বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের স্থল সীমান্তের দৈর্ঘ্য ২৭১ কিলোমিটার। সীমান্তের ওপাশে রয়েছে প্রতিবেশী দেশটির রাখাইন ও চিন স্টেট। দুই রাজ্যের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ এখন সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে রাখাইনের ঘনিষ্ঠতা থাকলেও মিয়ানমার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে সম্পর্ক খুব মধুর– এমনটি বলা যাবে না।

আশির দশক থেকে রাষ্ট্রীয় ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হয়ে রাখাইনে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা দফায় দফায় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশে ঢুকছে। জাতিগত নিধনের মুখে ২০১৭ সালেই বাংলাদেশে প্রবেশ করে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। পুরোনোদের প্রত্যাবর্তন দূর কা বাত, এখনও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকতে বাধ্য করছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও উগ্রপন্থি আরাকানরা। ফলত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ইতোমধ্যে ১২ লাখ ছাড়িয়েছে।

মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের স্থল সীমান্তের বড় অংশ পড়েছে বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায়। উন্মুক্ত ও দুর্গম এ সীমান্ত দিয়ে গৃহযুদ্ধে টালমাটাল দেশটি থেকে রোহিঙ্গা জনস্রোত তো আছেই; মাদক, অস্ত্র চোরাচালানসহ নানা অপরাধের স্বর্গ হয়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগর-তীরবর্তী দুই দেশের অরক্ষিত সীমান্ত।

নিরাপত্তার অজুহাতে ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে বেড়া দেওয়া শুরু করে মিয়ানমার জান্তা সরকার। ওই সময় আপত্তি জানায় ঢাকা। পরবর্তী সময়ে উভয় দেশই একমত হয়, ‘কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবে না।’ এ পর্যন্ত ২০০ কিলোমিটারেরও বেশি কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে তারা। কিন্তু আরও ৭১ কিলোমিটারে বেড়া নেই। যেখানে বেড়া রয়েছে, তাও যথেষ্ট নাজুক। অভিযোগ রয়েছে, এই বেড়া ভাঙতে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং আরাকান আর্মির হাত রয়েছে, যাতে রোহিঙ্গা বিতাড়ন সহজ হয়।  

এদিকে, গত দেড় দশকে প্রতিবেশী দুই দেশের আর্থসামাজিকসহ নানা সূচকে আমূল পরিবর্তন এসেছে। গড় আয় ও আয়ু, সামাজিক নিরাপত্তাসহ নানা সূচকে মিয়ানমারকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। যেমন বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় বার্ষিক আয় যেখানে ২৭৮৪ ডলার, সেখানে মিয়ানমারে মাত্র ১২৩০ ডলার। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু যেখানে ৭২ বছর, মিয়ানমারের ৬৭। অন্যান্য সূচকেও বাংলাদেশ তুলনামূলক ভালো অবস্থানে।

এটা ঠিক, বাংলাদেশ নীতিগতভাবে প্রতিবেশী দেশের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়ার পক্ষে নয়। কিন্তু নিরাপত্তাজনিত হুমকি বাড়িয়েছে গৃহযুদ্ধকবলিত মিয়ানমার। সামরিক জান্তা ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর লড়াইয়ে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বহিঃশক্তির বদান্যতায় মিয়ানমারে এখন অস্ত্রের ছড়াছড়ি। অরক্ষিত সীমান্ত হয়ে এই অস্ত্রশস্ত্র যে বাংলাদেশে ঢুকছে না বা ঢুকবে না– তার নিশ্চয়তা কী?

যেমন গত ৯ জানুয়ারি খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর গোলাম রব্বানী কক্সবাজারে খুন হন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, এ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রটি এসেছে মিয়ানমার থেকে। অবৈধ অস্ত্র সহজলভ্য হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলারও নিরাপদ রুট হতে পারে উন্মুক্ত সীমান্ত। বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রামে মিয়ানমারের বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতার যেসব কথা শোনা যায়, সেগুলো মাথায় রাখা জরুরি। 

কক্সবাজার, বান্দরবানসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইতোমধ্যে বড় বোঝা হয়ে ওঠা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আরও অনুপ্রবেশ বড় মাথাব্যথার কারণ। টেকনাফ, উখিয়ার জনপদের মূল স্রোতে ইতোমধ্যে মিশে গেছে অনেকে। সেখানে কে রোহিঙ্গা, কে বাংলাদেশি; বোঝা মুশকিল। কক্সবাজার থেকে সন্ধ্যার পর টেকনাফে যাতায়াতে মেরিন রোডও নিরাপদ নয়। অপহরণ, ছিনতাই, ডাকাতির খবর প্রায়ই সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আসছে। স্থানীয় দুর্বৃত্তদের সঙ্গে এসব অপরাধে নেতৃত্ব দিচ্ছে রোহিঙ্গারা। অপরাধীদের মধ্যেও বাড়ছে রক্তপাত ও খুনোখুনি। 

