বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। বর্তমান ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ করার প্রস্তাবও করেছে কমিশন।

আজ বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে সংস্কারের সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশন। বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানের নাম হিসেবে উল্লেখ আছে, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সংবিধানের প্রস্তাব হিসেবে বলা হয়েছে, ‘জনগণের সম্মতি নিয়ে আমরা এই সংবিধান জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করছি।’

এই কমিশনের সূপারিশে বলা হয়েছে- সংবিধানের প্রযোজ্য সব ক্ষেত্রে ‘প্রজাতন্ত্র’ এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দের পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ এবং ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দ ব্যবহৃত হবে। তবে ইংরেজি সংস্করণে ‘রিপাবলিক’ ও ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ শব্দগুলো থাকছে।

.

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

সংবিধান সংস্কার কমিশনের অপ্রয়োজনীয় প্রস্তাব

সংবিধান সংস্কার কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ওয়েবসাইটে তাদের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন এই কমিশন নভেম্বর মাসে দেশের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করে। আমাকেও ওই সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে আমি সংবিধান সংস্কারে আমার প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন করেছিলাম। পরে কমিশনের অনুরোধে প্রস্তাবগুলো লিখিতভাবে কমিশনে পেশ করেছিলাম। আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই, আমার প্রায় সবক’টি প্রস্তাব কমিশনের প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে। সেগুলো হলো:

১) সংবিধানের ৭০ ধারা সংশোধন; ২)    প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা; ৩) নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা; ৪) পাঁচ বছরের স্থলে চার বছর পরপর সংসদীয় নির্বাচন; ৫) পরপর দু’বারের বেশি কাউকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দেওয়া; ৬) বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা; ৭) দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু করা; ৮) সংসদের উচ্চকক্ষে ১০০টি আসনে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু করা; ৯) সংসদে ১০০ জন নারী সদস্যের সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু করা; ১০) কমিশনের সুপারিশগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য গণভোটের ব্যবস্থা চালু করা; এবং

১১) পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংশোধনীগুলো অনুসমর্থনের মাধ্যমে আইনগত বৈধতা প্রদান।
কমিশনের ‘ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল’ গঠনের প্রস্তাবটি অত্যন্ত ভালো। এই কাউন্সিলের মাধ্যমে সাংবিধানিক কমিশন, কমিটির চেয়ারপারসন ও সদস্য-সদস্যাদের নিয়োগ করা হলে এসব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর খামখেয়ালিপনা ও স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতির অবসান হবে; রাষ্ট্র পরিচালনায় বহুমাত্রিকতার সম্প্রসারণ ঘটবে। (এসব পদের জন্য তদবির সংস্কৃতিরও নিরসন ঘটবে)। একই সঙ্গে সংসদের দুটো কক্ষেই ডেপুটি স্পিকারের আসনে একজন বিরোধী সদস্য নির্বাচনের বাধ্যবাধকতার প্রস্তাবও অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোটদানকারী সংখ্যার সম্প্রসারণও ভালো প্রস্তাব। 
তবে কমিশন কতগুলো অপ্রয়োজনীয় ও আপত্তিকর সুপারিশও করেছে, যেগুলো উল্লেখ করা দরকার।

১) প্রথমত আমি সংবিধান পুনর্লিখনের পক্ষপাতী নই। কারণ ১৯৭২ সালের সংবিধান আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের শাহাদাত এবং দুই লাখ সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদের আত্মত্যাগ ধারণ করে রচিত। রাষ্ট্রের চার মূলনীতির মধ্যে তিনটিকে বদলে ফেলার যে সুপারিশ কমিশন করেছে, সেগুলো একেবারেই অপ্রয়োজনীয় ও আপত্তিকর।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ১০ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি তাজউদ্দীন আহমদ যে তিনটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা রচনা করে বেতারে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেগুলো ছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। চতুর্থ মূলনীতি বাঙালি জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছানুসারে, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি দেশে ফেরার পর। অতএব, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধান থেকে ছুড়ে ফেলার অধিকার আমরা কাউকেই দিতে পারব না। তার কোনো প্রয়োজনও নেই। ২) কমিশনের সুপারিশকৃত ‘বহুত্ববাদ’ নীতির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্নিহিত– বলা হলেও সাধারণ জনগণের পক্ষে তা উপলব্ধি করা প্রায় অসম্ভব। তাই আমি এই সুপারিশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছি। ৩) ঠিক একইভাবে আমি সংবিধান থেকে ‘সমাজতন্ত্র’কে বাদ দেওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান জানাতে চাই।

