নাশতার বিরতি নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যায় পৌঁছে যাই হিমালয় নামক লজে। আজকের মতো এখানেই রাতযাপন। লজগুলোয় সন্ধ্যার মধ্যেই খাবার শেষ করে সবাই শুয়ে পড়েন। খাবার টেবিলে দেখা হলো ভিন্ন দেশের নানা বয়সী ও বিভিন্ন পেশার মানুষজনের সঙ্গে। তারা সবাই পাহাড়ের টানে ছুটে এসেছেন হিমালয়ে। মানুষগুলো বিভিন্ন দেশের হলেও মানসিকতা, পছন্দ, অপছন্দ, ভালো লাগা, মন্দ লাগাগুলো যেন একই সুতোয় গাঁথা। হিমালয়ে এসে জীবনে প্রথমবারের মতো মাইনাস তাপমাত্রায় রাত পার করছি। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের দুই-তিন ডিগ্রি নিচে নেমে গেছে। এ এক অন্যরকম অনুভূতি, যা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
সকালে নাশতা শেষে আজকের যাত্রা শুরু। উদ্দেশ্য একেবারেই অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্প। আমাদের আজকের পরিকল্পনা হলো দুপুরে আমরা মাছাপুছার বেসক্যাম্পে দুপুরের খাবার খেয়ে অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্পে গিয়ে থাকব। মাছাপুছার বেসক্যাম্পে পৌঁছানোর পর হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন একদল মেঘ এসে চারপাশ ঢেকে দিল। এমন অদ্ভুত আবহাওয়া কখনও দেখিনি। দুপুরের খাবার খেয়ে আবার রওনা দিলাম অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্পের উদ্দেশে। মাছাপুছার বেসক্যাম্পের আগ থেকেই জায়গায় জায়গায় বরফ দেখতে পাচ্ছিলাম। আমরা অনেক আগেই ট্রি লাইনের ওপরে চলে এসেছিলাম; যার কারণে এখানকার বাতাস ছিল অনেক পাতলা এবং প্রকৃতির অবস্থা একটু অন্যরকম। যেহেতু বড় কোনো গাছপালা নেই, তবে ছোট ছোট সোনালি বর্ণের ঘাসের চাদরে ঢাকা ছিল।
বেলা শেষে রোদ এসে পড়েছে বরফে ঢাকা পাহাড়ের গায়ে। দেখে মনে হচ্ছে পাহাড়ের গায়ে যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। সবাই আমাদের আগে চলে গেছেন। আমার সঙ্গে শুধু শাকিল ভাই আছেন। একটা সময় মনে হচ্ছিল শরীর যেন আর চলছে না। এর মধ্যে পর্বতের পেছন থেকে পুরো চাঁদ বেরিয়ে এলো। জ্যোৎস্না আমার ভীষণ পছন্দের। কাকতালীয়ভাবে সেদিন ছিল পূর্ণিমা। বিশাল বড় থালার মতো চাঁদ যেন সাপের মাথার মণির মতো জ্বলজ্বল করছে। চারপাশে সাদা বরফের পাহাড়গুলোয় চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে তৈরি হয়েছে এক অলৌকিক পরিবেশ। যেন