‘রিকশা-ভ্যান দিয়ে গুদামে ধান নিয়ে যেতে বাড়তি খরচ হয়। ঠিকমতো শুকনো না হওয়াসহ নানান অজুহাতে তা ফিরিয়েও দেওয়া হয়। রয়েছে দালালের দৌরাত্ম্য। গুদামে ধান দিলে নগদ টাকা পাওয়া যায় না, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করতে হয়। সরকারি দামের চেয়ে বাজারে দাম বেশি। পাইকাররা বাড়ি থেকে নিয়ে যান, পাওয়া যায় নগদ টাকা। এজন্য আমরা গুদামে না দিয়ে বাজারে ধান বিক্রি করছি।’ কথাগুলো রংপুরের গঙ্গাচড়ার কৃষক আহাম্মদ আলীর।
চলতি মৌসুমে রংপুর অঞ্চলে আমন ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযান চলছে ধীরগতিতে। ঝক্কি-ঝামেলা এড়ানোসহ বাজারে ধানের দাম বেশি হওয়ায় সরকারি গুদাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন আহাম্মদ আলীর মতো কৃষকগণ। পাশাপাশি গুদামে চাল সরবরাহে লোকসান হচ্ছে দাবি করে মিলাররাও অনীহা দেখাচ্ছেন। এতে চলতি মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার আশঙ্কা জোরালো হচ্ছে। দুই মাসে বিভাগের আট জেলায় ধানের গড় সংগ্রহ মাত্র ৩ শতাংশ। তিন জেলায় এক কেজি ধানও সংগ্রহ হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে গঙ্গাচড়া খাদ্যগুদামে ১ হাজার ২৬৭ টন ধান ও ৬৬৬ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এ পর্যন্ত ১১২ টন চাল সংগ্রহ হলেও গুদামের জন্য এক ছটাক ধানও কেনা যায়নি।
উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা উম্মে কুলসুম খাতুন বলেন, বাজারে দাম বেশি হওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে খাদ্যগুদামে। তারা চেষ্টা চালাচ্ছেন। ধান না পাওয়া গেলেও চাল সংগ্রহের ব্যাপারে
তারা আশাবাদী।
রংপুর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৭ নভেম্বর শুরু হয় আমন ধান-চাল সংগ্রহের অভিযান, চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। দুই মাসে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ধান সংগ্রহ মাত্র ৩ শতাংশ। এর মধ্যে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও পঞ্চগড়ে সংগ্রহের হার শূন্য।
সবচেয়ে বেশি দিনাজপুরে ৭ শতাংশ, ঠাকুরগাঁওয়ে ৩, নীলফামারীতে ৬ এবং গাইবান্ধা ও রংপুরে ১ শতাংশ সংগ্রহ হয়েছে। চলতি মৌসুমে আট জেলায় আমন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৭৫ হাজার ৯৪০ টন। এ পর্যন্ত আড়াই হাজার টনের মতো সংগ্রহ হয়েছে।
আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ১৬৪ টন। এ পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে ৬ হাজার ১৬৫ টন, যা শতকরা ৩৯ শতাংশ। সেদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৩৪ হাজার ৭৫৪ টন। সংগ্রহ হয়েছে ৫৯ হাজার ৩৪ টন। শতকরা হিসাবে অর্জন ৪৮ শতাংশ। এবার চাল সরবরাহের কথা রয়েছে বিভাগের ৩ হাজার ২৩৬ জন মিলারের।
এর আগে বোরো মৌসুমে প্রতি কেজি ধানের ক্রয়মূল্য ৩০ টাকা হলেও চলতি আমন মৌসুমে তিন টাকা বাড়িয়ে ৩৩ টাকা করা হয়েছে। বোরোতে চালের কেজি ছিল ৪৪ টাকা। এবারে ৩ টাকা বাড়িয়ে ৪৭ টাকা করা হয়েছে। তারপরও তেমন সাড়া মিলছে না কৃষকের।
তাদের অভিযোগ, খাদ্যগুদাম ১৪ ভাগ আর্দ্রতা না হলে ধান নিতে চায় না। এ কারণে গুদামে ধান দিতে গিয়েও ফিরে আসতে হয়। পাশাপাশি প্রতি টনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দিতে হয় কর্মকর্তাদের। এর সঙ্গে রয়েছে পরিবহন ভাড়া ও শ্রমিকের চাঁদা। এর চেয়ে বাজারে ধান বিক্রিতেই লাভ বেশি।
খাদ্যগুদামে ৩৩ টাকা কেজি দরে প্রতি মণ ধানের দাম ১ হাজার ৩২০ টাকা হয় জানিয়ে পীরগাছার তাম্বুলপুর এলাকার কৃষক নওশের আলী বলেন, ৩৬ টাকা কেজি দরে বাজারে বিক্রি করা যাচ্ছে। এখন বাজারে প্রতি মণ ধান ১৪০০ থেকে ১৪৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সরকারি দরে বিক্রি করলে তাদের লোকসান গুনতে হবে।
