১৯৯৬ সালে আমি বাংলাদেশের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর অর্থনৈতিক কৌশল নিয়ে আলোচনা করার জন্য ঢাকা সফর করি। এটি কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না। তাঁর বিপরীতে তাঁর ছোট বোনের মেয়ে লেবার পার্টির দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক বরং আকর্ষণীয়।

খালার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের জেরে তিনি শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করেছেন। শেখ হাসিনার প্রতি ন্যায্যতা দেখাতে বলতে হয়, তাঁর অস্বাভাবিক আচরণের পেছনে অজুহাত ছিল। তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল ফোকাসে ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা এবং দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতি তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ড।

ক্যারিশম্যাটিক বিপ্লবী নেতা শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দমনমূলক ও সমাজতান্ত্রিক শাসক হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি দল তাঁর বাসভবনে হামলা চালায় এবং তাঁকে সপরিবারে ১৭ সদস্যসহ গুলি করে হত্যা করে। সে সময় ২৭ বছর বয়সী শেখ হাসিনা ইউরোপ সফরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। ১৯৮১ সালে তিনি দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের লাগাম ধরেন। 

শেখ হাসিনার প্রথম কার্যকাল পাঁচ বছর স্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ পরপর চারটি নির্বাচনী বিজয়ের পর গত আগস্টে টানা ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। তবে এসব নির্বাচনী ফলাফলের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। রাস্তাজুড়ে গণবিক্ষোভের মুখে তাঁকে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে চলে যেতে হয়েছে। ওই আন্দোলনে প্রায় ২ হাজার মৃত্যু এবং ২০ হাজার লোক আহত হয়েছিল। তিনি দেশত্যাগ করে ভারতে যান।

দুর্নীতি দমন, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং মানবাধিকার সমুন্নত করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থেকে শেখ হাসিনা সরে এসেছিলেন। একজন বাংলাদেশি সাংবাদিক বলেছেন, তিনি বিভ্রান্তিকর বুদ্বুদে বাস করতেন।

ড.

মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কারজয়ী বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ, যিনি ‘ক্ষুদ্রঋণ’ ধারণাকে জনপ্রিয় করেছিলেন। দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি এবং উচ্ছ্বাসের সঙ্গে পুনর্গঠন কাজ শুরু করেছেন। শেখ হাসিনা এখন হত্যা মামলা, দুর্নীতিসহ শতাধিক অভিযোগের মুখোমুখি। তাঁর নিকটতম আস্থাভাজন অনেকে আটক হয়েছেন। যেসব বাংলাদেশি ব্যবসায়ী বিদেশি হোল্ডিং কোম্পানির মাধ্যমে লন্ডনে বিশাল সম্পত্তির সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন, তাদেরও কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন। টিউলিপ সিদ্দিকসহ শেখ হাসিনার পুরো পরিবার এখন ফৌজদারি তদন্তাধীন। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি করপোরেশন রোসাটমের সঙ্গে জড়িত ঘুষ কেলেঙ্কারিতে টিউলিপের অভিযুক্ততা নিয়ে তদন্ত চলছে। শেখ হাসিনার সহযোগীদের কাছ থেকে টিউলিপ লন্ডনে যেসব সম্পত্তি নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে, মুহাম্মদ ইউনূস সেগুলো ফেরত পাওয়ারও দাবি তুলেছেন। 

ইস্যুটি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমারের জন্য দারুণ কোনো মুহূর্ত ছিল না। যদিও মন্ত্রীর মানদণ্ড-সংক্রান্ত স্বাধীন উপদেষ্টা দেখতে পেয়েছেন, টিউলিপ সিদ্দিক মন্ত্রিত্বের শর্ত ভঙ্গ করেননি। তাঁর মতে, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থেকে উদ্ভূত সম্ভাব্য সুনামগত ঝুঁকির ব্যাপারে তাঁর ও সরকার উভয়ের আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।’