টাইম মেশিনে করে রূপকথার কোনো মায়ার রাজ্যে চলে এসেছি। যেন স্বর্গের একটি খণ্ড পৃথিবীতে নেমে এসেছে। আমি আর শাকিল ভাই মিনিট পাঁচেকের মতো সময় দাঁড়িয়ে থেকে শুধু এই পরিবেশ উপভোগ করেছি। কোনো কথা বলিনি, একদম চুপ। হিমালয়ের নীরবতা আর বরফ ছুঁয়ে আসা শীতল বাতাস অনুভব করছি। দূর থেকেই বেসক্যাম্পের আলো দেখা যাচ্ছে। যখন ‘নমস্তে অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্প’ লেখা সাইনবোর্ড দেখলাম পথের সব ক্লান্তি ভুলে গিয়ে এক দৌড়ে চলে এলাম। সাইনবোর্ডের খুঁটিতে হাত রেখে আবেগে নেচে উঠলাম। এতটা নির্ভেজাল খুশির মুহূর্ত অল্পই আছে আমার জীবনে। জ্যোৎস্নার আলোয় দিনের মতোই সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমরা আমাদের লজে চলে এলাম। রাতের খাবার খেয়ে যখন রুমে এলাম তখন আরও অবাক হলাম। মাথার কাছে বিশাল গ্লাস লাগানো জানালা। জ্যোৎস্নার আলো এসে ঘরময় আলোকিত। জ্যোৎস্নার আলোয় অন্নপূর্ণার অপরূপ সৌন্দর্য মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে আর চাঁদের আলোর চাদর গায়ে দিয়ে প্রশান্তির ঘুমে ডুবে গেলাম। হিমালয়ের যে অপার সৌন্দর্য আমাকে বিমোহিত করল, তা আমি চাইলেই চোখ বন্ধ করেও দেখতে পাই। এই মুগ্ধতার ঘোর থেকে আমি কখনোই বের হতে চাই না। এটি ক্ষুদ্র জীবনের স্মৃতিতে আঁকা হয়ে থাকুক জন্মদাগের মতো।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ঈশ্বর ও মুনিয়া
হাইওয়ের রাস্তা ধরে মিনিট বিশেকের পথ সীতাপুর। সীতাপুর বাস স্টপেজ। বাস স্টপেজে নেমে সোজা পশ্চিমের লাল ইটের পথ। ইটের ফাঁকে ফাঁকে দূর্বাদল চোখ মেলে তাকায় সূর্যের দিকে।
আরও একটু পথ এগিয়ে যেতেই উত্তাল সমুদ্র। ম্যানগ্রোভ আর হিজলের ভিড়ে সমুদ্রের নীল জল দৃশ্যমান।
শোনা যায় গাঙচিলের উৎসব। মনে হয় ওরা ডাকছে, বলছে আরও আরও কাছে এগিয়ে যেতে। ছুঁয়ে দেখতে বলছে জলরাশি।
সাগরতীরে জেলেদের আবাস। জোয়ারের তোড়ে জেলেদের ঝুপড়িতে হুহু করে জল ঢোকে। জলের তাণ্ডবে বাঁশের মাচায় বাঁধে ওরা রাতের সংসার। কেরোসিনের গন্ধে আলোরা মিশে যায় অন্ধকারে।
হরিহর দাস হরি নাম করতে করতে রাত কাবার করে। জোয়ারের জল কমে আসতেই হরিহর চিৎকার করে জানান দেয়, ‘ওরে বেণু, দেখ সমুদ্রের জল কমছে। চল মাছ ধরতে যাই।’
ওরা সবাই জানে ভাটার টানে ইলিশের মহোৎসব নামে সাগরের জলে।