চাল ব্যবসায়ীরাও কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা লোকসান হওয়ায় গুদামে দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন বলে জানিয়েছেন। তাদের ভাষ্য, ১৪০০ টাকা মণ দরে ধান কিনে চালে কেজিতে খরচ পড়ছে ৫০ টাকার বেশি। অথচ সরকারি গুদামে ৪৭ টাকা দরে দিতে হয়। এবার গুদামে চাল দিতে কেউ সাহস পাচ্ছেন না জানিয়ে গঙ্গাচড়ার আরাফাত অ্যান্ড রোমান চালকলের মালিক মশিউর রহমান বলেন, ‘এবার চালের বরাদ্দ পেয়েছি ১০ টন। না দিলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নসহ লাইসেন্স বাতিলের হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। বাধ্য হয়ে কেজিতে ২ টাকা লোকসানে চাল দিতে হয়েছে।’
সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় বাধ্য হয়ে গুদামে চাল দিতেই হবে জানিয়ে রংপুর চালকল মালিক সমিতির নেতা লোকমান মোল্লা বলেন,
চাল সরবরাহ করে লাভ দূরের কথা, উল্টো লোকসান গুনতে হবে। না দিলে সরকার কালো তালিকাভুক্ত করবে, লাইসেন্স বাতিলসহ অন্য ব্যবস্থা নেবে। তারপরও লোকসানে চাল দিতে চাচ্ছেন না মিল মালিকরা।
এ বিষয়ে রংপুর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক জহিরুল ইসলাম বলেন, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বাজারে ধানের দাম বেশি হওয়ায় কৃষকরা গুদামে দিতে আগ্রহী নন। মাড়াইয়ের পর তারা পাইকারের কাছে বিক্রি করতে পারছেন। আর্দ্রতা পরিমাপেরও প্রয়োজন হয় না। তাই গুদামে ধান দিতে অনীহা রয়েছে তাদের। তারপরও সময় আছে, ধান-চালের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের চেষ্টা চলছে বলে জানান এ কর্মকর্তা ।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
চাঁদাবাজি ও মজুতদারি বন্ধ করতে না পারায় নিত্যপণ্যের দাম কমাতে ব্যর্থ সরকার
নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে চাঁদাবাজি বন্ধ ও মজুতদারি বা অযৈাক্তি মূল্য নির্ধারণের মতো অনিয়ম মোকাবিলা করতে পারেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাই নিত্যপণ্যের দাম কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ শৃঙ্খলে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে সাহসী ও জরুরি পদক্ষেপ না নিলে মূল্যস্ফীতির হার কমানো কঠিন হবে।
আজ বুধবার ধানমন্ডিতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২৪-২৫: সংকটময় সময়ে প্রত্যাশা পূরণের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানানো হয়।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান, সিপিডির গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রমুখ।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ফাহমিদা বলেন, সিপিডির পর্যবেক্ষণে পেঁয়াজ, আলু, বেগুন, ডিম, রুই মাছ, হলুদ, গম, মসুর ডাল, চিনি, গরুর মাংস, রসুন, আদা, সয়াবিন তেল এবং পাম তেলসহ ১৪টি বিভিন্ন প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খল বিশ্লেষণে দামের ওঠানামা এবং অদক্ষতার জন্য বেশ কিছু বাধা দেখা দিয়েছে। বেশিরভাগ কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে, প্রাথমিক বাধাগুলোর মধ্যে রয়েছে মজুতদারি, কমিশন এজেন্ট বা গুদাম পরিচালনাকারীদের আধিপত্য, অপর্যাপ্ত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা এবং কৃষি পদ্ধতি, উচ্চ উপকরণ খরচ, নিম্নমানের সংরক্ষণ এবং পরিবহন সুবিধা এবং সামগ্রিক সরবরাহকে প্রভাবিত করে এমন অপ্রত্যাশিত আবহাওয়া।
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, চালের বাজার ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত জটিল। সে কারণে সিপিডি চালের সরবরাহ শৃঙ্খলে বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা নিরূপণের জন্য মাঠ পর্যায়ে একটি অনুসন্ধানমূলক জরিপ পরিচালনা করে, বিশেষ করে মাঝারি-পাইজাম চাল। যার লক্ষ্য ছিল প্রধানত দামের যে অস্থিরতা তার মূল কারণগুলো সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি করা।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, চাল সরবরাহ ব্যবস্থায় অসংখ্য বাজার এজেন্ট রয়েছে। বাজার মূল্যের ওপর গুদাম মালিকদের বা অটো রাইস মিলারদের উল্লেখযোগ্য আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়। ফলস্বরূপ ধান চাষীরা প্রায়শই সঠিক দাম পান না। কিন্তু ভোক্তারা অযৌক্তিকভাবে উচ্চ মূল্যের সম্মুখীন হন, যার ফলে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়।
খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রসঙ্গে সিপিডি বলছে, বাংলাদেশে পূর্ববর্তী কর্তৃত্ববাদী সরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতির মাধ্যমে একটি অকার্যকর অর্থনীতি রেখে গেছে, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ঠিক করতে হবে। বেশ কিছু খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ শৃঙ্খলের বিশ্লেষণে মধ্যস্থতাকারীদের একটি জটিল নেটওয়ার্কের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
সিপিডি বলছে, অর্থনীতিতে মুল্যস্ফীতির চাপ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদহার বৃদ্ধির অনুমতি দিয়েছে এবং নীতি সুদহারও বৃদ্ধি করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের উপর উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির বোঝা কমাতে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সরবরাহ-পক্ষীয় ব্যবস্থাও বাস্তবায়ন করেছে, যেমন ট্রেডিং কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশের মাধ্যমে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য খোলা বাজারে বিক্রি করা এবং ঢাকার ভেতরে ও বাইরে ন্যায্য মূল্যের বাজার প্রতিষ্ঠা করা। তবে দুঃখের বিষয় হলো, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খলে চাঁদাবাজি, মজুদদারি বা অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের মতো অনিয়ম মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তাই মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলি এখনও পর্যন্ত বাজারে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম কমাতে ব্যর্থ হয়েছে।
সংস্থাটি আরও বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার যদি প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ শৃঙ্খলে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে সাহসী এবং জরুরি পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে মূল্যস্ফীতির হার কমানো কঠিন হবে।
রাজস্ব প্রসঙ্গে সিপিডি বলছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে ২০২৫ অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত মোট রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩.৭ শতাংশ যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময় ছিল ১৭.৭ শতাংশ অর্থাৎ এখানে উল্লেখযোগ্য অবনতি দেখা গেছে।
২০২৫ অর্থবছরের মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে অর্থবছরের বাকি সময় ৪৫.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে যা মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। সামগ্রিকভাবে কর রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক। কর রাজস্বের দুটি উৎসেই (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত ও বহির্ভূত) একই চিত্র দেখা গেছে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ওই সময়ে মূসক এবং সম্পূরক শুল্ক আহরণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। জুলাই-আগস্টের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে শ্লথগতি এর বড় কারণ। কর রাজস্ব আহরণের পরিস্থিতি বহুলাংশেই সরকারকে মূসক এবং সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধিতে ধাবিত করেছে। তবে আইএমএফের শর্তপূরণের চাপও এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান উচ্চ-মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতিতে এ ধরনের উদ্যোগ মোটেই কাম্য নয়। কারণ পরোক্ষ কর সকল ধরনের আয়ের মানুষের জীবনেই প্রভাব ফেলে।