সরদার ফজলুল করিমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জাহানারা ইমাম বলেছিলেন– “আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় নেতা শেখ মুজিবের কিছু পারিবারিক ব্যাপারে দুর্বলতা ছিল। নিজের ছেলে, নিজের ভাগ্নেকে তিনি কনট্রোল করতে পারতেন না।... তাঁর যে ভাই খুলনায় মারা গিয়েছিলেন, আমি শুনেছি লোকের মুখে, সেখানকার লোকেরা নাকি আনন্দে মিলাদ পড়িয়েছে। তিনি এতোই অত্যাচারী ছিলেন। এসব বলতে খারাপ লাগে, কষ্ট লাগে। কিন্তু এমন ঘটনা ঘটেছে তো!.

.. তাঁর আরও আরও আত্মীয়স্বজন এগুলো যে করত– অনেককে অত্যাচার করা, অন্যায় সুযোগ-সুবিধা নেওয়া– এগুলো সে সময়কার লোকেরা সবাই জানে। কিন্তু শেখ স্নেহে অন্ধ হয়ে এগুলোর কিছু করেননি।” (প্রথম আলো, ঈদ সংখ্যা, ২০০৯)।

সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন ব্রিটেনের বহুল বিতর্কিত সিটি মিনিস্টার ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবিরোধী দায়িত্বে থাকা টিউলিপ সিদ্দিক। টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার মেয়ে। শেখ হাসিনার পতনের পর টিউলিপের বিরুদ্ধে দুর্নীতির খবর বোমার মতো ছড়িয়ে পড়ে। অভিযোগ ওঠে, শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ একজন আওয়ামী লীগ নেতা উপহার হিসেবে ব্রিটেনের কিংস ক্রসে একটি ফ্ল্যাট দিয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিককে। তাঁর বোন আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তির নামে আরও একটি ফ্ল্যাট উপহার দেন আইনজীবী মঈন গণি। প্রকারান্তরে সেই ফ্ল্যাটও টিউলিপকে উপহার দেওয়া হয়েছে। কারণ, রূপন্তি ওই ফ্ল্যাট টিউলিপকে পরিবারসহ ব্যবহার করতে দিয়েছেন। এর বাইরে রাশিয়ার সঙ্গে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চুক্তি করার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা, টিউলিপ, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় প্রমুখ ৫০০ কোটি ডলার মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগে বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে। তদন্ত চলছে ব্রিটেনে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দুদকের দুর্নীতিবিষয়ক তদন্তে ক্রমবর্ধমান চাপের ফলে পদত্যাগ করেছেন ব্রিটিশ ট্রেজারি মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক। 

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে ৩০ কোটি ডলার বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন মার্কিন ব্যাংকে স্থানান্তরের প্রমাণ পাওয়ার কথা প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। হংকং এবং কেম্যান দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্ক, সেই সঙ্গে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ পাচার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ, তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা এবং রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ৮০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে নতুন তদন্ত শুরু করেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ ৯টি প্রকল্প থেকে এসব দুর্নীতি করা হয়েছে।

শেখ হাসিনা প্রায়ই সভা-সমাবেশে বলতেন, দেশ থেকে তাদের পরিবারের নেওয়ার কিছু নেই। ঘটনা দেখা গেল উল্টো। নিজ পরিবারের সদস্যদের নামে নিয়েছেন একাধিক সরকারি প্লট। পরিকল্পিত শহর গড়তে পূর্বাচলকে বেছে নেয় রাজউক। আবেদনকারীদের মধ্যে লটারি করে প্লট বরাদ্দ দেয় সংস্থাটি। সবার জন্য একই পদ্ধতি নয়। সরকারি সিদ্ধান্তে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে প্লট বরাদ্দ দিতে আইনে একটি ধারা যোগ করা হয়। এই ধারা ব্যবহার করে নানা সময়ে বিভিন্নজনকে দেওয়া হয়েছে পূর্বাচলের প্লট। এ তালিকায় ছিলেন শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের ৫ সদস্য। প্রত্যেকের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১০ কাঠার মোট ছয়টি প্লট। 