‘হইহই’ করে পাড়ার সবাই হাজির হয় হরিহরের ভিটায়। ওরা সবাই সার বেঁধে বসে। হরিহর কেরোসিনের কুপিতে আগুন দেয়, নিয়ে আসে মনসামঙ্গল। সুর করে পড়ে হরিহর।
রাতের তিন প্রহর যেতেই ওরা সবাই বদর বদর করে ডিঙি ভাসায় সমুদ্রের জলে। ভোরের আলোয় ওদের কেরোসিনের আলো নিভে যায়। ধীরে ধীরে ওরা মাছ ধরা শুরু করে। দুপুর হতেই ওরা সবাই ফিরে আসে। ইলিশের মহোৎসব হয় না কারও ভিটেয়। মহাজন দাদনে কেনে ইলিশ।
ওদের সানকিতে সামুদ্রিক পুঁটির ঝোল আর বেগুনে সয়লাব হয় সেদ্ধ চাল।
সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু পাহাড়।
ঘন শ্যামল পাহাড়ের কোল ঘেঁষেই এঁকেবেঁকে চলে গেছে পথ। একেবারে পাহাড়ের চূড়ায়। আবার সেই পথটাই– পাহাড়ের চূড়া হয়ে নেমে গেছে ঝরনার হয়ে অন্য প্রান্তে।
পাহাড়ি পথের কোল ঘেঁষে লজ্জাবতী আর বুনোফুলের সবুজ আস্তিন। মানুষের আলতো বাতাসে লজ্জাবতী লতারা নুয়ে পড়ে স্বমহিমায়। বুনোফুলের সারে সারে হাজার রঙিন প্রজাপতি ওড়ে। ঘাসফড়িং ঘাসফুলে লেপ্টে থাকে।
মেঠোপথ ধরে এগিয়ে যেতেই দেখা মেলে শালপাতার ছোট্ট খুপরি। আরও একটু যেতেই পাহাড়ের চূড়া। চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে হাজার বছরের একটা পোড়া শিবমন্দির।
পাহাড়ের ওপাশেই সুনসান নিস্তব্ধতা। একেবারেই জনবসতিহীন। পাহাড়ের উত্তর পাশ হয়ে নেমে গেছে ঝরনা। ঝরনাটা এখন মৃতপ্রায়। টুপটাপ বৃষ্টির মতো জল পড়ে নদীর মুখে। নদীটির নাম চন্দনা।
কাঠুরিয়ারা বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে গল্প ফাঁদে। ইনিয়ে বিনিয়ে বলে ডাহা মিথ্যে গল্প। কোনো এক বর্ষায় নাকি ঝরনার তোড়ে ভেসে গেছে একটি মেয়ে। দীঘল চুল। সোনার বরণ। মেয়েটি নাকি কাঠের গুঁড়ি খুঁজতে এসেছিল। আর কখনও ফিরে যায়নি। সেই থেকে মেয়েটির নামেই নদীটির নাম।
চন্দনার জলে এখনও মেয়েটি নাকি হাঁটুজলে নামে, করপুটে জল তোলে। একেলা হাসে আবার মা-মা বলে চিৎকার করে। কখনও কাঁদে আবার হাসে। এসব দৃশ্য কেউ স্বচক্ষে দেখেনি। শুধু গল্প শুনেছে। মেয়েটি নাকি প্রতিমার ছায়ায় হরিণীর শাবক। চোখগুলো টানা টানা অনেকটা হরিণের আদল। ঠোঁটে স্থির হয় রাজহাঁসের গান।
চন্দনার তীরে উল্টো কালীর মূর্তি। কে কখন কালীর মূর্তি উল্টো করে রেখেছিল, কেউ জানে না। সবাই বলে এমনটাই দেখেছিলাম। বাপ-ঠাকুরদার মুখেও এমন কথা– কোনো এক সন্ধ্যায় কাপালিকের মন্ত্রে উল্টে গেছে কালী। সেই থেকে অমাবস্যাতে উল্টো কালীমূর্তির আশপাশে হাজার প্রদীপ জ্বলে। বেদমন্ত্র উচ্চারণের শব্দ ভেসে আসে। ঢোল বাজে। শঙ্খসুরে মোহিত হয় পাহাড়ের চূড়া। পাহাড়ের চূড়ার শাল তমালের শাখায় দাঁড়িয়ে ঈশ্বর দেখে সব। দেখে পোড়া মন্দিরের চুন সুরকি ক্ষয়ে পড়ার যন্ত্রণা।
