হালান্ড জানালেন ‘প্রিয় ডিফেন্ডাররা, আমি এখানে থাকতে এসেছি’
Published: 17th, January 2025 GMT
পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটি নিশ্চিতভাবেই সাম্প্রতিক সময়টা ভুলে যেতে চাইবেন। এই স্প্যানিশ ম্যানেজারের ২০১৬ সালে সিটিতে যোগ দেওয়ার পর, ক্লাবটি কোন ধরনের পয়েন্ট হারালেই সেটা খবর হতো। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাক্তিগত জীবনে ঝড় বয়ে যাওয়া গার্দিওলার অধীনে গত বছরের সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখ থেকে দেখা মিলল ভিন্ন এক ম্যানসিটির। সেদিন থেকে এখন পর্যন্ত ২৬ ম্যাচ খেলা ম্যানচেস্টারের ব্লু’রা জিতেছে মাত্র ৯ ম্যাচ! তবে তাদের এই অসময়ে স্বস্তির সংবাদ হয়ে এসেছে দলের সেরা তারকা স্ট্রাইকার আর্লিং হালান্ডের নতুন করে ক্লাবের সঙ্গে ‘সাড়ে নয় বছরের’ বিশাল চুক্তি করাটা!
ম্যানচেস্টার সিটির সঙ্গে হলান্ডের আগের চুক্তির মেয়াদ ছিল ২০২৭ সাল পর্যন্ত। শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি, ২০২৫) করা নতুন চুক্তিতে সেটা বেড়ে গেল আরও ৭ বছর। আগামী ২০৩৪ সাল পর্যন্ত এখানে থাকবেন নরওয়েজিয়ান তারকা। এই চুক্তির আর্থিক বিষয়গুলো এখনও প্রকাশ করেনি সিটি। তবে সংবাদমাধ্যম ইএসপিএনের দাবি ইতিহাসের চোখধাঁধানো চুক্তিগুলোর একটি এটি!
আরো পড়ুন:
জয়বঞ্চিত ক্লান্ত ম্যানসিটি
এভারটনের বিপক্ষেও জয় পেলো না ম্যানসিটি
সিটির সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তি করে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ডিফেন্ডারদের ভিন্ন ধরনের এক বার্তা দিলেন হালান্ড। এটাকে খোলা চিঠিও বলা চলে। যার প্রথমাংশ ছিল অত্যন্ত আবেগী। হালান্ড নিজেই সেই তা পাঠ করেন, “প্রিয় ডিফেন্ডাররা, আমি আমাদের গত কয়েক বছরের সম্পর্ক নিয়ে ভাবছিলাম। সব সম্পর্কের ক্ষেত্রেই উঁচু এবং নীচু থাকে। এটা স্বাভাবিক। হ্যাঁ, আমাদের লড়াই হয়তো হয়েছে, তবে তোমরা আমাকে নিজের সেরাটা পেতে ধাবিত করেছ।”
আপাত দৃষ্টিতে বার্তাটিকে আবেগী মনে হলেও দ্বিতীয়াংশে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের প্রতি ছিল সূক্ষ খোঁচা, “কখনও যদি পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে যায়, আমাদের মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। যাই হোক, সাম্প্রতিক সময়ে অনেক গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ছে। আমি বুঝতে পারছি। কখনও কখনও হয়তো তোমরা আমাকে আশাপাশে চাও না, কিন্তু আমি মনে করি, আমরা একে অপরের প্রয়োজন। অন্যভাবে বললে, তোমরাই আমাকে পরিপূর্ণ করো। সুতরাং, আমি বলতে চাচ্ছি যে, দুঃখিত, আমাকে এখানে (ম্যানসিটিতে) থাকতে হবে।”
আরেক সাক্ষাৎকারে এই ২৪ বছর বয়সী স্ট্রাইকার নিজের আনন্দ ধরে রাখতে পারেননি, “নতুন চুক্তি করতে পেরে আমি সত্যিই খুশি। ম্যানচেস্টার সিটি বিশেষ একটি ক্লাব, এখানে সবাই চমৎকার মানুষ এবং দারুণ সব সমর্থক আছে। এখানকার আবহই এমন যে, সবার ভেতর থেকে সেরাটা বের করে আনতে সাহায্য করে। পেপ (গার্দিওলা), তার কোচিং স্টাফ, আমার সতীর্থ এবং ক্লাবের প্রত্যেককে ধন্যবাদ জানাতে চাই, কারণ গত কয়েক বছরে তারা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।
