গল্প আর উপন্যাসের প্লট সম্ভবতঃ অভিন্নরূপ ধারণা নয়। উপন্যাস তো গল্পই, গল্প তো থাকতেই হবে। একের পর এক গল্প উপন্যাসের অবয়ব নির্মাণ করে এবং একটি পরিণতির দিকে নিয়ে যায়
আমার প্রথম উপন্যাসটির কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন একজন প্রখ্যাত লেখক, কিন্তু আমি ওই লেখকের জীবনীকে উপজীব্য করিনি। উপন্যাসের নাম ‘দুর্দানা খানের চিঠি’: কাঠামোর বিচারে পত্রোপন্যাস; কিন্তু কাহিনি সুস্পষ্ট কিছু নয়। একজন লেখকের ব্যক্তিজীবনের কিছু গল্প; যাতে রয়েছে প্রেম, বিবাহ এবং বিচ্ছেদ। এবং নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির প্রেক্ষাপট। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদে প্রথম স্ত্রী দীর্ঘ দুই যুগের নীরবতা ভেঙে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি লিখলে কাহিনির সূত্রপাত হয়।
তারপর?
তারপর লেখক সে চিঠির উত্তর দেন। উত্তর দিতে গিয়ে তিনি অতীতের কথা স্মরণ করেন। বলেন, কেন প্রথম স্ত্রী তাঁকে পরিত্যাগ করেছিলেন সে প্রশ্নের উত্তর আজও তাঁর অজানা।
তারপর? প্রথম স্ত্রী লেখকের সে চিঠির উত্তর দিলেন? কী লিখলেন তিনি? কেন তিনি তাঁর স্বামীকে পরিত্যাগ করেছিলেন সে কথা জানালেন?
গল্পের শ্রোতা এমতরূপ প্রশ্ন করেন: তারপর? তারপর কী হলো। নটে গাছটি না মোড়ানো পর্যন্ত ‘তারপর’ এবং ‘তারপর’।
কিন্তু গল্প আর উপন্যাসের প্লট সম্ভবত অভিন্নরূপ ধারণা নয়। উপন্যাস তো গল্পই, গল্প তো থাকতেই হবে। একের পর এক গল্প উপন্যাসের অবয়ব নির্মাণ করে এবং একটি পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু প্লট সম্ভবত তাৎপর্যপূর্ণ একটি কাহিনিছক; যা উপন্যাসের অভিমুখ, চরিত্রসমষ্টি, কাহিনির বক্রতা, নাটকীয়তা, সাসপেন্স প্রভৃতির সমবায়ে একই সূত্রে গ্রন্থিত পরিকল্পনার মতো লেখককে পরিচালিত করে;–পরিচালিত করে যার ফলে আদি ও অন্তের মধ্যে সৃষ্টি হয় একটি ধারাবাহিক, কার্যকারণসংবলিত, যুক্তিগ্রাহ্য ঘটনাপ্রবাহ।
দ্বিতীয় উপন্যাস ‘কক্সবাজার’ লেখার সময় আমার প্রথম সমস্যা ছিল কাহিনিছক যাকে সচরাচর ‘প্লট’ বলা হয়ে থাকে, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না-নিয়ে উপন্যাসটি লিখতে বসে যাওয়া। যে গল্পটি দিয়ে উপন্যাসের শুরু, তা নানাভাবে বিকশিত হতে পারত কিন্তু ঠিক কীভাবে অগ্রসর হলে আমি গন্তব্যে পৌঁছতে পারব, সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত ছিল না। কার্যত যাত্রা শুরু করেছিলাম কোনো গন্তব্য স্থির না করেই। ফলে উপন্যাসটি–প্রারম্ভ, বিকাশ এবং চূড়ান্ত পরিণতির যে বৃত্তাকার কাঠামোর ব্যতিচারে–অনেকগুলো গল্পের সমষ্টিতে পরিণত হয়েছে। একজন কেন্দ্রীয় চরিত্র বা নায়কের উপস্থিতি সত্ত্বেও গল্পগুলো সুচারুরূপে সমন্বিত হয়ে উঠতে পারেনি।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস “উনিশ শ’ একাত্তর” নিয়ে আমার সমস্যা ছিল অন্যরকম। একদিকে এটি হবে ইতিহাস আশ্রিত একটি উপন্যাস, অন্যদিকে তাতে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের বিবিধ অনুষঙ্গ। প্রচুর উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়েছিল গবেষণার মাধ্যমে। আমি ঠিক একজন নায়ককে কেন্দ্র করে উপন্যাসটি লিখতে চাইনি। আমার মনে হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে একজন নায়ক থাকাটা সমীচীন হবে না। কারণ মুক্তিযুদ্ধ ছিল অসংখ্য মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত, স্বাত্যন্ত্রিক ও বিচ্ছিন্ন অথচ শেষাবধি যৌথ একটি প্রয়াস। মুক্তিযুদ্ধে নায়কের মৃত্যুর পরেও উপন্যাসের কাহিনি অব্যাহত ছিল; কারণ আমি বলতে চেয়েছিলাম একজন পিতার পুত্রশোক পরিমাপের অতীত একটি অনুভূতি, যা একটি জাতির ঐতিহাসিক অর্জনে কিছুমাত্র প্রশমিত হয় না। আমি সচেতন ছিলাম যে এবম্বিধ উদ্দেশ্যমূলকতা উপন্যাসের শিল্পরূপ ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। আর তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ঘটনাবলি আহত না করে কেবল শেষ অধ্যায়ে উদ্দিষ্ট বক্তব্যটির অবতারণা করেছিলাম যথাযোগ্য ঘটনার মধ্য দিয়ে: বিজয় দিবসের দু’দিন পরে, একেবারে শেষ অধ্যায়ে।
এরপর আরও চারটি উপন্যাস আমি লিখেছি। সব উপন্যাসের ক্ষেত্রে আমি দুটি অনতিক্রান্ত বাধার সম্মুখীন হয়েছি। প্রথমটি হলো, আমাকে মানুষের জীবনের যৌনতাকে এড়িয়ে চলতে হয়েছে। অথচ এমন সময়ে ও পরিবেশে আমি বসবাস করছি যখন মানুষের জীবনের প্রেম-ভালোবাসার চেয়ে যৌনতা বেশি অনুপ্রবিষ্ট হয়ে গেছে। ‘ভালবাসাবাসি’ উপন্যাসে একটি ঘটনায় স্বামী ঘুম ভেঙে আত্মরতিতে মগ্ন হয়, যদিও স্ত্রী একই শয্যায় শায়িত। অনেক পাঠক এ বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। অন্যদিকে নিশ্চিতভাবে বলা যায়: সৎমায়ের সঙ্গে কিশোরপুত্রের যৌনসম্পর্ক নিয়ে ‘ইন প্রেইজ অব স্টেপ মাদার’ লিখতে মারিও বার্গাস ইয়োসাকে কোনোরূপ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে হয়নি।
আর দ্বিতীয়টি হলো, সমাজ, রাষ্ট্র এবং ইতিহাস সম্বন্ধে আমি সর্বতোরূপে বাস্তবোচিৎ হতে পারিনি।
দ্বিতীয় সমস্যাটি রীতিমতো প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে যখন চতুর্থ উপন্যাস ‘গোপনীয় ডায়েরি’ লিখতে শুরু করেছিলাম। আমার এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন সাদামাটা ব্যাংকে চাকরি করা যুবক, যার স্কুলে পড়া ভাইকে থানা-পুলিশ বিনা কারণে আটক করে এবং স্বীকারোক্তি আদায়ের লক্ষ্যে থানায় নিয়ে নির্যাতন শুরু করে। থানায় গোপন একটি কক্ষে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে পেটাতে পেটাতে শেষ পর্যন্ত মেরে ফেলে। বড় ভাই সাধারণ একজন যুবক হলেও প্রতিজ্ঞা করে ওই সাব-ইন্সপেক্টর যেভাবে তার ভাইকে পেটাতে পেটাতে হত্যা করেছে–সে তাকে ধরবে এবং একইভাবে ছাদ থেকে ঝুলিয়ে পেটাতে পেটাতে সেই সাব-ইন্সপেক্টরকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেবে। একজন পুলিশের কর্মকর্তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে–এমতরূপ একটি দৃশ্য উপন্যাসে তুলে আনবার মতো পরিবেশ ২০২২ সালের বাংলাদেশে ছিল না। সুতরাং ‘গোপনীয় ডায়েরি’ অমীমাংসিত একটি উপন্যাস হিসেবেই একটি ঈদসংখ্যায় মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
সাতটি উপন্যাস লেখার পর আমি এরকম একটি সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হয়েছি যে উপন্যাস লিখতে বসার আগে এক বা দুই বাক্যে হলেও কাহিনির শুরু, বিকাশ এবং পরিণতি সম্পর্কে লেখকের ধারণা থাকা দরকার। এই ধারণা যত স্পষ্ট হবে লেখকের জন্য উপন্যাস লেখা তত সহজ হবে। এডগার অ্যালেন পো তাঁর দ্য ফিলোসফি অফ কম্পোজিশন প্রবন্ধে লিখেছেন: Nothing is more clear than that every plot, worth the name, must be elaborated to its dénouement before anything be attempted with the pen.
কিন্তু কার্যত লেখকের কল্পনায় আদি থেকে অন্তের দিকে অভীষ্ট যাত্রার গতিপথ কখনোই খুব স্পষ্ট কোনো নকশা হয়ে ওঠে না। উপন্যাসে কয়টি অধ্যায় থাকবে, কোন অধ্যায়ের ঘটনা কেমন হবে–এরকম নিপাট ছক কেটে কোনো লেখক লিখতে বসবেন এটা আশা করা যায় না। বরং লেখা শুরুর পর উপন্যাস একটি আত্মগতি (ডায়নামিকস) অর্জন করে, যার আবছায়ায় আদি ও অন্তের মধ্যবর্তী পরিক্রমাটি যুক্তিগ্রাহ্যভাবে সম্পন্ন হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত উপন্যাসটি একটি পূর্ণতা ও পরিণতি লাভ করে–যেরকম পূর্ণতা ও পরিণতি একজন সাধারণ পাঠক আশা করেন। ফ্রেডরিখ ফোরসাইথ ‘দ্য ডে অব জ্যাকল’ শুরু করেছিলেন একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে। ১৯৬২ সালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট দ্য গলকে হত্যার ষড়যন্ত্রটি বাস্তব। কিন্তু যেভাবে আততায়ীকে খুঁজে বের করার জন্য গোয়েন্দারা চেষ্টা চালিয়েছিল, তা একটি মনোমুগ্ধকর কল্পকাহিনি। এখানেই ফোরসাইথের কৃতিত্ব।
আমার ধারণা সাধারণ পাঠক আশা করে একটি সমস্যা এবং তার সমাধান। কিংবা একটি রহস্য এবং সেই রহস্যের উন্মোচন। কিন্তু উপন্যাস তার চেয়েও বেশি কিছু। একজন আধুনিক কথাসাহিত্যিকের কাজ হচ্ছে এবম্বিধ একটি কাহিনিছকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেই মানুষের জীবনের দর্শন এবং জিজ্ঞাসাগুলোকে পাঠকের কাছে অবারিত এবং দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তোলা। তাকে কিছু চরিত্র সৃষ্টি করতে হবে এবং কিছু ঘটনা চিত্রায়িত করতে হবে। বেছে নিতে হবে একটি সময় এবং প্রেক্ষাপট। একজন ঔপন্যাসিকের কাছে পাঠকের এসব ন্যূনতম দাবি। সমালোচক হিসেবে আমার অনুসন্ধিৎসা হচ্ছে, লেখক কি নতুন কিছু বলেছেন, যা ইতোপূর্বে বিবৃত হয়নি? প্রেম ও ঘৃণা, প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্ব, পুরস্কার ও প্রতিশোধ–এসবের পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে কোনো নতুন জিজ্ঞাসা বা দর্শন? প্রতিফলিত হয়েছে অকথিত কোনো বাণী?