রামচরণরা দুই ভাই। রামচরণ আর হরিহর। সেই হরিহর কাকার কাছে শুনেছি, এই মন্দির নাকি গড়েছেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। তিনিও শুনেছেন তার বাবার কাছ থেকে। বাবাও শুনেছেন তার বাবার কাছ থেকে। এভাবেই বংশপরম্পরায় শোনা কথা। কোনো এক পূর্ণ চন্দ্রিমায় অমরা হতে দেবরাজ ইন্দ্র আসেন মর্ত্যে। তখন মর্ত্যের পাঠশালায় জমে উঠে বিবিধ উপনিষদ। এই স্থান ভালো লাগে ইন্দ্রের এবং সেই রাতেই বিশ্বকর্মাকে নির্দেশ দেন মন্দির নির্মাণ করতে।
যেমন আজ্ঞা তেমন কর্ম। চতুষ্প্রহরেই নির্মিত হলো মন্দির। ভোরের আলো ফুটতেই হইহই ব্যাপার। জনস্রোত আসে পাহাড়ের চূড়ায়। জেলেপাড়া থেকে আসে রমা বউঠান। মানতের লাল সুতোয় ভরে উঠে মন্দিরের থম। লোকারণ্যে ভাসে হাজার গুঞ্জন। মরা ছেলে বেঁচে ওঠার গল্প ফাঁদে কেউ কেউ। কেউ কেউ বলে, বন্ধ্যা স্ত্রীও পোয়াতি হবে।
হরিহর চিৎকার করে বলে, দেবতা ছিলেন। আছেন। থাকবেন নিরন্তর সত্যের মাঝারে।
হরিহরের কান্তি মাসি বলে, দ্বাপর যুগে এই খানে সীতা এসেছিল বনবাসে। কিংবা তারও আগের ঘটনা পরশুরামের কুঠারে পাহাড়ের সিঁড়িগুলো নেমে গেছে নিচে।
পোড়া মন্দিরে একেলা থাকে ঈশ্বর। ঈশ্বর রামচরণের একমাত্র ছেলে। ঈশ্বর কোনো একদিন জেলেপাড়ায় থাকত। মাছের মতো নেচে বেড়াত মাঝসমুদ্রে। এখন এই পাহাড়েই থাকে। বয়স তেমন নয়– চল্লিশের ঘরে স্থির এ বছর। মন্দিরে যেতে হলে, তাকেই বলে যেতে হয়। নচেৎ কারও যাওয়া হবে না।
ঈশ্বর সারাদিন কাঠ কাটে খটখট শব্দে। গভীর রাতে কাঠে আগুন জ্বালিয়ে গুনগুন করে গায় রামপ্রসাদি। শীত-গ্রীষ্মে রোদ বৃষ্টি কুয়াশায় ধাঙড়ের মতো শক্ত বাহু নিয়ে শুয়ে পড়ে ঈশ্বর।
রামচরণের ছেলে ঈশ্বর একদিন ভূতের ভয়ে তটস্থ থাকত। সে সন্ধ্যা হতে হতে বাড়ি ফিরত বাপের হাত ধরে। একেলা কোথাও যেত না। আজ ঈশ্বর একেলা। রাতবিরাতে পাহাড়ে জাগে স্বপ্নের মতো।
গ্রাম থেকে রোজ মুনিয়া আসত, কাঠ কুড়াত, শালপাতায় মোড়ানো খুপরি ওপাশে কেউ যেতেই একটা ভারী কণ্ঠ ভেসে আসে, কে যাস?
মুনিয়া বলে, আমি গো ঠাকুর আমি রাই।
ঈশ্বর বলে, ও তুই! কই যাস এত্ত সকাল সকাল?
মুনিয়া বলে, কাঠ কুড়াতে গো ...