বালু নদির পাড়ে পূর্বাচল প্রকল্পের ডিপ্লোম্যাটিক জোনের ২৭ নম্বর সেক্টরে ২০৩ নম্বর রোডের একটি প্লট শেখ হাসিনাকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। পাশেই শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির প্লট। পরের প্লটটি নেন শেখ রেহানা। পরের দুটি প্লট শেখ হাসিনার দুই সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের। সবশেষ প্লটটি বরাদ্দ দেওয়া হয় শেখ রেহানার মেয়ে আজমিনা সিদ্দিকের নামে। বরাদ্দ দেওয়ার পরপরই প্রাচীর দিয়ে পুরো ৬০ কাঠা প্লটের চারপাশ ঘিরে ফেলা হয়। এসবের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলেন আনসার সদস্যরা। সরকার পতনের পর নিরাপত্তা উঠে গেলে উত্তেজিত জনতা প্রাচীরের মূল ফটক ভেঙে ফেলে। 

এখন অবশ্য কেবল সীমানা প্রাচীরের ফটকের মধ্যেই শেখ হাসিনা পরিবারের দুর্নীতি আটকে নেই। এমনকি শেখ হাসিনার কর্মচারীরাও শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তিনি নিজেই এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন– ‘আমার বাসায় কাজ করেছে, পিয়ন ছিল সে, এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক (সমকাল, ১৪ জুলাই ২০২৪)।’ এই সংবাদ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নেটিজেনরা প্রশ্ন তুলেছিলেন– ঘরের কর্মচারীর ৪০০ কোটি টাকা হলে মালিকের কত আছে? 

ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মিশেলে আওয়ামী লীগ যে ভিত্তি তৈরি করেছিল, ৫ আগস্টের (২০২৪) সূর্য মধ্যগগন স্পর্শ করার আগেই তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কথায় কথায় পরিবারতন্ত্র নিয়ে চটকদারি আলোচনা যারা করেন, তারা কি অনুগ্রহ করে শেখ হাসিনা পরিবারের ৭০ বছরের দুর্নীতির ধারাবাহিক তালিকা তৈরিতে উদ্যোগী হবেন? 
শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে যাওয়ার পরে আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড নেতা থেকে মন্ত্রী, অনেককেই আটক করা হলো। শেখ পরিবারের কাউকে এখনও আটক করা গেল না কেন? তাদের নিরাপদে দেশত্যাগের সুযোগ কারা তৈরি করল? বাংলাদেশের মানুষের কষ্টার্জিত টাকা যারা বিদেশে পাচার করল, সেই তালিকায় প্রথম দিকে অবস্থান করা শেখ পরিবারের একজন সদস্যকে এখনও কেন দৃশ্যমান আইনের আওতায় আনা গেল না? 

ইতিহাস তা-ই সাক্ষ্য দেয় যে, পরিবারটি যখনই রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে তখনই রাষ্ট্রীয় অর্থ নিজেদের মনে করেছে। আমরা গল্প-উপন্যাসে আরব শেখদের কিস্‌সা পড়ি, সিনেমা দেখি।  বাংলার শেখদের এমন দুর্নীতির ঘটনা নিয়ে কি সিনেমা বানাতে আগ্রহী হবো না?
 
এহ্‌সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক, 
সমকাল; কথাসাহিত্যিক 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ক ষমত চ য ত পর ব র র য গ কর সরক র আওয় ম তদন ত সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

দেশের প্রথম নারী ইউপি চেয়ারম্যানের মৃত্যু

বাংলাদেশ প্রথম নির্বাচিত নারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট চন্দনা গ্রামের বাসিন্দা শামসুন্নাহার চৌধুরী মারা গেছেন।

শুক্রবার আছর নামাজের পর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

এর আগে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

মৃত্যুকালে তিনি স্বামী, সন্তানসহ আত্মীয়স্বজন ছাড়াও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। সিঙ্গাপুর, ভারতসহ বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। চুনারুঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবু তাহেরের স্ত্রী তিনি।

তিনি চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশী ও দেওরগাছ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ৩ বার চেয়ারম্যান নির্বাহিত হন। এরমধ্যে ১৯৮৮ সালে প্রথম মিরাশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সারা দেশে তখন তিনিই ছিলেন প্রথম নারী ইউপি চেয়ারম্যান। সেই থেকে রাজনীতিতে জড়ান। ১৯৯৩ সালে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।

শামছুন্নাহার চৌধুরী ৩ বার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নানা সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন। পেয়েছেন অতিশ দীপঙ্কর জয়িতাসহ নানা পুরস্কার। হয়েছেন জেলার শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান। কাজ করেছেন নারী উন্নয়নে।

তার মৃত্যুতে সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন শোক প্রকাশ করেছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