কলোনিয়াল ন্যারেটিভ আর অধিপতি মতাদর্শকে চুরমার করে দাঁড়ানো জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকে জনমনে আড়াল করে দাবিয়ে রাখা শত সহস্র অমীমাংসিত জিজ্ঞাসা ও আকাঙ্ক্ষা জনআওয়াজ হিসেবে সামনে এসেছে গ্রাফিতির ভেতর দিয়ে। জনগণের এই আকাঙ্ক্ষা ও আওয়াজ গায়েব করার এখতিয়ার কারও নেই। কিন্তু অভ্যুত্থানের রক্তস্মৃতি অস্বীকার করে এসব জনআকাঙ্ক্ষা মুছে ফেলতে নানা কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। গ্রাফিতি বদলে ফেলা বা তা নিয়ে আপত্তি উত্থাপন অন্যায় ও অমূলক। গণঅভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট থেকে বিচ্ছিন্ন। দেশে যখন সংস্কার ও জনআকাঙ্ক্ষা পাঠের তৎপরতা চলছে, তখন পাঠ্যবইয়ের মলাটে গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি ব্যবহার নিয়ে আপত্তি সংঘর্ষমূলকই শুধু নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিরও বিরোধী।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) মাধ্যমিক স্তরের নবম-দশম শ্রেণির বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি বইয়ের মলাটের পেছনে  গণঅভ্যুত্থানের একটি গ্রাফিতি ব্যবহার করেছিল। ঐ গ্রাফিতিতে পাঁচটি সতেজ পাতাসহ গাছের ছবি আছে। একেকটি পাতা একেকটি সামাজিক-ধর্মীয়-জাতিগত পরিচয় বহন করছে: মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, হিন্দু ও আদিবাসী। নিচে লেখা আছে– ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’। গণঅভ্যুত্থানের মূল আওয়াজ ‘ইনক্লুশন’ এতে স্পষ্ট। 

পাঠ্যপুস্তকে এই গ্রাফিতি ব্যবহারের কারণে এনসিটিবি যেখানে ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার, সেখানে গণঅভ্যুত্থানের পাঁচ মাস পর এটা নিয়ে আপত্তি তোলে কিছু মানুষ। এনসিটিবিও গ্রাফিতিটি বদলে ফেলেছে! বদলাতে গিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা নিয়ে তৈরি আরেক গ্রাফিতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে। এটি গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি অসম্মান। গণঅভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষা বদলে ফেলার এই পাঁয়তারা কোন কর্তৃত্ববাদকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়? জনআকাঙ্ক্ষার আওয়াজকে রাষ্ট্র কি এভাবে বদলে দিতে পারে? 

বাইনারি-বিভাজন নয়

যারা আপত্তি তুলেছেন, তারা ভিত্তিহীন বহু বক্তব্য সামনে আনছেন। প্রথমত, এনসিটিবির উল্লিখিত বইতে কোথাও ‘আদিবাসী’ প্রত্যয় ব্যবহার করা হয়নি। ব্যবহার করা হয়েছে গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতির আলোকচিত্র। ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ গড়তে কর্তৃত্ববাদী সংবিধান বদলের আওয়াজও তুলেছে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান। অথচ আপত্তিকারীরা গ্রাফিতিটির বিরোধিতা করতে গিয়ে আগের সংবিধানকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সেখানেও তারা মন গড়া তথ্যকে সংবিধান প্রদত্ত বলে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। সংবিধানে নাকি আছে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’, তাই ‘আদিবাসী’ শব্দটি অসাংবিধানিক। অথচ সংবিধানের কোথাও ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ শব্দ নেই; আছে ‘নৃগোষ্ঠী’। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ২৩.