আবার ঈশ্বর বলে, ফেরার পথে একটু বসে যাস্
মুনিয়া বলে, যাব ক্ষণ।
মুনিয়ার চিকন কণ্ঠ মিলিয়ে যেতেই ... দূর হতে বাতাসে ভাসে পাখি ও ঝিঁঝির তান।
অনেকেই বলে, নদীর জলে হাঁটু ডুবিয়ে ঈশ্বর নাকি দু’বেলা জলকেলি করে মুনিয়ার সাথে। মুনিয়ার বয়স তেমন নয়। একুশের যুবতী। ফিরতি পথে ঈশ্বরের ঘরে বসে মুনিয়া। সুখের বাতাস বহে যায় ইথারে ওথারে। মেঘলা দিনের টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ শোনে ওরা সারাটা রাত। ওরা মুখোমুখি বসে থাকে রাতভর।
মুনিয়া আর ঈশ্বর পাহাড়ের চূড়ায় বসে বসে দেখত আন্তঃনগর ট্রেন। কাছাকাছি বসে দেখত শেষ বিকেলের আবির খেলা। চুপচাপ হয়ে কান পেতে শুনত শেষ ট্রেন চলে যাওয়ার ধ্বনি।
মুনিয়ার ঠাকুর ঈশ্বর। মুনিয়ার শরীরের নোনা গন্ধ ভালো লাগত ঈশ্বরের। কিন্তু মুনিয়া বলত রোহিতের কথা। রোহিত মুনিয়ার হাতে হাত ধরে দেখত সমুদ্র। মুনিয়ার মন রোহিতকে টানত ভীষণভাবে।
ঈশ্বর পাহাড়ের শালপাতার ভাঁজে কবে আশ্রয় নিয়েছিল, সেই ইতিহাস কেউ জানে না। শুধু এইটুকু জানে সমতল তার ভালো লাগে না। মাঝসমুদ্রের মাছের কোলাহল আর ভালো লাগে না। যেটুকু তার ভালো লাগে– এই পাহাড়, শালপাতা। ওই ঝরনা, উল্টো কালীর মূর্তি। আর মুনিয়া।
মাঝে মাঝে ঈশ্বরের মনে পড়ে যুদ্ধের কথা। যেবার এই মুলুকে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেই বছরে, পরের বছর ঈশ্বরের মা-বাপও গেছে স্বর্গে। সেই থেকে একেলা ঈশ্বর এই পাহাড়ে।
ঈশ্বরের বেড়ে ওঠা যদিও সমতলে। কেন জানি না নিচে নামতে প্রচণ্ড ভয় করে ঈশ্বরের। মুনিয়ারও কেউ নেই। ঠাকুরমার কোলে পিঠে মানুষ। খিদের জ্বালায় রোজ একা একা পাহাড়ে আসে। কাঠ কুড়িয়ে বিকেলে ফিরে যেতে ঈশ্বরের সাথে গল্প হয়। আবার শেষ বিকেলে মেয়ে হয়ে ফিরে যায়।
রোহিতের হাতে পড়ে কতবারই যে গতর বাড়িয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বারবার শুধুই স্বপ্ন দেখেছে মুনিয়া। একটা ঘর। ছোট্ট সংসার। ছেলেমেয়ে। কিন্তু স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকেছে। এখন রোহিত নেই, পাহাড়ে এলে একেলা লাগে মুনিয়ার। তাই ঈশ্বরের সাথে গল্প হয়।
এখন বসন্ত। বনফুলের ভিড়ে হাজার ভ্রমর ওড়ে। মাঝে মাঝে হেসে মুনিয়া বলে– ও ঠাকুর, নদীটির নাম ক্যান এমন হলো?
ঈশ্বর হেসে বলত, মুনিয়া তোর পাখির নামে নাম। তুই ক্যান পাখি হলি না?