অন্যদিকে সদ্যই ব্যক্তিগত জীবনের ঝামেলায় বিধ্বস্ত সিটি ম্যানেজার গার্দিওলা যেন দীর্ঘদিন পর আনন্দের একটু খোরাক পেয়েছেন,“এটা আমাদের সবার জন্য অসাধারণ একটি সংবাদ, ক্লাবের জন্যও। একজন খেলোয়াড় এই ধরনের চুক্তিতে স্বাক্ষর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা সে আগে কখনো করেনি। কারণ, ও (হালান্ড) প্রমাণ করতে চায় এখানে থাকতে কতটা মরিয়া সে।”
২০২২ সালের গ্রীষ্মে বরুসিয়া ডর্টমুন্ড থেকে ৫১ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে ম্যানচসিটিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে হালান্ড ১২৬ ম্যাচে করেছেন ১১১টি গোল। সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন ১৫টি গোলে। তার অসামান্য অবদানে ক্লাবটি প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ সহ ট্রেবল জিতে। বরুসিয়া ডর্টমুন্ড থেকে রিলিজ ক্লজ সক্রিয় করে হালান্ডকে দলে ভিড়িয়ে ছিল ম্যানচেস্টার সিটি।
ঢাকা/নাভিদ
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
লেনিন কেন এখনও জরুরি
আজ ২২ এপ্রিল, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের জন্মদিন। ১৯১৭ সালে সংঘটিত রুশ বিপ্লবের অগ্রনায়ক লেনিন ছিলেন মার্ক্সের সফল উত্তরাধিকারী। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ইতিহাসের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। একটি পশ্চাৎপদ পুঁজিবাদী দেশে বিপ্লব সংঘটনের পথ বের করেন তিনি। চিন্তা ও প্রয়োগের মেলবন্ধন ঘটানোর দক্ষতাই ছিল তাঁর সাফল্যের অন্যতম কারণ। মার্ক্স সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলেন। কিন্তু রাশিয়ার মতো দেশে যেখানে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেনি, সেখানে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক বিপ্লব করে নতুন পথ দেখালেন। লেনিনের এই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ ধরেই চীনসহ পিছিয়ে পড়া পুঁজিবাদী দেশে বিপ্লব হয়েছে। ইতিহাসের কোনো পর্বকেই লাফ দিয়ে ডিঙিয়ে যাওয়া যায় না। বিপ্লবকে ইতিহাসের ভেতর দিয়েই যেতে হয়– এটি ছিল লেনিনের শিক্ষা।
লেনিন দেখিয়েছেন রাষ্ট্রযন্ত্র কোন প্রক্রিয়ায় বল প্রয়োগ করে টিকে থাকে এবং শাসক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট রূপ বুঝতে সহায়তা করে। তিনি বল প্রয়োগের মাধ্যমে বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্র উচ্ছেদের কথা বলেন। গ্রামসি বলেন, শুধু বল প্রয়োগ নয়; শাসক শ্রেণি সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শিক আধিপত্য বজায় রাখার মধ্য দিয়েও টিকে থাকে। ব্যবস্থার পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করে। ফুকোর মতে, ক্ষমতা শুধু রাষ্ট্রে কেন্দ্রীভূত নয়; সমাজের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকে। আধুনিক সমাজ শুধু বল প্রয়োগের মাধ্যমে শাসন করে না; তা মানুষের জীবন ও কর্তাসত্তার মনোজগৎ গঠনেরও নিয়ন্ত্রণ নেয়। ফুকো এর নাম দিয়েছেন বায়োপলিটিকস– জীবন ও মগজ দখল- নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি। ফুকো ক্ষমতা কী করে কাজ করে তার বর্ণনা দিলেও ক্ষমতাকে কীভাবে প্রতিরোধ ও উচ্ছেদ করতে হয়, তা দেখাননি। সেটা দেখিয়েছেন লেনিন। তার মানে এই নয়, আমাদের বলশেভিক মডেলই অনুসরণ করতে হবে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র নিবর্তনমূলক ও দুর্নীতিবাজ। গণতন্ত্রের লোভ দেখানো নির্বাচন, উন্নয়ন, ধর্মরাষ্ট্র, স্বর্গ– এসব ফ্যান্টাসি তৈরি করে রেখেছে। এসব ফ্যান্টাসি ভাঙতে হবে। আমাদের মুক্তির বিকল্প বয়ান তৈরি করতে হবে। মানুষের কাছে সেটা তুলে ধরতে পারলে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের খোলনলচে না বদলে শুধু কিছু সংস্কার দিয়ে বিদ্যমান সংকটের সমাধান সম্ভব হবে না।