দাম্পত্য জীবনের সমস্যা ঔপন্যাসিকদের প্রিয় থিম। আমার বিশ্বাস ‘মাল্যবান’ লেখার জন্য জীবনানন্দ দাশকে খুব বেগ পেতে হয়নি। সবকিছু তাঁর মাথায় ছিল: চরিত্রগুলো, ঘটনাবর্ত, সংলাপ–সবকিছু। জীবনানন্দ দাশকে কেবল কাগজ-কলম নিয়ে বসতে হয়েছে। সময় দিতে হয়েছে। অবারিত ছন্দে যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে উপন্যাসটি লেখা হয়ে গেছে। ১৯৪৮ সালে লিখিত হলেও ‘মাল্যবান’-এর বীজ রোপিত হয়েছিল ১৯৩০ সালের ৩০ মে, যেদিন আদি ঢাকা শহরে, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে, জগন্নাথ কলেজের পাশে অবস্থিত ঢাকা ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে জীবনানন্দ দাশ রোহিণীকুমার গুপ্তের কন্যা লাবণ্য গুপ্তের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। সে সময় লাবণ্য গুপ্ত পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন একটি স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে ঢাকার ইডেন কলেজে পড়াশোনা করছিলেন। ওই দিনই ‘মাল্যবান’-এর বীজ প্রোথিত হয়েছিল; অঙ্কুরোদ্গম ও পরিণতি হয়েছিল দ্রুত। বেকার, দুস্থ, অসহায়, জীবনের কাছে পর্যদুস্ত জীবনানন্দ দাশ ১৯৪৮-এ কেন–অনেক আগেই ‘মাল্যবান’ লিখে ফেলতে পারতেন। কেন তিনি সময় নিয়েছেন, তা অপরিজ্ঞাত থেকে গেছে। তবে যখন লিখতে বসেছেন, তখন অক্লেশে অনায়াসে ‘মাল্যবান’ লেখা হয়ে গেছে। ‘মাল্যবানের’ পাণ্ডুলিপি দেখার সুযোগ ঘটেনি আমার। কিন্তু ‘বাসমতির উপখ্যান’ নামীয় উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপির ৯টি খাতা দেখবার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। প্রথম দিকে কিছু অদল-বদল, কাটাকুটি থাকলেও জীবনানন্দ পুরো উপন্যাসটি লিখেছেন এমন অবিচল গতিতে যে কেবল একজন ওস্তাদ লিখিয়ের পক্ষেই সম্ভবপর।
গার্সিয়া মার্কেস তার ‘হানড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচুড’ ততটা সহজে লিখে উঠতে পারেননি। তাঁকে অনেক ভাবতে হয়েছে, অনেক কিছু আবিষ্কার করতে হয়েছে। অনেকবার খসড়া করতে হয়েছে ঘরের দরজা বন্ধ করে। কী বলবেন তা স্থির করা থাকলেও কীভাবে বলবেন তা ছিল অনির্ণীত। একটি ঘটনা কতভাবেই না বর্ণনা করা যায়, কত কায়দা করেই না প্রকাশ করা যায়। কত না বর্ণিল হতে পারে প্রতীক উপমার সমাবেশ।
স্মরণযোগ্য যে কবি বুদ্ধদেব বসু ‘রাত ভরে বৃষ্টি’ শুরু করেছিলেন পরিসমাপ্তি দিয়ে:
‘হয়ে গেছে ─ ওটা হয়ে গেছে ─ এখন আর কিছু বলার নেই। আমি, মালতী মুখোপাধ্যায়, একজনের স্ত্রী আর একজনের মা, আমি ওটা করেছি। করেছি জয়ন্তর সঙ্গে, জয়ন্ত আমাকে চেয়েছে, আমিও তাকে। নয়নাংশু হয়ত ভাবছে আগেই করেছিলুম, কিন্তু না–আজই প্রথম। আজ রাত্রে–চার ঘণ্টা আগে। এই বিছানায়। যেখানে মালতী এখন শুয়ে আছে। ─ কেমন ক’রে হ’লো? খুব সহজ। সত্যি বলতে আগে কেন হয় নি জানি না– আমার সংযমে, জয়ন্তর ধৈর্যে, আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। রাত্তির ন‘টা নাগাদ জয়ন্ত এলো, আর তক্ষুনি এমন বৃষ্টি নামলো যে আধ ঘণ্টার মধ্যে জল দাঁড়িয়ে গেলো আমাদের গলিতে। দশটা, সাড়ে দশটা─বৃষ্টি আর থামে না। অংশু গেছে তার মুমূর্ষু পিসিমাকে দেখতে বেলেঘাটায়, বুন্নি আমার মা-র কাছে থাকছে আজ, দুর্গামণি ভাঁড়ার ঘরে মাদুর বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। আমি ফ্ল্যাটের দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে শোবার ঘরে এলুম বৃষ্টির ছাঁটে কিছু ভিজেটিজে যাচ্ছে কি না দেখার জন্য।’
