টেকসই সংস্কারের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
Published: 15th, January 2025 GMT
গত ২১ নভেম্বর নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে দেশের সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের মতবিনিময় সভার অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করা যাক। সমকালের প্রকাশক ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের সঙ্গে আমিও ওই সভায় যোগ দিয়েছিলাম। সেখানে একটি টেকসই নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলার উপায় নিয়ে অনেক প্রস্তাবই এসেছিল। এক পর্যায়ে প্রশ্ন ওঠে– বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? যত ভালো সুপারিশই আসুক, দিন শেষে সেগুলো জাতীয় সংসদে পাস হতে হবে, যার এখতিয়ার শুধুই রাজনৈতিক দলের। কিন্তু এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা খুব ভালো না। বিশেষ করে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারগুলোর অঙ্গীকার ভাঙার দুঃখজনক প্রসঙ্গও আলোচনায় আসে। ২০০৭-০৮ সালে ‘ওয়ান ইলেভেন’ সরকারের ব্যর্থ চেষ্টার কথাও স্মরণ করা হয়।
এবার যেন এত পরিশ্রম বৃথা না যায়, তাই বলা হলো, সবার আগে রাজনৈতিক দলের সংস্কার জরুরি। আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এমন কিছু শর্ত রাখতে হবে যেন সংসদে সংস্কার প্রস্তাবগুলোর চূড়ান্ত অনুমোদনে কোনো দল বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। কিন্তু সেই শর্তগুলো কী হতে পারে, তা কেউ বলতে পারলেন না। শেষে কমিশনপ্রধান ও অন্য সদস্যরা বললেন, দায়িত্বটা সংবাদমাধ্যমকেই নিতে হবে। তারা যদি সংস্কার প্রস্তাবগুলোর ব্যাপক প্রচার দেয়, তাহলে এগুলোর পক্ষে জনমত প্রবল হবে। তখন সংসদও এগুলো এড়াতে পারবে না।
আমার ধারণা, একই প্রশ্ন অন্যান্য সংস্কার কমিশনকেও ভাবায়; খোদ সরকারও এ নিয়ে চিন্তিত। সে কারণেই গত বিজয় দিবসে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। কমিশনের নেতৃত্বে আছেন প্রধান উপদেষ্টা নিজে; সদস্য থাকবেন প্রথম ধাপে গঠিত ছয় কমিশনের প্রধানরা। ওই ভাষণে যেমনটা বলা হয়েছে, এ কমিশনের কাজ হবে রাজনৈতিক দলসহ সব পক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করা; যেসব বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপিত হবে সেগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি বাস্তবায়নের সুপারিশ করা।
তাতেও কি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন বিষয়ে আশাবাদী হওয়া যায়? অতি আশাবাদীরাও উত্তরে খুব আস্থার সঙ্গে হ্যাঁ বলতে পারবেন না। ১৯৯০ ও ২০০৭-০৮ পরবর্তী তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা আগেই বলেছি। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাও ভরসা জোগায় না।
জনপ্রশাসন সংস্কার-বিষয়ক কমিশনপ্রধান সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বললেন, তারা প্রশাসনের নীতনির্ধারণী পর্যায়ে সব ক্যাডারের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে চান। এ জন্য উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের বাইরের কর্মকর্তাদের জন্য বিদ্যমান ২৫ শতাংশ কোটা বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করার সুপারিশ দেবেন। অমনি বিদ্যমান প্রশাসনিক ব্যবস্থার মূল অংশীজন বা সুবিধাভোগী প্রশাসন ক্যাডারের চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত সদস্যরা রীতিমতো রে রে করে তেড়ে এলেন। এমনকি কমিশনপ্রধান তাদের স্বগোত্রীয় হওয়ার পরও তাঁর আশু অপসারণ চাইলেন তারা।
৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর আমলারা নিজেদের ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’ বলে গলা ফাটালেও, বাস্তবে বরাবরই সরকারের আদেশ-নির্দেশ মেনে এসেছেন– নির্বাচিত বা অনির্বাচিত যা-ই হোক। এখনও তারা তা করতে বাধ্য। কিন্তু সেই আমলারাও যখন মৌরসি পাট্টা হারানোর ভয়ে গোটা সংস্কার প্রক্রিয়াকেই ভন্ডুল করতে উদ্যত, তখন দলীয় সরকার নির্বাচিত হওয়ার পর সব জবাবদিহির ঊর্ধ্বে চলে যাওয়ার বিদ্যমান সুবিধা কেন যেচে বিসর্জন দেবে?
সম্ভবত এরই সমাধান হিসেবে অনেকে বলছেন, জনগণ তো নির্বাচনের জন্য ‘পাগল’ হয়ে যায়নি। নির্বাচনের আগেই প্রচলিত ধারার রাজনীতিতে আমূল সংস্কার আনতে হবে। সম্প্রতি রাজধানীতে অনুষ্ঠিত ঐক্য সংস্কার ও নির্বাচন-বিষয়ক জাতীয় সংলাপে নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.
কথা হচ্ছে, অংশীজনের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কিছু চাপিয়ে দিলে তা টেকসই হয় না– গত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সব ব্যবস্থা তছনছ হওয়াই তার প্রমাণ। একই ভুল কি আবারও হবে? জনমতের দোহাই সব শাসকই দেয়। কিন্তু আসল জনমত প্রকাশ পায় সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে। সেই নির্বাচনকে দীর্ঘ অপেক্ষায় রাখবে যে সরকার, তার কর্মকাণ্ড জনতার দরবারে ভালো মূল্যায়ন পাবে?
বিশ্বের যে দেশগুলোতে অন্তত কার্যকর গণতান্ত্রিক শাসন আছে বলে ধরে নেওয়া হয়, সেগুলোর রাজনৈতিক ইতিহাসও কিন্তু এমন ধারার সংস্কারের উদাহরণ তুলে ধরে না। দুনিয়া কাঁপানো ফরাসি বিপ্লব শুধু দেশটির জনগণকে গণতন্ত্রের স্বাদই দেয়নি; ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কারের মানদণ্ড স্থাপন করেছিল। ১৭৮৯ সালের সেই ফরাসি বিপ্লবই কি ফ্রান্সের জন্য শেষ কথা ছিল? বস্তুত, এর প্রায় দু’শ বছর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির দখল থেকে ফ্রান্সকে মুক্তকারী ফরাসি সেনা কর্মকর্তা শার্ল দ্য গলের নেতৃত্বেই দেশটিতে স্থায়ী একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। যুক্তরাজ্যেও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী হাউস অব কমন্স আজকের পর্যায়ে আসতে প্রায় হাজার বছর লেগেছে। ১২১৫ সালে বিখ্যাত ম্যাগনাকার্টা পেশের পর লর্ড, নাইট প্রভৃতি উপাধিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নিয়ে হাউস অব লর্ড প্রতিষ্ঠিত হলেও আমজনতার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না। আবার হাউস অব কমন্স চতুর্দশ শতকে প্রতিষ্ঠিত হলেও রাজার কর্তৃত্বের বাইরে আসে সপ্তদশ শতকে, যখন সেখানে বিখ্যাত বিল অব রাইটস পাস হয়। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতেও আছে গৃহযুদ্ধসহ বহু রক্তপাতের ঘটনা। তিন দেশের ক্ষেত্রেই রাজনীতির উন্নয়নে অর্থনীতিসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নতিরও অবদান অভাবনীয়।
অনস্বীকার্য, বারবার রক্ত ঝরানো ঘটনা কোনো উন্নতিকামী রাষ্ট্রের জন্যই কাঙ্ক্ষিত নয়। আবার রাজনীতিকে তার মতো এগোতে না দিয়ে বিশেষত অসাংবিধানিক পন্থা বেছে নিলে তা রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে সহায়ক হয়– এমন প্রমাণও সমসাময়িক বিশ্বে নেই। রাজনৈতিক দলগুলো তো অন্ধ বা বধির নয়। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের বার্তা নিশ্চয় তারা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে। জনগণ অতিষ্ঠ হলে অতি জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতারও পরিণতি কী হয়, তার উদাহরণ এখানেই আছে। আবার জনগণের মধ্যে তাগিদ থাকলে নতুন রাজনৈতিক দল যে জন্ম দেবে না– তাই-বা কে বলতে পারে! ফলে সামনের দিনের রাজনীতি নিয়ে অতি উচ্চাশার যেমন সুযোগ নেই, তেমনি পুরোপুরি ৫ আগস্টের আগের ধারায় ফিরে যাবে না– এমন আশাবাদও রাখা যায়।
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র গণঅভ য ত থ ন ৫ আগস ট র ক ব যবস থ র র জন ত র জন য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
শাবিপ্রবিতে গণঅভ্যুত্থানের শহীদের স্মরণে দোয়া
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) ২৪ এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে দোয়া ও জিয়াফত অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে ‘বিপ্লবী সংস্কৃতিক মঞ্চ’ এর উদ্যোগে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
এ উপলক্ষে তিনটি গরু ও দুইটি ছাগল জবাই করা হয়েছে। নিবন্ধনের মাধ্যমে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, শাবিপ্রবির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সাজেদুল করিম। বিশেষ অতিথি ছিলেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সৈয়দ সলিম মোহাম্মদ আবদুল কাদির, শাহপরাণ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. ইফতেখার আহমেদ, সিলেট অনলাইন প্রেস ক্লাব সভাপতি গোলজার আহমেদ হেলাল, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর সহধর্মিণী তাহসিনা রুশদীর লুনা, শাবিপ্রবি শিবিরের সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম সুজন প্রমুখ।
অধ্যাপক ড. মো. সাজেদুল করিম বলেন, “ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর তাদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। জাতীয় স্বার্থে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি।”
তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নতুন প্রশাসন শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে, যেন ফ্যাসিজমের পুনরাবৃত্তি না হয়।”
ঢাকা/ইকবাল/মেহেদী