একান্তই গরিব যারা, তারাই ধরে রেখেছেন এই পেশা। যারা সুযোগ পেয়েছেন, তারাই বদলে ফেলেছেন বাপ-দাদার পেশা। নতুন করে যারা এই জেলে পেশায় যুক্ত হচ্ছেন, তারাও নিতান্তই গরিব। বছরে কোটি টাকার মাছ শিকার করেও ভাগ্য বদলায় না এসব জেলেদের। দারিদ্রতার সাথে লড়াই করতে একই পরিবারের প্রজন্মের পর প্রজন্ম কাটিয়ে দিচ্ছেন জেলে পেশায়। তবে, কেন বদলায় না জেলেদের ভাগ্য?
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে কোল ঘেঁষা। এই উপজেলার চার ভাগের তিন ভাগ মানুষ জেলে পেশায় জড়িত ছিলেন। তবে, সময়ের সাথে সাথে অনেকেই পেশা বদল করেছেন। গোটা উপজেলার জেলেদের কেন এই দশা? এমন প্রশ্ন মনে জাগতেই পারে। এর কারণ হলো- মহাজনের দাদন! এই উপকূলের জেলেরা জানান, মহাজনের দাদনের শেকলে বন্দি তাদের জীবন।
৬২ বছর ধরে গভীর বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার করেন পাথরঘাটার পদ্দা এলাকার ৭২ বছরের বৃদ্ধ আলম ফিটার। প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় তার।
আলম ফিটার বলেন, “অভাবের তাড়নায় বাবা আজম আলীর সাথে ১০ বছর বয়সে গভীর বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার করা শুরু করি। তখন জাল টানার মতো শক্তি ছিল না। তবে জাল থেকে মাছ ছুটিয়ে বরফ দেওয়ার কাজ করতে পারতাম।”
তিনি বলেন, “যখন মাছ বেশি ধরা পড়তো, তখন আমি খুব খুশি হতাম। কিন্ত বাবাসহ সবাই থাকতো চুপচাপ। তাদের মধ্যে আনন্দ দেখতাম না। তখন বাবার চুপচাপ থাকার কারণ বুঝতে না পারলেও যখন বড় হয়েছি, তখন বুঝেছি। মাছ কম পেলে বেতন সামান্য। কিন্তু বেশি পেলেও লাভ নেই। সবটাই চলে যাবে দাদন নেওয়া মহাজনের কাছে।”
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একসময় নীল চাষিদের অগ্রিম অর্থ প্রদান করে যে দাদন প্রথা চালু করেছিল, সে দাদনের ধারাবাহিকতা যেন অব্যাহত রেখেছে মৎস্য আড়তদার কিংবা মহাজনরাও।
পাথরঘাটার কালমেঘা এলাকার মোবাস্বের মিয়ার ট্রলার এফবি বাপ্পি। ২০১৬ সালে দেড় কোটি টাকা ব্যায়ে ট্রলারটি নির্মাণ করেছিলেন তিনি। মোবাস্বের মিয়া বলেন, “লাভের আশায় সাগরে গিয়ে একবার মাছ পাই তো ১০ বার পাই না। ১৮ জন জেলের বেতন দেওয়াই দায় হয়ে ওঠে। এরপর থেকে শুরু করলাম দাদন নেওয়া। সাগরে যাওয়ার আগে মহাজনের (আড়ৎদার) কাছ থেকে দাদন নিয়ে ট্রলার পাঠাই মাছ শিকারে। চুক্তি হলো- সাগর থেকে এসে মাছ যা পাই সবটাই দিতে হবে মহাজনকে। সে পছন্দমতো একটা দামে মাছ সব নিয়ে যাবে।”
ট্রলারের মাঝি সোহায়েল হোসেন বলেন, “মাছ যদি ১০ জনের কাছে দামাদামি করে বিক্রি করতে পারতাম, তাহলে বেশি দামে বিক্রি করতে পারতাম। কিন্তু যার কাছ থেকে মালিক দাদন নিয়েছে, তার কাছেই বিক্রি করতে হবে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ট্রলার মালিক বলেন, “রূপালী ইলিশের জোগান দিচ্ছি আমরা। অথচ আমাদের জীবনেই আনন্দ নেই। আমরাই দাদনের মারপ্যাঁচে আটকে আছি। একজন আড়ৎদার সমুদ্রগামী ট্রলারে ৫ থেকে ১০ লাখ বা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দাদন হিসেবে দেন। আমরা সেই টাকা ট্রলারের জেলেদের দাদন হিসেবে দেই। তবে, শর্ত থাকে দাদনের টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত নির্দিষ্ট আড়তেই দিতে হবে মাছ।”