শ্রমজীবী জনগণের শোষণমুক্তি ও জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল ভিত্তি। কেউ কেউ বলতে পারেন, কমিশনের সুপারিশকৃত ‘সাম্য’ নীতির মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে সমাজতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। কিন্তু সংবিধানে সমাজতন্ত্র গুরুত্ব সহকারে মূলনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকলে জনগণের শোষণমুক্তি ও অর্থনৈতিক মুক্তিকে রাষ্ট্রের নীতিমালার মধ্যে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। ‘সাম্য’ কথাটি দিয়ে সমাজতন্ত্রকে সংবিধান থেকে মুছে ফেলার প্রয়াস আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সব ধরনের বৈষম্য থেকে মুক্তির সর্বাত্মক সংগ্রাম ধারণ করতে হলে সমাজতন্ত্রের কোনো ভালো বিকল্প ব্যবস্থা আজও আবিষ্কৃত হয়নি, যদিও সমাজতন্ত্রের কোনো ‘একক গ্রহণযোগ্য মডেল’ বিশ্বের কোনো দেশে সফলভাবে আজও চালু করা যায়নি।  

৪) ‘বহুত্ববাদ’ নীতির মধ্যে দেশের নানা জাতিগোষ্ঠীর সমমর্যাদার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত– মনে করা হয়। তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে যদি সংবিধানে ‘জাতিগত বহুত্ববাদ’ কথাটি অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয় তাহলে আমি আপত্তি করব না।

৫) কমিশন ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামের পরিবর্তে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামকরণের সুপারিশ করেছে। ভারতের নাম ইংরেজিতে ‘রিপাবলিক অব ইন্ডিয়া’ এবং বাংলায় ‘ভারতীয় প্রজাতন্ত্র’। ১৯৫০ সালে ভারতীয় সংবিধান চালু হওয়ার পর গত ৭৫ বছরে ব্যাপারটি নিয়ে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হয়নি। আমাদের কমিশন এই অপ্রয়োজনীয় নাম পরিবর্তন কেন প্রয়োজনীয় মনে করল– বুঝতে পারছি না। তবে ‘জনগণতন্ত্রী’ কথাটি আপত্তিকর নয়। যেটা আপত্তিকর সেটা হলো একটি রাষ্ট্র ‘জনগণতন্ত্রী’ হলে সেখানে সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে না থাকা। বিশ্বে যে ক’টি রাষ্ট্রের নাম জনগণতন্ত্রী, সেগুলোর সবক’টিতে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রের মূলনীতির স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

৬) কমিশন সংসদের নিম্নকক্ষে সদস্য সংখ্যা ৪০০-তে উন্নীত করার প্রস্তাব করেছে, যাদের মধ্যে ৩০০ জন বর্তমান পদ্ধতি অনুসারে এবং বাকি ১০০ জন নারী সদস্য সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। এই সুপারিশ জটিলতা সৃষ্টি করবে এই ১০০ জন নারী সদস্যের নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণের ক্ষেত্রে। আমার প্রস্তাবে আমি বর্তমান ৩০০টি নির্বাচনী এলাকার ১০০টিতে প্রতি নির্বাচনে শুধু নারী সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা রোটেশন পদ্ধতিতে চালু করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। (রোটেশন পদ্ধতিতে তিনটি নির্বাচনে দেশের সব এলাকায় নারী সদস্য নির্বাচিত হতেন)।
বর্তমান সংবিধানকে যেসব গোষ্ঠী ‘নালায় ছুড়ে ফেলতে’ উদগ্রীব, তারা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতাবিরোধী মহল, যারা সুকৌশলে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেছে। জনগণের ৫ শতাংশও তাদের সমর্থন করে না। সংবিধান সংস্কারের অপরিহার্যতা স্বীকার করতে কারও দ্বিমত নেই। কারণ, বর্তমান অবয়বে সংবিধান ‘নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠার দলিলে পরিণত হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় সুপারিশগুলো বাদ দিয়ে কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশমালা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনীর প্রস্তাবাবলি নির্ধারিত হতে পারে। সেগুলো গণভোটের মাধ্যমে সফলভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হবে। আগামী সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্য-সদস্যাদের দুই-তৃতীয়াংশের সম্মতির বিষয়টিও সফলভাবে নিষ্পন্ন করা যাবে।

অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ
 অর্থনীতি সমিতি
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সংবিধান সংস্কার কমিশনের অপ্রয়োজনীয় প্রস্তাব