চরিত্র গঠন এবং ঘটনা চিত্রণের জন্যে লেখককে তার কল্পনাশক্তির আশ্রয় নিতে হয়। চরিত্রসমূহ এবং ঘটনাবলির মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের অবয়ব ধীরে ধীরে পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হয় এবং কাহিনি সমাপ্ত হয় চূড়ান্ত পরিণতির মধ্য দিয়ে। একজন দক্ষ লেখক চরিত্র গঠন এবং ঘটনা চিত্রণের মধ্য দিয়ে একটি কাল্পনিক বিশ্ব তৈরি করতে সক্ষম হতে পারেন। সব লেখকের পক্ষে একটি বিশ্বাসযোগ্য কাল্পনিক বিশ্ব তৈরি করা সম্ভবপর হয় না। কিন্তু সম্ভবত কল্পনারও নাকে লাগাম থাকা দরকার। সল বেলো লিখেছিলেন: Great literature is subtle, dignified, profound. তাঁর ‘হেন্ডারসন দ্য রেইন কিং’ সম্ভবত মহৎ সাহিত্য হিসাবে স্বীকার্য। এ কথা মেনে নিলেও অধোবদনে স্বীকার করি এ উপন্যাসের fun and facts পূর্ণমাত্রায় আস্বাদন করা সম্ভবপর হয়নি।
অন্যদিকে কল্পনার অভাবে উপন্যাস বাস্তবের প্রতিফলনে পর্যবসিত হয় মাত্র। কিন্তু একজন ঔপন্যাসিক এবং সাংবাদিকের মধ্যে যোজনপ্রতিম দূরত্ব রয়েছে। কারণ সাহিত্যিকের কাজ কেবল ঘটনা বিবৃত করা নয়, শুধুমাত্র কিছু তথ্য জানান দেওয়া নয়। কথাসাহিত্য এমন একটি গদ্য, যার লক্ষ্য শৈল্পিক বিনোদন; যার প্রকৃত সৃজন সম্পূর্ণ হয় লেখক এবং পাঠকের যৌথ প্রয়াসে। সব কথাসাহিত্যিক পাঠককে সমমাত্রায় তার রচনার সতীর্থে পরিণত করতে পারেন না।
এ সূত্রে উদাহরণস্বরূপ হুমায়ূন আহমদের ‘দেয়াল’ উপন্যাসটির একটি অংশের কথা উল্লেখ করতে চাই। ‘দেয়াল’ শফিক ও অবন্তির গল্প। শফিক ও অবন্তির গল্প বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে ১৫ আগস্টের প্রেক্ষাপট বেছে নিয়েছেন। ওই দিন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয় ও সরকারের পতন হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পরে আওয়ামী লীগের নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে পরবর্তী সরকার গঠিত হয় ও ক্ষমতার পালাবদল ঘটে।
হুমায়ূন আহমেদের রসবোধ তীক্ষ্ণ। এই রসবোধের প্রমাণ হিসেবে ঘটনার বর্ণনা ও সংলাপ উভয়ই উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৫ আগস্ট সকালে মেজর রশিদ পুরানো ঢাকা শহরের আগা মসিহ লেনে গিয়েছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদকে সাথে করে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যাওয়ার জন্য। খন্দকার মোশতাক এবং মেজর রশিদের মধ্যে কী আলোচনা হয়েছিল তার সাক্ষী কেউ নেই;–কেউ এই সাক্ষাৎপর্ব অবলোকনপূর্বক দিনপঞ্জি বা আত্মজীবনীতে লিখে যাননি। লেখককে এই কথোপকথন রচনা করতে হয়েছে কল্পনার ভিত্তিতে। হুমায়ূন আহমেদ কীরূপে এই অংশটি লিখেছিলেন তা আবার পড়া যেতে পারে:
‘সিঁড়িতে বুটজুতার শব্দ হচ্ছে। খন্দকার মোশতাক একমনে দোয়ায়ে ইউনুস পড়তে লাগলেন। এই দোয়া পাঠ করে ইউনুস নবি মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। তাঁর বিপদ ইউনুস নবির চেয়ে বেশি।
দরজা খুলে মেজর রশীদ ঢুকলেন। তাঁর হাতে স্টেনগান। তাঁর পেছনে দু’জন সৈনিক। তাদের হাতেও স্টেনগান। সৈনিক দু’জন স্টেনগান মোশতাকের দিকে তাক করে আছে।
মোশতাক নিশ্চিত মৃত্যু ভেবে আল্লাহপাকের কাছে তওবা করলেন। মেজর রশীদ বললেন, ‘স্যার চলুন।’
মোশতাক বললেন, ‘কোথায় যাব?’