অন্যদিকে, নদ নদীতে যে-সব জেলেরা মাছ শিকার করেন তারাও ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা দাদন নিয়ে থাকেন আড়ৎদার বা মহাজনের কাছ থেকে। সেই টাকায় ট্রলার মেরামত বা নতুন ট্রলার নির্মাণ করে মাছ ধরতে নেমে পড়েন নদ-নদীতে।
নদীতে মাছ শিকার করা জেলেরা জানান, প্রতিদিন যে পরিমাণ মাছ শিকার করেন, সেগুলো শর্ত অনুযায়ী বিক্রি করতে হয় নির্দিষ্ট আড়ৎদারের কাছে। এক্ষেত্রে, প্রতিবারে মাছের দাম নির্ধারণ করেন আড়ৎদার নিজেই। পাশাপাশি কাটেন মোটা দাগে কমিশন। অন্যদিকে দাদনের মূল অংক ঠিকই স্থির থাকে।
বাংলাদেশ মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, “সাগরে মাছ কম ধরা পড়ায় জেলে ও ট্রলার মালিকরা লোকসানের মুখে। বাধ্য হয়ে ট্রলার মালিকরা দাদনের দারস্থ হয়। মৎস্যজীবীদের কোনো ব্যাংক অথবা এনজিও লোন দেয় না। কারণ হিসেবে কোনো দালিলিক ব্যাখ্যা না দিলেও লোন দাতারা দাবি করেন, সাগরে ট্রলার ডুবে গেলে লোন গ্রহীতার লোন পরিশোধের আর কোনো উপায় নাই। তাই বাধ্য হয়ে ট্রলার মালিক ও জেলেরা দাদনে জড়িয়ে পড়েন।”
তথ্য বলছে, উপকূলীয় জেলা বরগুনার প্রতি ১০০ জন জেলের মধ্যে ৯৫ জনই দাদন নিয়েছেন। যাদের মধ্যে ৮০ জনই দাদনের মারপ্যাঁচে শ্রমের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত। এদের অনেকেই আবার দায় মেটাতে না পেরে প্রস্তুতি নিচ্ছেন পেশা পরিবর্তনের। আবার অনেকে পেশা পরিবর্তন করে এলাকা ছেড়েছেন।
অর্থনীতিবিদ ড.
তিনি আরও বলেন, “উপকূলীয় এলাকা বা জেলেদের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে স্বল্পসুদে বা সুদবিহীন ঋণ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ থেকে কোনো বাধা নেই। তবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে এ সংক্রান্ত তহবিলও গঠন করতে পারে।”
এভাবেই দাদনের দুষ্টচক্রে জেলেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রতারিত হয়। বঞ্চিত হয় শ্রমের সঠিক মূল্য থেকে। অন্যদিকে আড়তদাররা ইলিশের নতুন নতুন সিন্ডিকেট তৈরি করে চাহিদা বা যোগানের হেরফের দেখিয়ে সাধারণ ক্রেতাদের ফেলেন বিপাকে।
বরগুনার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসীন বলেন, “জেলেদের স্বাবলম্বী করতে বিনামূল্যে বকনা বাছুর বিতরণ করি। পাশাপাশি ছাগল ও খাবার দিয়ে থাকি যেন তারা বিকল্প আয় করতে পারেন। এছাড়া আমরা নানা ধরনের প্রশিক্ষণও দিই। এছাড়া নগত অর্থ দিয়ে জেলে অথবা মৎস্যজীবীদের সহায়তার কোনো সুযোগ নেই।”
বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম রাইজিংবিডিকে বলেন, “দাদন প্রথা থেকে জেলেদের বের করে আনতে মৎস্য অধিদপ্তরকে সাথে নিয়ে কার্যকরী কিছু পরিকল্পনা আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবো।”
টেকসই মৎস্য আহরণে প্রয়োজন একটি পরিকল্পিত কার্যকরী পদক্ষেপ। এক্ষেত্রে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ নীতি নির্ধারকদের এগিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি। তা না হলে দাদনের এই ফাঁস জালে পড়ে একটি বিরাট সম্ভাবনাময় খাত নষ্ট হবে দেশের। নষ্ট হবে এই পেশায় জড়িত থাকা হাজারও মানুষের জীবন।