মিয়ানমারে উৎপাদিত ইয়াবা চোরাচালানের সহজ রুট এই অরক্ষিত সীমান্ত। এমনও শোনা যায়, কক্সবাজার ও বান্দরবান অঞ্চলে রাতারাতি ধনী হওয়ার নেশায় সাধারণ মানুষ থেকে রাজনীতিবিদ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও জড়িয়ে পড়ে ইয়াবা ব্যবসায়। 

শুধু ভারত সীমান্তেই যে বাংলাদেশিরা মারা পড়ছে, তা নয়। সংবাদমাধ্যম ঘেঁটে দেখা গেছে, গত এক দশকে ১০ জনেরও বেশি বাংলাদেশি নিহত হয়েছে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির গুলিতে। গত বছরই বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে একজন এবং টেকনাফের নাফ নদে দু’জনকে হত্যা করেছে বিজিপি। অথচ আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিজিপিসহ মিয়ানমার জান্তা বাহিনীর কয়েকশ সদস্য বেআইনিভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও ঢাকা তাদের সসম্মানে ফেরত পাঠায়।

এটাও অনস্বীকার্য, মিয়ানমারের প্রতি আমরা যতই সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করি না কেন, মিয়ানমার খুব কমই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে। দেশটি মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশের আকাশসীমার পাশাপাশি স্থল ও সামুদ্রিক সীমাও লঙ্ঘন করছে। মিয়ানমারের গোঁয়াতুর্মিতে সমুদ্রসীমার দাবি নিয়ে ঢাকাকে আন্তর্জাতিক আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে এই যে অস্বস্তিকর সম্পর্ক, সে জন্যও কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগের পাশাপাশি সীমান্তে আটঘাট বাঁধা জরুরি। 

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষা রাখাইন রাজ্যে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠার কারণেও অরক্ষিত সীমান্তের সুরক্ষার প্রশ্নটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কেননা, রোহিঙ্গা প্রশ্নে সামরিক জান্তা ও আরাকান আর্মির অবস্থানে এখন পর্যন্ত ধর্তব্য পার্থক্য দেখা যাচ্ছে না। ফলে সামনে হয়তো আরও রোহিঙ্গার ঢল সামলাতে হতে পারে ঢাকাকে।

স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত অরক্ষিত রেখে কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়া, বান্দরবান অঞ্চল নিরাপদ রাখা যাবে না। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশেরই উচিত ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তকে কাঁটাতারের বেড়ার আওতায় আনা। যে ঢাকা এক সময় সীমান্ত বেড়া নির্মাণে নেপিদোর কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছিল, এখন তাকেই মাদক, অস্ত্র চোরাচালান ও অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এবং আন্তঃসীমান্ত নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার প্রশ্নে দ্রুততম সময়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ শুরু করতে হবে।

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ হয়তো আরও আগেই দরকার ছিল। তাহলে হয়তো রোহিঙ্গা, অস্ত্র ও মাদকের ঢল এতটা বড় হয়ে উঠত না। তবে সময় ফুরিয়ে যায়নি। বেটার লেট দ্যান নেভার।

হাসান জাকির: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
prantojakir@gmail.

com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব ন দরব ন আর ক ন

এছাড়াও পড়ুন:

আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটতেই থাকবে?

সমকালসহ গতকালের সংবাদপত্রে প্রকাশিত দুটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এক. মাসখানেক আগে ধর্ষণের শিকার এক তরুণী আত্মহত্যা করেছে। তার পিতা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একজন শহীদ। পটুয়াখালীর দুমকীতে পিতার কবর জিয়ারত করে ফেরার পথে সে আক্রান্ত হয়। এতে গ্রেপ্তার হয় অভিযুক্ত দু’জন। এর মধ্যে তারা জামিনও পায়। তারপর ঢাকায় আত্মহত্যা করে তরুণী। পরিবার বলছে, আসামিরা জামিন পেয়ে যাওয়ায় মর্মাহত হয়ে সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। দুই. টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে একটি পাঠাগারের বইপত্র লুট করে ইউএনওর কাছে জমা দিয়েছে ‘তৌহিদি জনতা’। পাঠাগারে ধর্মবিরোধী বই রাখার অভিযোগে ওই ঘটনা তারা ঘটায়। মামলা হয়েছে। এদিকে ইউএনও বলেছেন, দু’পক্ষের সঙ্গে বসে বিষয়টির নিষ্পত্তি করা হবে। 

প্রথম ঘটনাকে সামাজিক অপরাধ বলে বিবেচনা করাই সংগত। অনেকে হয়তো বলবেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদের কন্যা ধর্ষিত হওয়ার ঘটনায় রাজনৈতিক উপাদান আছে। তেমনটি হলে মনে হয় না বর্তমান শাসনামলে আসামিরা সহজে জামিন পেত। তবে এ ধরনের মামলায় জামিন লাভ কতখানি গ্রহণযোগ্য– সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তারা ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছিল বলেই জানা যায়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর যেসব ক্ষেত্রে তেমন পরিবর্তন আসেনি, তার মধ্যে রয়েছে বিচার বিভাগ। তদন্তকারী পুলিশের বিষয়েও অভিযোগ কমেনি। যা হোক, আসামি জামিন পাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে ধর্ষিতার আত্মহত্যার ঘটনা মানুষকে ব্যথিত করবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদের কন্যাও ন্যায়বিচার না পাওয়ার ঘটনাটি হবে বিশেষভাবে আলোচিত। 

দ্বিতীয় ঘটনা ‘মব ট্রায়াল’ বলেই বিবেচিত হবে। হালে এগুলোকে ‘মব ভায়োলেন্স’ বলা হচ্ছে। এসব অনেক বেশি ঘটছে গণঅভ্যুত্থানের পর। এর শিকার কেবল ক্ষমতাচ্যুতরা নয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও আক্রান্ত। জনপ্রশাসনও বাদ যায়নি। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপরেও কিছু হামলা হয়েছে। একই ধর্মাবলম্বীর মধ্যে ভিন্নধারার প্রতিষ্ঠানও হয়েছে আক্রান্ত। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তির সংকট কম উপস্থিত হয়নি। তা সত্ত্বেও সরকারকে কড়া ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে কমই। এর ধারাবাহিকতায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িসহ অনেক স্থাপনায় এক দল লোক বুলডোজার চালানোর মতো কাজও করেছে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল– এসব আর ঘটতে দেওয়া হবে না। কিন্তু মব ভায়োলেন্স যে বন্ধ হয়নি– ধনবাড়ীর ঘটনাই তার প্রমাণ। ওই পাঠাগার থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের বইও বস্তায় ভরে নেওয়া হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। সালিশে এমন ঘটনার কী নিষ্পত্তি করা যাবে, কে জানে! কিছু লোকের একটা কিছু মনে হবে আর তারা দলবদ্ধ হয়ে যা খুশি করবে– এই বাংলাদেশ তো কেউ চায়নি। মব দ্বারা শতাধিক মাজার আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় বোঝা যায়, এদের হাতে স্বধর্মের ভিন্নধারাও নিরাপদ নয়। বিচারের দাবি উঠলেও এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি নেই। তৌহিদি জনতার নামে পাঠাগারে নৈরাজ্য চালানোর বিচারও কি হবে না? বিচার না হলে এমন ঘটনা আরও বড় পরিসরে ঘটার শঙ্কা অমূলক নয়। যেসব বইপত্র তারা বস্তায় ভরে নিয়ে গেছে, সেগুলো দেশের অন্যান্য পাঠাগার আর বইয়ের দোকানেও আছে নিশ্চয়। 

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর সমকালে দীর্ঘ প্রতিবেদন ও বিশেষজ্ঞ মন্তব্য ছাপা হয়েছে গত শনিবার। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে হওয়া মামলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়– খুন, অপহরণ, ডাকাতি, ছিনতাইসহ ছয় ধরনের অপরাধ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে। এর মধ্যে নারী-শিশু নির্যাতন আছে বৈ কি। আছে আসামি ছিনতাই, থানায় হামলার ঘটনা। খোদ শাহবাগ থানায় এক নারী উত্ত্যক্তকারীকে ছাড়িয়ে নিতে এক দল লোক কী করেছিল, তা সবার জানা। ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ চলাকালেও এসব ঘটে চলেছে। এ পরিস্থিতিতে এক দিন মধ্যরাতে সংবাদ সম্মেলন করতে দেখা গেল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কিছুদিন পরই মহলবিশেষের দাবির মুখে এ পদে পরিবর্তন এনে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও তিনি কতখানি সাফল্য দেখাতে পেরেছেন, তা পৃথকভাবে বলার কিছু নেই। চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিই সেটা বলছে। 

গেল বছরের প্রথম তিন মাসের সঙ্গে চলতি বছরের সরাসরি তুলনা অবশ্য যুক্তিযুক্ত নয়। এর মধ্যে নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বাহিনীও ভেঙে পড়ে। এর কারণ সবার জানা। পুলিশকে সক্রিয় করতে এখনও লড়তে হচ্ছে সরকারকে। মাঠে বিশেষ ক্ষমতাসহ থাকতে হচ্ছে সেনাবাহিনীকে। তাদের ওপর আস্থা আছে জনসাধারণের। তবে পুলিশের কাজে তাদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সেনাবাহিনী অপেক্ষা করছে– কবে পুলিশ পূর্বাবস্থায় ফিরবে। কিন্তু সরকারের ৯ মাস হতে চলার সময়ও পুলিশকে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। তাদের কাছে এসে অভিযোগ দাখিলে লোকে উৎসাহী হলেও এর নিষ্পত্তির চিত্র উৎসাহব্যঞ্জক নয়। সেনাবাহিনীকেও অভিযুক্তদের থানায় এনে সোপর্দ করতে হচ্ছে। এর পর থানা ও আদালতপাড়ায় যা ঘটছে, তার চিত্র কি উৎসাহব্যঞ্জক? 
গণঅভ্যুত্থানের পর কোথায় কোথায় আইনশৃঙ্খলার কতটা অবনতি ঘটেছিল, সে উদাহরণ টেনে অনেকে বাংলাদেশ পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন। এটা অযৌক্তিক নয়। অনেকে এমনও বলেন, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে গোটা পুলিশ বাহিনী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার ঘটনা বিরল। তবে আট-নয় মাস পরও অন্তর্বর্তী সরকার কেন পরিস্থিতিতে লক্ষণীয় উন্নতি ঘটাতে পারছে না, তার পক্ষে যুক্তি দেওয়া কঠিন। মাঝে রমজানে পণ্যবাজারের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকার এক ধরনের সাফল্য কিন্তু দেখিয়েছিল। ঈদের পর সেটা ধরে রাখা গেল না কেন? 

সামাজিক অপরাধের পাশাপাশি রাজনৈতিক অপরাধ যেন আরও বেশি করে ঘটছে। গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থের চেষ্টা বাড়তে পারে। এসব দেখা যেত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদলের সময়ও। এবার স্বভাবতই তা সীমা ছাড়িয়েছে। সঙ্গে নতুন উপাদান হিসেবে চলছে মব ভায়োলেন্স। মবের ভয়ে মিডিয়াও কাজ যথাযথ  করতে পারছে না বলে অনেকের অভিমত। সরকার ঘোষণা দিলেও তা দমনে এখন পর্যন্ত ব্যর্থ। আর রাউজানের মতো কোনো কোনো অঞ্চলে খুনখারাবি মানুষকে রীতিমতো আতঙ্কিত করে তুলছে। 

রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর হানাহানি চলছে আর্থিক অপরাধের ক্ষেত্র দখলকে কেন্দ্র করেও। দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকলে যে কোনো সরকারকেই দমাতে হয় এসব অপরাধ। বিশেষ কোনো পক্ষ অতিউৎসাহী হয়ে মব ভায়োলেন্স চালালে সেটাও দমন করতে হবে। নতুন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে বিশেষ নীতিকৌশল জরুরি হলে সে পদক্ষেপও সরকারকে নিতে হবে। সমধর্মী পট পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাও নেওয়া যায়। সেগুলো কেবল বর্ণনা করা হলে অনেকেরই মনে হবে, সরকার হয়তো পরিস্থিতির উন্নয়নে অনিচ্ছুক! 

এমন ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ও রয়েছে– অন্তর্বর্তী সরকার এসব হতে দিচ্ছে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার অজুহাত তৈরি করতে। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা তো স্পষ্টভাবেই জানিয়েছেন, আগামী বছরের জুনের মধ্যে হবে জাতীয় নির্বাচন। তার অনুকূল পরিবেশ তৈরিতেও আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটাতে তৎপর হতে হবে সরকারকে। এদিকে বিনিয়োগ বাড়াতে কম সচেষ্ট নয় সরকার। সে লক্ষ্য অর্জনেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে আনতে হবে। বর্ণাঢ্য বিনিয়োগ সম্মেলন চলাকালেও কিন্তু মব ভায়োলেন্সের শিকার হয়েছিল কয়েকটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের দেশীয় প্রতিষ্ঠান!

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ডিবির অভিযানে আ.লীগের সাবেক এমপিসহ গ্রেপ্তার ৭
  • পুলিশ সপ্তাহ শুরু মঙ্গলবার, নির্বাচনী নির্দেশনা পাবে আইনশৃঙ্খলা ব
  • সাবেক আইজিপিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় আবার বাড়ল
  • আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটতেই থাকবে?