‘প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। প্রথমে রেডিওস্টেশনে যাবেন। জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন।’
‘ট্যাংক এসেছে কেন?’
‘প্রেসিডেন্টের মর্যাদা রক্ষার জন্যে ট্যাংক এসেছে।’
মোশতাক বললেন, ‘শুক্রবারে আমি জুম্মার নামাজের আগে কোনো কাজকর্ম করি না। দায়িত্ব যদি গ্রহণ করতে হয় জুম্মার নামাজের পর।’
মেজর রশীদ কঠিন গলায় বললেন, ‘আপনাকে আমি নিতে এসেছি; আপনি আমার সঙ্গে যাবেন। অর্থহীন কথা বলে নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই।’
মোশতাক বললেন, ‘অবশ্যই অবশ্যই। তবে আমাকে কিছু সময় দিতে হবে।’
‘আপনাকে কোনো সময় দেওয়া হবে না।’
‘কাপড় চেঞ্জ করার সময় দিতে হবে। আমি নিশ্চয়ই লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিব না?’–”
এই অংশটি যে কৌতুকাবহ তা ব্যাখ্যা করে বলার আবশ্যকতা নেই। হুমায়ূন আহমেদ জানেন পাঠক এবম্বিধ কৌতুকচিত্র উপভোগ করতে ব্যর্থ হয় না। এ প্রসঙ্গে মহামতি অস্কার ওয়াইল্ডের একটি প্রবচন স্মরণযোগ্য। জগতের লেখককুলের উদ্দেশে তাঁর উপদেশ ছিল: ‘পাঠকের নিকট সত্য তুলিয়া ধরিতে চাহিলে তাহাদের হাসাইয়া দিন। নচেৎ তাহারা আপনাকেই শেষ করিয়া দিবে।’ হুমায়ূন আহমেদের কথাসাহিত্য লেখকদের উদ্দেশে সর্বদাই অভিন্ন উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে। ঔপন্যাসিকদের তা মনে রাখা দরকার।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: হ ম য় ন আহম দ কর ছ ল ম কর ছ ল ন প রথম স হয় ছ ল র জন য ত হয় ছ সময় দ সমস য ত রপর বলল ন ন একট
এছাড়াও পড়ুন:
জামালপুরে ট্রাকের ধাক্কায় সিএনজির ৫ যাত্রী নিহত
জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলায় ট্রাকের ধাক্কায় সিএনজিতে থাকা পাঁচ জন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় একজন আহত হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) সন্ধ্যা ৬টার দিকে উপজেলার মহাদান ইউনিয়নের কড়োগ্রাম এলাকায় জামালপুর-টাঙ্গাইল মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন- এনাম ফকির, সিএনজি চালক আব্দুর রাজ্জাক, আরিফুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর আলম ও আব্দুল করিম আলাল।
জামালপুর সদর উপজেলার নারায়ণপুর তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ মো. লুৎফর রহমান জানান, মধুপুর থেকে ছেড়ে আসা জামালপুরগামী একটি সিএনজি অটোরিকশাকে মধুপুর থেকে ছেড়ে আসা দ্রুত গতির একটি ট্রাক সামনে থেকে ধাক্কা দেয়। এতে সিনএজি অটো রিকশায় থাকা ঘটনাস্থলেই চার জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আহত দুজনকে উদ্ধার করে স্থানীয়রা।
উদ্ধারকৃতদের মধ্য এনাম ফকির স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালে মারা যায়। এনামের বাবা আমজাদ ফকির গুরুতর আহত অবস্থায় জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
মালপুর সদর উপজেলার নারায়ণপুর তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ মো. লুৎফর রহমান বলেন, “ঘটনার খবর পেয়ে এখান থেকে চার জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। একজন হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা গেছে। মরদেহ উদ্ধার করে আইনানুগ প্রক্রিয়া করা হচ্ছে।”
ঢাকা/শোভন/এস