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ম ছ শ ক র কর প রজন ম উপক ল
এছাড়াও পড়ুন:
হিজরতের ৫টি শিক্ষা
সাহাবিদের হিজরতের ঘটনাবলি কেবল ইতিহাসের অংশ নয়, বরং তা মুমিন জীবনের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। তাদের হিজরতের ঘটনা ও ত্যাগের আদর্শ থেকে কয়েকটি মৌলিক শিক্ষা উঠে আসে:
১. হিজরত প্রথমত আল্লাহর আদেশ পালনহিজরত কেবল কৌশলগত পরিকল্পনা ছিল না, বরং ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা এক ইবাদতমূলক নির্দেশ। এই কারণে সাহাবিরা সবচেয়ে প্রিয় বস্তু—ঘরবাড়ি, সম্পদ, আত্মীয়স্বজন—সহজে ত্যাগ করতে পেরেছিলেন। (মুহাম্মদ সাইদ রমাদান আল-বুতি, ফিকহুস সিরাহ, পৃষ্ঠা: ১৫৬, দারুল ফিকর, দামেস্ক, ২০০৪)
২. ইমানের জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগহিজরত শেখায় যে একটি জাতির ভিত্তি স্থাপন এবং সত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য চরম মূল্য দিতে হয়। সুহাইব তাঁর সব সম্পদ, আবু সালামা তাঁর পরিবার এবং বনু জাহশ (রা.) জন্মভূমি ত্যাগ করে এই মূল্য পরিশোধ করেছিলেন। এই ত্যাগ বিনা মূল্যে অর্জিত হয়নি।
আরও পড়ুনমদিনায় হিজরত: ইসলামের ৬টি মাইলফলক০২ জুলাই ২০২৫৩. ইমানের সম্পর্ক অন্য সব সম্পর্ক থেকে ঊর্ধ্বেওমর (রা.) আইয়াশকে যখন তার মায়ের দোহাইয়ের ফিতনা থেকে সতর্ক করেছিলেন, তা প্রমাণ করে যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি আনুগত্যের বন্ধন অন্য সব জাগতিক সম্পর্ক (গোত্র, পরিবার, রক্ত) থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী।
৪. ঐকান্তিক প্রচেষ্টার সঙ্গে আল্লাহর ওপর ভরসাহিজরত মোটেই বিশৃঙ্খল ছিল না। ওমর (রা.)-এর পরিকল্পনা, কাফেলাবদ্ধ হয়ে যাত্রা এবং কৌশল অবলম্বন—সবই প্রমাণ করে যে আল্লাহর ওপর নির্ভরতার পাশাপাশি মানবীয় প্রচেষ্টা ও সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণ করাও আবশ্যক।
আরও পড়ুনমহানবী (সা.)–র হিজরত মদিনায় হলো যে কারণে২৯ জুন ২০২৫৫. আল্লাহর দয়ার বিশালতাএই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ফিতনা ও দুর্বলতা মানুষের জীবনে আসতে পারে। কিন্তু যখন তারা মক্কায় বন্দী হয়ে নিজেদের পাপী মনে করছিলেন, তখন আল্লাহ তাআলা এই আয়াতটি নাজিল করে আশার দরজা খুলে দেন, ‘বলো, “হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজেদের ওপর বাড়াবাড়ি করেছ (পাপ করেছ), তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ মাফ করে দেন।”’ (সুরা জুমার, আয়াত: ৫৩)
এই আয়াতটি ছিল তাঁদের জন্য এক ঐশী ক্ষমা ও নতুন সুযোগের বার্তা।
হিজরত কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়; এটি একটি অক্ষয়–দর্শন—যেখানে ইমান, ধৈর্য এবং আত্মত্যাগের সমন্বয়ে একটি আদর্শ সমাজ গঠনের বীজ নিহিত ছিল। এই দর্শনই মুসলমানদের নতুন এক দিগন্তে পৌঁছে দেয়।
আরও পড়ুনআবিসিনিয়ায় নারী সাহাবিদের দ্বিতীয় হিজরত১৪ নভেম্বর ২০২৫