ক ধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’

গণঅভ্যুত্থানের বদলে ফেলা গ্রাফিতি পুনর্বহালের দাবিতে আদিবাসী তরুণদের সমাবেশে হামলা হয়েছে এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাসহ অনেকে গুরুতর আহত হয়েছেন। হামলাকারী পক্ষ গ্রাফিতি বাতিলের আন্দোলনকারীরাও আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। এনসিটিবি কি এই রক্তপাত ও সংঘাতের দায় এড়াতে পারে? দ্রুত এই ঘটনার তদন্ত, ন্যায়বিচার ও আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব নিক রাষ্ট্র। 

আদিবাসী ও আদিবাসিন্দা

‘আদিবাসী’ ও ‘আদিবাসিন্দা’ শব্দ দুটি উচ্চারণের কারণে বহুজনের কাছে সমার্থক মনে হলেও এগুলো সম্পূর্ণ পৃথক অর্থ বহন করে। বাঙালি জাতি অবশ্যই বাংলা ভূখণ্ডের আদিবাসিন্দা। বহু আদিবাসী জাতিও এই ভূখণ্ডের বহু অঞ্চলের আদিবাসিন্দা। কিন্তু বাঙালিরা আদিবাসী নন। ঠিক যেমনভাবে বহু আদিবাসী বহু অঞ্চলের আদিবাসিন্দা নন। প্রান্তিক জাতিসত্তাগুলো নিজেদের একক সামাজিক বর্গ পরিচয় হিসেবে এই প্রত্যয়টি বহু আগে থেকেই ব্যবহার করছে। সেটা বাঙালিসহ সবার কাছে বহুকাল থেকেই সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য। ১৯৪৪ সালে নওঁগার বদলগাছীতে পাহাড়পুর বা সোমপুর বৌদ্ধবিহারের কাছে স্থাপিত হয় ‘পাহাড়পুর আদিবাসী উচ্চ বিদ্যালয়’। এর পর দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। কেউ বিদ্যালয়ের নাম থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দটি মুছে দেয়নি। দেশব্যাপী ‘আদিবাসী’ নাম নিয়ে এমন অনেক শিক্ষালয় জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে মজবুত করে চলেছে। দিনাজপুরের বোচাগঞ্জের মহেশপুর আদিবাসী উচ্চ বিদ্যালয়, শেরপুরের শ্রীবরদীর বাবেলাকোনা আদিবাসী উচ্চ বিদ্যালয়, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের খৈচালা আদিবাসী রেজি. প্রাথমিক বিদ্যালয়, দিনাজপুরের কাহারোলের সাধনা আদিবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বটতুলী আদিবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নওগাঁর ধামইরহাটের সোনাদিঘী আদিবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

নামকরণের এই ধারা সমাজ-শ্রেণি কি বর্গে বহুত্ববাদ ও অন্তর্ভুক্তির মৌলিক সাংস্কৃতিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। ১৯৬২ সালে মধুপুর জাতীয় উদ্যান ঘোষণার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ যে প্রচারপত্র বিলি করে, তা শুরু হয়েছিল ‘আদিবাসী জনগণ’ পরিচয় দিয়ে। ১৯৭২ সালে গণপরিষদে দাঁড়িয়ে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাও বলেছিলেন, ...আমরা বাঙালি নই, আমরা অনেকে চাকমা, মারমা। সংবিধানে সকল জাতিসত্তার পরিচয় নাই। সংবিধানে ‘আদিবাসী’ শব্দটি না থাকলেও দেশের অন্য আইন ও নীতিতে এই শব্দটি গৃহীত হয়েছে। 

‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০’ অনুযায়ী ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলতে উক্ত আইনের তপশিলে উল্লিখিত বিভিন্ন আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও শ্রেণির জনগণকে বোঝানো হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতির (২০১০) অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ‘দেশের আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংস্কৃতি ও ভাষার বিকাশ ঘটানো’। 

কে কোথায় কোথা থেকে আগে বা পরে এসেছে এবং এর মাধ্যমে মানুষের ইতিহাস কিংবা বিকাশমানতাকে রুদ্ধ করার প্রক্রিয়াও প্রবলভাবে ঔপনিবেশিক ও কর্তৃত্ববাদী। ঢাকার মণিপুরিপাড়া, মগবাজার, কুর্মিটোলা কিংবা তেজতুরীপাড়া কি আজ আর আদিবাসী মানুষের আছে? আদিবাসী পরিচয়ের খুব ঘনিষ্ঠ ইনডিজেনাস পিপলস এবং এর সর্বজনীন সংজ্ঞায়ন হয় না। জাতিরাষ্ট্র গঠনের আগে থেকে যেসব সমাজ প্রথাগত আইনে পরিচালিত হয় এবং নিজস্ব ভাষা, দর্শন, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি আত্মপরিচয়ের মাধ্যম হিসেবে মানে, তারাই ‘আদিবাসী’ প্রত্যয়টি ব্যবহার করে। আত্মপরিচয়ের এই মর্যাদা রাষ্ট্র থেকে জাতিসংঘ– সর্বত্র স্বীকৃত। 