এটা স্পষ্ট, টিউলিপ সিদ্দিকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অবসান ঘটেছে। কিন্তু লেবার পার্টি ও কিয়ার স্টারমার তাঁকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন। এমনকি এখন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, টিউলিপ যদি আবার সরকারে যোগ দিতে চান তাহলে ভবিষ্যতে তাঁর জন্য ‘দরজা খোলা থাকবে’। টিউলিপ ধারাবাহিকভাবে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। খালার বিরুদ্ধে আনা কারসাজিতে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ থেকে টিউলিপ মুক্তি পেতে পারেন। কিন্তু তিনি কি প্রতারণাপূর্ণ নির্বাচন, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির বিষয়ে শেখ হাসিনার খ্যাতির ব্যাপারে জানতেন না? তিনি কি খালার সহযোগীদের সম্পত্তি নিজের কাছে তুলে দেওয়ার কারণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি?

এ ছাড়া টিউলিপ ও লেবার পার্টির কীভাবে অজানা থাকতে পারে যে, ২০২৩ সালের নভেম্বরে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ বিশ্বের ১৭০ জনেরও বেশি বিশ্বব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে ‘নিরবচ্ছিন্ন বিচারিক হয়রানি’ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখেছিলেন? কেবল বিশ্বাসপ্রবণ কেউ এটা ভাবতে পারে, টিউলিপ ও লেবার পার্টি শেখ হাসিনার দুর্নীতির ব্যাপারে জানত না। মুহাম্মদ ইউনূস টিউলিপকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘হয়তো আপনি হাসিনার দুর্নীতির ব্যাপারে বুঝতে পারেননি; কিন্তু এখন তা পেরেছেন। আপনার বলা উচিত– দুঃখিত, আমি এটা তখন জানতাম না। আমি এর জন্য লোকদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আমি এটা করেছি, আর সে কারণে পদত্যাগ করছি।’ টিউলিপ সিদ্দিক হয়তো ক্ষমা চাননি; তবে তিনি পদত্যাগ করে অন্তত বিলম্বে হলেও সঠিক কাজটি করেছেন। 

ফ্রান্সিস পাইক: ইতিহাসবিদ; দ্য স্পেকটেটর থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন য কর ছ ন র র জন

এছাড়াও পড়ুন:

ইউক্রেনে জেলেনস্কির বিকল্প নেতা খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র!

ইউক্রেনে শান্তিচুক্তির জন্য দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির পদত্যাগ করা লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালৎস। তিনি বলেছেন, ‘ইউক্রেনের একজন নেতা প্রয়োজন, তিনি আমাদের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন। তিনি শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করতে পারবেন এবং এই যুদ্ধ থামাতে পারবেন।’ খবর- সিএনএন

গণমাধ্যমের সামনেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির নজিরবিহীন বাগবিতণ্ডার পর এ কথা বললেন তিনি। বাগবিতণ্ডার এ ঘটনাটি নিয়ে নানা আলোচনা চলছে বিশ্বজুড়ে। ওই ঘটনার পর ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে ঐতিহাসিক চুক্তি হওয়ার কথা ছিল, সেটিও বাতিল হয়ে যায়। আর এর পরই ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কোন পথে, তা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা।

এই প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। শুক্রবারের ওই ঘটনায় সাবেক ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গড়া ওয়াশিংটন-কিয়েভ সম্পর্ক ভেঙে পড়েছে। এই প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। 

যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে আবারও এক টেবিলে বসার ইঙ্গিত দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন ও রাশিয়া-দুই পক্ষই আলোচনায় না বসলে যুদ্ধ থামবে না। হোয়াইট হাউসে শুক্রবার ট্রাম্প-জেলেনস্কি বিতণ্ডার পর থেকে ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আর কথা হয়নি। যুদ্ধ থামানোর জন্য রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে আনতে হবে। তবে তাদের প্রতি বৈরী মনোভাব রাখলে, মস্কোকে আলোচনায় যুক্ত করা সম্ভব হবে না। কোনো চুক্তি করার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই মনোভাবই দেখিয়ে আসছেন।

তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, সবকিছু আবার শুরু হতে পারে। আশা করি, তিনি (জেলেনস্কি) এটা বুঝতে পারবেন যে আমরা আসলে আরও হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর আগে, তাঁর দেশকে সাহায্যের চেষ্টা করছি।’
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