এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে আরও উন্নতির সুযোগ রয়েছে
Published: 16th, January 2025 GMT
সমকাল: আপনাদের এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাই।
নাজমুস সায়দাত: ২০১৫ সালের ২৫ অক্টোবর সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ৩৭৪টি আউটলেটের মাধ্যমে তিন লাখ চার হাজারটি বিভিন্ন ধরনের হিসাব খুলতে সক্ষম হয়েছি। সংগৃহীত আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৬০ কোটি টাকা। হাঁটি হাঁটি পা পা করে আট বছরে এখন দেশজুড়ে আমাদের ৩৭৪টি আউটলেট বিস্তার লাভ করেছে। এর মাধ্যমে এবং আরও নতুন আউটলেট খোলার মাধ্যমে ভবিষ্যতে সারাদেশে ব্যাংকিং সুবিধা বঞ্চিত মানুষের কাছে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে এসআইবিএল নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
সমকাল: এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রসারে আর কী করণীয় রয়েছে?
নাজমুস সায়দাত: এজেন্ট ব্যাংকিং শুরুর দিকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল। সমবায় কারবার এবং ডেসটিনির মতো এমএলএম বিজনেসের কারণে গ্রাহকদের মধ্যে এজেন্ট ব্যাংকিং নিয়ে বিশ্বাস এবং আস্থার সংকট ছিল। তাছাড়া সীমিত ব্যাংকিং সেবা, আঙুলের ছাপ দিয়ে লেনদেন, চেক বই ব্যবহার না করতে পারা– এসব কারণে আউটলেটে অনেক গ্রাহকের হিসাব খোলা এবং লেনদেনে অনীহা ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুসারে বাংলাদেশের যে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক এজেন্ট হওয়ার যোগ্যতা রাখে, যদি না সে সরকারি চাকরি অথবা ব্যাংকে কর্মরত থাকে অথবা আদালত দ্বারা অভিযুক্ত হয়। তাছাড়া এজেন্ট ব্যাংকিং দেশের গ্রামের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করেছে। এজেন্টদের কমিশন অপ্রতুল হওয়ায় সারভাইব করা মুশকিল হয়ে গেছে। এসব বিবেচনায় সরকার এজেন্ট কমিশনের ৫ শতাংশ ভ্যাট মওকুফ করে এজেন্টদের প্রণোদনা দিতে পারে।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় এজেন্ট ব্যাংকিংকে এখনও সব ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হিসেবে আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। তার একটু বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে যদি কোনো এক ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট থাকে, সেই ব্যাংকের স্টেটমেন্ট কোনো দেশের ভিসা ফেস করার জন্য সাবমিট করলে সেটা গ্রহণযোগ্য হয় না। বিষয়টি বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা উপস্থাপন করেছিলাম; কিন্তু এগুলো এখনও আগের অবস্থায় রয়ে গেছে। এ চ্যালেঞ্জ দূর করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কাজ করতে পারে।
সমকাল: এ নিয়ে আপনাদের আগামী দিনের পরিকল্পনা কী? কোনো সীমাবদ্ধতার জায়গা দেখেন কিনা?