মুনিয়া বলত, দেখো ঠাকুর, মুই একদিন সত্যিকারের পাখি হবো। সেদিন আর নাগাল পাবে না ঠাকুর।
ঈশ্বর বলত, সে তো এখনও পাচ্ছি না। কবে যে পাব, হেই কথাও জানি না।
মুনিয়া বলত, তুমি ঠাকুর বেশ আছো। পাহাড়ে বসে বসে রাতের চাঁদ দেখো। শিয়ালের হাঁক শুনো ... বনমোরগের লাফালাফি দেখো। এবার মোরে চন্দনা নদীর কথা কহ।
চন্দনা নামের ইতিহাস কেউ জানে না। এমনকি আমার বাপ-ঠাকুরদার কাছেও কখনও শোনেনি। চন্দনার স্বচ্ছ জলে হাঁটু ডুবিয়ে রোজ কাঠ কুড়িয়ে আনত মুনিয়া। তারপর বাজারে হাজার পুরুষের ভিড়ে উৎকট সংলাপ।
গাঁয়ের জোতদার রহমান। নব্য পয়সাওয়ালা। বিদেশ করে করে আজ ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। তারই ছেলে রহিম। মুনিয়াকে বাজারে হাজার লোকের সামনে থুতু ছিটিয়ে মজা লুটে নিয়েছে বহুবার। একদিন ওড়না টান দিয়ে বুক দেখেছে বেজন্মার মতো।
শ্রাবণ ফিরে গেছে সপ্তা দুই আগে। এখন ভাদ্রের মাঝামাঝি সময়। কদমের শাখায় শাখায় হলুদ ফুল। দাঁড়কাকের বাচ্চাগুলো সবেমাত্র উড়তে শিখছে। আগামীকাল কিংবা হয়তো আরও দুই-এক দিন পরে ওরা আকাশ ছুঁয়ে বলবে, আমি বড় হয়েছি।
বড় হতে হতে যেমন আমরা ছুঁয়েছি চাঁদ মঙ্গল কিংবা অন্য জীবন। শাল-পিয়ালের মগডালে হুতোম প্যাঁচার ক্রন্দন ভেসে আসে। প্যাঁচার কান্না জানান দিচ্ছে আকাশের বিরূপ অবস্থা। মেঘের ঘনঘটা। পাহাড়ের শেষ প্রান্তের গ্রামের কেরোসিনের আলোগুলো নিভুনিভু।
রাত্তি গহিন। চুপচাপ ধরণি। মেঘলা চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত বনভূমি। শালপাতারা আছন্ন নিদ্রায়। পোড়া মন্দির এবং অধিষ্ঠিত দেবতাও আজ বেসামাল। হঠাৎ একটা বিদঘুটে কান্নার কোলাহলে ঘুম ভেঙে যায় ঈশ্বরের।
আধো আধো স্বর ভাঙা কণ্ঠে বলে, কে?
খুপরির ওপর প্রান্ত থেকে বলে, আমি।
কথার সমাপ্তি রেখা না টেনে হুহু করে শ্রাবণের ধারা বিলাপে শোনা যায়। যেন ঠুংরি তালে তাল ঠেকে দিয়েছে মহাকাল।
হকচকিয়ে উঠে ঈশ্বর। বুকের কোণের ব্যথা চিনচিনিয়ে ওঠে। কপাট খুলেই বলে, এত রাতে তুই! কী হয়েছে? কানছিস ক্যান?
মুনিয়া বলে, ঈশ্বর, জোতদার আমার ভিটেবাড়ি দখল করে নিয়েছে। ঠাকুরমা মৃতপ্রায়। এইসব করে যদি হে ক্ষান্ত হতো তবে শান্তি পেতাম। কিন্তু গত রাতের আন্ধারে জোতদারের জোয়ান মরদ মোর গতর নিল। ঠাকুর, কহ এবে মোর কী হবে?
ঈশ্বরের বুকের দীর্ঘশ্বাস আরও দীর্ঘ হয়। সমুদ্রের মতো ফুঁসে ওঠে বুক। চোখে আজ সমুদ্রের তরঙ্গ। শালপাতার ভাঁজ থেকে খড়্গটা হাতে নেয়।
একাত্তরের কথা। তখন তার বয়স কত, হয়তো বারো-তেরো। বাপের হাতে সেদিন অন্য অস্ত্র ছিল না। এই খড়্গে শান দিয়ে পাকিস্তানি সেনার দোসর রহমতকে কতল করেছিল। সেই রামচরণের ছেলে ঈশ্বর। পিতার মতোই দ্রোহী হয়ে ওঠে।
কালবৈশাখীর রুদ্রবীণায় যেমন একদিন মহাকাল নেচে উঠেছিল পৃথিবীতে, ঠিক তেমনি আজ ঈশ্বর। তার দু’চোখে নেচে ওঠে আগুন, দাউদাউ করে জ্বলে মানসের শস্য। v