রাষ্ট্রের কর্তব্য

আদিবাসী প্রত্যয়ের বিরোধিতা করতে গিয়ে আপত্তিকারীরা কোথা থেকে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ শব্দটি হাজির করলেন, নিশ্চিতভাবে তা অনৈতিহাসিক নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কলোনিয়াল লিগ্যাসি এবং অধিপতি জাত্যাভিমান ও নিওলিবারেল কর্তৃত্ববাদ। সংবিধানে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ শব্দটি না থাকলেও এই পরিচয়টি রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো বিগত কর্তৃত্ববাদী রেজিমে বহুলভাবে ব্যবহার করেছিল। আর দেশের বাঙালি ও আদিবাসী জনমনে এক ধরনের বাইনারি-বিভাজন টিকিয়ে রেখেছিল। এই নামে একটি আইনও তৈরি হয়েছিল। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান এসব বাইনারি-বিভাজনকেই প্রশ্ন করেছে।

কোনো মানুষ কোনো বিষয়ে তার মতামত কিংবা আপত্তি অবশ্যই উত্থাপন করতে পারে। রাষ্ট্র সবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করবে। কিন্তু মতপ্রকাশের নামে গণঅভ্যুত্থানের উল্লিখিত গ্রাফিতির বিরুদ্ধে অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন আপত্তি তোলা হচ্ছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ‘আদিবাসী তর্কের’ বাইনারি-বিতর্ক উস্কে দেওয়া হচ্ছে। জবরদস্তিমূলক আদিবাসী-বাঙালি পাতানো বিরোধ তৈরির এমন কূট-প্রবণতা অতীতেও বহু হয়েছে। দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়েছে, প্রাণ গিয়েছে, বাস্তুতন্ত্র বিনষ্ট হয়েছে। খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিতে হামলা থেকে নাহার চা বাগানে নিতাই তাঁতি কিংবা জুড়িতে অবিনাশ মুড়ার প্রাণহানির ঘটনা বিশ্লেষণ করলে আদিবাসী-বাঙালির মধ্যে বাইরে থেকে পাতানো বিরোধকে বোঝা যায়। গণঅভ্যুত্থান এসব পাতানো বিরোধ ও বাইনারি ন্যারেটিভের বিপরীতে অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের আওয়াজ উঠিয়েছে। আমরা আশা করব, পাঠ্যপুস্তকে গণঅভ্যুত্থানের সেই গ্রাফিতি ফিরিয়ে আনা হবে। জনআকাঙ্ক্ষার রাষ্ট্র সকল পাতার মর্যাদা ও আত্মপরিচয় সুরক্ষায় সক্রিয় হবে।

গণঅভ্যুত্থানের গণআকাঙ্ক্ষা মুক্তি পাক

বাংলাদেশে আদিবাসী জনসংখ্যা এবং মোট জাতিসংখ্যা নিয়ে তর্ক আছে। সর্বশেষ ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’ অনুযায়ী দেশে আদিবাসী জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৬ লাখ ৫০ হাজার ১৫৯ এবং জাতিগোষ্ঠী ৫০টি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট পরিচালিত ২০১৮ সালের ভাষাগত জরিপের তথ্য অনুযায়ী দেশে আদিবাসীদে মাতৃভাষা ৪০টি। আদিবাসী জীবন- জনপদ বিভিন্নভাবে বিমর্ষ, প্রান্তিক ও অধিকারহীন। পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সমাজের জাত্যাভিমানী ও কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা আদিবাসী পরিসরকে আরও সংকুচিত ও রক্তাক্ত করে তোলে। গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতির মধ্য দিয়ে সমাজের সর্বস্তরের সর্বজনের মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা উচ্চারিত হয়েছে, গায়ের জোরে তা বদলে ফেলা কর্তৃত্ববাদকেই পুনঃস্থাপনের প্রবণতাকে উস্কে দেয়। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ গড়ার জনআকাঙ্ক্ষার মুক্তি ঘটুক!

পাভেল পার্থ: লেখক ও গবেষক
animistbangla@gmail.com 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন র গ র ফ ত এনস ট ব প রবণত ত হয় ছ আওয় জ

এছাড়াও পড়ুন:

বৈষম্যবিরোধীদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান অগ্রহণযোগ্য

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যে গণঅভ্যুত্থান হয়, তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতার ফসল, সন্দেহ নেই। আন্দোলনটি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহের আগে নেহাতই সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা অবসানের দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল, যদিও ১৪ জুলাই দেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বক্তব্যটি আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে কয়েকজন সমন্বয়ককে ডিবি হারুনের অফিসে ধরে নিয়ে গিয়ে ‘মিডিয়া-ডিনার’ খাওয়ানোর দৃশ্য এবং সমন্বয়কদের একজনকে দিয়ে লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় আন্দোলন সমাপ্ত করার ঘোষণা দিতে বাধ্য করা জনগণের ক্রোধকে দ্রুত ঘনীভূত করে। অন্যদিকে আন্দোলন মোকাবিলার জন্য পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মাস্তান বাহিনীকে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের, যার ফলে সারাদেশে এক দিনেই শতাধিক আন্দোলনকারীর প্রাণহানি ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে কারফিউ জারি করে তা বলবৎ করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু কারফিউ প্রায় ১০ দিন চলার পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ৩ আগস্ট দুপুরে সামরিক বাহিনীর ঢাকায় অবস্থিত সব অফিসারের সভা (দরবার) ডাকেন। সভায় প্রধানত জুনিয়র অফিসাররা মতামত ঘোষণা করেন– সেনাবাহিনী জনগণের বিপক্ষে গুলি চালাবে না। সেনাপ্রধান তাদের মত মেনে নেন। সেনাবাহিনীর এই সিদ্ধান্ত জানাজানি হওয়ার পর ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিশাল সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা সরকারের পদত্যাগ চেয়ে এক দফা দাবি ঘোষণা করেন। তাদের ঘোষিত ৬ আগস্টের ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিকে এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে ৪ আগস্ট আবারও ছাত্রলীগ-যুবলীগ-পুলিশের যৌথ বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন শেখ হাসিনা। ওই দিনও শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। ওই দিন দেশের প্রায় ৪০০ থানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়। উপরন্তু, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় আক্রমণ চালিয়ে ১৩ জন ও নরসিংদীতে ৬ জন পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সাহস হারিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে থানা থেকে পালিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ বুঝে যায়, শেখ হাসিনার পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। 

এ প্রেক্ষাপট তুলে ধরার কারণ এটা বলা, গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মানুষের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, শেখ হাসিনাকে উৎখাত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে কারা রয়েছে– সেটা তাদের কাছে বিবেচ্য ছিল না। শেখ হাসিনার স্থানে কে ক্ষমতায় আসবে– সেটাও তাদের ভাবনায় ছিল না। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের সাড়ে পাঁচ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর জনগণের সিংহভাগ বুঝতে পারছে– বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রভাবশালী সমন্বয়কদের বড় অংশ একটি বিশেষ মতের। আন্দোলনের সময় তারা তাদের পরিচয় সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাদের অনেকেই ছদ্মবেশে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক পরিচয় পর্যন্ত ধারণ করেছিলেন। এখন শীর্ষ সমন্বয়করাই বলে বেড়াচ্ছেন, আন্দোলনের ভ্যানগার্ড ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির, যদিও লাখ লাখ জনতার মিছিল সংঘটিত করার পেছনে ছাত্রশিবিরের কোনো দলীয় তৎপরতার চিহ্নই ছিল না। 

এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে– সরকারে অন্তর্ভুক্ত ছাত্রনেতারাসহ অন্যান্য নেতৃস্থানীয় সমন্বয়ক, যারা বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে ইতোমধ্যে জনপরিসরে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন; তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিবিরের লোক। এই ব্যাপারটি এখন জাতির সামনে একটি মহাবিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে। কারণ তারা জাতির প্রধান ঐতিহাসিক অর্জন ও আদর্শ ‘মুক্তিযুদ্ধ’কে মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর বলে মনে হচ্ছে। বিষয়টি সিংহভাগ সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৭১ সালে কারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তা কারও অজানা নয়। তারা গণহত্যাকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অক্সিলিয়ারি ফোর্স’ হিসেবে ‘আলবদর’ ও ‘আলশামস’ গঠন করেছিল। এই আলবদর ও আলশামস বাহিনীর ক্যাডাররা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ঘাতকদের সশস্ত্র সহায়তাকারী, গোয়েন্দা বাহিনী ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি নিজেরাও অত্যন্ত নৃশংস ঘাতকের ভূমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল রাও ফরমান আলীর নীলনকশা অনুসারে এই আলবদর বাহিনীর ক্যাডাররাই দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠেছিল। 

মুক্তিযুদ্ধ নিছক একটি গণঅভ্যুত্থান ছিল না। ছিল এক জনযুদ্ধ, যেখানে ধনী-গরিব-মধ্যবিত্ত সব অংশের প্রায় সব সদস্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিল। এ কথা সত্য, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে দুই বা আড়াই লাখ মানুষ। কিন্তু ভারতের মাটিতে গড়ে ওঠা শরণার্থী শিবিরের এক কোটিরও বেশি মানুষ বলতে গেলে সরাসরি এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। দেশের ভেতরে কত লাখ পরিবার যে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছে, তার কোনো হিসাব নেই। সর্বোপরি এ যুদ্ধের প্রস্তুতি চলেছে পাকিস্তানি শাসনের প্রায় ২৩ বছর ধরে। ফলে এর স্মৃতি, আবেগ ও চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলবে।
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি যদি মনে করে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী সমন্বয়কদের মদদ পেলেই তারা জনগণকে ধোঁকা দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা স্বীয় কবজায় রাখতে পারবে– তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদেরও বলতে চাই, তাদের এই বিশেষ মহলকে তোষণ এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্য ও অবস্থান দেশের সিংহভাগ জনগণ মোটেও পছন্দ করছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার কমিশনগুলো গঠন করেছে, সেগুলোর প্রতিবেদনে যদি মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার কিংবা খাটো করার কোনো প্রয়াস দৃশ্যমান হয়, তাহলে তাদেরও জনরোষ মোকাবিলা করতে হবে। সম্প্রতি ছাত্রদের ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বেশ হইচই হলো। বলা হচ্ছে, সব রাজনৈতিক দলের মত নিয়ে এই ঘোষণাপত্র সরকার দেবে। এই ঘোষণাপত্র আদৌ আলোর মুখ দেখবে কিনা, আমরা জানি না। তবে এতে যদি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন সংবিধানকে ‘ছুড়ে ফেলা’র মতো কোনো কোনো সমন্বয়কের দম্ভোক্তির প্রতিফলন ঘটে, তাহলে জনগণ এর উদ্যোক্তাদের শুধু রুখে দাঁড়াবে না, ছুড়েও ফেলতে পারে– আগেভাগেই এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করছি।

অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি                                                             

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ছাত্রলীগের ‘ভয়ংকররূপে’ ফেরার বার্তা কী বার্তা দেয়?
  • লাল, কালো, সাদার মন্ত্রে এবারের অমর একুশে বইমেলা
  • শেখ হাসিনার ফাঁসির দাবিতে চট্টগ্রামে অনশনে বৈষম্যবিরোধীরা
  • জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত সবুজের লাশ উত্তোলন 
  • গণমাধ্যম এখন নজিরবিহীন স্বাধীনতা ভোগ করছে: প্রধান উপদেষ্টা
  • গণমাধ্যম নজিরবিহীন স্বাধীনতা ভোগ করছে: প্রধান উপদেষ্টা
  • কোটি টাকা সহায়তা দাবি শহীদ পরিবারের
  • বৈষম্যবিরোধীদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান অগ্রহণযোগ্য
  • শাবিপ্রবিতে গণঅভ্যুত্থানের শহীদের স্মরণে দোয়া