নাজমুস সায়দাত: নতুন বছরে এজেন্ট ব্যাংকিং নিয়ে আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে গ্রাহকের আস্থা ফেরানো, আমানত ও ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি, নেটওয়ার্ক বিস্তার ও উন্নত গ্রাহকসেবা প্রদান অন্যতম। দেশে ২০১৪ সালে এজেন্ট ব্যাংকিং যাত্রা শুরু করে এবং এখন পর্যন্ত ২৯টি ব্যাংক দেশব্যাপী আউটলেট পরিচালনা করছে। বিভিন্ন দেশে এজেন্ট ব্যাংক যে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, বাংলাদেশও অনেকাংশে সেটি পূরণে সাফল্য পেয়েছে। তার পরও বিশেষ করে বৃহৎ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আর্থিকভাবে সম্পৃক্ত করা, তাদের উন্নতর এবং নিরাপদ সেবার মাধ্যমে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ও জীবিকার সংস্থান করার ক্ষেত্রে আরও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির সুযোগ রয়েছে। আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে আজ এজেন্ট ব্যাংকগুলোর ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এই উদ্যোক্তারা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন। দেশের মফস্বল ও গ্রামের সমবায় কারবারের সঙ্গে ব্যাংকের এজেন্টদের একটা অস্তিত্বের লড়াই চলছে। এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবসায় কিছু মূলধন তহবিল এবং অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় আছে, যা গ্রামের তরুণ শিক্ষিত বেকারদের অনেক সময় জোগান দেওয়া সম্ভব হয় না। অপরদিকে সমবায় কারবারের মতো ভুঁইফোঁড় সংগঠনগুলো মূলধন তহবিল এবং অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় ছাড়া সমাজের মানুষের কাছ থেকে সহজে আমানত সংগ্রহ করে আত্মসাৎ এবং প্রতারণা করে উধাও হয়ে যাচ্ছে, যার প্রভাব এজেন্টগুলোতে পড়ছে। আবার অপেক্ষাকৃত কম আয়ের কারণে এজেন্টগুলো ভালো বেতনে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারছে না। ফলশ্রুতিতে অদক্ষ এবং প্রযুক্তি নিরক্ষর জনবল দিয়ে এজেন্ট পরিচালনা করতে বাধ্য হচ্ছে তাদের অনেকে, যা খুব বিপজ্জনক।
দেশের ভঙ্গুর গ্রামীণ অর্থনীতির কারণে আপামর জনগোষ্ঠীকে আর্থিকভাবে সম্পৃক্ত করতে এজেন্টগুলো এখনও পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে শুধু হিসাব খোলা, নগদ জমা, নগদ উত্তোলন, কিছু প্রবাসীর রেমিট্যান্স গ্রহণ, বিদ্যুৎ বিল প্রদান ও বিতরণের মধ্যে এজেন্ট ব্যাংকিং সীমাবদ্ধ থাকাটা এজেন্টদের কাঙ্ক্ষিত মুনাফায় না পৌঁছানোর অন্যতম কারণ। কাঙ্ক্ষিত মুনাফা না করতে পেরে অনেক এজেন্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং অনেক এজেন্ট অসদুপায় অবলম্বন করছে, যা এই মুহূর্তে দেশের এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আর তাই এখন এই এজেন্টদের কীভাবে টেকসই করা যায়, তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ব্যাংকগুলোর এজেন্টদের ওপর মনোযোগ দিতে হবে– কী করে এজেন্ট কাঙ্ক্ষিত মুনাফা করে টিকে থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগে সহজ শর্তে এজেন্ট ব্যবসা করার জন্য ঋণের বাবস্থা করা যেতে পারে। বিনিয়োগসহ শাখা-উপশাখার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন ধরনের সেবা এজেন্ট পয়েন্ট থেকে চালু করতে হবে, যার মাধ্যমে এজেন্ট লাভজনকভাবে এই ব্যবসা করতে পারে। যেহেতু তারা প্রান্তিক পর্যায়ের উদ্যোক্তা, তাই তাদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ইইএফ ফান্ড অথবা যে কোনো তহবিল থেকে ন্যূনতম অঙ্কের ঋণ অথবা প্রণোদনা দেওয়ার কথা বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।
আবার নিয়ন্ত্রণকারী ব্যাংক যেন আউটলেট খুলে বিপদে পড়ে না যায়, তাও খেয়াল রাখতে হবে। অর্থঋণ আইন এবং হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন প্রয়োগের মাধ্যমে যেন ব্যাংক আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে গ্রাহকের আমানত তছরুপের কোনো ধরনের অভিযোগ পেলেই ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট এজেন্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
মিয়ানমার জান্তার মরিয়া চেষ্টা