লেনিনের শিক্ষার একটা বড় দিক হলো, অসংগঠিত স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন দিয়ে ব্যবস্থার অবসান ঘটানো যায় না। এ জন্য চাই বিপ্লবী মতাদর্শ ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক সংগঠন। যাকে তিনি বলেছেন বিপ্লবী পার্টি। লড়াইকে তিনি স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর ছেড়ে না দিয়ে সচেতন সংগঠিত রাজনৈতিক লড়াই চালানোর কথা বলেন। শুধু জীবনদান আর অভ্যুত্থান করলেই হবে না; সেই অভ্যুত্থানের রাজনীতি ও শ্রেণি প্রশ্নটি পরিষ্কার থাকতে হবে। অভ্যুত্থান-উত্তর পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে অভ্যুত্থানকারী শক্তির সংগঠন থাকতে হয়। চব্বিশের অভ্যুত্থানে এর কোনোটাই নেই। নেই কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনীতি ও শক্তিশালী সংগঠন। এ ধরনের ভয়ানক দুর্বলতার পরিণতিতে পর্বতের মূষিক প্রসব ঘটতে পারে।
স্বৈরতান্ত্রিক জারের ভয়ানক নির্যাতনে লেনিনের জীবন কখনোই স্থির ছিল না। বন্দি ও পলাতক জীবন এবং নির্বাসনের মধ্যে স্ত্রী ক্রুপস্কায়াকে নিয়ে কেটেছে তাঁর জীবন। তবুও এক অমিত শক্তি নিয়ে তিনি অব্যাহত রেখেছেন বিপ্লবী কর্মযজ্ঞ। লিখেছেন অবিরাম ৫৫ খণ্ড। বিতর্কে লিপ্ত থাকতে হয়েছে তাঁকে সারাক্ষণ দলের ভেতর ও বাইরে। অব্যাহতভাবে প্রকাশ করেছেন ইস্ক্রা পত্রিকা। এভাবে একদিন নতুন সূর্যের ভোর আসে ১৯১৭ সালে; অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে।
রুশ বিপ্লবের পরে বেশি দিন বাঁচেননি লেনিন। ১৯১৮ সালে আততায়ীর গুলিতে আহত হন। এরপর কখনোই পুরোপুরি সুস্থ হননি। ১৯২৪ সালে লেনিন মস্কো থেকে দূরে তাঁর নিজ গ্রাম গোর্কিতে মারা যান।
১৯৪৮ সালে কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, ‘ইউরোপ ভূত দেখেছে; কমিউনিজমের ভূত।’ বিশ শতকজুড়ে ইউরোপ ও আমেরিকাকে কমিউনিজমের এ ভূত তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। সমাজতন্ত্র ধ্বংস করতে তারা চালিয়েছে কখনও সরাসরি যুদ্ধ, কখনও স্নায়ুযুদ্ধ।
বামপন্থিদের ও সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সে যুদ্ধ এখনও জারি আছে। এ যুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের আপাত পরাজয় হলেও তা নতুন এক অনিরুদ্ধ শক্তি নিয়ে আবারও ইতিহাসে আবির্ভূত হবে। পুঁজির শোষণ ও শাসনমুক্ত একটি সভ্য মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন মার্ক্স ও লেনিন। সেটা এখনও আরাধ্য। তা অর্জনে লুটেরা পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নেই। এ সংগ্রামে লেনিন শুধু প্রাসঙ্গিক নন, জরুরিও বটে। লেনিনের জন্মদিনে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
ড. আখতার সোবহান মাসরুর: লেখক ও নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম ছাত্রনেতা