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম আসিয়ানের চেয়ারম্যান হিসেবে ঐতিহাসিক যে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিযেছিলেন, তা খুব দ্রুতই মুখ থুবড়ে পড়ল। তিনি মিয়ানমারের যুদ্ধবিরতি-বিষয়ক একটি চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার কালি শুকানোর আগেই তাকে ভণ্ডুল করে দেওয়া হলো। আবারও সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের তাতমাডো বাহিনী সেই সাগাইং অঞ্চলে নতুন করে বোমা হামলা শুরু করে, যে এলাকা ছিল সাম্প্রতিক ৭.৭ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল।
যেটি মানবিক জানালা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা ছিল তা এখন মিয়ানমারের দীর্ঘ ট্র্যাজেডির আরেকটি অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। এটি লেখা হয়েছে বিশ্বাসঘাতকতার ভাষায়। কিন্তু এই বিশ্বাসঘাতকতা যদিও গভীরভাবে হতাশাজনক, এটি আসিয়ানের ব্যর্থতা নয়; বিশেষ করে আনোয়ারের তো নয়ই। বরং মিয়ানমারের জান্তা ও ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টকে (এনইউজি) যুক্ত করতে তাঁর এই বিরল সাহস ও রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ কৌশল এখনও পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। এর কারণ এই নয়, এটি কয়েক দিনের জন্য হলেও শান্তি এনেছে। বরং এটি তাতমাডোর প্রকৃত একগুঁয়েমিকে উদোম করে দিয়েছে এবং আসিয়ানের কূটনীতিকে নতুন করে স্পষ্টতা ও বৈধতা দিয়েছে।
যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের প্রতিটি ঘটনা আশ্চর্যজনক নয়, বরং এটি একটি সংকেত। এ ক্ষেত্রে সংকেত যতটা স্পষ্ট ততটাই বিপজ্জনক যে, তাতমাডো অঞ্চল, সংহতি ও আস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে।
এটি কেবল আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে নয়, বরং নিজস্ব কমান্ড চেইনের মধ্যেও একই ঘটনা দেখা যাচ্ছে। এটি বিশেষ করে সাগাইংয়ের ক্ষেত্রে সত্য, যা দীর্ঘদিন ধরে অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতীকী ও কার্যকরী কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত।
স্থিতাবস্থা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়– যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেওয়া স্পষ্টত তারই প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। সমাধানের চেষ্টা না করে নিরপেক্ষতার মানে হলো কুকর্মে সহযোগিতা করা এবং তা মিয়ানমারের চলমান ভাঙনের সঙ্গে আসিয়ান ও অন্যান্য শক্তির যোগসাজশ বলে বিবেচিত হবে।
উভয় পক্ষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার পর আনোয়ার এখন তার সহযোগী রাষ্ট্রপ্রধানদের এটা বোঝাতে সক্ষম যে, অস্পষ্ট কোনো ঘোষণা দেওয়ার সময় শেষ হয়ে গেছে। জান্তা ও এথনো-ন্যাশনালিস্ট অর্গানাইজেশন (ইএনওএস) উভয়ই যখন তাদের সবচেয়ে দুর্বলতম পর্যায়ে থাকে, তখন পদক্ষেপ অবশ্যই চূড়ান্ত হতে হবে।
এ কারণে আনোয়ারের দ্বৈত-কূটনীতিকে ব্যর্থ বলা যায় না। এটি ছিল একটি কৌশলগত প্রকাশ। জান্তা ও এনইউজি উভয়ের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে আনোয়ার দেখিয়েছেন, অভ্যন্তরীণ ঐক্য যাচাই-বাছাইয়ের পরও এবং বহিরাগত প্রত্যাশা বেশি থাকলেও আসিয়ান এখনও একসঙ্গে বসতে, যোগাযোগ করতে ও বিষয়গুলো স্পষ্ট করতে আহ্বান জানাতে পারে।
এখন আসিয়ান+জিসিসি+চীন শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ার তিনটি ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতা আর কাল্পনিক নয়, এটি চলমান। সমন্বিত হস্তক্ষেপ গৃহীত না হলে আসিয়ান ও জিসিসি বা উপসাগরীয় সহযোগিতা অঞ্চলে সশস্ত্র সংঘাত, মানব পাচার, ডিজিটাল দাসত্ব ও রাষ্ট্রহীনতার বিস্তার লাভ অনিবার্য।
প্রকৃতপক্ষে, মিয়ানমারের বিভক্তির ফলে চীন, থাইল্যান্ড, ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ন্ত্রণহীন অঞ্চলের সৃষ্টি হচ্ছে।
সেগাইং-এ যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন আরেকটি প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনের চেয়েও বেশি কিছু। এটি ভেঙে পড়ার একটি বিন্দু। আর বিপরীতভাবে এটি আনোয়ার ও আসিয়ানকে তাদের প্রয়োজনীয় শক্তি জোগায়। এই শক্তি তিরস্কার করার জন্য নয়, বরং আঞ্চলিক সংকটের মুহূর্তে নেতৃত্ব ও কৌশল নির্ধারণের জন্য।
ফার কিম বেং: মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক; এশিয়া টাইমস থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম